ছিল না তো৷ ওই তো ও দিকটায় পুরো জঙ্গল ছিল। বড়ো বড়ো অশ্বত্থ গাছ, কাঁটামনসা, আঁশ শেওড়ার গাছ!

—শেওড়া গাছ! মেয়েটা বড়ো বড়ো চোখে বলে, শেওড়া গাছে তো ভূত থাকে?

—তা কেন দিদিভাই, পাকা বাড়িতেও থাকে।

দু’জনে দু’জনের দিকে তাকায়, তারপর বলে, ‘তুমি ভূতে বিশ্বাস করো?” করি।

—ভূত দেখেছ কখনও?

চায়ের কেটলি থেকে চোখ সরিয়ে এবার ওদের দিকে তাকায় রামু। কিছুক্ষণ কী দেখে। তারপর হাসে, ‘দেখেছি।”

মাঝে মাঝে ওরা প্রশ্ন করে, “তোমার সংসারে কে কে আছে রামুকাকা?’

—আমার বউ আছে, দুই ছেলে মেয়ে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বোনটাও আমার সঙ্গে থাকে।

—কেন? ছায়া শুধোয়, তোমার বোন বিয়ে করেনি?

—করেছিল দিদিভাই। ওর বর ওকে রাখেনি।

রামু কিন্তু ওদের ব্যপারে কিছু জিজ্ঞেস করে না কখনও। যেন জানে, জিজ্ঞেস করতে নেই।

একদিন ছেলেটা হঠাৎ নিজে থেকেই বলে, “জানো রামুকাকা, আমাদেরও নিজেদের বাড়ি ছিল, বাবা মা ছিল, আমারও একটা বোন ছিল, আর ছায়ার একটা ভাই।’ বলেই চুপ করে যায়, , কী যেন ভাবতে থাকে।

—আমার বোনটা সারাক্ষণ আমার পেছন পেছন ঘুরত, আর আমি ওর চুল টেনে দিতাম।

মনোময় মাথা নীচু করে বসে থাকে।

—ভুলতে পারছেন না দাদাবাবু, আবার ফিরেও যেতে পারছেন না, তাই না?

মনোময় উত্তর দেয় না, মুখ ফিরিয়ে নেয়।

—আপনার চোখে জল, তাই না দাদাবাবু? আমাকে লুকোতে পারবেন না। কাঁদেন না একটু, মন খুলে কাঁদেন। কষ্ট কমে যাবে। চোখের জল চাপতে নেই।

—তুমি খুব ভালো রামুকাকা।

—আপনারাও তো ভালো।

—আমরা? মনোময় অদ্ভুত ভাবে হাসে! আমরা কীরকম তুমি জানো না।

—হক কথা কইছেন দাদাবাবু। কে কীরকম, কেউ জানে না। আমার বোনের বরটার কথা বলছিলাম না? ও তো খুব ভালোবাসত আমার বোনটাকে। দু’বেলা গায়ে গতরে খেটে ওর জন্য গয়না গড়িয়ে দিত, বোনটার জ্বর জ্বারা হলে বোনের মাথা টিপে দিত। সেই লোকটাই তো হঠাৎ ওকে ছেড়ে চলে গেল অন্য একটা মেয়ের সাথে। বোনটা এখনও ওকে মনে করে কাঁদে।

—ও এখন কোথায় থাকে? ছায়া বলে

—কে?

—তোমার বোনের বর ।

—আমাদের ঘরেই থাকে।

—তোমাদের ঘরে?

—হ্যাঁ। মাঝখানে একদিন এসেছিল। কান্নাকাটি করল। বলল ভুল হয়ে গেছে। ঘরে রামদা ছিল। বোন রামদা দিয়ে ওর মাথা নামিয়ে দিল। মেয়েমানুষের রাগ। তারপর আমি আর বোন মিলে ঘরের মেঝেয় গর্ত খুঁড়ে ওকে শুইয়ে দিলাম। মাটি চাপা দিয়ে দিলাম। ও এখন ওখানেই আছে!

রামু ওদের চা দেয়। নিজেও এক গেলাস নিয়ে ওদের পাশে এসে বসে।

ছায়া হঠাৎ করেই হেসে ওঠে বলে, ‘গলা কেটে দিলে রামুকাকা, ওষুধ দিয়েছ? ভালো করে মাটি চাপা দিয়েছ তো? উঠে আসতে পারে। পুরুষমানুষকে বিশ্বাস নেই!” রামু আর মনোময় চায়ে চুমুক দেয়। ছায়া হাসতে হাসতেই আবার বলে, ‘আমার বরটাও আমাকে খুব ভালোবাসতো। কাজের জন্য দূরে দূরে যেত আর যখন আসত, সারা দুনিয়া কিনে আনত। আমায় নতুন শাড়ি পরিয়ে, গয়না পরিয়ে বলত — আমায় একটা গান শোনাও ছায়া।”

গরম চায়ের কাপটা গালে চেপে ধরে ছায়া, তারপর আস্তে আস্তে বলে, ‘ও আমাকে ছেড়ে যায়নি, আমিই ওকে ছেড়ে এসেছিলাম।’

—ও আপনার খোঁজ করেনি দিদিভাই? এখানে আসেনি? এতক্ষণে কথা বলে রামু, তার চোখদুটো চকচক করে।

—খোঁজ করেছিল, কিন্তু খুঁজে পায়নি।

—তারপর দিদিভাই?

—তারপর ও একদিন এল। আমিই ওকে ডাকলাম। ওকে গান শোনালাম। ও আমাকে ছেড়ে ফিরে যেতে চায়নি। ছায়া হাসে, আমরাও ওকে ফিরে যেতে দিইনি! রামু মনোময়ের দিকে তাকায়, মনোময় অন্ধকারে চেয়ে থাকে।

ক্রমশ…

অঙ্কনঃ লেখক

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...