ওই যে ধন্যিমেয়ে বইতে উত্তমকুমার দাঁত মুখ খিঁচোয়ে ওর অমন সুন্দর ভাইডারে বলতিছিল গো, এই বগলা গোল দে, এই বগলা গোল দে, ত্যাকোন থে মুঁই বগলার প্রেমে। আহা, কচি কলাপাতার মোতন ডগমগে রূপ ঝ্যামোন, আর নামডাও তেমনি ডাংগুলির গুলি ঝ্যানো। বনবন করি হাওয়ায় ঘুরতি ঘুরতি বুকের ভেতর সেঁইধে যায়।

বেশি লোকজন নেই। কাজের সুবিধেই হয়েছে। স্টেশনের দুচারজন দোকানদার কলকাতার বাবুদের দেখে পায়ে পায়ে এসেছে। তা আসুক। এটুকু ঝক্কি সামলেই ওরা কাজ করে।

তা যা বলেন বাবুরা, ত্যাকোন থে মোর মাথাটা লড়বড়ে হুয়েছে। ওই যে গেরামের মাঠে তাঁবু খাটায়ে বই পড়ল। মুঁই ধন্যিমেয়ে দ্যাকলাম। ব্যাশ, মোর প্রেম পালো। মনে মনে ঠিক করি নিলাম, না আর মুঁই মাঠে গোবর কুড়ব নে। মোর একখান বগলা চাই-ই চাই। আর সারা দিনমান ঘরে, বাইরে, পুকুরঘাটে— ঝিদিক পানে যাই না ক্যান, সিকেনেই গানখানা গুনগুন করি। জয়া ভাদুড়ি গেয়েছিল গো। বইয়ে তার নাম মনসা ছেল। আর মোর নামও মনসা। হি হি হি!

তা দিদি, ওই গানটি একটিবার শোনাও আমাদের! মদন, ভাই দোকানদারকে বল না, টিনের গেলাসে দু-কাপ চা আর কয়েকটা ভালো বিস্কুট কাগজে মুড়ে দিতে।

সামনে থেকে টিনের গেলাস তুলে নিয়ে মদন নামে ছেলেটি প্ল্যাটফর্মের স্টলে চা আনতে গেলে বেশ উৎসাহ লাগিয়ে মনসা বলে ওঠে, চা খাওয়ার আগে গাতি হবে, না কি পরে গাবানে?

দিদি, তোমার মন চাইলে এখনই গাইতে পারো।

মনসা মাথাটা চুলকে নেয়। উকুনগুলো সড়সড় করে চলে ফিরে কিছু বলছে। ও কান পেতে ওদের কথা ধরার চেষ্টা করে। এক কানে হাত চাপা দিয়ে অন্য কানের দিকে চোখ আর মন যত্ন করে লাগায়।

তার একমাথা চুল কাকের বাসার মতো নয় ঠিক, তবে বেশ এলোমেলো। মাঝে মাঝে চুলকোয়। তবে উকুন মারে না সে। উকুনরা যে তার আশ্রয়ে আছে। গুটি কয়েক প্রাণকে সে তার এই বিরাট মাথার ভেতর আশ্রয় দিয়েছে, তা কী এমন বেশি! তাছাড়া সন্ধের পর এই নির্জন প্ল্যাটফর্মে কার সাথে কথা কয়ে সময় কাটাবে! ওরা না থাকলি অমন থেবড়ে বসা রাতখানা কাটায় কী করে সে! ঘুম তো আসতি চায় না। ওদের সাথেই তো সুখ-দুঃখের কথা কইতে কইতে ভোরের ট্রেনের খবর নেয় কানে। প্যাসেঞ্জারের পায়ে শব্দে মনে আরাম হয়।

সুধাময়, প্রাণেশ, টিঙ্কু-রা নানা কোণ থেকে ছবি তুলছে, তবে গোপনে। স্টেশন চত্বরের চার-পাঁচজনের ভিড়টা লক্ষ করেনি যে ছবি উঠছে খেপির। তারা দেখছে একজন নীল জিন্স প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট পরা সুন্দর মতো লোক মাটিতে পা মুড়ে বসে খেপির সাথে কথা বলতে লেগেছে।

কদবেলের দোকানদার উবু হয়ে বসে সবটা বুঝতে চাইছিল। সে বলল, গা তো খেপি ওই গানটা। কদবেল মাখা দেব দুপুরবেলায়। গা।

প্যাসেঞ্জাররা তাড়াহুড়োয় দেখে না সবটা। কদবেলওলা বেল ফাটিয়ে চিনি, লংকা, নুন, ধনেপাতা আর কাসুন্দি দিয়ে মেখে তুলে দেয় প্লাস্টিকের বাটিতে। কিন্তু গেলাসের নীচে খানিকটা যে ফেলে রাখে দোকানদার তা নজরে পড়ে না খদ্দেরদের। আর পরেরটা বানানোর আগে দোকানদার চামচ দিয়ে টেনে তুলে তা একটা বাটির ভেতর রেখে দেয়। দুপুর পর্যন্ত যা জমে তা খেপিকে এক ফাঁকে দিয়ে আসে।

মনসা উকুনদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় লুঙ্গি পরা, বুক খোলা পেট উঁচু ওই কদবেল দেওয়া লোকটার দিকে। তার চোখের তারায় মেঘ ঢোকে। ছায়া লাগে মুখে, বুকের ভেতর জয়া ভাদুড়ির সেই আদুরে আর অভিমানী মুখের ঢল নামে। পেটের ভেতর গুড়গুড় করে, গলা খুসখুস করে। কথা হয়, কিন্তু কেউ শোনে না। শুধু মনসা ঠোঁট নাড়ে জয়া ভাদুড়ির মতো। উকুনেরা দিব্যি শুনতে পায় তা যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

ভিডিও রেকর্ডিং করছিল যে মোবাইলগুলো, তারা একটু একটু এগিয়ে আসে। প্ল্যাটফর্মের একটা গোটা দিক, রেল লাইন, সিগন্যাল, স্টেশনের নাম লেখা কংক্রিটের বোর্ড, একটা খেঁকুরে কুকুরের হেঁটে যাওয়া কিছুই বাদ যায় না। তারা মোবাইল ফোনের লেন্স মনসার দিকে যতটা পারে জুম করে। সামনে বসে গল্প করতে থাকা ওদের এডি শুভঙ্করের ছবিও একই ফ্রেমের ভেতর রাখতে হবে যে।

মনে হয় এবার গান শুরু হবে। গান আর মুখের প্রথম অভিব্যক্তি ধরা চাই। তারপর কলকাতায় ফিরে, এডিটিং করে, মনসা পুজোয় মনসার গান ক্যাপশন দিয়ে ইউ টিউব-এ ছাড়বে কাল। কাল যে শ্রাবণ মাসের শেষ, মনসা পুজো।

টিউবে ওদের চ্যানেলের নাম দ্য নেচার। কৃত্রিমতাহীন সবকিছুই ওদের সাবজেক্ট। বাজারে খাসি কাটার দৃশ্য, তার ব্যা ডাক, আর অল্প পা-দাপানো যেমন থাকে, তেমনি ঘুঘু পাখি, পায়রা বা ফড়িং-এর সোহাগদৃশ্য হাঁ করে দেখছে তিন-চার বছরের বাচ্চারা, তাও দেখায়।

ওরা চায় প্রাকৃতিক কিন্তু অড সাবজেক্ট। এই আগস্ট মাসের শুরুতেই একটা ভিডিযো গোটা ইউ টিউবে হইচই ফেলেছে। সেটা ছিল, হাত-পা হীন এক কিশোরীর সমারসেট ভল্ট। সে গ্রামের দিকে হাটে বাজারে খেলা দেখায়। সুন্দরী মেয়েটি একেবারে পেঙগুইনের মতো কোমরের নীচে একটুকু ছড়ানো থাই দিয়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতেই সে মাটি থেকে শূন্যে লাফ দিয়ে উঠে ডিগবাজি খেয়ে আবার দাঁড়ায়। এরপর সে মাদারি খেলার মতো দুটো বাঁশের আগায় বাঁধা দড়িতে উঠে যায়। তার তো হাত নেই। সে ব্যালান্সের লাঠিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে দড়ির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বাবার ডুগডুগির বাজনা কানে নিয়ে চলে যায়। তারপর আবার ফেরে। ফিরে আসে দড়ির মাঝখানে। সেখান থেকে সে মুখের সরু বাঁশটি ফেলে দেয়। ডুগডুগিতে দ্রিমি দ্রিমি দ্রুতলয়ে বাজে। সে ওখান থেকে ঝাঁপ মারে মাটিতে। শূন্যে দুটো-তিনটে ভল্ট দিয়ে সে অনায়াসে মাটিতে দাঁড়ায় থপ করে। তার ঘন করে লাল করা ঠোঁট খুলে যায়, এক ঝলক সাদা দাঁত হাসির বিদ্যুৎ ছড়ায়।

মনসাদি গাও।

এটা কলকাতার বাবু, সামনে যে বসে আছে, তার গলা। যে এসেই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছে। তার কথা মান্যি করবে না তো মদনার কথা শোনবে! তারপর বাবু একেবার মনসার সঙ্গে মাটিতে বসেছে। কেমন লেপটে বসেছে। হি হি হি স্টেশনের ধুলো-ময়লার কোনও জ্ঞান-গম্যি নাই বাবুর। তারে কেমন নিজের নিজের লাগে মনসার। এসব ভাবতে ভাবতে সে বলেই ফেলল, গাইব! কোনটা গাতি হবে বল ত?

মদন চায়ের গেলাস আর পাউরুটির ঠোঙায় জড়ানো বিস্কুট নিয়ে সিনের ভেতর এন্ট্রি নিয়ে ফেলেছে। এখানে তো কাট, ক্লাপস্টিক-এর ব্যাপার নেই। মনসা চায়ের গেলাস হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতেই একটা মোবাইলে ধরা পড়ে তার মুখে কী সরল হাসির ঝিলিক খেলে গেল। মেঘের ভেতর থেকে এক চিলতে রোদের মুখ বার করার মতো। তারপর সে কাগজে মোড়া হাতের বিস্কুট থেকে একটা লম্বা বিস্কুট নিয়ে চায়ের গেলাসে ডুবিয়ে কামড় দিল।

আহ! কি দারুণ দাঁত! একেবারে সুচিত্রা সেন না!

প্রাণেশ এর কাছাকাছি চলে এসেছিল টিঙ্কু। এই যে গান হবে হবে করে হচ্ছে না, তাতে ওর বিরক্তি লেগে গেছে। আর অফিসের বস ইচ্ছে করে ওকে পাঠিয়েছে এত দূরে। শয়তানি আর কী! না হলে কলকাতার মেয়েকে এতটা দূরে সমুদ্রগড়ে পাঠানো কেন!

প্রাণেশ টিঙ্কুর দিকে ফিরে বলল, যা বলেছিস। একে সাজিয়ে গুছিয়ে চোখে কাজল আর চুলের কলি কানের উপর টেনে বের করে একখানা সাদা কালো হাসির সাইড ভিউ তুলে নিলে দর্শকরা স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকবে। কে কত উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা দেখেছে, আর তাঁদের সিনেমা দেখে প্রেম করতে শিখেছে কেমন ভাবে দিব্য ঘোরের ভেতর ঢুকে যাবে। সাবস্ক্রাইব করে ফেলবে এক দিনেই কয়েক হাজার।

খেপি, তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ কর। গানটা গা।

ওই লুঙ্গি পরা লোকটা আবার এন্ট্রি নেয়। কী করবে, খানিকটা মস্করাটস্করা করে সময় কাটাতে চায় কদবেল, আমড়া, কল-ওঠা ছোলার দোকানদার। ট্রেনের ঘন্টা হয়নি। ট্রেন না এলে তার খদ্দের নেই। পরের আপ ট্রেন ঢুকতে এখনও ঘন্টাখানেক।

চায়ের ভেতর বিস্কুট ডোবাতে ডোবাতে মনসা ডুব দিয়েছে ভাবনায়। এই যে সামনে উবু হয়ে বসে আছে বুক খোলা দোকানদার, সে যে কদবেল আর ছোলা খাইয়ে কতবার তাকে খেয়েছে সন্ধাবেলায় নদীর চরে নিয়ে গিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। বেহুলা নদীর পাশে সরু কাশ বনের ভেতর অনেকখানি জায়গা বেশ পরিষ্কার। কাশ আর হোগলা শুকিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা বিছানার মতো করে রাখা। সেসব খুব মনে পড়ছে এখন মাথা নীচু করে থাকা মনসার। এই কদবেলের কারবারি ছাড়াও লাইনের ওপারে ভাতের হোটেলের থালাবাসন ধোওয়ার লোকটাও তাকে নিয়ে গেছে কয়েকবার সেখানে। বদলে সে প্রায় সন্ধেতে দুটো আলাদা আলাদা প্যাকেটে গুছিয়ে রাখা সারাদিনের হোটেলের খদ্দেরদের ফেলে দেওয়া ভাত তরকারি এনে দেয়। মনসা আরাম করে খায়।

তার এখন মনে এল, এই লোকটার বাচ্চা তো সে পেটে ধরেছিল। সেটা ছেলেই হবে। আর ওই হোটেলের লোকটার মেয়ে তারা সব কোথায় গেল! ওরা সব কোথায় গেল! হারিয়ে গেল! মনে পড়ল তার, চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

হেমন্তের গান। বগলার সাথে ভাব হবার পর বগলা রেডিও কিনে দিয়েছিল। লাল টুকটুকে রেডিও। সেখান থেকে শুনে শুনে কত গান যে শিখেছে সে।

মনসা জানে এই যে সে বিড়বিড় করে কথা কইছে, গান গাইছে, উকুনেরা সেসব শুনছে কান পেতে। তখন ওরা চুপ করে থাকে। মাথায় নড়াচড়া করে না। মনসার মাথা চুলকোতে হয় না। এই কথা বলা বা গান গাওয়ার তালে মনসা ওদের জব্দ করে রাখে। ওরা ভালো ছেলেমেয়ের মতো মনোযোগী হয়। মনসার গান, গল্পে মজে যায়।

মনসা চুপি চুপি মুখে মৃদু হাসি টেনে এখন মাথা নিচু করে ওদেরই শোনাচ্ছে সব। উকুনদের শোনাচ্ছে মনসার পুরোনো জীবন। অনেকগুলো বছর আগে ছেলে-মেয়ে সহ ওদের তিনজনকেই নবদ্বীপ স্টেশনে ভিক্ষা করতে রেখে এসেছিল এই কদবেল ব্যাপারী-ই। তখন বয়স অনেক কম, শরীরে যৌবন থইথই করছে।

শ্রীচৈতন্য ভক্তরা স্টেশনে নেমে গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখত একখানা রাধা যেন বসে আছে। দিতও হাত খুলে। মেলা মানুষ, মেলা পয়সা। কিন্তু ভিড় যে-ভালো লাগে না মনসার। একদিন ট্রেনে চেপে নিজে নিজে ফিরে আসে পুরোনো জায়গায়। বাচ্চা দুটোর কথা ভুলেই মেরে দেয়। তা সে দুটো গেল কোথায়! এতদিনে তো ডাগর হওয়ার কথা!

মদনাকেই দোষারোপ করা শুরু করেছে সকলে। ওর কোনওদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না। কোন সময় কী করা উচিত, তা নিজে নিজে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। একদম কলের পুতুল। তা না-হয়ে ওর উপায় কী! অভ্যাস অভ্যাস! ও যে-মাছের দোকানে কাজ করত আগে, সেখানে তো ছিল ভিড় আর ভিড়। সকালবেলায় দম ফেলার ফুরসত নেই। মাছ মাপার সঙ্গে সঙ্গে আঁশ ছাড়াতে হতো। তারপর দোকানদার মাছ কাটতেই ডাক্তারকে চিৎকার করে ডাকা। সেই মাছের ডাক্তার রুইমাছের মাথার ভেতর সন্না ঢুকিয়ে একটা গোলমতো সাদা কড়াইয়ের দানা টেনে বের করে নিজের বাঁ হাতের তালুতে লাগিয়ে নিয়ে চলে যেত। তখন মদনের কাজ মাছের মাথার কানকো ফেলে দেওয়া। তারপর সাদা পলিথিনের প্যাকেটে মাছ ভরা আর গুছিয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দেওয়া। এই রুটিনের বাইরে তার তো ভাবার কোনও অধিকার নেই। দুপুরের দিকে দোকান গুটোনোর কাজ, মাঝেমধ্যে খইনি বানানো সেসব এক্সট্রা। অন্যমনস্ক হলেই চোদ্দো-গুষ্ঠির আকাশ থেকে নেমে আসার মতো গালাগালির বৃষ্টি। একদিন তো সেই মাছের ব্যাপারী লাথি মেরেই বসল ভরা বাজারে, অত লোকের সামনে। সেই দিনই মদন কাজ ছেড়ে চলে এসেছে। এখানে প্ল্যাটফর্মে সে জুতো পরিষ্কার করে। তাতে কম টাকা হলে হোক, কারও কথা তো শুনতে হয় না।

মদনও দেখল মনসাদি চায়ের গেলাসে বিস্কুট ডুবিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। আর গেলাসের ভেতর দেখছে। সে বুঝতে পারল বিস্কুট ভিজে গিয়ে হাত ছুটে গেলাসের নীচে পড়ে গিয়েছে। সে এক দৌড়ে গিয়ে চায়ের দোকান থেকে একটা চামচ এনে দিতেই মনসাদির হাসি মুখ থেকে সারা গালে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেমন চাঁদ ঝাঁপিয়ে পড়ে কোজাগরীতে। সে চামচ দিয়ে গোলা বিস্কুট তুলে তুলে খেতে লাগল।

কী চার্মিং না! কী সরল না! প্রাণেশ একেবারে বিগলিত। সে টিঙ্কুর চোখে চোখ রাখে।

জানিস, আমার ছোটোবেলায় এরকম হতো। দুধের ভেতর ঢুকে যেত বিস্কুট। আঙুল দিয়ে তুলতে গেলে হাতে ছ্যাঁকা লাগত। তখন বাধ্য হয়ে সব দুধটা চোঁ চোঁ মেরে দিতাম ওই বিস্কুট খাবার লোভে। অনেককাল পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল মায়ের কারসাজি। মা বিস্কুট চুবিয়ে খেতে বলত। কারণ আমি একদম দুধ পছন্দ করতাম না।

ঢং ঢং করে বড়ো একখানা ঝোলানো রেলের পাতের গায়ে ছোটো লোহা পেটানোর শব্দ হল। জুতোকালি করা ছেলে মদন, শুভঙ্করের কাছে উবু হয়ে বসেছিল। সে বলল, আপ ট্রেনের খবর হল। তবে আসতে আসতে এখনও মিনিট চল্লিশ। এই ফাঁকে গানটা না হলে আবার লোকজন যে-জমে যাবে দা! মনসাদির গানের মুড আনতে তখন আবার সময় লাগবে। তখন সে ভিক্ষে করবে। বলবে দাও, দশটা টাকা দাও, ভাত খাব।

শুভঙ্কর যে কথাটা ভাবেনি, তা নয়। কিন্তু সে তার অভিজ্ঞতায় জানে, জোরাজুরি করে এদের কাছ থেকে কিচ্ছুটি বের করা যায় না। এদের মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারলে, তবে নদী কি ঝরনার দেখা মেলে।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল গো?

মনসা মুখ তুলে বাবুটির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফ্যালে। তা আমি কতি পারব নাকি! আমার কি তা মনে আছে!

তোমার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে না? শুভঙ্কর ইচ্ছে করে বরের কথা জিজ্ঞাসা করল না। কী জানি সেখানে কোনও দুর্বলতা থাকতে পারে। বিরাগ থাকতে পারে। এরকম পথের ভিখিরি মেয়েরা একশোটার মধ্যে প্রায় একশোটাই স্বামী খ্যাদানো হয়।

মনসা শুভঙ্করের মুখের উপর তার আয়ত চোখ ফেলে রেখে মাথা নাড়ল। না মনে পড়ে না।

মুখে খানিকটা মেঘ উড়ে এসে বসেছে। মনসা চেষ্টা করছে মায়ের কথা মনে করতে। চেষ্টা করছে বাবার মুখটা কেমন ছিল স্মৃতির ভেতর দেখে উঠতে। কিন্তু শীতের দিনের ভোরবেলায় যেমন ধু ধু মাঠ থাকে, গাছপালা, বাড়িঘর কিচ্ছুটি চোখে পড়ে না, সেরকমই ওই সাদা জলছাপের ভেতর থেকে দুখানি মানুষের চেহারা বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মনসার চোখের উপর ভাসছে কালো কালো দুটি ছবি, ছটফট করছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

শুভঙ্করের চোখে পড়েছে মনসার মুখের উপর থেকে ঝকমকে ভাবখানা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সে মনসাকে এই আটকে পড়া অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। মনসাদি, তোমার যে-একটা ছাগলাছানা ছিল, বলো, তার কী হল!

একদম ঠিকঠাক জায়গায় ছুঁয়ে দিয়েছে শুভঙ্কর। এই ছুটে বেড়ানোর কাজ করেও সে কবিতা লেখাটা ফেলে দিতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই লেখে। আর সে তা লেখে মানুষের নরম মনের কাছে পৌঁছোতে। বছরে পাঁচ-ছটা লিখলেও সই। সে জোরাজুরি করে কবিতা লেখে না। কবিতা তার কাছে ধরা দিলে সে লেখে।

মনসা ছটফট করে উঠল। সে তার গায়ে কাপড় টেনেটুনে নিয়ে বাবুটির আরও একটু কাছে ঘষটে গিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, মোর তো ছাগলছানা ছেল না। মোর ছেল এক সাদা ধবধবে বাছুর। ওরে নে মুঁই মাঠে যাতাম ঘাস খাওয়াতি। আমাগে ছেল ধুধু করা মাঠ, আর তার ভেতর দিয়ে হুস করে চলে যাওয়া নদী। আমাগে ধানের খেত ছেল, পাটের খেত ছেল। আর পুকুরভর্তি হাঁস। ঝুপঝুপ করে ওদের সাথে সাঁতার কাটতাম। সারাদিন মাঠেঘাটে চই চই। লাল লাল চুকোই ফল তুলতাম কোঁচড়ে। তারপর নুন মাখিয়ে পা ছড়িয়ে খাতাম। ওরা সব কোথায় গেল? হারিয়ে গেল। চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

আহা কী মিঠে সুর! ফিসফিস করল প্রাণেশ। টিঙ্কুর চোখটা যেন একটু ভিজে। কিন্তু দারুণ, দারুণ। পুরোটা তুলেছে। দুজনে দুরকম অ্যাঙ্গেলে। ওরা জানে, সুধাময়ও তুলছে অন্যদিক থেকে। বড়ো মুভি ক্যামেরায়। লোকজনের ভেতর থেকে ফাঁকফোকর খুঁজে ওর ফোকাস। ছেলেটা ছমাসের সিনে কোর্স করেছিল। স্পেশাল পেপার নিয়েছিল ক্যামেরা। ওর অনেক সাধ ছিল বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবে। কিন্তু শিকে ছিঁড়তে পারেনি।

শুভঙ্কর উল্লসিত। মনসা মন মেলছে। শুভঙ্কর যে-মনে মনে নিজেকে মনের ডাক্তার ভাবে। সে মানুষের মনের উপর যে-কালো মেঘ এসে জমে, তাকে ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে চায়। তাইতো এরকম অ্যাসাইনমেন্ট পেলে সে লুফে নেয়।

কী ওলট পালট গাইছিস রে খেপি! তোর গান গা। ওই যে চোখ গেল, বয়ে গেল! সেই গান।

আরে মশাই, সেই তখন থেকে আপনি ওস্তাদি করছেন। কে আপনাকে বলতে বলেছে! এখানে বসলে, চুপ করে বসুন। সমস্ত মাটি করে দিলেন! আপনার গান আমরা রেকর্ড করতে আসিনি কলকাতা থেকে। মনসাদেবীর গান শুনতে আর রেকর্ড করতে এসেছি।

কদবেলওলা বমকে গেছে ওই তাড়া খেয়ে সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, তার ঠিক পাশেই এক বাবু মোবাইল ক্যামেরায় ফটো তুলে যাচ্ছে। সে খানিকটা শঙ্কিত হয়। সত্যিই তো। তার কথা বলা উচিত হয়নি। সামনের বাবুটি খুব রেগে গেছে।

শুভঙ্করের রাগ শুধু রেকর্ডিং-এর সমস্যার জন্য নয়। এই যে মনসা নিজে নিজে চেষ্টা করছিল তার মনের কালো অংশ সরিয়ে যেটুকু ভালো, তা সামনে আনতে, সেটাতে হোঁচট খেল তো! পারবে সে, আবার পারবে! শুভঙ্করকে দোলাচল ঘেরে।

মনসা শুভঙ্করকে আশ্বস্ত করে। সে তার মনের দরজা বন্ধ করেনি। বলে, তালে, ওই গানখান গাই বাবু! ওই গানখান গালি আমার যে খুব প্রাণের আরাম হয়। আমার বগলা সামনে আসি দাঁড়ায়। আমার গানখান শুনে সে ঝরঝর করি কাঁদে, আর বলে, তোরে নিয়া পালায় যাবানে রে মনসা। আর একানে থাকবনি। পালায় গিয়া বিয়া করবানে।

বলতে বলতে মনসা গান ধরে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

খুব নরম হয়ে গেছে শুভঙ্করের মন। ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে। সে জানে যত বেশি সম্ভব রেকর্ডিং হবে, তত ভালো। ৫০ মিনিট তুললে তবে কেটে ছেঁটে সাচ্চা ৩০ মিনিট বানাতে পারবে। ইউ টিউব চ্যানেল ৩০ মিনিটের জন্য ভিডিযো দিলে এবং সাবক্রিপশন ৪০ হাজার ছাড়ালে ভালো টাকা দেয়।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তা তোমার বগলার সাথে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে?

মনসা একটু লজ্জা পেয়েছে যেন এমন একটা ভাব করে শাড়ির আঁচল মাথায় নিয়ে আঁচলের প্রান্ত দাঁতে চিবোতে চিবোতে বলল, হ্যাঁ পালায় গেলাম তো। বগলা একদিন ভোর রাতে মোর হাত ধরে পলান দিল। তারপর কত টেরেন চাপল, বাস চাপল, ঝালমুড়ি খাওয়াল। কত গেরাম ছাড়ায়ে কোন দেশের দিকে যাতি লাগল যে, জানি না। এক চড়ক মেলায় বগলার সাথে আলাপ হয়ে ছেল, আবার পালাতি পালাতি অমন এক মেলার মাঠে গিয়ে বগলারে হারায় ফেললাম। আর পালাম না বগলারে।

শুভঙ্কর বুঝে ফেলেছে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর খপ্পরে পড়েছিল মনসাদি। তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় হয়তো রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। সেকথা এখানে জানানোর দরকার নেই। কিন্তু এই যে মনসা অনেকটা নিজের কথা বলতে পারল, অতীত বলতে পারল, তা অনেক। শুভঙ্কর জানে এই মনসার মুক্তি গানে। কিন্তু গান করার সুযোগ কোথায় পাবে সে! আর শুভঙ্করেরও এমন কিছু ক্যাচ নেই যে মনসার জন্য কিছু করতে পারে। দ্য নেচারের এপিসোডটুকু দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। সে সামান্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ডিরেক্টর কলকাতার বাইরে যেতে চায় না বলে শুভঙ্কর বাইরে এসে এই স্বাধীনতাটুকু এনজয় করে। নিজের মতো করে বিষয়টা সাজায়, শুট করে। মোবাইলে ভিডিও তোলে। আর তার নিজের সোশাল সাইটে একটা প্রিলিউড-এর মতো করে পোস্ট দেয়। তাতেই আনন্দ।

ফিরে যাবার আগে টিঙ্কু বলল, শুভঙ্করদা, মনসাদির লুকের ভেতর একটা সুচিত্রা সুচিত্রা ভাব আছে না! তুমি আমার মোবাইলে দ্যাখো। এই যে ওর দাঁত মেলে হাসি। শাড়ি পরিয়ে সুধাময়দার ক্যামেরায় একটা দুটো লুক শুট করলে হয় না!

স্টেশনের পাশের বাজার থেকে সামান্য তিনশ টাকা দিয়ে একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে আনা হল। মনসাদি যথেষ্ট ফরসা। তোলা কাপড় পেয়ে সেও ডগমগ। আর এবার সুধাময়ের এক্তিয়ার। সে নানা পোজে ছবি তুলল মনসার। সুধাময় তার শেখার সবটা দিয়ে প্রায় নিখুঁত সুচিত্রা লুক দাঁড় করিয়ে দিল।

দুই

এই দাদা, তুই কনে রে! তখন থেকে কল করতিছি, কিছুতেই লাগতিছে না।

মুঁই গাড়ি চালাইতেছি রে, একটু বাদে তোরে ফোন দি?

পাঁচ মিনিট হয়নি আবার সে ফোন করে। সে যে ধৈর্য ধরতে পারছে না। তাছাড়া দিদিভাই, মানে যে-বাড়িতে সে কাজ করে, সে গেছে গড়িয়াহাটে। দাদাবাবু অফিসে যাবার পর ফোন করে কয়েকটা জিনিস আনতে বলেছে। তার টুর আছে কালই। চম্পা ফাঁকা বাড়িতে বসে মোবাইল দেখছে আর ঘরের ভেতর পায়চারি করছে। এক একটা সেকেন্ড তার কাছে অনেকক্ষণ। সে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। মা যদি চিনতে পারে তো আর দাসীগিরি করতে হয় না। মা তো এখন খুবই জনপ্রিয় মানুষ। টাইম লাইন ভরে যাচ্ছে মায়ের ফটোতে। শেয়ার হয়েছে কত কত। মায়ের চেহারার কী খোলতাই হয়েছে। খুব গর্ব হচ্ছে চম্পার। একেবারে সিরিয়ালের দিদিমণিদের মতো দেখতে লাগছে।

ডাবলু হালতু বাজারে সওয়ারিকে নামিয়ে ভাড়া নিতে না নিতেই আবার ফোন। সে পোস্ট অফিসের দিকে রিকশা সাইড করে ফোন ধরল। তার স্বরেও উত্তেজনা। ডাবলু বলল, আমার মোবাইলে তো ছবি দেখা যায় না। তুই কি তোর বউদির মোবাইলে পাঠাতে পারবি? আমি বাড়ি গিয়ে দেখে নিতাম। তবে শুধু ছবি পাঠাবি। অন্য কিছু লেখার দরকার নেই। তার যা কুচুটে বুদ্ধি, কোথা থেকে আবার কী বাগড়া না দিয়ে বসে।

হাওড়া স্টেশন থেকে সকাল আটটার নবদ্বীপ লোকাল ধরেছে ওরা। সমুদ্রগড় যেতে ঘন্টা আড়াই। কিন্তু দুই ভাই-বোন উত্তেজনায় ছটফট করছে। চম্পা বলল, এই দাদা, মায়ের বাড়িতে থাকি যাই কটাদিন, কী বলিস? আর মোটে পারা যাচ্চে না। আর ইচ্ছা করে না এই ঝি-গিরি করতে। তুই অন্য আর একজনকে জোগাড় করে দিদিমণিকে দিস আনে। নাইলে তার কষ্ট হবে।

ডাবলু বলল, সে তুই চিন্তা করিসনে। তুই মায়ের কাছে কিছুদিন থাকবি, থাক। তার জন্যি একটা ভালো বাড়ি ভাড়া কততি হবেনে। তারে কইলকাতায় নে যাবানে। সবাই মিলে একসাথে থাকবানে। মায়ের কাছ থে কিছু ট্যাকা পেলি একখান ব্যাটারির রিকশাক কিনুম আনে, ভাবছি। তাতে একটু আয়-টায় বেশিই হবে।

চম্পা বলল, অ্যারা, কিন্তুক মা সমুদ্রগড়ে কুথায় থাহে তাই তো জানি নারে দাদা! ফেসবুকে সবাই তো কইছে সমুদ্রগড়ের মনের মানুষ মনসাসুন্দরী। তো সিকেনে সবাই ঝ্যাকোন চেনে, ত্যাকোন লিশ্চই কয়েক দেবেনে, তাই নারে দাদা?

হ্যাঁ, তাই তো মনে কয়।

একটু লেট করে ট্রেন সমুদ্রগড়ে এগারোটা নাগাদ এল। বেশি লোক নামে না। জনা পঞ্চাশেক হবে। ওরা ভাই-বোন দুজন দুনম্বর প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে এমনি এমনি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়টা কমে গেলে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোবে। একজন সাইকেলের রডে দু-কাঁদি ডাব ঝুলিয়ে বাঁশের স্ট্যান্ড লাগিয়ে বিক্রি করছিল। চম্পার খুব লোভ হল। এখন তো তারা বড়োলোক। মায়ের পয়সা মানে তার ছেলে-মেয়েদের পয়সা। সে দাদাকে বলল, দ্যাখ দাদা, কী সুন্দর ডাব। কইলকাতায় এমুন তাজা ডাব পাওয়াই যায় না। খাবা?

ডাবলু একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। ট্রেনের টিকিট কেটেছে। হাওড়ায় আসার বাসের টিকিট কেটেছে। তারপর আজ তো কাজ হল না। মানে রোজগার নেই। ঘরে ফিরে টাকা ধরাতে না পারলে তো বউ-এর মুখ ঝামটা শুনতে হবে। কিছু পয়সা বাঁচিয়ে ঘরে না দিলে তো বিপদ। সে তো তো করে।

চম্পা বোঝে। সে বলে, দাদা তুমি তো অনেক খরচ করিছ, আমি ডাবের দাম দেবানে। তাছাড়া দিদিভাই আজ সকালেই মাইনে দেছে।

ডাব খাওয়া শেষ করে টাকা মিটিয়ে কী মনে করে চম্পা ডাবঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি কতি পারেন মনসাসুন্দরী এখানে কই থাহেন!

ডাবওয়ালা পরের খদ্দেরের জন্য ডাব কাটতে কাটতে পেছন দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভাই-বোন চটপট সে দিকেই পা চালায়। মনে মনে চম্পা ভাবল, ডাবঅলাও বলে দিতে পারল মানে মায়ের খুবই জনপ্রিয়তা হয়েছে।

প্ল্যাটফর্মের শেষে লেভেলক্রসিং-এ রেললাইনের উপরেই গোটা দুয়ে্ক টোটো দাঁড়িয়ে হাঁকছে। দুজন আসছে দেখে তারা উৎসাহী হয়েছে। ডাবলু আর চম্পার চোখও টোটোঅলাদের দিকে। ওদের যে-কোনও একটাতে উঠে বসে মনসাসুন্দরীর বাড়ির কাছে নামাতে বলবে।

প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষে এসে পড়েছে। চম্পা একটা স্বর শুনে পিছন ফিরল। গলাটা চেনা যেন! একজন মহিলা গাছতলায় বসে আছে। সে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পার পা আটকে গেছে। সে দাদার হাত খামছে ধরেছে। যেন ভূত দেখছে। চম্পার পা কোনও দিকে যাচ্ছে না। না সামনে না পেছনে। সামনের ভিখারিনি তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রেনের থেকে নামা আর তেমন কোনও প্যাসেঞ্জার নেই। এদের কাছ থেকে যদি পাওয়া যায়। ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পা তার কাজের বাড়ির একটা বাতিল লেডিজ ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছিল। সে ব্যাগের ভেতর থেকে দশটা টাকা খুঁজে হাতে নেয়। হাত মুঠো করে। টাকাটা দলা পাকায়। তারপর এক পা এগিয়ে সেই দলাকরা টাকা ছুড়ে দেয় ভিখারিনির থালার দিকে। থালার একটু আগেই পড়ে টাকা। চম্পা মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সে দাদার হাত ধরে টান দেয়। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাবে ডাউন ট্রেনের জন্য। কলকাতায় ফিরবে।

ভিখারিনি টাকা কুড়িয়ে সেটা সোজা করতে করতে মনের খুশি ওর মাথার উকুনদের জানাতে চেয়ে খানিকটা জোরেই গেয়ে ফেলে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা…।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...