মুগের ডাল কোথায় আছে বার করে দাও তো দিদিভাই। এমনি করে আজ মহানন্দে সুভাষিণী রান্না করেন মুগের ডাল, পটলের তরকারি, পোস্ত, চাটনি—সবই নিরামিষ। মাছ উনি ছোঁন না। তবে আজ উনি মাছও রান্না করতে রাজি আছেন সংসারের সবার জন্য।

খেতে বসেছে ছেলেরা। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা পরিবেশন করছেন। অনেকদিনের পর বড়ো আনন্দে মন ভরে যাচ্ছে তাঁর। ‘মেজোখোকা, তোর জন্য আগে তুলে রেখেছি। তুই তো ঝাল খেতে পারিস না।’

“তুমি তাও এখনও মনে রেখেছ মা।”

‘মায়েদের সবই মনে থাকেরে। যার যা লাগে চেয়ে নিস।”

আজ যে একাদশী একথা তার আজ মনেই নেই। একসময় বড়োছেলে শুভ বলে, ‘তোমার কখন রান্না হবে মা?”

‘আমার এ বেলার খাওয়ার ব্যবস্থা কিছু নেই। একেবারে রাত্রে, আজ আমার একাদশী।’ ছেলেরা বলে আসার সময় তারা ফলমিষ্টি নিয়ে আসবে।

সংগীতা বলে, ‘চলো ঠাম্মা, তোমার ঘরে যাই। আমার স্নান হয়ে গেছে। তোমায় চা করে দিই। কতদিন তোমার ঘরে যাইনি। চা খাবার পর বাগানে গিয়ে কালকের ঝড়ে তোমার যে চাঁপাফুলের গাছটা পড়ে গেছে সেটা দুজনে তোলার চেষ্টা করব।’

আজ বাগানে ফুল তুলতে গিয়ে সুভাষিণী দেখেন ওঁর স্বামী প্রিয়তোষের হাতে লাগানো সেই চাপা গাছটি শিকড়-সহ মাটিতে উপড়ে পড়ে আছে। সেই থেকে মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে সুভাষিণীর। বাড়ি করার পর এই মস্ত বাগানখানি যখন প্রিয়তোষ ফল ও ফুলের গাছে ভরিয়ে ফেলেছেন তখন এক বর্ষার দিনে অফিস ফেরত এই চাঁপা গাছটি হাতে করে বাড়ি ফিরলেন। সব কাজ ফেলে সন্ধ্যার মুখে দুজনে এই গাছটি লাগালেন গেটের মুখে। ঠাকুরঘরের পিছনে। আর গর্ত করার সময় প্রিয়তোষের হাতের আংটি খুলে জলে কাদায় কোথায় হারিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া গেল না সেই আংটি।

নাতনি-ঠাকুমা দুজনেই আপ্রাণ চেষ্টা করেন গাছটিকে দাঁড় করানোর। কিন্তু একি! শিকড়ের নীচে কী ওটা চকচক করছে। অনেক চেষ্টায় সংগীতা জল কাদায় মাখানো জিনিসটা তুলে আনে।

“দ্যাখো ঠাম্মা কী পেয়েছি— ভালো করে দ্যাখো।’

এত বছর পরে আংটিটি পেলেন তিনি। আজকের দিনটা সত্যিই তাঁর কাছে খুব সুন্দর আর পবিত্র। অনেকগুলি হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পেলেন। তাঁর হারানো অধিকার আবার ফিরে পেয়েছেন। একান্ত আপন ছেলে-বউমার সঙ্গ পেয়েছেন। পরমপ্রিয় নাতি-নাতনিদের বুকে টেনে নিয়েছেন। আংটিটি হাতে করে বসে থাকেন সুভাষিণী। কত কথা আজ মনে পড়ছে তাঁর। প্রিয়তোষের জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। অতীতের পলি পড়া টুকরো টুকরো কত স্মৃতি মনে আসছে আজ, যা ছিল তাঁর কাছে বর্ণময় আর মনোরম। এই বাগানটি ছিল বলেই দশ দশটি বছর তিনি একা একা বাঁচতে পেরেছেন।

‘কী এত ভাবছ গো ঠাম্মা? তোমার চোখে জল কেন?’ সংগীতার ডাকে মিষ্টি হেসে ওর মুখের দিকে তাকান তিনি।

সংগীতা বলে, ‘আংটিটা দাও ঠাম্মা। কাদামাটি ধুয়ে নিয়ে আসি। আর এবার তোমার ঘরে চলো। মা-কাকিমাদের নামতে এখন অনেক দেরি। আর আমিও তো কিছু খাব না। এখ ন তোমার সাথে অনেক গল্প করব। আজ আমায় কয়েকটা রান্না শিখিয়ে দিতে হবে।

‘রান্না শিখে এখন কী করবে ভাই? আগে পড়াশোনা শেষ করো। যদি শেখার ইচ্ছা থাকে রান্না শিখতে ক’দিনই বা লাগবে?”

“মানস বলে, আমার দ্বারা নাকি কিচ্ছু হবে না।’ বলেই লজ্জা পেয়ে যায় সংগীতা।

‘মানস, সে আবার কেরে দিদিভাই!”

“আগে বলো কাউকে এখন বলবে না কিছু। তাহলে সব বলব তোমায়।”

ওর কথায় সব বুঝতে পারেন সুভাষিণী। হেসে ওঠে দুজনেই।

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...