গালে, ঠোঁটে রং-চং মেখে ঝিমলি নামের ওই মেয়েটা নাচছে ভেতরে। রেশমি ফিতে আর জরি জড়ানো ঝলমলে পোশাকের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে একটি নারী শরীর বাজনার ছন্দে ধনী পুরুষদের প্রলোভিত করছে। ওয়েটার মারফত পানীয়র অর্ডার যাচ্ছে বার কাউন্টারে। আরও রঙিন হোক আজকের সন্ধ্যা। ব্যাবসা মানবদেহের। ঝিমলির মতোই বোধহয় একদিন ছোটো মালিক, রাজেশ বাজাজের হঠাৎ তার কথা মাথায় এসেছিল। স্বাভাবিক গড়নের মানুষের চেয়ে অনেক ইন্টারেস্টিং একজন বাঁটকুল মানুষ। বিকৃত অপরিপূর্ণ শরীরে যে প্রতিবাদী হতে সাহস পায় না।

পূর্ণবয়স্ক পাকস্থলী আরও একমুঠো টাকার বিনিময়ে তাকে বহু আপস করতে শিখিয়েছে। আরও একটু বেঁচে থাকার প্রলোভন দিয়ে, রসদ জুগিয়ে, খোলা আকাশের নীচে সং সাজিয়ে সভ্য ধনীসমাজ তাকে নাচায়। রোজ সন্ধে থেকে রেস্তোরাঁ বন্ধ হওয়া অবধি কখনও সে চার্লি চ্যাপলিন, কখনও এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজা, কখনও-বা সার্কাসের ক্লাউন। রেস্তোরাঁর ছোটো মালিকের শখ এটা। তার পৈতৃক ব্যাবসার প্রধান ফটকে নানান চরিত্রের সাজে আগত সবাইকে বিরামহীন কুর্নিস করবে এই বণ্ঠ। যা দেখে ধনকুবের খদ্দেরের দল ঢুকতে বেরোতে মজা পাবে। তার বিনিময়ে অসহায় বামন মানুষটা তিনশো টাকা অতিরিক্ত মাসোহারা পাবে। ভাবলে অবাক হয়, সুন্দরী নারী শরীরের মতো তার এই বামন শরীরও মানুষকে উদ্ভাসিত, পুলকিত করে।

প্রতিদিনই নতুন সাজে এই মস্ত বড়ো বার-কাম রেস্তোঁরার বাইরে ক্রেতা মনোরঞ্জনের জন্য তাকে দাঁড়াতে হয়। রেস্তোরাঁর প্রধান ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে ফ্লুরোসেন্ট আলোয় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এখন সে সাঁ-পিচ্ছিল গাড়ি চালিয়ে আসা কাস্টমারদের অনবরত ‘বাও’ করছে। ঝলমল পোশাকে কেউ কেউ তার দিকে প্রতিদানে মুচকি হাসি উপহার দিয়ে ভেতরের ঠান্ডা ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। অবশ্য সবাই যে গাড়ি চালিয়ে আসছে, তা নয়। ট্যাক্সি চেপে কিংবা পায়ে হেঁটেও সুরালোভী, স্বাদু খাদ্যলোভী ধনী মানুষেরা আসছে। সিকিউরিটি রামাচন্দ্রন দম দেওয়া পুতুলের মতো বারবার সুইংডোর খুলে দিয়ে তাদের ভেতরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করছে।

নাকের নীচে আঠা দিয়ে লাগানো পেল্লায় গোঁফটা সুড়সুড় করছে গাঁটুলের। পার্ট দিয়ে বানানো ওই গোঁফের একটা আঁশ উঠে এসে বারবার হিমেল হাওয়ায় তার নাকের ভেতর ঢুকে পড়ছে। সশব্দ একটা হাঁচিকে বারবার ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে তাকে প্রাণপণ শক্তিতে। ফলে একটা দমবন্ধ অবস্থা এবং দুচোখের কোলে জল। ওই হাঁচির সাথেই পুরো গোঁফটা যদি খুলে মাটিতে পড়ে যায়। একবার বাথরুম করার অছিলায় ভেতরে যায় সে। ভাবে, দেখতে পেলে আঙুল দিয়ে বসিয়ে দেবে তা। টয়লেটের মিরারগুলি এতটাই উপরে যে মুখ দেখার কোনও উপায়ই নেই তার। তিনফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতায় মুখ দেখার একমাত্র উপায় তার নিজের ঘুপচি কামরার ভেতর রাখা হাত আয়নাই। কিন্তু সেখানে যাওয়া এখন বারণ।

—আরে, ইয়ার! এ ঘোঞ্চু কীধার গিয়া?

রেস্তোরাঁর মালিকের ছেলে প্রতাপ বাজাজ সাদা কন্টেসা থেকে নামতে নামতে খোঁজ করে গাঁটুলের। আসলে গাঁটুল নামটা তারই দেওয়া। আসল নাম প্রবাল গুহ কবেই হারিয়ে গেছে তার শারীরিক খর্বতার আড়ালে। নিজের ঘরে ঢোকার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে রেস্তোরাঁর ভেতর থেকে সুইং ডোর ঠেলে বাইরে বেরিয়েই চোখাচোখি হয় ছোটো মালিকের সাথে।

—এ ডোয়ার্ফ মাস্টার, হারামসে পয়সা মিলতা হ্যায়, ক্যাঁ?

—নো বস! নেচারস কল। গাঁটুল তার বাঁ হাতের থ্যাবড়া পুঁচকে কড়ে আঙুলটা ওপরে তুলে ধরে।

—ইসটাইম পানি মৎ পিয়া করো, শাআআলে!

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...