কথায় কথায় রাগ করা এবং কেঁদে ফেলাও এখন স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে মনামীর। আর ওর এই ব্যবহারে বাড়ির লোকেরাও খুবই অস্বস্তিতে আছেন। স্বামী সবকিছুই সহ্য করে নেওয়া সত্ত্বেও, মনামী খুশি হয় না। আর এইসব দেখেশুনে মনামীর শাশুড়ির অভিযোগ, কাজ না করার জন্য এসব বাহানা করে দিনেরাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখছে বউমা।
ভয়ের আবহ থেকে সমস্যা
মনামীর মতো অনেকেই আছেন যারা আরও অনেকরকম সমস্যায় রয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই জানেন না যে, এরা মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছেন। সময় য়েভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে, চারিদিকে য়েভাবে ভয়ের আবহ তৈরি হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া যেভাবে আমাদের গ্রাস করে চলেছে, এর ফলে অবসাদের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। অবশ্য অনেকেই এখন এই অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
মানসিক অবসাদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই চালাচ্ছেন, তাদের বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না অনেকসময়। শরীরে-মনে কে যে কতটা ভেঙে পড়েছেন, তা বুঝে ওঠা সত্যিই কঠিন কাজ। এমনকী রুপোলি পর্দায় যাদের প্রাণবন্ত রূপে দেখা যায়, তাদের মধ্যেও অনেকেই মানসিক অবসাদের শিকার। এই তালিকায় আলিয়া ভাট, বরুণ ধাওয়ান, মনীষা কৈরালা, শাহরুখ খান, লেখক জে কে রাউলিং প্রমুখের নামও যুক্ত হয়েছে।
সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর অবসাদ প্রসঙ্গে সমাজে বিস্তর চর্চা শুরু হয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয়, শুধু আর্থিক অভাব অনটনের ফলেই নয়, অতিরিক্ত অর্থ এবং হঠাৎ সাফল্যও মানুষকে বিপথে চালিত করতে পারে এবং অবসাদ গ্রাস করতে পারে। আসলে, কোনও কিছুর ঘাটতিই হোক কিংবা প্রযোজনের অতিরিক্ত কিছু পেয়ে যাওয়াই হোক, অবসাদ আসতে পারে যে-কোনও পথ ধরে। না-পাওয়ার গ্লানি কিংবা সাফল্য ধরে রাখার দুঃশ্চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় অবসাদ।
লড়াই করতে করতে যখন ক্লান্তি আসে কিংবা অসাফল্যে যেমন নিজের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলার ভয় গ্রাস করে, ঠিক তেমনই চরম সাফল্যে যখন অতিরিক্ত অহংবোধ তৈরি হয়, ঠিক তখনই সামাজিক দূরত্ব তৈরি হয়। আর এই দূরত্ব যখন বাড়তে থাকে, তখনই একাকিত্ব গ্রাস করে এবং অবসাদের জন্ম হয়।
চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
ওই সময় আমি খুব লোনলি ফিল করছিলাম কিংবা গত তিনদিন আমি খুব ডিপ্রেসড ছিলাম এমন বাক্য প্রায়ই শোনা যায় অনেকের থেকে। আসলে, যারা এই ধরনের কথা বলেন, তাদের অবশ্যই চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, মানসিক অবসাদের সূচনাপর্বে যদি চিকিত্সা শুরু হয়, তাহলে আত্মহত্যার মতো বড়ো বিপদ থেকে বাঁচা যায়, বাঁচানো যায় সহজেই।
ডা. সমীর পারেখের মতে, মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছেন এমন বিষয় আজও অনেকে স্বীকার করতে চান না কিংবা চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে চান না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে, শরীরের অন্যান্য অসুস্থতায় যেমন চিকিত্সকের পরামর্শ নেন, ঠিক তেমনই অবসাদগ্রস্ত হলেই দ্রুত চিকিত্সা পরিষেবা নেওয়া উচিত। এর ফলে আপনার মূল্যবান জীবন বাঁচবে।
আসলে, কোনও কিছু ভালো না লাগা, কাউকে কিছু বলতে না পারা কিংবা নিজেকে গুটিয়ে রাখাই যে মানসিক অবসাদের লক্ষণ, এটাই বুঝে ওঠেন না অথবা বুঝতে চান না অনেকেই। অথচ ঠিক সময়ে চিকিত্সা শুরু হলে এড়ানো যায় আত্মহত্যার মতো ঘটনা।
কীভাবে বুঝবেন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযাযী, অবসাদ এক মানসিক রোগ। জীবনের ওঠাপড়ার সময় যে-মানসিক অস্থিরতা কিংবা ভয় তৈরি হয়, তার থেকেই অবসাদ জন্ম নেয়। কোনও কঠিন এবং জটিল পরিস্থিতি কিংবা সমস্যা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পাওয়ার ফলস্বরূপও অবসাদ গ্রাস করতে পারে। আর এর ঠিক পরবর্তী পর্যায় হল বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হওয়া। অর্থাৎ, আশাহীনতাই অবসাদের প্রধান কারণ।
যখন কোনও মানুষ মনে করেন সমস্যা সমাধানের কোনও পথ খোলা নেই, যখন কেউ মনে করেন সমাজে তাঁর আর কোনও গুরুত্বই নেই এমন পরিস্থিতি তাদের নিশ্চিত অবসাদের দিকে ঠেলে দেয়। অর্থাৎ এরা তখন নিজেদের এক হেরে যাওয়া অপদার্থ ব্যক্তি ভাবতে শুরু করেন। আর এই আত্মবিশ্বাসের অভাবই ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদের শিকার হতে বাধ্য করে।
সমাজ বিশেষজ্ঞ এমিল দুরখাইম আত্মহত্যা শীর্ষক তাঁর এক বইতে উল্লেখ করেছেন, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষরাই বেশি আত্মহত্যা করেন। তাই তাঁর পরামর্শ, কাউকে উদাস এবং হতাশ হতে দেখলেই দ্রুত চিকিত্সা শুরু করান।
বারবার ভুলে যাওয়া, ভুল করা, কোনও কিছুতে নিশ্চিত না হওয়া, ছোটো সমস্যায় নিরাশ হয়ে পড়া, আনমনা থাকা প্রভতি মানসিক অবসাদের প্রধান লক্ষণ। শুধু তাই নয়, সবকিছুর নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গিও ভালো লক্ষণ নয়। সেইসঙ্গে, সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখাও মানসিক অবসাদের কারণ হতে পারে।
নিজের উপর বিশ্বাস এবং আস্থা না থাকাও একরকম মানসিক রোগ। জীবনে কিছুই পেলাম না, আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন এমন ভাবনা মনের অসুখের ইঙ্গিত দেয়। একটা ছোট্ট বিষয়কে নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দুঃশ্চিন্তায় থাকাও মানসিক অবসাদের লক্ষণ।
কেউ যদি প্রযোজনীয় কাজে ঠিকমতো মনোনিবেশ না করে কিংবা কাজ করার থেকে বেশি সময় বসে থাকে কিংবা অতিরিক্ত ঘুমোয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, সে আশাহত। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সবসময় অস্থিরতা এবং রাতে ঘুমোতে না পারার মতো সমস্যা। এক্ষেত্রে কারও ওজন বেড়ে যেতে পারে, আবার কারও ওজন কমে যায়। সর্বদা মাথা ব্যথা কিংবা পিঠ ব্যথাও মানসিক রোগের সূচনাপর্ব হতে পারে।
কারও ক্ষেত্রে আবার মানসিক অবসাদের প্রধান লক্ষণ হতে পারে রাগ। বিনা কারণে সবসময় রেগে ওঠা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। ডা. সমীর পারেখ এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত আসক্তি এবং বাস্তবে যদি সামাজিক দূরত্ব তৈরি হয়, তাহলে মানসিক অবসাদ বাড়তে বাধ্য।
তাই, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কাউকে যদি হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখেন কিংবা খারাপ ভাবে বদলে যেতে দেখেন, তাহলে সাবধান হোন এবং দ্রুত মানসিক চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়ে চিকিত্সা শুরু করান।
যা যা করণীয়
কেউ যখন মানসিক অবসাদের শিকার হবেন, তখন তাকে কীভাবে বাঁচাবেন জেনে নিন :
- অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিকে একা রাখবেন না। ওকে ওর পছন্দ মতো কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন।
- ওর সঙ্গে সবসময় কথা বলে মন ভালো রাখার চেষ্টা করুন। ওর কথাও মন দিয়ে শুনুন। ওর মনের ভয়-ভীতি কিংবা দুঃখবোধের কারণগুলো জেনে নিন।
- কেউ অবসাদগ্রস্ত হয়েছে কিনা বুঝে ওঠার জন্য ওর সমস্ত অ্যাক্টিভিটির উপর নজর রাখুন। এরজন্য আপনাকেও কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে। অবসাদের লক্ষণ এবং চিকিত্সা সংক্রান্ত বিষয়ে বইপত্র পড়ুন, অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেও জ্ঞান সঞ্চয় করুন এবং চিকিত্সকের পরামর্শ নিন। লক্ষ্য রাখুন কী কী পরিবর্তন ওর মধ্যে প্রকট হচ্ছে। রাগ, হিংসা, অপরাধবোধ জন্ম নিচ্ছে কিনা অতিরিক্ত মাত্রায়, তা নজর রাখুন এবং সেইমতো সব জানিয়ে চিকিত্সকের সাহায্য নিন। আর যদি নিশ্চিত হন যে, মানুষটি অবসাদগ্রস্ত, তাহলে তার প্রতি আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠুন।
- পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তা কেটে যাবে এবং আপনারা তার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে সবসময় পাশে আছেন, এমন বার্তা দিন তাকে।
- কোনও ভাবে যেন আশাহত না হয় এবং পরিবারে এবং সমাজে তারও যে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, তা ভালো ভাবে বোঝান।
- সহানুভতি থাক কিন্তু ওর যেন মনে না হয়, ও মানসিক অবসাদের শিকার বলে করুণা দেখাচ্ছেন। ও যে কারওর বোঝা কিংবা করুণার পাত্র নয়, বরং তার নিজস্ব সত্ত্বা আছে এবং সেও যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তা তুলে ধরুন ভালো ভাবে।
- মানুষটির গুণ কিংবা মহত্বের দিকগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করুন নানা ভাবে। প্রযোজনে কোনও উপলক্ষ্য করে ওর হাতে উপহার সামগ্রী তুলে দিয়ে ওর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করুন।
- বাড়ির সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যান কোনও সুন্দর প্রকৃতিতে এবং খুব হইহুল্লোড় করুন ওকে নিয়ে
- জীবন মানেই লড়াই একথা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। আর পরিবারের সবাই যাতে ওর প্রতি যত্ন নেয়, ভালোবাসা দেয়, সে খেয়াল রাখুন। আর বোঝান যে, সমস্যার সমাধান হবেই। কারণ, যে-সমস্যার সমাধান নেই, সেটা কোনও সমস্যাই নয়।