বর্ষা মানেই কখনও গরম, কখনও স্বাভাবিক তাপমাত্রা। আর তাপমাত্রার এই তারতম্যের কারণে খাবার সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে খাদ্যে বিষক্রিয়া এবং তীব্র গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তাই এই পরামর্শ দেওয়া হয় যে, বর্ষাকালে তাজা রান্না করা গরম খাবার খাওয়া উচিত। কিন্তু এখন ফ্রিজে রাখা খাবার খাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে সবার। তবে যাই করুন না কেন, খাবার বাইরে বেশিক্ষণ খোলা জায়গায় রাখা উচিত নয়।

মনে রাখতে হবে, যে-কোনও বয়স এবং লিঙ্গের জনসংখ্যার একটি বড়ো শতাংশকে প্রভাবিত করে হজমের সমস্যা। আর এটি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে।

প্রবাদ আছে— যার পেট ভালো, তার সব ভালো। যারা পেটের অসুখে ভুগেছেন অথবা ভুগছেন, তারা অন্তত এই প্রবাদের যথার্থতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আসলে, শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ভালোমন্দ অনেকটাই নির্ভর করে পেটের সুস্থতার উপর।

একটু ভালো ভাবে নজর রাখলে প্রমাণ পাবেন, মাথার চুল পড়ে যাওয়া এবং ত্বকের জৌলুস হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল ওই পেটের অসুখ। তবে শুধু চুল পড়া কিংবা ত্বকের সমস্যাই নয়, পেপটিক আলসার কিংবা লিভার ক্যানসারের মতো বড়ো অসুখগুলির সূত্রপাতও কিন্তু নিয়মিত হজমের গোলমাল কিংবা অ্যাসিডিটি থেকে। অতএব, পেটের সুস্থতা জরুরি। কীভাবে পেট ভালো রাখবেন, সেই বিষয়ে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন কলকাতার এএমআরআই হাসপাতালের কনসালট্যান্ট গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সার্জন(অ্যাডভান্সড ল্যাপারোস্কোপি এবং জিআই অংকোসার্জারিতে বিশেষজ্ঞ) ডা.সঞ্জয় মণ্ডল৷

Health article
Dr. Sanjoy Mandal

সমস্যা

বর্ষাকালে খুব সহজেই খাদ্যে ব্যাকটেরিয়া এবং রোগজীবাণু বেড়ে যায়, যদি খাবার ঠিকমতো ঢেকে না রাখা হয়। এতে শুধুমাত্র খাদ্যে বিষক্রিয়া এবং গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের ঝুঁকি বাড়ে তা নয়, পেট ফোলা, বমি বমি ভাব, বমি, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে ব্যথা, জ্বালাপোড়া প্রভৃতি সমস্যারও সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, বর্ষাকালে অ্যাসিডিটির কষ্ট বেড়ে যায় কম হাঁটাচলা করার জন্য। আর ধারাবাহিক অ্যাসিডিটি মানে অনেকসময় পিত্তথলির পাথর এবং এর জটিলতার লক্ষণও হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— বর্ষাকালে যারা মাংস বেশি খান, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেশি হয়। কারণ, এই সময় শারীরিক মুভমেন্ট কমে যাওয়ার জন্য ভারী খাবার হজম হয় না ঠিক ভাবে। এর ফলে পাইলস এবং ফিসারও হতে পারে। তৈলাক্ত এবং চর্বিযুক্ত খাবারও নানারকম সমস্যায় ফেলতে পারে। আর যারা অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যালকোহল গ্রহণ করেন, তাদের প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে এবং এতে বিপদের ঝুঁকি আরও বেয়ে যায়।

অপর একটি গুরুতর সমস্যা যা খাদ্য গ্রহণের ফলে ঘটতে পারে, তা হল— অস্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করা খাবার,অর্থাৎ যা সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এর ফলে টাইফয়েড এবং ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হতে পারেন এবং এটি বর্ষাকালেই হয়।

চিকিৎসা ও সতর্কতা

  • বিনা প্রয়োজনে ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। এই বিষয়টি অ্যান্টাসিড গ্রহণের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। নিয়মিত কখনওই অ্যান্টাসিড খাওয়া উচিত নয়।
  • একজন ডায়াবেটিক রোগীকে প্রথমেই চিনি ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য বর্জন করতে হবে। খাদ্য-তালিকায় রাখতে হবে প্রোটিন জাতীয় খাবার। অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই অত্যধিক তেল ও মশলা জাতীয় খাবারকে তাদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। খাদ্য তালিকা হতে হবে সুষম এবং খাদ্য গ্রহণ করতে হবে পর্যাপ্ত সময়ের ব্যবধানে। খাবারের মধ্যে ক্যালোরি’র মাত্রাকে সঠিক ভাবে বিচার করে খাবার খেতে হবে।
  • ব্রেকফাস্ট করতে হবে ভারী। লাঞ্চ হবে হালকা এবং ডিনারটিও করতে হবে হালকা। এটাই হচ্ছে প্রাত্যহিক জীবনের ভালো খাদ্যাভ্যাস। তাছাড়া তেল-মশলা জাতীয় খাবারকে বর্জন করতে হবে। অ্যালকোহল ও ধূমপান বর্জন করতে হবে। ভালো ভাবে তৈরি টাটকা খাবার খেতে হবে এবং রেস্তোরাঁর খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
  • বাড়িতে তৈরি খাবার দিতে হবে ছেলেমেয়েদের। খাবারকে হতে হবে সুষম ও পুষ্টিকর। বাইরের রেস্তোরাঁর খাবার থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে। ছেলেমেয়েদের টাটকা ফল ও তরিতরকারি খেতে উৎসাহিত করতে হবে। ঠান্ডা ও নরম পানীয় এবং বাইরের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
  • নিয়মিত ভাবে ব্যয়াম করতে হবে। সময়মতো খাবার খেতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ও সঠিকমাত্রার

ক্যালোরি-যুক্ত খাবার খেতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন করতে হবে।

  • খাবার এড়িয়ে গিয়ে কখনওই ডায়েটিং হতে পারে না। সঠিক সময় উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত মাত্রায় খাবার গ্রহণ করেই সঠিক ডায়েটিং করা সম্ভব। সবসময় অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার, চিনি ও তেল-মশলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
  • অ্যাসিডিটি হল কোনও মানুষের দেহের পাকস্থলি থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যাসিড ক্ষরণের ঘটনা। এর কারণে পেটের উপরের দিকে ব্যথা হয় এবং বমি বমি ভাব তৈরি হয়। এর মাত্রা বেড়ে গেলে পাকস্থলিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে রক্ত বের হয় এমনকী অন্ত্রে ছিদ্রও হয়ে যেতে পারে। এর চিকিৎসায় অ্যান্টাসিড খেতে হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে চিকিৎসা হয় প্রোটন পাম্প ইনহিবিটার-এর সাহায্যে, যাকে পিপিআই বলা হয়ে থাকে।
  • সুস্থ পাকযন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যায়াম নেই। তবে সার্বিক ভাবে নিয়মিত ব্যায়াম করলে সেটা শরীর এবং পরিপাক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ভালো হয়।
  • তেল ও মশলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে এবং সেইসঙ্গে বর্জন করতে হবে ধূমপান এবং মদ্যপান।
  • নিয়ম করে আহার গ্রহণ করতে হবে। মানসিক চাপমুক্ত হয়ে থাকতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোতে হবে। অতিরিক্ত মাত্রায় চা, কফি ও এনার্জি ড্রিংকস বর্জন করতে হবে। জল পান করতে হবে পরিমাণমতো, দিনে অন্তত চার লিটার।
  • স্বাস্থ্যকর অভ্যাস বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ— খাবার আগে ভালো ভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। খাবার তৈরি ও সংরক্ষণ করতে হবে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে। টাটকা ও সঠিক পদ্ধতিতে তৈরি খাবার খেতে হবে। ফল ও তরিতরকারি খাবার আগে সেগুলিকে ভালো ভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। যদি কারওর গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস দেখা দেয় তাহলে প্রচুর পরিমাণে জল পান করতে হবে এবং ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন নিতে হবে। প্রয়োজনে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেইমতো চলতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। অধিকাংশ সময়ই গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস ভাইরাল অসুখ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না।
  • নানান কারণে ক্ষুধামান্দ দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ সময়ই এটা দেখা দেয় সীমিত সময়ের জন্য। তখন এর জন্য কোনও চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না। তবে যদি এই ঘটনা বেশিদিন ধরে চলতে থাকে এবং দিন দিন দেহের ওজন কমে যেতে থাকে তখন অবশ্যই এই বিষয় নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

• কাঁচা ফল ও সবজি খাওয়ার আগে ভালো ভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...