বর্তমানে আমাদের দেশে মোবাইল ব্যবহারকারীদের সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, সংখ্যার গণনায় ভারতবর্ষ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এবং মোবাইল কানেকশন আছে এমন ভারতীয়র সংখ্যা ৯০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আর যোগাযোগ করার জন্যে মোবাইল ফোনের উপর নির্ভরতা এমন অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার জন্য, টেক্সট অর্থাৎ এসএমএস করার মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে একটি অসুখ, যার নাম– ‘টেক্সট নেক সিন্ড্রোম’।

৭৫ শতাংশেরও বেশি ব্যক্তি প্রতিদিন অন্তত ১৮ ঘণ্টা তাঁদের কাছে একটি সেল ফোন রাখেন। কেবলমাত্র মোবাইল ফোন-ই নয়, কিন্ডল্স, ট্যাবলেটস এবং আই-প্যাডস– এই ডিভাইসগুলির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলেও মহামারীর মতো একটি অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, যার নাম ‘টেক্সট নেক সিন্ড্রোম’। যদিও ‘টেক্সট নেক’ নতুন কোনও বিস্ময়কর ঘটনা নয়, কিন্তু বর্তমানে যেহেতু বিশাল সংখ্যক মানুষ এর শিকার হচ্ছেন, তাই এই বিষয়টির প্রতি সকলের মনোযোগ অনেক পরিমাণে বেড়েছে।

সম্প্রতি বহু সংখ্যক মানুষের মধ্যে টেক্সট-নেক সিন্ড্রোমের লক্ষণ দেখা গেছে। কিছুদিন পরে এই টেক্সট নেক থেকে হতে পারে স্পাইন্যাল আর্থ্রাইটিস এবং ডিস্ক প্রোল্যান্স, যার জন্য হয়তো শল্য চিকিৎসারও প্রয়োজন হতে পারে। প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং আবিষ্কারের ফলে, ডিস্ক রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি এখন হয়েছে অনেক নিরাপদ।

মাথা ব্যথা, পিঠের উপরের অংশে অর্থাৎ কাঁধ এবং ঘাড়ে ব্যথা এবং তার উপর শিরদাঁড়ায় বর্ধিত বক্রতা, এইসবগুলির যদি চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে তার থেকে স্পাইনাল ডিজেনারেটিভ সমস্যা, যেমন ডিস্ক প্রোল্যান্সও হতে পারে। ডিস্ক প্রোল্যান্সের ক্ষেত্রে ঘাড় থেকে বাহুর দিকে চিন্চিনে ব্যথা হয় এবং তারপর অসাড়ভাব, মুষ্টিবদ্ধ করার ক্ষমতা লোপ পাওয়া এবং হাত ও পায়ের শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাওয়া শুরু হয়। যদিও অল্প বা মাঝারি অবস্থায় ফিজিওথেরাপি এবং চিকিৎসার দ্বারা সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু যদি চরম আকার নেয়, তাহলে ডিস্ক রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির মতো শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

বেশিরভাগ মানুষই এ বিষয়ে অসচেতন। অনেকে বেশিরভাগ সময়েই সামনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁদের সেল ফোন ব্যবহার করেন। এঁদের মধ্যে সবথেকে বেশি পরিমাণে ‘টেক্সট নেক’-এর শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বারবার সামনের দিকে ঝোঁকা এবং ভঙ্গিগত পরিবর্তনের জন্য তাদের সার্ভিকাল স্পাইনে পরিবর্তন হয় এবং তার ফলে তাদের পেশিতে স্টিফনেস এবং ব্যথা হতে পারে। আর শীতকালে শীতের পোশাকের ভারের জন্যে ঘাড়ের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ার ফলে শিরদাঁড়া-সংক্রান্ত অসুখের শিকার হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়।

আমাদের মেরুদণ্ড তৈরি হয়েছে ৩৩ টি হাড়ের সমষ্টি (২৪  আর্টিকুলেটিং এবং ৯ ফিউজড) দ্বারা যেগুলিকে বলে কশেরুকা। এগুলি আবার স্পঞ্জের মতো ইন্টার-ভার্টিব্রাল ডিস্কের দ্বারা যুক্ত, যা কেবলমাত্র আমাদের ঘাড় ও পিঠেই সাপোর্ট দেয় না, আমাদের গতিশীলতাতেও সাহায্য করে। যেমন, অসমুচিত দেহ ভঙ্গি, অপুষ্টিকর আহার অথবা অতিরিক্ত পরিশ্রম মেরুদন্ডকে করে তোলে অনমনীয় এবং তার সঙ্গে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

প্রথাগত শল্য চিকিৎসাতে যা করা হয়, তা হল দুটি সার্ভিক্যাল কশেরুকার মাঝখানের অসুস্থ ডিস্কটি সরিয়ে ফেলে সেখানে একটি হাড় গ্র্যাফটিং করে লাগানো হয়। যা থেকে দৃঢ় হাড় তৈরি হতে পারে এবং দুটি কশেরুকার মাঝখানের ফাঁক ভরিয়ে দিতে পারে। সম্পূর্ণভাবে এই অসুস্থ হাড়টিকে সরিয়ে ফেললে ব্যথা সম্পূর্ণ সেরে যেতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে ফিউজন পদ্ধতির জন্য মেরুদণ্ডের গতিশীলতা এবং নমনীয়তাতে বাধার সৃষ্টি করে।

কৃত্রিম সার্ভিক্যাল ডিস্ক রিপ্লেসমেন্ট চিকিৎসায়, পুরাতন এবং অসুস্থ ডিস্ক একটি নকল যন্ত্র (কৃত্রিম ডিস্ক) দ্বারা বদল করা হয়, যেটি মেরুদণ্ডের কশেরুকা বিভাগটির গতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করে তৈরি করা হয়। এই গতিশীল ধাতুর ডিস্কটি কশেরুকাগুলির মাঝখানে ঢুকিয়ে, যতটা সম্ভব গতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়, যেমন ভাঁজ করা, ছড়ানো, পাশের দিকে বাঁকানো, ঘোরানো এবং সোজা রাখা, অর্থাৎ উচ্চতা এবং বক্রতার মতো স্বাভাবিক ডিস্কের মতো এটি যাতে কাজ করতে পারে।

আগে ডিস্ক সমস্যার চিকিৎসা করা হতো দুটি কশেরুকাকে মিলিয়ে দিয়ে বা ফিউজন করে কিন্তু ফিউজন চিকিৎসা শিরদাঁড়ার গতিশীলতা কম করে দেয় এবং অন্যদিকের কশেরুকার উপর চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে দীর্ঘদিন পরে একই ধরনের ব্যথার উপসর্গ দেখা দিত। তবে এখন আধুনিক ডিস্ক রিপ্লেসমেন্ট চিকিৎসা এই সমস্যার জন্য একটি অবিশ্বাস্য সমাধান হিসাবে উদ্ভাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডা. সুজয় সান্যাল।

যারা এখনও বয়সে তরুণ, অর্থাৎ যাঁরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কাজকর্মকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মতো ততটা ফেলে রাখতে পারেন না, তাদের জন্যে ডিস্ক রিপ্লেসমেন্ট একটি আদর্শ উপায়। তাছাড়া একটি কৃত্রিম সার্ভিক্যাল ডিস্ক রিপ্লেসমেন্ট পদ্ধতির পরে, রোগী খুব তাড়াতাড়ি সেরে ওঠেন এবং সার্জারির দুই থেকে তিনদিন পরেই বাড়ি চলে যেতে পারেন এবং আরও পাঁচদিন পর থেকেই সাধারণ জীবনযাত্রা শুরু করতে পারেন।

বর্তমানের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে প্রযুক্তি এবং মোবাইল ডিভাইস থেকে সরে থাকা সত্যিই অসম্ভব। তাই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এ বিষয়ে পরামর্শ হল, যেন বর্তমান প্রজন্ম এগুলিকে যথেষ্ট সমীচীন ভাবে ব্যবহার করেন। কিছুক্ষণ পর পর স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করা, মোবাইল ফোন যতটা সম্ভব চোখের সঙ্গে লেভেল করে ব্যবহার করা এবং অফিস আর্গোনোমিক্সের অধ্যয়ন করার মতো কিছু কিছু উপায় ‘টেক্সট নেক সিনড্রোম’ হওয়া থেকে বিরত করতেও পারে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...