অঘটন বিভিন্ন রকমের হয়। সবই যে শরীর ধ্বংস করে বা হাত পা মাথা কাটে এমন নয়, মাঝে মাঝে এই অঘটন একটা অদ্ভুত আনন্দও দেয়। আনন্দের ধারণাটাও আপেক্ষিক, তাই একই ঘটনা এক পরিবারের একজনকে আনন্দিত করলেও অন্য আরেকজনকে দুঃখিত করে। সমস্যা হল এই দুঃখ আবার প্রকাশ করা যায় না, ঠিক যেমন রূপার হল।

ক্লাস টুয়েলভে পড়বার সময় একদিন রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে বাবার গুজুরফুসুর কানে এল। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোনওদিন এইভাবে বাবা-মা আড়ালে ফিসফাস করেছে বলে কোনও কিছু চোখে পড়েনি। আর পড়বেই বা কী করে— তিনজনের সংসারে ঝামেলা বলতে শুধুমাত্র স্কুল আর অফিসের ভাত দেওয়া নিয়ে। তাও তো অর্ধেক দিন বাবাকে আগের দিনের রান্নাই গরম করে দেয়। বাবা অম্লান মুখে খেয়ে নেয়। মায়ের টুকটাক ঠুসঠাস যা হয়, তা রূপার সঙ্গে।

সরাসরি মা বা বাবাকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না, তোমরা কী সব চুপিচুপি আলোচনা করছিলে? বাবা চুপ থাকলেও মা হয়তো রেগে যাবে। তাই জানার ইচ্ছে থাকলেও চুপ করেই থাকতে হল। কয়েকদিন পরেই অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।

স্কুল থেকে ফেরবার সময় কমার্স সেকশনের অমৃতা বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল, কী রে খবরটা দিসনি তো?

কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল রূপা। চয়ন মানে চাঙ্কির সঙ্গে ঘোরাঘুরি নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করে। রূপা উত্তরও দেয় আবার দেয়ও না। তবে অমৃতাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে, কোন খবরটা রে?

—সে কী রে, তোর নাকি ভাই বা বোন হবে? বেশ ভালো, তবে এজ গ্যাপটা একটু বেশি হয়ে যাবে।

রূপা এবার বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, কী বাজে বকছিস?

—বাজে নয় কাজের কথাই বলছি, তুই খবর না দিলেই বা কী! আমি ঠিক খবর পেয়ে গেছি। কবে ট্রিট দিবি বল?

আকাশ থেকে পড়ল রূপা, চারপাশটা দেখে গম্ভীর ভাবেই বলে উঠল, তোকে কে বলল?

—মা-বাবা আলোচনা করছিল, আমি শুনেছি। তোর মা আমার মাকে বলেছে।

সব শুনেও রূপা কিছু সময় কোনও কথা বলতে পারল না। রাস্তার একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তাহলে গুজুরফুসুর মানে এইসব। কয়েক সপ্তাহ আগে বাবা অফিস কামাই করে মা-কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিল, তার মানে ভিতরে ভিতরে এতদূর সবকিছু হয়ে গেল, আর কিছুই জানা গেল না। নিজের ওপরেই রাগ হল রূপার। অমৃতাকে বলল, আমার একটু তাড়া আছে। তারপরেই তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।

বাড়ি পৌঁছে নিজের ঘরে ঢুকতেই চোখ ফেটে জল এল। কারওর সঙ্গে কোনও কথা না বলে দরজা বন্ধ করে সন্ধে পর্যন্ত বসে রইল। মাঝে মা কয়েকবার এসে, কী হয়েছে? কেন এমন করছিস? এসব জিজ্ঞেস করল। স্কুলে বা টিউশনে কোনও কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল। রূপম নামের সেই ছেলেটা আর বিরক্ত করছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করল।

সব প্রশ্নেরই এক উত্তর, না, কিছু হয়নি। কেউ কিছু করেনি। তুমি যাও। সন্ধের পর বাবা এসেও জিজ্ঞেস করল কিন্তু এবারেও উত্তর পেল না।

সমস্যা আরও বাড়ল। খেতে বসবার সময়। রূপা প্রথমে তো আসতেই রাজি হচ্ছিল না। পরে বাবার কথা শুনে খাবার টেবিলে এলেও খাবার নিয়ে বসে রইল। বাবা-মা দুজনে গিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, রূপার দুচোখ দিয়ে জল নেমে এল।

কিছুসময় পর রূপা কাঁদতে কঁদতেই বলে উঠল, আমার নাকি ভাই-বোন কিছু একটা হবে?

—কে বলল তোকে? কথাটা মা কিছুক্ষণ চুপ থাকবার পর বলল।

—কে বলল জানতে হবে না। সত্যি না মিথ্যা সেটা বলো।

বাবা এবার লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল, হ্যাঁ, চারমাস চলছে।

—আর ইউ ম্যাড, অর স্যাভেজ ইললিটারেট?

মা কোনও উত্তর না দিয়ে গালে এক চড় কষিয়ে দিল। আচমকা আসা এই আঘাতে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও কিছুসময় পরেই গালে হাত বোলাতে বোলাতে রূপা বলে উঠল, আমাকে চড় মারলে কিন্তু পাড়ার সবাই, ফ্ল্যাটের সবাই? ছিঃ ছিঃ করছে তোমাদের। কজনকে চড় মেরে মুখ বন্ধ করবে।

সেই রাতে আর কারওরই খাওয়া হল না। পরেরদিন সকালে উঠেই বাবা রূপাকে চায়ের টেবিলে ডেকে বলল, দেখ তুই বড়ো হয়ে গেছিস। আজকের যুগের মেয়ে তুই, আসলে ঘটনাটা খুবই সাডেন। এমনকী তোর মা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি।

—বোকা বোকা কথা বোলো না বাবা। তুমি বুঝতে পারোনি দ্যাটস ওকে, বাট মা!

—তোর মায়ের একটা প্রবলেম আছে সেটা তো জানিস। তোর সঙ্গে ডাক্তারও দেখাতে গেছিল।

—আমি বুঝতে পেরেছি কি পারিনি, সেটা তোকে বলব না। তোর আমি ইয়ার দোস্ত না। আমরা মা-কাকিমাদের কখনও এইসব কথা বলবার সাহস পেতাম না। কথাগুলো একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল মা।

—তোমাদের কথা আলাদা মা।

—আলাদা মানে কি? মা-বাবার সঙ্গে এইসব কথা বলা?

—তোমরা কি এইসব কথা বলবার জন্য আমাকে ডাকলে, তাহলে আমি আসছি, কাজ আছে।

—কাজ মানে তো ফোনে ফটর ফটর করা।

—আমার এটাই বয়স। যে-বয়সে যেটা মানায়, সেটাই করতে হয়।

বাবা কিছুসময় চুপ থেকে মা-মেয়ের কথা শুনছিল। রূপার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠল, ঠিক আছে, এবার বল তোর মতামত কী?

—হোয়াই শুড আই বাবা? ইউ হ্যাভ নট আস্কড মি বিফোর ডুইং দ্যাট।

—তা না, আমরা তো, মানে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।

—দুর্ঘটনা! হাউ ফানি বাবা, দুর্ঘটনা মেড মাই মাদার প্রেগন্যান্ট।

—শোন ব্যাপারটা ঠিক ওইরকম নয়। আসলে আর বছর তিন পরে তোকে বিয়ে দিতে হবে, তার পরে তো আমরা একা।

—ইজ ইট এনি এক্সকিউজ? আমার বিয়ের পরে তোমার জামাই আসবে। কোথাও তো লেখা নেই বিয়ের পর মেয়েরা বাবা-মা-কে দেখবে না। তাছাড়া আমি বিয়ে করব কিনা সেটাও ঠিক নেই। তোমরা এত কিছু ভেবে এই বয়সে এরকম করে ফেললে?

—শোনো, মেয়ের কথা শোনো, তোমার প্রশ্রয়ে আজ এইরকম অবস্থা। আমার না হয় ভাই বোন নেই কিন্তু তোমার তো আছে। বুগি তোমার থেকে কত ছোটো?

—মা, ননসেন্সের মতো কথা বলো না। বুগি বাবার থেকে এগারো বছরের ছোটো, না জ্যাঠা বাবার থেকে বারো বছরের বড়ো, এটা নিয়ে কোনও কমপ্যারিজন হয় কি?

—ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে বলে কথা, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলবার বহর শোনো।

—মা, আমার শিক্ষা আমাকে তোমাদের সামনে এইভাবে কথা বলতে শিখিয়েছে। আর পৃথিবীর কোথাও লেখা নেই সন্তান হলে বাবা-মায়ের ভুল বলা যাবে না।

শেষের কথাগুলো বলেই ব্রেকফাস্টের টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রূপা। বাবা একভাবে দরজার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে আবার একটা জোরালো শ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়ে গেল বলো তো?

—তুমি বলো। তখন বারবার বারণ করেছিলাম, এখন সামলাও।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...