স্বপ্নের ঘর তৈরি করতে কে না চায়! আর সেই স্বপ্নকে সাকার করে তুলতে ঘরের রং যদি মনের মতো হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তবে ঘরের রং এবং রং করাতে যেসব জিনিসপত্রের প্রয়োজন হয়, সেগুলির দামের থেকে রং করার মজুরি অনেক বেশি পড়ে যায়। আবার মজুরি দিয়েও অনেকসময় পছন্দমতো কাজ পাওয়া যায় না। তাই নিজেই পেইন্টার হয়ে যান। নিজের হাতে রং করুন আর আপনার ঘরের দৃশ্যপট বদলে দিন।
পেইন্টের নির্বাচন
পেইন্ট বা রং নানা ধরনের হয়ে থাকে। যেমন, চুন। ঘরের দেয়াল চুনে ভিজিয়ে সাধারণত সাদা রং করা হয়। এই রং করা খুবই সুবিধাজনক, সস্তা এবং সহজেই পাওয়া যায়। ঘরের ভিতর ও বাইরে, ছাদের সিলিং-এ রঙের প্রলেপের জন্য এটি উপযুক্ত। তবে কাঠ ও যে-কোনও ধাতুতে এই রং ধরে না।
ড্রাই ডিসটেম্পার
ব্রাইট এবং বিভিন্ন রঙের শেডে এই পেইন্ট ডিসটেম্পার পাওয়া যায়। চুনের থেকে অনেক ভালো কিন্তু সামান্য দামি।
অয়েল বাউন্ড ডিসটেম্পার
এই পেইন্ট ওয়াশ করা যায় এবং অনায়াসেই ২-৩ বছর একইরম উজ্জ্বল ব্রাইট থাকে। তবে ঘরের ভিতরের দেয়ালের জন্যই এটি উপযুক্ত।
প্লাস্টিক ইমালশন
খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় প্লাস্টিক ইমালশন। এগুলি ওয়াশেবল ও রং করার পর দাগ ছোপ তেমন পড়ে না। এয়ার বাউন্ড ডিসটেম্পারের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই। তবে রং লাগানোর সময় অবশ্যই দক্ষতার সঙ্গে লাগাতে হবে।
অ্যাক্রেলিক ইমালশন
অন্যান্য পেইন্টের থেকে এটি অনেকবেশি জনপ্রিয়, টেকসই-ই শুধু নয়, খুব গ্লসিও। এটির ম্যাট ফিনিশও হাজার রকম রঙের শেডে পাওয়া যায়।
সিমেন্ট বেস্ড পেইন্টস্
শুধুমাত্র বাড়ির বাইরের দেয়ালগুলি নানারঙে রাঙিয়ে তুলতে এটি ব্যবহার করা হয়।
টেক্সচার্ড পেইন্টস্
বাড়ির ভিতর এবং বাইরে, দু’ধরনের দেয়ালেই এই শৌখিন পেইন্ট লাগানো যায়। দারুণ সুন্দর সব শেড ও টেক্সচারে পাওয়াও যায় রংগুলি। টেকসই ও সহজে ধোয়া যায়। তবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দেয়ালে এই পেইন্ট লাগাতে হবে।
সিন্থেটিক এনামেল্স
এই পেইন্ট দুধরনের হয়ে থাকে। যেমন – জেনারেল পারপাসে ব্যবহূত ও সুপার সিন্থেটিক এনামেল্স। সাধারণ এনামেল্স কাঠ, স্টিলের বিভিন্ন ফার্নিচার এমনকী দেয়ালেও লাগানো যায়। কিন্তু সুপার সিন্থেটিক এনামেল শুধুমাত্র কাঠ ও স্টিলেই লাগানো যায়। বিভিন্ন পেইন্ট কোম্পানিগুলির মধ্যে এশিয়ান, নেরোল্যাক, শালিমার, বার্জার, জেনসন অ্যান্ড নিকলসন এবং বম্বে পেইন্টস্ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
রং নির্বাচন
রং করার সময় মুখ্য বিচার্য বিষয় হল রং নির্বাচন। এই নির্বাচন দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন – ঘরগুলি কেমন ও তাতে আলোর প্রাচুর্যতা কেমন। যদি ঘরে পর্যাপ্ত আলো খেলে, তাহলে সেই ঘরের জন্য গাঢ় রং বাছাই করতে পারেন। আর যদি ঘরে আলোর প্রাচুর্য না থাকে অর্থাৎ অন্ধকার ধরনের হয়, সেক্ষেত্রে ঘরের রং বেশি গ্লসি হওয়া উচিত। তাই এইসব ঘরে হলুদ, লাইট ব্লু, এইধরনের রং লাগাতে পারেন। তবে প্রত্যেকটি রঙেরই পৃথক বৈশিষ্ট আছে। যেমন –
সাদা – যে-কোনও ঘরেই সাদা রং মানানসই। রং করলে ঘরের আয়তন আরও বড়ো বলে মনে হয়। তবে বেশিরভাগ মানুষ কিচেন ও বাথরুমেই সাদা রং লাগিয়ে থাকেন।
লাল – লাল রং অ্যাগ্রেসিভনেসের প্রতীক বলে বিবেচিত। কখনওই বেডরুমে লাল রং লাগানো ঠিক নয়। তার চেয়ে লালের অন্যান্য শেড যেমন মেরুন, অরেঞ্জ এগুলো বেশ ভালো।
হলুদ – হলুদ রং উৎসাহ ও মনে আনন্দ বয়ে আনে। ব্রাইট হলুদ, একটু কম আলো প্রবেশ করে এমন ঘরে লাগালে, ঘর বেশি আলোকিত বলে মনে হয়।
নীল – শান্তি, বিশ্বস্ততা ও ঐক্যের প্রতীক। নীল রং বেডরুমের জন্য পারফেক্ট।
প্রয়োজনীয় সামগ্রী
বাড়ির দেয়াল, সে ঘরের ভিতরে বা বাইরে যেখানেই হোক, রং করার জন্য প্রয়োজনীয় এই জিনিসগুলি আপনার লাগবেই। যেমন পছন্দের পেইন্ট, ৩-৪ ইঞ্চির চওড়া ব্রাশ, ছোটো অ্যাংগেল ব্রাশ, একটা তোয়ালে বা মাথায় বাঁধার জন্য কাপড়, পরিমাণ অনুযায়ী তারপিন তেল (যদি পেইন্ট অয়েল বেসড হয়) বালতি, শিরীষ কাগজ, পরিমাণ অনুযায়ী প্রাইমার (রং করার আগে প্রলেপের জন্য), পুরোনো কাপড়, মই, রোলার, রোলার ট্রে, ডিসপোসেবল রবার গ্লাভ্স।
প্রস্তুতি
১) প্রথমেই মোটামুটি বাতিল হওয়া জামাকাপড় পরে নিন, যাতে রং লাগলে ভালো জামাকাপড় নষ্ট হবে না। হাতে গ্লাভ্স পরে নিন। একটু মোটা ধরনের অ্যাপ্রনও পরে নিতে পারেন।
২) রং করার আগে ঘরের সমস্ত ফার্নিচার সরিয়ে দিন। যদি একান্ত সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে দেয়ালের দিক থেকে সেগুলি সরিয়ে ঘরের মাঝখানে রাখুন। এগুলি কোনও প্লাস্টিক পেপার বা মোটা কাপড় দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে দিন, যাতে রং পড়ে নষ্ট না হয়।
৩) রং করার সময় ব্রাশ থেকে রঙের ফোঁটা মেঝেতে পড়ে। আর এগুলি তুলতে সময় নষ্ট যাতে না হয়, তার জন্য রং করার আগে মেঝেতে কাগজ পেতে দিন।
৪) দেয়ালে লাগানো ছবি, আয়না, ঘর সাজানোর অন্যান্য জিনিস থাকলে নামিয়ে নিন।
৫) সিলিং ফ্যান, বাল্ব, টিউবলাইট, দেয়াল থেকে নামিয়ে কাপড় বা কাগজে ঢেকে রাখুন।
৬) যদি ঘর আগে রং হয়ে থাকে, তাহলে সেই রং ভালোভাবে ঘষে তুলে দিন।
৭) আগের রং ভালোভাবে তুলতে, ক্লিনজার ব্যবহার করতে পারেন।
৮) যদি দেয়ালে ফাটল বা গর্ত থাকে, সেগুলো আগে সারিয়ে নিন।
৯) পেইন্ট করার আগে প্রাইমার লাগিয়ে দেয়াল শুকিয়ে নিন।
কী করে রং করবেন
সবসময়ই ঘরের যে-কোনও কোণ থেকে শুরু করে মাঝখানের দিকে আসা উচিত। রঙে ডোবানো তুলি দেয়ালে বোলানোর আগে ভালো করে ঝেড়ে নিন এবং তুলি সবসময় উপর থেকে নীচের দিকে টানুন।
সিলিংয়ের রং
১) সবচেয়ে আগে রং করতে হবে ছাদের সিলিং। তবে তার আগে দেখে নিন, ছাদের কোনও জায়গা থেকে জল পড়ে কিনা। যদি পড়ে, আগে তা সারিয়ে নিন।
২) ছাদ আর দেয়াল যেখানে মিশেছে সেখান থেকে ব্রাশ দিয়ে দু-তিন ইঞ্চি পটির মতো দিয়ে শুরু করুন। একে ‘কাট ইন’ বলে।
৩) এবার রোলার ট্রেতে রং ঢালুন। যদি ব্রাশ দিয়ে রং করেন সেক্ষেত্রে ছোটো একটি বালতিতে রং রাখুন।
৪) মিড স্ট্রোকে রোলার থামিয়ে দেবেন না। যদি থামাতেই হয় তখন পুরো লাইন টানুন।
৫) পুরো ছাদ রং করার সময় একবারও ব্রেক না নিয়ে করুন।
৬) প্রথম কোটিং শুকিয়ে যাওয়ার পর ঠিক ওইভাবেই দ্বিতীয় কোটিং দেওয়া শুরু করুন।
দেয়াল
১) ছাদ পুরো শুকিয়ে গেলে তবেই দেয়াল রং করতে শুরু করুন।
২) প্রথমে ছোটো ব্রাশ দিয়ে ‘কাট ইন’ এরিয়া তৈরি করে, ব্রাশ বা রোলারের সাহায্যে কালারিং শুরু করুন।
৩) একটি দেয়াল একবারে রং করে ফেলুন।
৪) প্রথমে উপর থেকে নীচে, তারপর আশেপাশে লাগান।
৫) প্রথম কোটিং শুকিয়ে গেলে দ্বিতীয় কোটিং শুরু করুন।
দরজা
১) নব, লক ও অন্যান্য হার্ডওয়ার ঢেকে দিয়ে শুরু করুন দরজায় রং করা।
২) যদি দরজা একেবারে মসৃণ হয়, তাহলে দেয়ালের দিক থেকে রং শুরু করুন। দরজার মাথা ও নীচের কিনারা রং করতে ভুলবেন না।
৩) যদি দরজায় প্যানেল দেওয়া থাকে, তাহলে আগেই প্যানেল রং করে নিন। তারপর পুরো দরজা রং করে নিন।
জানলা
১) জানলা রং করার সময় আগে জানলা খুলে দিন, এরপর বাইরের কিনারা থেকে রং করা শুরু করুন।
২) বাইরের রং শুকিয়ে গেলে ভিতরের অংশ রং করুন।
৩) তবে দরজা রং করার আগে চারপাশের চৌকো ফ্রেম রং করে নিন।
৪) রং না শুকোনো পর্যন্ত জানলা বন্ধ করবেন না।
যদি রঙের কাজ হওয়ার মাঝখানে কোনওদিন কাজ বন্ধ রাখেন, সেদিন ব্রাশ কেরোসিনে ভিজিয়ে অথবা প্লাস্টিকে বা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে জড়িয়ে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিন। এতে ব্রাশ নরম থাকবে। কাজ হয়ে গেলে ব্রাশ ও রোলার পরিষ্কার করে রাখুন। এতে এগুলি দ্বিতীয়বার ব্যবহার করতে সুবিধা হবে।