সিপিআর জানা থাকলে, আপনিও একজন রোগীকে দিতে পারেন বেসিক লাইফ সাপোর্ট। আর তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন মৃত্যুর মুখ থেকে।
মনে করুন আপনার চোখের সামনে কেউ বুকের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আপনি ডাক্তার ডাকার চেষ্টা করলেন। অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিলেন। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এই সময় থেকে ডাক্তারের হস্তক্ষেপ শুরুর সময়ের মধ্যে ঘটে যেতে পারে মৃত্যুর মতো চরম ঘটনাও।
অথচ ডাক্তার ডাকা, অ্যাম্বুলেন্স ডাকা, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ইত্যাদির পাশাপাশি তাকে সিপিআর-এর মাধ্যমে বেসিক লাইফ সাপোর্ট দিলে, তিনি ফিরে আসতে পারেন মৃত্যুর মুখ থেকে।
কেন এমন হয়?
এমনটি হয় হৃদযন্ত্র ঠিকমতো কাজ না করলে।
হৃদযন্ত্র অচল হওয়ার কারণ কী?
হার্ট বা হৃদযন্ত্র গঠিত হয় দুটি নিলয়, দুটি অলিন্দ, অনেক শিরা ও ধমনি দিয়ে। ধমনির মাধ্যমেই হার্ট-এ অক্সিজেনপূর্ণ রক্ত যায় এবং হার্ট সচল থাকে। কখনও কখনও ধমনির মধ্যে এমন পরিমাণে কোলেস্টেরল জমে যে তার মধ্য দিয়ে অক্সিজেনপূর্ণ রক্ত হার্ট-এ পেৌঁছোতে পারে না, তখন হার্ট অচল হয়ে যায়। আর এই অবস্থাকেই বলে হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
কাকে বলে সিপিআর?
হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে যে পদ্ধতিতে বেসিক লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয় তাকেই বলে সিপিআর বা কার্ডিয়ো পালমোনারি রিসাসিটেশন। এটি হার্ট মাসাজ করার একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।
সিপিআর শুরু করার আগে যে কাজগুলো আপনাকে করতে হবেঃ
১) প্রথমে রোগীকে জোরে জোরে ডাকুন। জিজ্ঞেস করুন তিনি ঠিক আছেন কিনা। তাঁর কি অসুবিধে।
২) সাড়া না পেলে সাহায্যের জন্য লোক ডাকুন।
৩) অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিন।
৪) লক্ষ্য করে দেখুন রোগীর মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোচ্ছে কিনা। দেখে নিন মুখের ভিতর অন্য কোনও বস্তু আটকে আছে কিনা। তাহলে সেটা চামচ বা অন্য কিছু দিয়ে বের করে নিন। আঙুল ঢোকাবেন না। এবারে রোগীর মাথাটি ধরে পিছনে হেলিয়ে দিন, সঙ্গে সঙ্গে থুতনিটি ধরে ওপরে তুলুন। এই পদ্ধতিটি ‘হেড টিল্ট চিন আপলিফ্ট’ নামে পরিচিত। এতে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়। এবার লক্ষ্য করুন রোগীর বুক ওঠা নামা করছে কিনা। তিনি শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছেন কিনা।
৫) এরপর খেয়াল করুন রোগীর পালস ঠিক আছে কিনা।
যদি দেখেন যে, ব্যাক্তিটি শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছেন না বা তার পালসও চলছে না, তাহলে তার হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে বলে মনে করতে পারেন। এবার শুরু করা প্রয়োজন সিপিআর-এর মাধ্যমে বেসিক লাইফ সাপোর্ট প্রদান।
সিপিআর-এর পদ্ধতিঃ
রোগী শায়িত অবস্থায় থাকবেন। এবার একটি হাতের পাতার উপর অন্য হাতের পাতা রেখে, হাতের তালু দিয়ে ব্যক্তিটির বুকের ঠিক মাঝখানে জোরে জোরে চাপ দিয়ে যেতে হবে। কনুই যাতে ভাঁজ না হয় এভাবে হাত সোজা রেখে, শরীরের উপরের অংশের ওজন কাজে লাগিয়ে মিনিটে ১০০ বার চাপ দিতে হবে। দেখতে হবে যাতে চাপের সময় ব্যক্তির বুক ৫-৬ সেন্টিমিটার নীচে নেমে যায়। তার মানে যথেষ্ট জোরে এবং দ্রুত চাপ দিতে হবে। এরকম জোরে এবং এই গতিতে ৩০ বার বুকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
এবারে মাথার কাছে এসে ‘মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে কার্ডিয়াক মাসাজটাই হল প্রাথমিকভাবে বেশি জরুরি।
রিসাসিটেশন
প্রথমে রোগীর মাথাটি পিছনে হেলিয়ে, থুতনিটিকে উপরদিকে তুলতে হবে। আবার দেখে নিতে হবে তার মুখের ভিতরে কোনও বস্তু আছে কিনা। থাকলে সেটি বের করে নিতে হবে। এরপর তার নাকটিকে চেপে ধরে, মুখে মুখ দিয়ে হাওয়া ভরতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে হাওয়া দেবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক্তিটির বুক ওঠা নামা করছে কিনা।
এভাবে দু’বার হাওয়া ভরার পরে যদি কোনও পরিবর্তন না দেখতে পান, তাহলে আবার একই পদ্ধতিতে মিনিটে ১০০ বার হিসেবে ৩০ বার বুকে চাপ প্রয়োগ করে ‘মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং’ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। যতক্ষণ না ডাক্তারের হস্তক্ষেপ শুরু হচ্ছে, রোগীর অবস্থার পরিবর্তন না হলে এভাবেই সিপিআর প্রয়োগ করে বেসিক লাইফ সাপোর্ট দিয়ে যেতে হবে। ৫.১ অনুপাতে বুকে চাপ এবং ‘মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং’ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, আমাদের দেশে প্রতি বছর শহরাঞ্চলে ৩২.৮ শতাংশ মানুষ এবং গ্রামাঞ্চলে ২২.৯ শতাংশ মানুষ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। প্রতি বছর ২.৮ মিলিয়ন মানুষ ভারতবর্ষে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে পেৌঁছোনোর আগেই বা ডাক্তারের হস্তক্ষেপ শুরু হওয়ার আগেই মারা যান।
অতএব এই ৫০ শতাংশ মানুষকে সিপিআর প্রয়োগ করে বেসিক লাইফ সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন। আর এঁদের উপর সিপিআর প্রয়োগ করলে মৃত্যুর হার নিশ্চিতভাবে অনেক কমে যাবে। এটি জানা থাকলে, সাধারণ মানুষই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সময়ে রোগীকে এই জীবনদায়ী প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন, নতুন জীবন ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারেন।