৬ পর্ব

তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে, অর্জুনের ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স’-এর কোনও হদিশ করতে পারল’ না নিখিল। প্ল্যাটফর্মের দোকানদার থেকে শুরু করে, রেলের বিভিন্ন কর্মচারীদের কাছে অর্জুনের খোঁজ করার পরে, সবার কাছ থেকে একই কথা জানতে পারল নিখিল, ‘অর্জুন সরকারি চাকরি করে। কলকাতায় ওর অফিস। সারাদিন সেখানকার কাজকর্ম সেরে, সন্ধ্যার পরে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসে অর্জুন। ওখানেই রাতে ওর পোষ্যরা আসবে, ওদের অর্জুন স্যারের কাছে পড়াশোনা করতে। তারপরে পড়াশোনা শেষ হলে, পোষ্যদের খাইয়ে দাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, ওই স্টেশন চত্বরেই যেদিন যেখানে মর্জি, সেখানে বিছানা পেতে রাত কাটিয়ে দেয় অর্জুন।”

পরদিন সকালে নিখিল অফিসে পৌঁছে, বড়োকর্তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। গতকাল সন্ধ্যায় সংগ্রহ করা, অর্জুন স্যার সংক্রান্ত সবিশেষ তথ্য বড়োকর্তাকে জানাতে জানাতে চোখের কোণে আঙুল ছোঁয়াল নিখিল। ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স বলে কোথাও কোনও ঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই স্যার। তবে আপনার ফাইলে যা তথ্য রয়েছে, তার কোনওটাই অসত্য নয়। কোনও অনাথ ছেলে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে জীবন কাটিয়ে, মাস্টার্স ডিগ্রি করে, সরকারি অফিসের অফিসার হতে পারেন, তা আমাদের অর্জুন-স্যারকে না দেখলে কোনওদিন বিশ্বাসই করতে পারতাম না। শুধু তাই নয়; সারাদিন এই অফিসে এইভাবে নিজেকে উজাড় করে পরিশ্রম করার পরে, রাতে আবার ওই হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফিরে গিয়ে, বহু অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে পড়াতে বসান। তারপরে তাদের রাতের খাবার খাইয়ে, ওদের সাথেই প্ল্যাটফর্মে রাত কাটিয়ে, পরদিন আবার যে-কেউ এইভাবে অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে পারে; তা অর্জুন স্যারকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। অর্জুন স্যার আমাদের ভগবান!” দু’-হাত কপালে ঠেকাতে ঠেকাতে অম্বরীশ চ্যাটার্জীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল নিখিল।

ওদিকে পরপর পাঁচদিন অফিস কামাই হওয়ার পরে, নিখিল যেদিন অর্জুনের খোঁজে হাওড়া স্টেশনে এসেছিল, সেদিনই সকালে শ্রাবণীকে সঙ্গে নিয়ে, এস আই জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন গিয়েছিল হাসপাতালেই। সাঞ্ঝাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে, সন্ধ্যার পরে যথারীতি হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, সাঞ্ঝাকে নিয়ে ফিরে এল অর্জুন। হাওড়া স্টেশন চত্বরে পা রাখতেই, রেল পুলিশের লোকজন, প্ল্যাটফর্মের স্টলমালিকরা থেকে শুরু করে, তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওর পোষ্যরা সকলেই এসে অর্জুনকে জানাল, ‘আজ তোমার অফিস থেকে তোমার খোঁজে একজন লোক এসেছিলেন। তোমার বাড়ি, ঘরদোর সম্বন্ধে খোঁজ করছিলেন তিনি।’

একথা শোনার পরে অর্জুনের কাছে সাঞ্ঝা জানতে চাইল, ‘আপনার ঘর এখান থেকে কতদূর?”

সাঞ্ঝার কথায় মুচকি হেসে অর্জুন জানাল, ‘এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া গোডাউনের পাঁচিল ঘেঁষেই আমাদের সবার ঘরবাড়ি। আমাদের সবার মানে, আমাদের এই ক’জন অনাথের।’

—কিন্তু সবাই যে বলছে, আপনি অফিসে চাকরি করেন! তাহলে কাছাকাছি কোথাও আপনার বাড়িঘর আছে নিশ্চয়ই।

—সে ছিল একসময়। রাঁচি স্টেশনের দক্ষিণদিকের রেল কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। আমরা মানে মা-বাবা, দাদু ও ঠাকুমা। আমার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার। দিল্লির একটা নামকরা হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে রাঁচি আসতেন। হঠাৎ করে কী একটা গবেষণার কাজে আমেরিকায় চলে গেলেন তিনি।

—তারপর… অর্জুন কথা বলতে বলতে একটু থামতেই, ফিরে জানতে চাইল সাঞ্ঝা।

—তারপর আর কী! আমার মা ছিলেন রাঁচির একটা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা। মা যে স্কুলে পড়াতেন, আমিও সেই স্কুলেই পড়তাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, মা নেই। বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে দাদুকে একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। এর পরে আমার সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ল দাদুর উপরে। দাদু আমাকে রোজ স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসতেন।

অর্জুন বলতে লাগল, ‘স্কুলে গেলেই সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষক শিক্ষিকারা সবাই আমার কাছে আমার মা-বাবা’র সম্বন্ধে জানতে চাইত। দিনের পর দিন সেটা আমার কাছে ভীষণ অসহনীয় লাগতে লাগল। একদিন স্কুল থেকে আমিও পালালাম!’

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...