আবারও নকল গোঁফ থেকে উঠে আসা পাটের সেই ফেঁসোটা নাকের ভেতর হাওয়ায় উড়ে এসে অভব্যের মতো বেদম সুড়সুড়ি দিয়ে ওঠে গাঁটুলের। প্রাণপণ শক্তিতে মস্ত হাঁচিটা গিলতে গিয়ে দু’চোখে জল ভরে ওঠে আবারও। না, ওই জলও রুমালে মোছার কোনও উপায় নেই। মেক-আপ মুছে যাবে সব। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দু’চোখে জল নিয়ে পায়ে হেঁটে আসা কাস্টমারদের মাথা ঝুঁকিয়ে ‘বাও’ করে।
দূরে অশ্বত্থ গাছটার নীচে মোবাইক থেকে ঝিমলিকে তার দাদা এসে নামিয়ে দিচ্ছে। রেস্তোরাঁর বাইরে ওর নাম ঝিমলি দত্ত। একটু বাদেই ওই সুইং ডোরটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই ওর নাম পালটে হবে ‘মিস লিলি’। কিছু বাদেই ছোটো জামাকাপড় পরে নাচবে। বাজার চলতি হিন্দি ফিলমি গানের সুরে অর্কেস্ট্রা বাজবে। সিন্থেসাইজারে সেই বাবরি চুল ‘রোমিও’ মার্কা ছেলেটা মাথা দোলাচ্ছে। রাত ন’টা অবধি নাচবে ঝিমলি। তারপর মিস লিলি পোশাক পালটে রেস্তোরাঁর বাইরে বেরিয়ে ঝিমলি দত্ত হয়ে যাবে। রোজ ঠিক পৌনে দশটায় ঘড়ি ধরে মোবাইকে এসে তার দাদা তুলে নিয়ে যায়। পেটের দায়ে জামাকাপড় খুলতে হয়, ছোট্ট কাঁচুলি আর ঘাগরা পরে নাচতে হয় ঝিমলিকে। ধনমদে মত্ত পুরুষেরা কুপ্রস্তাব দেয় সুযোগ পেলেই।
আজ রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢোকার আগে ঝিমলি এক লহমার জন্য প্রবালের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রথমত সুন্দরী তরুণী বলেই হোক বা নিজের শারীরিক খর্বতার কারণেই হোক প্রবাল একটু দূরে দূরেই সব সময় থাকে ঝিমলির থেকে। তার অপমান মাখা জীবন, ঘর ছেড়ে আসা, দৈনিক অনটন— সব খবরই ওই মেয়ে রাখে। কাছে এসে ঝিমলি তার হাতের বটুয়া খুলে কী একটা খুঁজে না পেয়ে ভেতরে চলে যাওয়ার আগে ঠোঁট উলটে মুচকি একটু হেসেছিল তার উদ্দেশ্যে। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে রোজই তাকে উদ্দেশ্য করে যাওয়া আসার সময় এই মুচকি হাসিটি উপহার দেয় ঝিমলি। খুব ভেতরের হাসি এটা। চোখদুটো চকচক করে তখন তার। সে বোঝে এটা কৃতজ্ঞতার হাসি। এর জন্য পুলিশি ঝামেলায়ও পড়তে হয়েছিল প্রবালকে। কিন্তু বটুয়া খুলে তার সামনে আজ কী খুঁজছিল সে? টাকা নয় তো? তাকে বকশিশ দেবে! যেভাবে কখনও সখনও নেশাতুর চোখে টাকার কুমিরেরা তার ভাঁড়ামো দেখে দেয়। সত্যি যদি তা হয়, তবে এবার সত্যি সত্যি তার জীবন শেষ করে দেবে। ঈশ্বর, ওই নিষ্পাপ সরল মেয়েটার হাত দিয়ে তুমি এ পাপ কাজ করিও না।
দিন পনেরো আগে, রবিবারের রাত ছিল সেটা। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। গাছটার নীচে মোবাইকে ঝিমলির দাদা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ঝড়ের বেগে সুইংডোর ঠেলে হঠাৎ ঝিমলি বেরিয়ে আসতেই চমকে ওঠে প্রবাল। কই, এভাবে তো কখনও সে বেরিয়ে আসে না। তারই সাথে সাথেই বেরিয়ে আসে দু’টি যুবক। আকণ্ঠ পান করেছে তারা। তাদের একজন খপ করে ধরতে চায় ঝিমলির হাত। তার হাতের টানে ঝিমলির শরীরের ওপর থেকে সালোয়ার কুর্তার সঙ্গের ওড়নাটি খুলে মুঠোর ভেতর থেকে যায় যুবকটির। প্রতিদিন পেটের দায়ে তাকে পোশাক পালটাতে হয়। কিন্তু প্রকাশ্য রাস্তায় সম্ভ্রম হারিয়ে লজ্জায় সে কুঁকড়ে যায়। হো হো শব্দে রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে দু’টি মাতাল। একই সাথে যারা এসেছে ভেতর থেকে ভরপেটে, তারা আর রাস্তায় জমে যাওয়া কিছু সুস্থ, সবল পূর্ণাঙ্গ মানুষও পকেটে হাত দিয়ে তখন মজা দেখছে। সিকিউরিটি রামাচন্দ্রন আর মোবাইকে বসে থাকা দাদাও “হাঁ” করে তাকিয়ে। কোথাও কোনও প্রতিবাদ নেই।
—ভালো হবে না বলছি, ওড়নাটা দিন আমাকে। কান্না মেশানো ঝিমলির গলা। ধনীর দুলাল দু’টি সম্ভবত রেস্তোরাঁর ভেতর থেকেই তাকে কুপ্রস্তাব দিচ্ছে বারবার। তখনও সরব তারা।
—যদি না দিই?
—অসভ্য! চোখ ছলছল করে ওঠে ঝিমলির।
মদমত্ত সামনের যুবকটি, যার হাতের মুঠোয় ধরা গোলাপি ওড়নাটা। সে কিছুটা কাছে এগিয়ে আসে ঝিমলির, ভয়ানক টলছে। জিভে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
—ইয়া! অসভ্য! তুমি সতী-সাবিত্রী, তাই না?
(ক্রমশ…)
***