আজ সকাল থেকেই প্রচণ্ড তাপদাহ। সূর্য যেন মাটিতে ঝুলে পড়েছে। সবাই গরমে হাঁসফাঁস করছে। অস্থির অবস্থা। এতটুকু হাওয়া নেই। দর দর করে ঘামছে মানুষজন। কিন্তু পল্লবকে আজ বেরোতেই হবে। আজ একটা জরুরি মিটিং আছে ধর্মতলায় চিত্র পরিচালক অভ্র রায়ের চেম্বারে।
গনগনে রোদ মাথায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে পল্লব। আজ ফাইনাল কথাবার্তা। অভ্র রায় তাঁর পরবর্তী ছবি ‘আগুন চোখ’-এর জন্য নায়ক নির্বাচিত করেছেন পল্লবকে। বিকেল চারটের মধ্যে পৌঁছোতে হবে। একটু বেশি মাত্রায় উত্তেজিত পল্লব।
ট্রেন ধরতে তাই আগেভাগে বেরিয়ে পড়েছে পল্লব। লাইন দিয়ে হাঁটলে শর্টকাট হবে। তাড়াতাড়ি স্টেশনে পৌঁছে যেতে পারবে। তাই ও লাইনের ওপর দিয়েই হাঁটা শুরু করে দিল।
লাইন থেকে গরম হলকা উঠছে। লোহার লাইন তেতে উঠেছে। সামনে তাকালে মনে হচ্ছে আগুনের গোলার মধ্যে দিয়ে যেন হাঁটছে। দ্রুত পা চালাল পল্লব। একটা চাপা উত্তেজনা ও ভয় কাজ করছে তার মনে। মোবাইলে দু’বার ফোন এসেছে ম্যানেজারের। ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে, তাও জানিয়ে দিয়েছে।
উলটো দিক থেকে একটা মেল ট্রেন দ্রুত বেগে ছুটে আসছে তীব্র শব্দ করে। পল্লব লাইন ছেড়ে সরে দাঁড়াল। কাছাকাছি আসতেই এক অদ্ভুত দৃশ্যের সাক্ষী হল। পল্লব দেখল একজন উলঙ্গ মানুষ দৌড়ে আসছে উলটো দিক থেকে ট্রেনের দিকে। পল্লব নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। ট্রেনটা সজোরে হুইসেল বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বেরিয়ে গেল। ট্রেনের ধাক্কায় উলঙ্গ মানুষটার দেহটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
পল্লব দু’হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করল। ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিতেই দেখল, কোথাও কেউ নেই। দুর্ঘটনার কোনও চিহ্ন নেই। সব ফাঁকা! এটা কী হল? নিজেকেই প্রশ্ন করল পল্লব। আশেপাশে কোনও লোকজন নেই। একটু আগে যে-মর্মান্তিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। তবে কি এই প্রচণ্ড রোদের তাপে ভুল দেখল সে।
পল্লব আবার চলা শুরু করল। কিন্তু মনের ভেতর একটা দ্বন্দ্ব চলছে। কেন দেখল এমন ভয়ংকর দৃশ্য। এর অর্থই বা কী!
কিছুদূর যাবার পর পল্লবের মনে হল কে যেন পেছন পেছন আসছে। ঘুরে তাকায় সে। কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার হাঁটা শুরু করে। খানিকটা এগিয়ে ওর মনে হল পা দুটো বড্ড ভারী লাগছে। টেনে নিয়ে যেতে পারছে না সে। কে যেন পেছন থেকে টানছে! ফিসফিস করে কথাবলা কারও কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
কে যেন বলে উঠল, “দাঁড়া, দাঁড়া বলছি৷’ পল্লব ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। না কেউ তো নেই। কিন্তু একটু খটকা লাগল।
এই ভর দুপুরে নির্জন রেল লাইনে ও একা। কেউ কোথাও নেই। দূরে নীচে সরু রাস্তা চলে গেছে। ক’টা ছোটো ছোটো কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে। গরমের জন্য কোনও মানুষকেই দেখতে পেল না।
পল্লব হাঁটা শুরু করল আবার। এবার সে অনুভব করল— কার হাত যেন ওর পা খামচে ধরেছে! নীচের দিকে তাকাতেই পল্লব ভয়ে চিৎকার করে উঠল। একটা কাটা হাত ওর ডান পা-টা সজোরে চেপে ধরেছে। ও পা টেনে টেনে চলবার চেষ্টা করল। গলা শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে ঠান্ডা জলের বোতলটা বার করে কাঁপা হাতে জল খেতে গিয়ে বোতলটা ছিটকে পড়ে যেতেই অদ্ভুত কাণ্ড!
কাটা হাত ওর পা ছেড়ে দিয়ে বোতলটা তুলে নিয়েছে। কে যেন বোতল থেকে জল খাচ্ছে। অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু কাটা হাতটা শূন্যে ভাসছে আর বোতল উলটে জল পড়ছে। এ যেন ম্যাজিক। পল্লব ভেবে পেল না কী করবে এখন। ওর পা দুটো যেন রেললাইনে আটকে গেছে!
শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে পল্লব ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল। তারপর দৌড়… দৌড়… আর দৌড়। রেললাইন ছেড়ে ঢালু পথ দিয়ে নীচে রাস্তার দিকে নামতে লাগল সে। কোনওরকমে রাস্তায় নেমে টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল পল্লব। ব্যস আর কিছু মনে নেই তার।
(ক্রমশ ……)