মেয়েটির নাম ছায়া। ছেলেটির নাম মনোময়। ওরা দু’জন পাড়ায় নতুন এসেছে। দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা কি ঠিক বোঝা যায় না। তবে স্বামী স্ত্রী যে নয় এটা জানা গেছে। পাশের বাড়ির প্রতিবেশিনীর কী, একটা কথায় ছায়া একবার বলেছিল, ওর বর কোন দূর দেশে কাজ করে। তাহলে মনোময় তার কে হয়? কেনই বা তারা দু’জন একসঙ্গে থাকে— এসব কথার কোনও উত্তর সে দেয়নি, শুধু হেসেছিল।
রাস্তার ওপর দোতলা বাড়িটায় ওরা ভাড়া উঠেছে। বাড়ির মালিক এখানে থাকে না। একতলাতেও কেউ থাকে না। ওরা আসার পরেই ঘরটায় আলো জ্বলল।
ওরা বাইরে বেরোয় না। পাড়ার কারওর সাথে মেশে না। মাঝে মাঝে শুধু ওদের কথা শোনা যায়। পাশের বাড়ির প্রতিবেশিনী জানলায় কান পাতে—
—তুমি আমাকে মারলে?
—বেশ করেছি। আবার মারব। —কেন মারবে?
—তোমায় ভালোবাসি বলে।
—ভালোবাসলেই বুঝি মারতে হয়?
কোনও কোনও দিন ছেলেটি বলে, ‘তোমায় এত কষ্ট করে পেলাম ছায়া, তবু মনে হয়…!’
—কী মনে হয়?
—মনে হয়, তুমি আমার হলে না!
—কেন এমন বলছ? আমি তোমার, তুমি জানো না।
—না ছায়া, তুমি সবসময় ওর কথা ভাবো।
—আমি ভাবি না, ভাবতেও চাই না।
রাত হলে মেয়েটি মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। গান করে। অন্ধকারে তাকে দেখা যায় না। গলা শোনা যায়। মিষ্টি, সুরেলা গলা৷ কিন্তু গানের ভাষা ঠিক বোঝা যায় না। রোজ যেন একটাই গান, একই সুর—
—তুমি আর ছাদে যাবে না।
—কেন?
—তুমি ওই গানটা গাইবে না।
—কেন?
—আমার ওই গানটা ভালো লাগে না।
—জানি।
—তাহলে?
—ও এটা শুনতে চাইত।
—কে?
—তুমি বুঝি জানো না?
মাঝে মাঝে চাপা কান্নার শব্দ পাওয়া যায়!
—তুমি আবার আমাকে মারলে?
—কেঁদো না ছায়া।
—আমি তোমার কাছে আর থাকব না।
—এমন বোলো না।
—কেন বলব না। তুমি আমার কে হও?
—আমি জানি আমি তোমার কেউ না!
—আমাকে আর মারবে না বলো।
—আমার কাছে এসো ছায়া।
মাঝে মাঝে মেয়েটিই ছেলেটিকে ডাকে, ‘কাছে এসো। আমাকে জড়িয়ে ধরো।’
—কী হয়েছে ছায়া?
—আমি আবার ওকে দেখলাম।
—তুমি স্বপ্ন দেখেছ।
—আমি জেগেছিলাম। ও এসেছিল, সবুজ জামাটা পরে।
—ও আর কখনও আসবে না ছায়া, তুমি জানো।
—ও এসেছিল। আমায় ডাকল। ওর হাতের আঙ্গুলে সেই আংটিটা!
–তুমিও তো পরে আছো একটা।
—হ্যাঁ। আমাকে ও বিয়েতে দিয়েছিল।
—ওটা খুলে ফেলো।
—খুলব না।
একটুক্ষণ চুপচাপ। তারপর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ, ‘কেন ওটা নিলে? আমায় ফিরিয়ে দাও।’
প্রতিবেশিনী ওদের কথার অর্থ বুঝতে পারে না।
এইসব টুকরো টুকরো কথা, কান্নার শব্দ আর মাঝে মাঝে ওই গানের সুর ছাড়া বোঝাই যায় না ওরা এই বাড়িতে বাস করে। তাদের কখনও বাইরে বেরোতে কেউ দেখে না, তাদের বাড়িতে আসতেও কাউকে দেখা যায় না। বাজার—হাট করতে বা অন্য কাজেও তো মানুষ বাইরে বেরোয়, এরা এসব করে কখন!
ওরা যে আছে, আর বোঝা যায় শুধু ওদের ছায়া দেখে। তাদের ঘরের সামনের দুটো জানলাতেই কালো কাচ লাগানো। দিনেরবেলা বাইরে থেকে ভিতরে কিছু দেখা যায় না। কিন্তু যখন সন্ধে নামবে, অন্ধকার হবে, সামনের চায়ের দোকানটায় উনুন জ্বলবে, তাদের দোতলার ঘরেও আলো জ্বলে উঠবে, উজ্জ্বল হলুদ আলো।
ক্রমশ…
অঙ্কনঃ লেখক