রাস্তার পাশে জমে থাকা জলে চাকাটা পড়তেই ছপাৎ করে শব্দ হল একটা। মাঝবয়সি রিকশাচালক বলল, ‘ইয়ে লিজিয়ে ভাইয়াজি আগয়ি আপকি শান্তিকুঞ্জ।’

রিকশায় বসেই অবাক চোখে স্যমন্তক তাকাল বাড়িটার দিকে। ছোটোখাটো চেহারার একতলা বাড়ি। সামনে একফালি সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি। দু’চারটে ফুল আর গোটা কয়েক সুপুরি গাছ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ছোটো লোহার গেটটা খুলল স্যমন্তক। ক্যাঁচ করে শব্দ হল একটা। বাড়ির হাতা পেরিয়ে এসে দাঁড়াল সদর দরজার সামনে। পুরোনো আমলের ডোরবেলটা বাজাতেই ভেতর থেকে শোনা গেল নারী কণ্ঠ, ‘কে?’

—আমি স্যমন্তক, স্যমন্তক সরকার। ম্যাডামের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল।

খুট করে একটা শব্দ হল দরজায় আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ পাল্লা খুলে বেরিয়ে এল ফরসা, ছিপছিপে চেহারার একটা মেয়ে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না। জিন্‌স, টি-শার্ট পরা, পিঠব্যাগ কাঁধে স্যমন্তককে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে সে বলল, ‘ও, আপনি? আপনার তো সকালের দিকে আসার কথা ছিল, তাই না?”

—হ্যাঁ কথা তো তেমনই ছিল। কিন্তু রাস্তায় একটু ফেঁসে গিয়েছিলাম। হাইওয়েতে সকালে একটা বড়োসড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তাই পথ অবরোধ ছিল অনেকক্ষণ। তার উপর জ্যাম, প্রায় ঘণ্টা তিনেক আটকে থাকতে হল ওখানে। ঝড়ের গতিতে কথাগুলো বলে থামল স্যমন্তক। তারপর জিজ্ঞেস করল, আজ কি তাহলে দেখা হবে না ম্যাডামের সঙ্গে? আসলে আমার দেখা করাটা খুব দরকার। অনেকটা দূর থেকে এসেছি।

ঘিয়ে রঙের সালোয়ার কুর্তি পরা মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, “আপনি ভেতরে এসে বসুন। আমি মাসিমণিকে খবর দিচ্ছি। যদি উনি দেখা করতে চান তবে নিশ্চয়ই দেখা হবে।’

স্যমন্তককে বৈঠকখানায় বসিয়ে সে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। ধবধবে সাদা দেয়াল। জানলা-দরজার পর্দা, সোফার কভার এমনকী ছোট্ট ডিভানের ঢাকাটা পর্যন্ত সাদা! একটা হালকা লাল আলো জ্বলছে ঘরে। চন্দনের সুবাসে ভরে আছে চারপাশ। ঘরটাতে ঢুকেই একটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেল স্যমন্তকের মন। একটু ইতস্তত করে স্যমন্তক বসল দুধ সাদা সোফার ধার ঘেঁষে। চারদিকটা ভালো করে দেখছিল সে।

ঘরের মেঝে থেকে টি-টেবিলের ঢাকনা, সবেতেই যত্নের ছাপ স্পষ্ট। ডানদিকের বড়ো দেয়াল জুড়ে রয়েছে একজন শুভ্র কেশ প্রৌঢ়ের ছবি। নীচে বড়ো বড়ো করে ইংরেজি হরফে লেখা ওম শান্তি। ধুপকাঠি জ্বলছে দু’খানা। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে। বোধহয় গুরুদেব-টেব হবেন। ছোটো একটা ট্রেতে এক গেলাস জল আর দুটো সন্দেশ নিয়ে ঘরে ঢুকল মেয়েটি। বলল, ‘মাসিমণি আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। একটু পরে আসছেন উনি।’

সে ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই স্যমন্তক পেছন থেকে আচমকা বলে উঠল, ‘ছোটোমা, মানে মধুরিমা ম্যাডাম কি আপনার আপন মাসি?’

প্রশ্ন শুনে ঘুরে তাকাল মেয়েটি। একটা সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল, ‘না ঠিক আপন নয়। একটু দূর সম্পর্কের। খুব ছোটো বয়সে আমার মা-বাবা মারা গিয়েছিলেন। তাই মাসিমণি নিজের কাছে রেখে মানুষ করেছেন আমাকে।’

—আমিও সেরকমই কিছু আন্দাজ করছিলাম, কারণ মিসেস মধুরিমা সরকারের কোনও ভাই বা বোন ছিল না বলেই জানতাম। কথাটা বলে ঠান্ডা জলের গেলাসে চুমুক দিল স্যমন্তক।

মেয়েটি খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল স্যমন্তকের দিকে। ভর দুপুরে আসা এই আগন্তুকের প্রতি যে তার অসীম কৌতূহল সে বিষয়ে স্যমন্তক নিশ্চিত। মধুরিমাদেবী মেয়েটিকে স্যমন্তকের বিষয়ে একেবারে অন্ধকারে রেখেছেন, বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটিকে একটু খেলাতে ইচ্ছে করল।

এমনিতে তার সুপুরুষ চেহারা, তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা যে-কোনও নারীর মনকেই টেনে নেয় চুম্বকের মতো। রমণীমোহন হিসেবে তার ভালোরকম খ্যাতি আছে বন্ধুমহলে। বান্ধবীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

জলের গেলাসটা টেবিলে রেখে বলল, উফ, প্রাণটা জুড়োল। এই রোদে ভিড় বাসে ট্র্যাভেল করা যে কী হ্যাপা, সেটা যারা করে তারাই জানে। তার উপর এই বিরক্তিকর জ্যাম! একবার ভাবলাম বাড়ি ফিরে যাই। পরক্ষণেই মনে হল মধুরিমাদেবী হয়তো অপেক্ষা করে বসে থাকবেন। কথার খেলাপ করাটা ঠিক হবে না। তাই তেতে পুড়ে হলেও চলে এলাম। বড্ড তেষ্টা পেয়েছিল, জানেন? জলটা দিয়ে আপনি আমাকে বাঁচালেন মিস…?

—তন্দ্ৰা৷

—বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো আপনার!

—আপনি বিশ্রাম নিন, আমি দেখি ওদিকে মাসিমণির হল কিনা। লাজুক হেসে তন্দ্রা আবার চলে গেল ভেতরে।

 

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...