ল্যান্ড অফ ডন-লিট মাউনটেনস – উদিত সূর্যের দেশ অরুণাচল। উদয়গিরি, উদয়াচলও নাম ছিল পূর্বে। আয়তনে উত্তর-পূর্ব ভারতের সবুজ সুন্দরী সাত ভগিনীর মধ্যে বৃহত্তমা রাজ্য, যদিও এই রাজ্যের জনবসতি বেশ কম। এই রাজ্যের সীমানায় রয়েছে তিন বিদেশি রাষ্ট্র, মায়ানমার, ভূটান ও চিন অধিকৃত তিব্বত। তিব্বতের সাংপো নদীর অরুণাচলে নাম হয়েছে সিয়াং, তারপর অসমে এই নদীরই নাম ব্রহ্মপুত্র।
ঘন সবুজের ঘেরাটোপে সারা রাজ্যটাই পাহাড়ি বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। ৫০০ রকমের অর্কিডের দেখা মেলে এই রাজ্যে। ১৯৪৮ সালে গড়া রহস্যময়ী সুন্দরী নেফার ১৯৭২-এর ২০ জানুয়ারি নতুন নামকরণ হয়েছে Arunachal। ভারতের ২৪-তম রাজ্য ১৯৮৭-এর ২০ ফেব্রুয়ারিতে গড়া অরুণাচলের সদর দফতর ইটানগর। ভারতের অরুণাচল রাজ্যে সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়ে ৪.৩০ মিনিটে। একদিকে তুষার কিরীট মাথায় নিয়ে হিমালয়, অপরদিকে আদিম অরণ্যে ছাওয়া পাহাড়ি উপত্যকায় বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণীর পাশে অরণ্যচারী উপজাতির বাস, আর নীল-সাদায় মেশামেশি জলের ধারা নিয়ে অশ্বখুরাকৃতি অরুণাচলের বুক চিরে বয়ে চলেছে পাঁচটি পাহাড়ি নদী – কামেং, সুবনসিরি, সিয়াং, লোহিত ও তিরাপ।
এই অচেনা রূপসীর রূপের খোঁজে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে চেপে বসলাম কাঞ্চনজঙঘা এক্সপ্রেসে। ট্রেন ছাড়ল ৬.৩৫ মিনিটে, সারাদিন রাত পেরিয়ে ভোর ৪.৩০ মিনিটে আমাদের ট্রেন প্রবেশ করল গুয়াহাটি স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে ওয়েটিং রুমে খানিক ওয়েট করতে হল গাড়ির ব্যবস্থা করার জন্য। গাড়ি ঠিক হলে তাতে মালপত্র তুলে আমরাও উঠে পড়লাম। পাড়ি দেওয়া হল অরুণাচলের সদরশহর ইটানগরের উদ্দেশে। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা, ৪৫০ কিমি দীর্ঘপথ। খানিক পরেই গাড়ি চলল ব্রহ্মপুত্রের কিনারা ধরে, দেখা গেল দূরে, দ্বীপের উপর উমানন্দের মন্দির। তারপর ব্রহ্মপুত্রের পুল পেরিয়ে গাড়ি ছুটল মনোরম পথ ধরে। শহর শেষ হতেই পথের দু’পাশে কখনও নানা গাছ-গাছালির স্নিগ্ধ সবুজ, কখনও পাকা ধান সোনার বরণ খেত। মাঝে মাঝে অবশ্য পড়ছে ছোটো বড়ো জনপদ, বাজার দোকান। তবে পথের দুধারে সবুজ আর সোনারঙের দখলদারিই বেশি। ৫২ নং ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলেছি, বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ বাইহাটা চারিয়ালিতে (মোড়) এসে একটা দোকানে জলখাবার খাওয়া হল। পথ চলতে চলতে প্রায়ই দেখছি বোর্ডে লেখা আদরনি, পরে বোঝা গেল আদরনির অর্থ হল স্বাগতম। সোনা রং আর সবুজে চোখ ডুবিয়ে ছুটে চলা, বেলা ১০টা নাগাদ চেকিয়াজুলিতে গাড়ি থামিয়ে চা খাওয়া হল, ভারি ভালো চায়ের স্বাদ। এবার পথের ধারে শুরু হল বড়ো বড়ো সবুজ গাছের ছাউনির নীচে নরম সবুজ চা-বাগান। বাগানের বিস্তার বিশাল, চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে সবুজ মখমলি রঙের ছোঁয়ায়। একসময় জিয়া ভরালি নদীর পুল পার হলাম।
দেড়টা নাগাদ গাড়ি পৌঁছোল বিশ্বনাথ চারিয়ালিতে, শুরু হল শোণিতপুর জেলা। ওখানে ধাবায় লাঞ্চ খাওয়া হল, রান্না বেশ ভালো। পথে পড়ল মেনোবাড়ির সুবিস্তৃত চা-বাগান, এই বাগান এখানকার সব থেকে বড়ো চা-বাগান। এবার এল বিহালি জনপদ, বিহালি নদীর পুল পার হলাম। এবার গহপুর জনবসতি। আর সামান্যক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম অরুণাচলের প্রবেশদ্বারে, হলঙ্গি চেক পোস্টে। ইনারলাইন পারমিট দেখিয়ে গাড়িতে ওঠা। পরপর পড়ল পাপুমুর ও চিম্পু জনপদ, এরপর পাঁচ কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম অরুণাচলের সদর শহর ইটানগরে।
পরদিন সকালে বার হতে নানা কারণে দেরি হয়ে গেল। জলখাবার খেয়ে প্রায় ৯.৩০ নাগাদ দেখতে যাওয়া হল গঙ্গা লেক। শহর থেকে ৬ কিমি দূরত্বে আরণ্যক পরিবেশে প্রকৃতিদত্ত গঙ্গাশেখী লেক। আমরা গাড়ি করে সামান্যক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম, বেশ খানিক সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতেই চোখের সামনে দেখা গেল অরণ্যের স্নিগ্ধ ছায়ায় সবুজ লেক-টি। গাছের ছায়া পড়ে লেকের জল সবুজ হয়েছে। লেক-টির বিস্তার খুব বেশি নয়, চারিপাশ দিয়ে জঙ্গলের ছায়ামাখা পথ। এই পথ দিয়ে লেক পরিক্রমা করা যায়। তবে পথটি খুব নির্জন। পরিক্রমা করতে হলে দলবদ্ধভাবে করা উচিত। আগে লেকের জলে নৌবিহারের ব্যবস্থা ছিল। দু’একবার দুর্ঘটনা ঘটার পর বন্ধ হয়ে গেছে।
শান্ত নির্জন পরিবেশে অরণ্যের ঘেরাটোপে লেকের পাড়ে বসে থাকতে খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু সময় নেই। অতএব আবার গাড়িতে ওঠা। ইটানগর শহর ছাড়িয়ে বিপরীত দিকে চলা। দেখলাম, শহরের ভালোই বিস্তৃতি। এবার গাড়ি উপরের দিকে উঠতে লাগল, দুই টিলা পাহাড়ের মাথায় একটিতে বৌদ্ধ গুম্ফা, অপরটির চূড়ায় গভর্নর হাউস, সেক্রেটারিয়েট, ডানহাতি টিলায় মনোরম বাগিচা মাঝে বৌদ্ধ গুম্ফা। দলাই লামার রোপিত বোধিবৃক্ষটিও দেখলাম। তিব্বতীয় শৈলীতে নির্মিত গুম্ফা থেকে শহরও সুন্দর দৃশ্যমান। আর একটু এগিয়ে বাঁহাতি টিলার উপর রাজভবন দেখে, এইপথেই আরও সামান্য এগিয়ে দেখা হল ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন– ইটাকোর্টের দক্ষিণ দ্বার। সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ৭৫০ মিটার উচ্চে ১১ শতকের জিতারি বংশের প্রাচীন রাজধানী মায়াপুরের ধবংসাবশেষ। আজ থেকে প্রায় সাতশো বছর পূর্বে জিতারি বংশের রাজার সময় ইটাকোর্ট নির্মিত হয়েছিল, আশি লক্ষ একরকম ইট দিয়ে। দুর্গ এখন ধবংসপ্রাপ্ত। দুর্গের দক্ষিণ দ্বারের সামান্য অংশ এখনও রয়েছে, তাই দেখা হল।
Arunachal-এর নানা জায়গার সংস্কৃতির একত্র সমাহার দেখতে গেলে যেতে হবে এখানকার মিউজিয়ামে। নানা উপজাতির সংস্কৃতির হাজারো নিদর্শন আছে মিউজিয়ামে। মিউজিয়াম সোমবার বন্ধ থাকে। এখানকার রামকৃষ্ণ মিশন ও মিশনের হাসপাতালটিও একটি দর্শনীয়। লোয়ার সুবলসিরি জেলার ৭৫০ মিটার উঁচুতে ইটানগরের অবস্থান, আয়তন ২৫০০ একর। হাজার পঁচিশ লোকের বাস, জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ, আরামপ্রদ।
ইটানগরের দর্শনীয় দেখা শেষ করে রওনা হলাম জিরোর উদ্দেশে। চোখ জুড়োনো, মনভোলানো পথ। খানিক চলার পর বড়াপানি নামে একটি বেশ বড়ো জনপদ পড়ল। তারপর পড়ল আরও একটি জনপদ নাহারলগান, ২০০ মিটার উঠে পটে আঁকা ছবির মতো সুন্দর শহর (জেলা সুবনসিরি)। জনপদ পার হতেই শুরু হল পথের দুধারে সবুজ বর্ণালি। পাহাড়ের উপর অন্যান্য গাছের থেকেও বুনো কলা গাছের আধিক্যই বেশি দেখা যাচ্ছে।
খানিক পরে পাহাড়ি পথ ছেড়ে নেমে এলাম অসমের হারমতি জনপদের সমতল ক্ষেত্রে। পথের দুধারে আবার দেখা গেল, সবুজ গাছের সারি। পাকাধানের সুবিস্তীর্ণ খেত। রোদ লেগে সোনা রং ঝিকমিক করছে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর কিমিন গ্রামের মধ্যে দিয়ে অরুণাচলে আবার পারমিট দেখিয়ে প্রবেশ করলাম। এখানেই একটা দোকানে লাঞ্চ খাওয়া হল। পাহাড়ি পথে ঘন অরণ্যের সবুজের ছড়াছড়ি। ড্রাইভার বলল এই বনে হাতির দেখা পাওয়া যায়। আকাশে কোদালে মেঘ, পুবের দেশ বলে সাড়ে চারটের মধ্যে সন্ধ্যার আভাস, আঁধার ঘনিয়ে আসে।
ঘন বন চিরে পাহাড়ি পথ। অনেকক্ষণ চলার পর উপর থেকে নীচে তাকিয়ে দেখি একটি আলোকিত উপত্যকা, আশ্চর্য সুন্দর লাগছে। ঘুরে ঘুরে নেমে এলাম আলোর চুমকি দেওয়া জায়গায়। এখানে রঙা নদীর বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। স্থানটির নাম ইয়াযলি। আরও কিছু চলার পর জিরোতে প্রবেশ করলাম। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমরা হোটেল খুঁজে পাচ্ছি না, খানিক এগিয়ে চলে এলাম নিউ জিরোতে। আবার ফিরে আসা সমস্ত জিরো উপত্যকার অন্ধকার মেখে। প্রায় ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর হোটেল পাওয়া গেল। আরামে ঘুমোলাম। ইটানগর থেকে জিরো প্রায় ১৫০ কিমি পথ।
সকালে বাইরে এসে দেখি আকাশে হালকা মেঘ। আটটার পর ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়া। লোয়ার সুবনসিরি জেলার সদর শহর ১৫৩৮ মিটার উচ্চতায় সৈনিক সবুজ, পাইনে ছাওয়া জিরো শহরকে দেখে ভালোবেসে ফেললাম। চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা আপাতানি উপত্যকার প্রান্তদেশে সমতলভূমির উপর জিরোর অবস্থান, নৈসর্গিক শোভা অতুলনীয়। এখানে উপজাতির বাস। এরা শিকারপ্রিয়, স্থানীয় সুরা, রাইস বিয়ার অর্থাৎ আপাং এদের প্রিয় পানীয়। পুরুষরা উঁচু করে চুল বেঁধে পাখির পালক চুলে গুঁজে রাখে, কোমরে গোঁজা থাকে দা বা ছোরা। তবে এখন উপজাতিদের দেখা খুবই কম পেলাম। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়ের মডার্ন সাজসজ্জা, স্কুল কলেজ পড়ে।
জিরোতে একটি প্রকৃতি নির্মিত শিবলিঙ্গ আছে জানা গেল। অতএব গাড়ি ছুটল তার খোঁজে। পথে আবার ভুল। তবে লাভ হল, দিনের আলোয় ভালো করে জিরো জনপদটিকে দেখা হল। জিরো শহর ৫ কিমি ব্যবধানে দুটি ভাগে গড়ে উঠেছে। পুরোনো জিরো শহর ১৭৫ মিটার উঁচু হাপোলি পেরিয়ে পথ চলে ২০০ মিটার নেমে শহর জিরোয়। পাকাবাড়ির সংখ্যা খুবই কম, বেশিরভাগই বাঁশ, কাঠ ও চ্যাঁচারি দিয়ে তৈরি করা ঘরে বসবাস। স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, দোকান বাজার সবই আছে। আর আছে সমতল উপত্যকাতে বিস্তৃত ধান খেত। ধান কাটা হয়ে গেছে তবে শূন্য খেতের ধূসর বর্ণও মনহরণ করতে পারে সেটা বেশ বোঝা গেল। সব মিলিয়ে জিরো, প্রকৃতির সুন্দরী কন্যা।
খানিক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে মহাদেবের দর্শন মিলল বেশ খানিক উপরে। ২৪ ফুট উঁচু শিবলিঙ্গের অনুরূপ বিশাল প্রস্তর খণ্ড পূজা পাচ্ছেন। অপরূপ পরিবেশ, এখানে প্রকৃতির আশ্চর্য সাজ, চোখ জুড়ানো। এবার ফেরার পালা।