প্রিয়া, বয়স সতেরো, কলকাতার এক নামি স্কুলের ছাত্রী। পড়াশোনায় বেশ ভালো কিন্তু সহপাঠীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের পৌনঃপুনিক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। প্রিয়ার কোনও ভালো বন্ধু নেই, কারণ সে অন্যের সাফল্য বা প্রশংসা সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া প্রিয়া, প্রথম স্থানাধিকারী মেয়েটির রিপোর্ট কার্ড চুরি করে ধরা পড়ে।

রঞ্জিতের বয়স ছত্রিশ। অফিসে এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত। তার দোষের অন্যতম কারণ একই পদে বহু বছর একসাথে কাজ করা সেই সহকর্মীর, বৈধ কারণেই একটি পদোন্নতি হয়। কিন্তু রঞ্জিত তা কিছুতেই ভালো মনে গ্রহণ করতে পারেনি। রঞ্জিত সম্পর্কে রিপোর্ট, তার আচরণ অত্যন্ত অহংকারী, উদ্ধত, বন্ধুত্বের প্রতিকূল এবং অতি কৌতূহলী।

শুধু প্রিয়া আর রঞ্জিতই নয়, চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের আমরা ঈর্ষাকাতর বা হিংসুটে আখ্যা দিয়ে থাকি। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কি, মনস্তত্বের কোন ক্রিয়াকলাপের ভিত্তিতে মানুষ এহেন আচরণ করে ফেলে?

সাধারণ ভাবে Jealousy বলতে আমরা যা বুঝি, তা আসলে অন্যের সম্পত্তি ও গুণাগুণ না থাকার ব্যর্থতার অসন্তোষ ও ক্রোধ মিশ্রিত একধরনের ভাবাবেগ। আসলে ঈর্ষা প্রতিটি মানুষের মধ্যেই থাকে। স্বল্প মাত্রায় এটি জীবনে চালিকাশক্তির উৎপাদন করতে পারে। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু অতি মাত্রায় ঈর্ষা জীবন থেকে সুখ ও আনন্দের সব রস শুষে বার করে নিতে পারে। প্রতিটি মানুষই যেহেতু কোনও না কোনও সময়ে ঈর্ষা অনুভব করে থাকে, তাই তার বিশেষ বিশেষ লক্ষণগুলি প্রত্যেকেরই জেনে রাখা খুব জরুরি। তাহলে নিজের বা অন্যের মধ্যে সেগুলি ধরা যাবে।

–    ঔদাসীন্যের প্রাথমিক প্রদর্শন হল ঈর্ষার একেবারে গোড়ার লক্ষণ। আপনার সাফল্যের খবরে আপনার কাছের কেউ বেশ চুপচাপ এবং অমনোযোগী হয়ে গেলে তা নিশ্চিত ভাবে ঈর্ষার লক্ষণ। ঈর্ষা অনুভব না করলে অন্যরা খুশি হয়ে আপনার সঙ্গে উৎসাহভরে প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলবেন।

–    ঈর্ষার অস্বস্তিকর অনুভূতির কবল থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় কেউ হয়তো আপনাকে, আপনার কাজকে বা আপনার চোখে গুরুত্বপূর্ণ কোনও মানুষকে অপমান করবে, ছোটো করবে।

–    ঈর্ষার তৃতীয় লক্ষণ দেখা যায় যখন কেউ আপনার সাফল্যে অত্যধিক কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। আসলে তিনি ততক্ষণে মনে মনে আপনার ও আপনার সফল কাজের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে বসে গেছেন। যারা অন্যের প্রতি অত্যধিক কৌতূহল দেখান তারা সাধারণত হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। নিজের সম্পর্কে তাদের আসলে খুবই বাজে ধারণা।

মানুষে মানুষে অসমতা আসলে জীবনের এক বাস্তবতা। আমাদের নিজস্ব কিছু দোষ-গুণ আছে যা অন্যের সঙ্গে সর্বতো ভাবে কিছুতেই মিলবে না। নিজের খামতি মেনে নেওয়া এবং সেই সঙ্গে নিজের ক্ষমতাগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করার বিচক্ষণতা কিছু মানুষের আছে। তারা কখনওই প্রতিনিয়ত নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না। কোনও শিশুকে ভালো হতে অনুপ্রাণিত করার বদলে তার গুরুজন যদি তার মনে নিকৃষ্টতা ও অসন্তুষ্টি বোধগুলো জাগ্রত করে দেন, তাহলে সেই শিশুটির মধ্যে আত্মমর্যাদা বোধ বেড়ে উঠতে পারে না। পরবর্তী জীবনে সে ‘লো সেলফ-এস্টিম’ এবং ঈর্ষার শিকার হয়। আবার অপরের সাফল্যকে নিজের ক্ষতি হিসেবে ছোটো থেকে দেখতে শেখালে, তার থেকেও ঈর্ষাবোধ জাগ্রত হয়। এতে শিশুদের মধ্যে প্রতিযোগিতার এবং তুল্যমূল্য বিচার বোধের মেজাজ তৈরি হয়। তাছাড়া ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে মানুষ করার ব্যবস্থায় দুর্বল হয়ে পড়ছে সামাজিক বন্ধনগুলি, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং অন্যের আনন্দের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থত্যাগ। তার বদলে বেড়ে চলেছে নিজের প্রতি দুর্নিবার ভালোবাসা। এই সমস্ত মনো-সামাজিক কারণেই আমাদের সমাজে ঈর্ষা আজকাল এতটা বেড়ে চলেছে। সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বস্ততা ও সন্তুষ্টি আক্রান্ত হয় ঈর্ষার দ্বারা। ঈর্ষার সঙ্গে এঁটে উঠতে সাহায্যকারী কয়েকটি টিপস দিচ্ছি।

–   অতিরিক্ত ঈর্ষাবোধের ফলে অনেকে অন্য কোনও ব্যক্তির আচার-আচরণ, হাবভাব, বেশভূষা এতটাই অনুকরণ করতে শুরু করে দেন যে, নিজের আত্মপরিচয় বোধটাই অন্য কেউ হতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেন। মিথ্যা রূপ ধারণ ত্যাগ করে নিজস্ব, অতি সুন্দর ও প্রীতিকর অনুপম রূপটি আবিষ্কার করুন।

–   সম্পর্কের সংযোগে, বন্ধনে, ঈর্ষা বাধা সৃষ্টি করে ও বন্ধুত্বের আনন্দ ক্ষয় করে। এই ক্ষয় আটকাতে এবং সম্পর্কগুলি রক্ষা করার জন্য যুক্তি-সহ আলোচনা করে সমস্যাগুলির মীমাংসা করুন।

–    অন্যের সাফল্যে ঈর্ষার হাত ধরে আসে ক্রোধ। মনে রাখুন অন্যের জীবনযাত্রা পাওয়ার মনোবাঞ্ছা এক নিরর্থক অন্বেষণ। প্রতিটি মানুষেরই কিছু ট্যালেন্ট থাকে তাই জীবনের যথার্থ দিকগুলির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা অনেক ভালো।

–    ঈর্ষাতুর মানুষ অনেক সময় অন্যের জীবনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। এরা নিজের জীবনের সঙ্গে অন্যদের জীবনের পার্থক্য নিয়ে অবিরত তুলনা করতে থাকেন। আসলে জীবনের বাস্তবতা মেনে নিয়ে তার মধ্যেই সুখ খুঁজে বার করতে হবে।

–    নিজের মেধাগুলির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন এবং নিজেকে শ্রদ্ধা করুন। নিজের প্রতি কৃতজ্ঞ হলে ঈর্ষা, লোভ, তিক্ততা অনুভব করা বেশ কঠিন।

–    আরও বেশি বেশি চাওয়ার আত্মকেন্দ্রিক অনুভূতির সঙ্গে ঈর্ষার গভীর যোগসূত্র। সহায়হীন বা জীবনান্তক রোগে আক্রান্ত মানুষের সেবা করুন স্বেচ্ছায়। তাদের কষ্ট, তাদের সংগ্রামের সান্নিধ্য আপনার আরও বেশি চাওয়ার তীব্র অনুভূতিকে অনেক স্তিমিত করে দেবে।

সাইকোলজিকাল হেল্প – মনোবিদ, শ্রীতমা ঘোষ

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...