ডেজার্ট

—বেশ তুমি যা ক্যারি করতে পারবে তাই পরো, নীলু।

—আশ্চর্য! এখানে ক্যারির প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? শাড়ি পড়তে আমার ভালো লাগে, সুদীপ! যাও, আমি যাব না…

—আরে আরে… বেশ তোমার যেমন মন চায় তেমনই ড্রেস-আপ করে যেও। আর শোনো, আমাদের এই গেট-টুগেদার প্রতি বছরই হয়। অন্য সব রান্না কেটারাররা করে। তা বাদে ডেজার্ট রান্নার কম্পিটিশন হয়। সব অফিসারদের স্ত্রী-রা যে যার হাতের স্পেশাল ডেজার্টটি বানিয়ে নিয়ে আসেন। তুমি কী ডেজার্ট বানাচ্ছ শুনি?

—সারপ্রাইজ!

—ওকে, ম্যাডাম!

মাত্র ছমাস বিয়ে হয়েছে সুদীপ আর নীলাঞ্জনার। বিয়ে পর কোন্ননগরের কানাইপুর গ্রাম থেকে নীলাঞ্জনা সোজা এসে পৌঁছেছে মহারাষ্ট্রের হাইটেক সিটি পুনেতে। চারদিকে গগনচুম্বী অট্টালিকার জঙ্গল! সবাই যেন কী ভীষন ব্যস্ত! এই ছমাসের ভেতরে আজ সন্ধেতে প্রথম তারা এখানকর কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছে।

—ওই দ্যাখ দ্যাখ, মিসেস সেনকে। কী গাঁইয়া গাঁইয়া সাজরে বাবা!… তারপরই হাসির ফোয়ারা ওঠে।

আড় চোখে তাকিয়ে নীলাঞ্জনা দেখে অত্যাধুনিক স্বল্পবসনা মহিলারা সব। তার মাঝে নীলাঞ্জনার এই বিষ্ণুপুরি বালুচরি শাড়ি, এক ঢাল খোলা চুলে রজনীগন্ধা— একটু বেমানান বই কি!

সুসজ্জিত হলটিতে ঢুকে নীলাঞ্জনা দেখে চারদিকে নারী-পুরুষেরা ওয়াইনের গেলাস হাতে প্লাস্টিক হাসি হাসছে! একটা সাদা টেবিল ক্লথে ঢাকা টেবিলে, কত্ত রকমারি ডেজার্ট রাখা! দেখে সে তো একেবারে থ! নামগুলোও লেখা আছে সব ক্যারামেল ব্রেড পুডিং, লেচে ফ্ল্যান, মিল্ক পুডিং, ব্ল্যাক ফরেস্ট ডেজার্ট, ব্রেড কাস্টার্ড পুডিং আরও কতো কী!

দুরু দুরু বুকে নিজের বানানো ডেজার্টের হাঁড়িটা টেবিলে রাখল নীলাঞ্জনা। হাঁড়ি দেখেই ওপাশের স্বল্পবসনাদের মধ্যে আবার হাসির রোল উঠল। গায়ে মাখল না নীলাঞ্জনা।

ডিনার শেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সব ডেজার্টগুলো টেস্ট করার পর নীলাঞ্জনার হাঁড়ি থেকে একটা করে রসগোল্লা মুখে পুরে বিচারকরা তো সবাই ক্লিন বোল্ড আউট! ডায়াসে ঘোষক তখন ঘোষণা করছেন, ফার্স্ট হয়েছে নীলাঞ্জনা সেনের নলেন গুড়ের রসগোল্লা। নীলাঞ্জনার হাঁড়ি দ্রুত সাবার হতে থাকে আর হল ফেটে পড়ে হাততালিতে!

ভাগ্যিস আসবার সময় মা দুবোতল নলেন গুড় দিয়েছিলেন! ততক্ষণে উঠোনে বড়ো বড়ো লোহার কড়াইতে মায়ের খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার সেই মিষ্টি গন্ধটা ছড়িয়েছে নীলাঞ্জনার বুকের ভেতর!

 

মায়ের গন্ধ

 

Bangla story Mayer Gondho

বিয়ে হয়ে সান্যাল বাড়িতে আসার পর থেকে লাবণ্য বুঝতে পারল, এ বাড়ির সব কিছুই আলাদা। এদের খাওয়া-দাওয়া থেকে জীবনযাপনে সম্পূর্ণ আভিজাত্যের ছাপ। এই ছাঁচে যেন এঁটে উঠতে পারছে না আশরীর মধ্যবিত্তের খোলসে মোড়া শ্যামনগরের লাবণ্য। সেজন্য মাঝে মাঝে পাঁচফোড়নী কথাও শুনতে হয় তাকে।

এ বাড়িতে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট টেবিলে নিঁখুত ভাবে সাজানো থাকে বাটার, টোস্ট, ডিম পোচ, কলা, কফি। খেয়ে বেরিয়ে যান কর্পোরেট সেক্টরের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তার স্বামী সুগত সান্যাল। তারপর বেরোন বিজনেস টাইকুন শ্বশুরমশাই আর দেওর। তারা চলে যেতে শাশুড়ি মায়ের নির্দেশে রান্না করে রাঁধুনি মালতি মাসি। লাবণ্যর শ্বশুরকুল পশ্চিমবঙ্গীয় বারেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণ। তাঁদের রান্না-বান্নার ধরনধারণ আলাদা। নুন-ঝাল কম, রান্নায় মিষ্টি দেবার প্রবণতা।

মা-বাবাকে অকালে হারিয়েছে লাবণ্য। কাকুর অভিভাবকত্বেই এই বিয়ে তার। একটা হালকা বিষণ্ণতা সবসময় ছুঁয়ে থাকে তাকে। তার খুব ইচ্ছে হয় মাঝেমধ্যে জলখাবারে পাঁচফোড়ন সম্বার দিয়ে সাদা আলুর চচ্চড়ি আর লুচি খায়। ঠিক যেমন ছোটোবেলায় মা করতেন। কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারে না। কে জানে, হয়তো গাঁইয়া ভাববেন এরা!

আনলক-১ শুরু হতেই আজ হঠাৎ বাড়িতে এসেছেন সোনা ঠাম্মা। শ্বশুরমশাইয়ের কাকিমা। কথায় তাঁর পূর্ববঙ্গীয় টান! উৎকর্ণ হয় লাবণ্য। মনটা হুহু করে ওঠে, স্মৃতির পাতা থেকে ভেসে আসে মায়ের মুখ!

বিকেলে গা ধুয়ে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে অস্তরাগের রংবাহারি খেলা দেখছিল লাবণ্য। হঠাপাঁচফোড়ন সম্বারের গন্ধে ম ম বাতাসটা নাক ছুঁয়ে দিলে, চমকে ওঠে সে…মা! মায়ের গন্ধ! দৌড়ে যায় রান্নাঘরে।

এক গাল হেসে সোনা ঠাম্মা বলেন, বুজলা নাত বউ, পাঁচফুড়ুন সম্বারা দিয়ে হলুদ ছাড়া আলুর চচ্চড়ি রানতাছি। ছুডুবেলা থিকা আমার হাতের এই রান্নাডা তুমার শ্বশুরের বড়ো প্রিয়।

চোখ ঝাপসা হয়ে আসে লাবণ্যর।

 

মরূদ্যান

 

Story Morudyan

সুজিত ঠিকা শ্রমিক। দিল্লির গোকুলপুরীতে ঘিঞ্জি শ্রমজীবী মহল্লায়, বৃদ্ধ বাবা-মা-কে নিয়ে তার বসবাস। প্রতিবেশীরা হিন্দু, মুসলমান, শিখ হলেও তাদের আসল পরিচয় তারা শ্রমিক। সারাদিন ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করে, সেদিন সন্ধেতে বাড়ি ফিরে সুজিত দেখল গোটা মহল্লা জ্বলছে। তাদের ঘর, ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আশেপাশের বহু ঘরই আগুনে ছাড়খার। চারদিকের ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তাদের আধপোড়া আবাসন। দমকল নাকি চারঘন্টা চেষ্টার পর আগুন আয়ত্তে এনেছে।

এলাকাটা থমথম করছিল কদিন থেকেই। ঈশ্বর-ভক্তদের আনাগোনা খুব বেড়েছিল। ঈশ্বর ভক্তদের নিশানায় ছিল সুজিতদের আবাসনের নীচের তলায় মুসলিমদের তিনটি দোকান। তারা নাকি এনআরসি, সিএএ বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিল।

প্রথমে ওই তিনটি দোকান লক্ষ্য করে চলেছিল পাথর বৃষ্টি। তারপর ঈশ্বরের নাম নিয়ে দোকানগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয় ধর্মের ধ্বজাধারীরা। সেই আগুন বাড়তে বাড়তে একসময় দোতলায় সুজিতদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আগুন তো ধর্ম চেনে না। তাই তার লেলিহান শিখা পৌঁছে যায় সুজিতের মায়ের লক্ষ্মী ঠাকুরের আসনেও।

সুজিত দেখল চারিদিকে ছাইয়ে গাদায় শ্মশানের নীরবতা। আগুন নিভে গেলেও ঘর প্রচণ্ড তেতে আছে। আর তার মা-বাবা ঘরে নেই। আতঙ্কে সে ছুটে যায় তাদের বহুদিনের প্রতিবেশী ইকবালদের ঘরে। সেখানে গিয়ে সুজিত দেখে, চোখে ছানিপড়া তার বৃদ্ধ বাবা আর হাঁপানি রোগী বয়স্কা মাকে আগ্রাসী আগুন থেকে উদ্ধার করে, পরম মমতায় আগলে রেখেছেন ইকবালের মা আমিনা চাচি।

ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সুজিত দেখতে পায় এক টুকরো মরূদ্যান।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...