জ্ঞান ফিরতে পল্লব দেখল একটা খাটিয়ায় শুয়ে আছে। বেশ কিছু মানুষ ওর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। পল্লব উঠে বসতে চাইল। কিন্তু শরীরটা ভীষণ ভারী লাগছে। ও বুঝতে পারল এই মানুষগুলোই ওর জ্ঞান ফিরিয়েছে। পল্লবের চোখে হাজার বিস্ময়! এইমাত্র যা ঘটল যেন একটা সিনেমার ভয়াবহ দৃশ্য। মাথাটা ভারী লাগছে। চোখে একটা ঘোর। পল্লবের গলা শুকিয়ে গেছে। কোনও কথা বের হচ্ছে না।
—কী হল তোমার। অমন দৌড়ে এসে এখানে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে কেন? জনৈক মহিলার প্রশ্ন শুনে পল্লবের সব মনে পড়ে গেল।
একটি ছেলে এক গেলাস ঘোলের শরবত নিয়ে এসে পল্লবের সামনে ধরল। কে একজন বলে উঠল ঘোল-টা খেয়ে নাও। যা গরম পড়েছে। মাথা ঘুরে গিয়েছিল নাকি?
পল্লব খানিক সুস্থ বোধ করতে যা যা ঘটেছে তার সবটা বিস্তারিত ভাবে জানাল। সব কথা শুনে ওরা বলে উঠল— এরকমটা অনেক আগেও কয়েকবার ঘটেছে। সেই থেকে কী দিন, কী রাত কেউ রেল লাইন ধরে যাতায়াত করে না। তুমি জানতে না? খুব জোর বেঁচে গেছ ভাই। আর কখনও লাইন ধরে যাতায়াত করবে না। লাইনে রেলে কাটা পড়া একজন মানুষের বিদেহী আত্মা ওভাবে ঘুরে বেড়ায় দিনেরাতে।
এও শোনা গেছে যে, এর আগে ওই কাটা হাত দুটো নাকি গলায় সাঁড়াশির মতো চেপে বসেছিল একটি ছেলের! আবার নিজেই ছেড়ে দিয়েছে। যেন একটা মরণ খেলায় মেতে ওঠা। যার সঙ্গে এইসব ঘটেছিল তার মুখ থেকেই শোনা। সেই থেকে কেউ আর লাইন ধরে হাঁটতে চায় না।
পল্লব মনে মনে ভাবতে লাগল। এরকমটা আবার হয় নাকি! কিন্তু এইমাত্র নিজের চোখে যেটা দেখল সেটা দুর্ঘটনার দিনের দৃশ্য, সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো চোখের সামনে ফুটে উঠল।
—আজ আর কোথাও গিয়ে কাজ নেই, তুমি বাড়ি ফিরে যাও বাপু। বলা যায় না শরীর খারাপ হতে পারে।
—হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো। সবারই এক মত।
ওরা সবাই বাড়ি ফিরে যেতে বলল পল্লবকে। এমনকী ওকে একা না ছেড়ে কেউ কেউ ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতেও চাইল।
কিন্তু ওর তো এখন বাড়ি ফিরে যাবার উপায় নেই। ও জানে আজ ডিরেক্টর কল আছে। সময়মতো পৌঁছোতেই হবে। কিন্তু এদের বোঝাবে কী করে। তাই ওদেরকে না করে দিয়ে উঠে পড়ল ট্রেন ধরবার জন্য।
—আমার জরুরি দরকার আছে। এখুনি যেতে হবে। পল্লবের কথা শুনে একটা ছেলে সাইকেলে উঠিয়ে পল্লবকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে গেল।
প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে পল্লব ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার সেই ভয়ংকর মুহূর্তটার কথা ভাবতে লাগল। ভয়ে সে শিউরে উঠল। এরই মধ্যে স্টেশনে ট্রেন এসে যাওয়ায় সে ট্রেনে উঠে পড়ল। তারপর ট্রেন থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা ডিরেক্টরের অফিসে চলে এল।
চেম্বারে ঢুকে দেখল অনেকেই এসে গেছে। ক্যামেরাম্যান সুকান্তদা, স্ক্রিপ্ট রাইটার দুলাল ভৌমিক, ম্যানেজার ব্রজদা— সবাই হাজির।
ডিরেক্টর অভ্র রায় পল্লবকে দেখে বললেন— বসো বসো। আজ স্ক্রিপ্টটা নিয়ে একটু ডিসকাশন করব। তারপর তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য বোঝাব।
ঠিক তখনই দেয়ালে চোখ গেল পল্লবের। দেখল একটা বড়ো ফেস্টুন ঝুলছে। তাতে দুটো কাটা হাত আড়াআড়ি রাখা। আর সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। পল্লব এই ছবিটা দেখে চমকে উঠল! ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া মুহূর্তের কথা মনে পড়ে গেল।
পল্লব চিৎকার করে উঠল। একটা ভয় কাজ করছে তার। সে অদ্ভুত একটা আচরণ করতে লাগল। একটা অস্বাভাবিক মুখভঙ্গি করতে লাগল। ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল পল্লব।
অভ্র রায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে উঠলেন। বাকিরাও তাঁর সঙ্গে তাল মেলাল।
—দারুণ দারুণ। এরকমটাই আমি চাই। ইউ আর সিমপ্লি গ্রেট মাই বয়। ডিরেক্টর পিঠ চাপড়ে দিলেন পল্লবের। এই সিনটার কথাই তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম আমি। অভ্র রায় খুব খুশি।
পল্লব নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। ব্যাপারটা কিছু বোঝার আগেই পল্লব বসে হাঁফাতে লাগল। ওর মনে হল— ও তো সিনের কথা ভেবে অ্যাক্টিং করেনি। ওর তো…। পল্লব উঠে দাঁড়াল।
—ওকে একটু জল দাও। অভ্র রায় বলে উঠলেন।
বাকিরা একে একে এসে পল্লবকে এই দুর্দান্ত অ্যাক্টিং-এর প্রশংসা করতে লাগল ।
পল্লব মনে মনে কাটাহাতের অশরীরী-কে ধন্যবাদ জানাল। সবটুকু কৃতিত্ব প্রেতাত্মার। হয়তো এই গরমে ঠান্ডা জল খাওয়ানোর ফল পেয়েছে ওই প্রেতাত্মা। সে আজ বেজায় খুশি। অভ্র রায়ের ছবিতে নায়কের সুযোগটা তাহলে শেষমেশ সে পেয়েই গেল।
পল্লবের ভয় কেটে গেছে। একটা আলাদা আনন্দ ও ভালোলাগায় তার মনটা ভরে উঠল।
এই তপ্ত দিনে শীতল বারি ঝরে পড়তে লাগল ছোট্ট অফিস ঘরে। পল্লব চোখ বন্ধ করে অনুভব করল বৃষ্টির সুখ। পরম তৃপ্তির সুখ।
(সমাপ্ত)