পর্ব ২

বড়োবাবু বুঝতে পারলেই চিৎকার করে, ‘দূর হ, এখন আর কাজ হবে না, হয় সব খসিয়ে আয়, না হলে ভাগ।’ ফুলমণিদের সবেই জ্বালা। এমনিতেই মাসে মাসে আরেকটা জ্বালা আসে, কয়েকটা দিন পেটে ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, সারাটা শরীরে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেই ম্যাদা মেরে যায়। তখন কাজ করতে হাঁপ ধরে, মাঝে মাঝেই আড়াল খুঁজতে হয়।

কথাগুলো তাঁবুতে প্রথম দিকে টুনটুনির মা বলেছিল, সেই সঙ্গে বড়োবাবুর থেকে সাবধানে থাকতে বলে। ফুলমণি নিজেও বড়োবাবুর চোখে সব সময়ের খিদে দেখছে। ফুলমণিরা শাড়ি বা সালোয়ার যাই পরুক তার উপর একটা জামাও পরে। তাও কাজ করবার ফাঁকে জামা সরে যায়, পোশাকের বাঁধন আলগা হয়, বড়োবাবু তখনই শকুন হয়ে ওঠে।

ফুলমণি নিজেও দেখেছে, গোবরার বউ কয়েকদিন আগে তার কোলের বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। বড়োবাবু মুখে একটা বিড়ি ভরে চোখ দিয়ে গিলে নিচ্ছিল মায়ের আদর, ভালোবাসা। গোবরার বউয়ের সেদিন কোনও উপায় ছিল না।

টুনটুনিও কাজ করত। কাজ করবার সময়েই বিয়ে হল, এখন কোনও নজর নাই। একবার টুনটুনি আর ফুলমণির একই সময়ে রক্তপাত আরম্ভ হল। টুনটুনি বয়সে অনেক ছোটো ছিল, তাও মেয়ে তো। কাজ করবার মাঝে বারবার আড়াল খুঁজতে গেলে বড়োবাবু ঝাঁঝি মেরে ওঠেন, ‘তুরা গেদে কামচোর, একটু ঝাঁট দিচ্ছিস আর পালাচ্ছিস।’

—উয়ারা এমনি পালাচ্ছে নাকি গো। তোমার ঘরে বিটিছিলা নাই! জানো না, কি বটে?

সেদিন অবশ্য বড়োবাবু সবার মাঝে হেসে উঠেছিল, ‘তুদের আবার লজ্জা?’

খেপে উঠেছিল টুনটুনির মা, ‘কেন গো বাবু, তুমার ঘরের মেয়েদের শরীর-ট শরীর, লাজলজ্জা সব তুমাদের, আমাদের নাই।’

—তুর কিন্তু খুব কথা হয়েছে। লাথ মেরে তাড়িয়ে দিলে বুঝবি।

আর কোনও কথা বলেনি টুনটুনির মা। সেদিনই রাতে রান্না করবার সময় ফুলমণিদের মাঝে বসে কথাগুলো বলে। ফুলমণি কোনও দিন তার মাকে কাঁদতে দেখেনি। চরম কষ্টের দিনেও শুকনো চোখে খেটে গেছে। গোবর কুড়িয়েছে, ঘুঁটে দিয়েছে, সেই ঘুঁটে মাথায় করে বিক্রি করেছে, রাতে বরের হাতে মার খেয়েছে, মারামারি করেছে, চিল্লিয়েছে। টুনটুনির মাকে কাঁদতে না দেখলেও চোখমুখে একটা চাপা ভয় দেখতে পেয়েছে।

ফুলমণি লম্ফের আলোটা একটু বাড়ায়। ভাতের মধ্যে কয়েকটা আলু আর দুটো ডিম ফেলে দেয়। আর বেশি কিছু করতে ভালো লাগছে না। লোকটার মুখে আবার খারাপ কিছু রোচে না, খিস্তি করে, মারতে যায়। আগে লোকটা এমন ছিল না। যে-রাতে বড়ো তাঁবুতে ফুলমণির পাশে মোটা বউয়ের বরটা ফুলমণির শরীর ছুঁয়ে নিজের আমিত্ব ফলাতে গেছিল তারপরের দিন সকালে উঠেই হারু লোকাটাকে খুব পেটায়। বড়োবাবুর কাছে খবর চলে যায়।

মোটাবউ ও তার বর দু’জনেই বড়োবাবুর পেয়ারের লোক ছিল। সবাই জানত নিজের শরীরের গন্ধ শুঁকিয়ে মোটা বউ বড়োবাবুর হকের মেয়েমানুষ হয়ে উঠেছে। সারাদিন কোনও কাজ না করে বসে থাকলেও তাকে কিছু বলে না, বরং ফুরসত পেলেই দু’জনে গল্প করে। বড়োবাবু একটা ক্লাব ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকে। মোটাবউ সকালে রাতে সেখানে রান্না করতে যায়।

—রান্না করে হাতি, ও যায় ধান্দা করতে। কথাগুলো হাবুলের বউ একদিন বলে।

ফুলমণি তখন এই কাজে নতুন এসেছে। কথা বললেও খুব বেশি মাখামাখি করে না। পরের দিনের ঝামেলার জন্যে দু’জনেরই কাজ চলে যেত, পোঁটলা গুটিয়ে চলে যেতে হতো। কিন্তু বড়োবাবুর হাত পা ধরে সে যাত্রায় কোনওরকমে কাজটা বাঁচলেও অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়, বড়োবাবুও সেখানে যাবে। হারু ও ফুলমণিকে আবার নিজেদের খরচে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে নতুন জায়গায় যেতে হয়।

হারুর বাবাও রাস্তা তৈরি করবার কাজ করত। ছোটো বয়সে মা মারা যাবার পর হারুও বাবার সাথে ছোটো থেকেই এই রাস্তা তৈরি করবার কাজে ঢুকে যায়। দু’জনের রোজগারে ভালোই চলছিল। বাবা ফুলমণির সাথে বিয়ের দেখাশোনাটাও করে গেছিল, তারপর হারুর বিয়ের আগেই একদিন রাস্তা তৈরি করবার সময় রোলার গাড়ির নীচে পড়ে এক্কেবারে মাটির সাথে মিশে যায়। কয়েক বছর সব চুপচাপ থাকবার পরেই ফুলমণির বাড়ি থেকে আবার হারুর সাথে যোগাযোগ করে, তাদের বিয়ে হয়। কন্ট্রাকটর কিছু টাকা দিয়েছিল, সেই টাকাতেই বিয়ের খরচ মেটে।

বিয়ে হলেও সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। হারুর তো বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে কাজ। গ্রামে বাবার একটা ঘর থাকলেও সেখানে আর কেউ থাকে না। হারুর জীবনও এই তাঁবুর ভেতরেই কাটতে আরম্ভ হয়ে গেছে। নতুন বিয়ে করা বউ তো আর সেভাবে থাকবে না। কথাগুলো তার তাঁবুর বাকি লোকদের সাথে আলোচনা করলে তারা বেশ মজা করেই বলে, “আরে বাবা, তুই বিয়ে করবি এটা তো ভালো কথা। এখানে অনেকেই বউ নিয়েই থাকে। তোরা যখন থাকবি আমরা না হয় চোখদুটো বন্ধ করে রাখব।”

হারু হেসে ওঠে। তাদের বিয়ে হয়, কন্ট্রাকটর কয়েকদিন ছুটিও দেয়, ফুলমণির বাড়িতেই তাদের ফুলশয্যা হয়। কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালেও বসে বসে কেউ আজীবন মুখে ভাত দেবে না। হারু ফুলমণি দু’জনই কাজে ঢুকে যায়। কাজ বলে কাজ— পিচ গরম, রাস্তা খোঁড়া, ধুলো বালি পরিষ্কার করা, পাথর বিছিয়ে সমান করা, দু’পায়ে চিকচিকি বেঁধে পিচ ফেলা, বালি দেওয়া, কাজের আর শেষ নাই।

ফুলমণির প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো। বিয়ের কয়েকদিন পর হারু কোনও পিচের রাস্তার উপর দিয়ে যাবার সময় বলে উঠত, “এই দ্যাখ এই রাস্তাটা আমরা করেছি।’ তারপরেই রাস্তা তৈরি করবার গল্প করত। তখন ফুলমণি অবাক হয়ে শুনলেও কাজ করতে এসে বোঝে, সব গল্প গল্প হয় না!

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...