সকালে ঘুম থেকে উঠে টয়লেটে যেতে, আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে অর্জুনের। ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে, কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল সাতটা বাজে। এইসময় টয়লেটে ঢুকতে গেলে, লম্বা লাইনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। রোজ সাধারণত ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যে টয়লেটে ঢুকে, একেবারে প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে নেয় অর্জুন। এর থেকে বেশি দেরি হয়ে গেলেই, হাওড়া স্টেশনের তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এই টয়লেটে সহজে ঢোকার সুযোগ পাওয়াটা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে।
দূরপাল্লার ট্রেনগুলো ভোরবেলায় ঠিক এই সময় থেকেই একের পর এক ঢুকতে শুরু করে হাওড়া স্টেশনে। যেসব প্যাসেঞ্জারদের ট্রেন থেকে নেমে, ট্রেন পালটাতে হয়, তারা এইসময় টয়লেটে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সবাই। এদের পিছনে লাইন দিতে হলে, সেদিনকার মতো সব কাজ যে মাথায় উঠবে, তা খুব ভালো করে জানে অর্জুন।
অর্জুন মনে মনে ভাবে, আজকের এই গণ্ডগোলের মূলে হচ্ছে গতকাল রাতের কালবৈশাখীর ঝড়। গতকাল রাত আটটা নাগাদ শুরু হয়ে, কয়েক দফায় যে ভীষণ বেগে এবছরের প্রথম কালবৈশাখীর ঝড় আছড়ে পড়েছিল, তাতেই তো সমস্ত রেল-যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। ওই ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গী ছিল অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি। সেই ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব যখন থামল, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা পার হয়ে গিয়েছে।
হাজার হাজার প্যাসেঞ্জার অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। তারা কেউ লোকাল ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবে, কেউ আবার বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন ধরবে বলে হাজির হয়েছে হাওড়া স্টেশনে। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা, সবার সে এক নিদারুণ অসহায় অবস্থা! সেই ঝড়-বৃষ্টির পর থেকে সারারাত, না আর কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশনে ঢুকেছে; না কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে বেরোতে পেরেছে।
গতকাল রাতে ঝড় যখন উঠল, অর্জুন তখন ওর দলবল নিয়ে হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের কোল ঘেঁষে বসেছিল। ওর দলবল বলতে এক পাঁচ বছর বয়সি থেকে শুরু করে, আঠারো-ঊনিশ বছর বয়স পর্যন্ত কয়েক জন কিশোর-কিশোরী মিলিয়ে জনা বিশেকের একটা দল। এদের সবাইকে এককথায় ‘অনাথ’ বলা চলে। কিন্তু অর্জুন তা মানতে রাজি নয়। অর্জুন বলে, ‘এরা সবাই আমার পরিবারের!” রোজ সন্ধ্যায়, মাঝখানে একটা হ্যাজাক জ্বেলে বসে অর্জুন। তাকে ঘিরে গোল করে বসে থাকে বাকি সকলে। অর্জুন ওদের গুরু। গুরুর কাছে পাঠ নিতে, সন্ধ্যা সাতটা বাজতে না বাজতেই যে যেখানে থাকুক না কেন, সকলেই এসে হাজির হয় হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই গোডাউন লাগোয়া পাঁচিলের গোড়ায়।
ওদের প্রত্যেককে একটা করে পিঠব্যাগ কিনে দিয়েছে অর্জুন। সঙ্গে দিয়েছে বই, খাতা, কলম, পোশাক; যার যেমন প্রয়োজন। পড়াশোনার স্তরও একেক জনের একেকরকম। সবচেয়ে বড়ো যে ছেলেটি, তার নাম বিল্টু; বয়স সতেরো আঠারো হবে। ওর ব্যাগে রয়েছে ক্লাস সিক্সের বইপত্র। বিল্টু কীভাবে এই হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তা অর্জুন অনেকবার বিল্টুর কাছে জানতে চেয়েছে। কিন্তু বিল্টু কিছুতেই তার জবাব দিতে পারে না। শুধু ওর কথাবার্তা থেকে অর্জুন বুঝতে পারে— ও কোনও সাঁওতাল মা-বাবার সন্তান। বিল্টুর পড়াশোনায় আগ্রহ থাকলেও, ভিতটা খুব দুর্বল হওয়ায়, অর্জুন ওকে গত দু’বছর আগে ক্লাস ফোরের স্তর থেকে সব বইপত্র কিনে দিয়ে, তালিম দিতে শুরু করেছিল। বয়স অনুপাতে অনেকটা পিছন থেকে শুরু করলেও, বিল্টুর অধ্যাবসায় যথার্থভাবেই ওকে ক্লাস সিক্স স্তর পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে।
আর বিল্টুর সমবয়সি যে-মেয়েটি, সে হল শ্রাবণী। আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। শ্রাবণীর মা-বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ত। ওর কতই বা আর বয়স হবে তখন; বছর এগারো হবে। মেদিনীপুর জেলার শ্যামচকে ওদের বাড়ি ছিল। একরাতে ঘুমের মধ্যেই শ্রাবণী টের পায়, ওদের গ্রামের সেই খড়ের চালের ঘরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ভয়ে আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবণী একরাশ ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। মালপত্র বের করতে গিয়ে, চালচাপা পড়ে ঘরের মধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে ওর মা-বাবা মারা গিয়েছিল সেদিন।
ক্রমশ…