মনটা ডুকরে কেঁদে উঠল পূজারিনির। ফটোটা বুকে চেপে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল, ‘সতিনকে ছেড়ে কেন পালিয়ে গেলি এত তাড়াতাড়ি? আমি এখন কী করব?”
নির্বাক ছবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ পূজারিনির মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগে বলা ঠাকুমার একটা কথা— আমি যখন থাকব না আমার ডায়ারিগুলো পড়িস, আমাকে খুঁজে পাবি ডায়ারির পাতায়। মনে পড়ে গেল পুরোনো দিনের কথা। ঠাকুমা প্রতিদিন শোবার আগে বসত ডায়ারি লিখতে। দাদু যখন বেঁচে ছিল কতবার এই নিয়ে তার ঠাট্টা তামাশা শুনতে হয়েছে ঠাকুমাকে।
দাদু যখন বলত— কাজের মধ্যে তো সারাদিন লুড়ি টানা হেঁশেল থেকে শোবার ঘর আর শোবার ঘর থেকে হেঁশেল। কী এত লেখো ওই ডায়ারিতে ?
ঠাকুমা অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিত— কথা কইছি নিজের সঙ্গে।
—কী এত কথা বলত ঠাকুমা নিজের সঙ্গে? কী এত লিখেছে ডায়ারিতে?
দেয়ালের তাকে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল এ বছরের ডায়ারিটা। পেড়ে নিয়ে এসে খুলে দেখল দিন চারেক আগে পর্যন্ত লেখা। বিছানায় বসে ডায়ারিটা পড়তে শুরু করল পূজারিনি।
দেখল ডায়ারির পাতায় পাতায় ঝরে পড়েছে পরলোকগত স্বামীর নানারকম স্মৃতির টুকরো টুকরো কথা। বেঁচে থাকার অনাগ্রহের কথা। আর ভগবানের কাছে তাকে তাড়াতাড়ি ডেকে নেওয়ার আকুতি। পড়তে পড়তে হঠাৎ পূজারিনির নজরে এল পাতাভর্তি একটু অন্যরকম লেখা। ভালো করে পড়তে শুরু করল।
‘মনটা মাঝেমাঝে গুমরে গুমরে ওঠে, কী একটা অস্বস্তি বুকের উপরে পাষাণ হয়ে চেপে বসে, নড়তে চড়তে পারি না। যুগান্ত সঞ্চিত না-বলা কথাগুলো বুকের মধ্যে এমন ভাবে চেপে বসে আছে যে, মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে। এই জগদ্দল পাষাণ বুকে নিয়ে মরেও শান্তি পাব না। সারাটা জীবন মুখে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কুলুপ এঁটে দিয়ে মনের কথাগুলো চেপে না রাখলে আজ সেগুলো এত ভারী হয়ে উঠত না। জীবনে কত লোককে কত কিছু বলতে চেয়েও বলে উঠতে পারিনি। পারিনি গৃহশিক্ষক সুজিত স্যারকে- তাকে আমার অপছন্দের কথা, বলতে পারিনি স্কুলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঈর্ষায় স্কুলের বান্ধবী নীরার অঙ্ক বইটা পরীক্ষার আগে আমারই সরিয়ে দেওয়ার কথা, বলতে পারিনি ভুল বোঝাবুঝির কারণে দূরে সরে যাওয়া ভাইপোকে আমার অন্তর থেকে তাকে ভালোবাসার কথা, বলার সুযোগ হয়নি রাগে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেওয়া কাজের ছেলেটাকে আমার অনুশোচনার কথা— এমনি আরও কত কথা। আর কলেজের সেই মুখচোরা পড়াশোনায় ভালো ছেলে সুবিমল? তাকেও বলতে পারিনি সেদিন তাকে আঘাত দিয়ে যা যা বলেছিলাম কোনওটাই আমার মনের কথা ছিল না, মন আসলে চেয়েছিল ঠিক উলটোটা। আজ মনে হয় মনের কথাগুলো সবাইকে সময়মতো খুলে বলে দিলেই ভালো হতো। তাতে হয়তো সাময়িক কষ্ট পেতাম! হয়তো বা জীবনটাও বইত অন্য খাতে! কিন্তু আজ শেষের বেলায় এইরকম আপশোশের বোঝা বইতে হতো না।’
ঠাকুমার লেখাগুলো গোগ্রাসে গিলছিল পূজারিনি। ভাবতে লাগল ঠাকুমা এত কথা চেপে রেখেছিল বুকের মধ্যে? আর কে এই সুবিমল? সেকি ঠাকুমার সঙ্গে মেদিনীপুরে কলেজে পড়ত? সত্যিই কি ঠাকুমা তাকে পছন্দ করত নাকি?
পাতা ওলটাতে ওলটাতে পূজারিনি থমকে গেল আর একটা পাতায়। ঠাকুমা লিখেছে, ‘আজ বড্ড মনে পড়ছে একটা মুখ, যে মনে সাহস জোগাত। বলত সাহস করে জীবনে এগিয়ে চলতে, অন্তরের সুপ্ত ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করতে। বয়সে সামান্য বড়ো ছোটোকাকু ছিল আমার বন্ধুর মতো। দু’জনে একসঙ্গে খেলাধুলা মারামারি করে বড়ো হয়েছিলাম। কখনও ভয়ে নিজের কোনও ইচ্ছের কথা বাবা-মাকে না বলতে পারলে সে বলত — কেন এত ভাবিস কে কী ভাববে তাই নিয়ে? কেন এত সংকোচ, কেন এত ভয়? লোকে কী বলবে, ঘরের লোক কী বলবে তাই ভেবে কখনও নিজেকে গুটিয়ে রাখবি না। মন যা চায় তা বলে দিবি। যা ভালো লাগে তাই করবি। এই ভাবে চুপ করে সবকিছু মেনে নিলে লোকের ফাঁপা প্রশংসা ছাড়া জীবনে সত্যিকার সুখ পাবি না কোনওদিন। কিন্তু কাকুর শত উৎসাহেও আমি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারিনি। পারিনি ঘরের মানমর্যাদার কথা না ভেবে নিজের ইচ্ছেমতো চলতে। পারিনি লোকনিন্দার ভয় ঝেড়ে ফেলে নাচগানের চর্চা চালিয়ে যেতে। পারিনি শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বাঁকা কথার খোঁচা অগ্রাহ্য করে লেখালেখি করতে। কেবলি চিন্তা করেছি লোকের কথা, তারা কী ভাববে, তারা কী বলবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি লোকের কথা ভাবতে গিয়ে সারা জীবন কেবল নিজেকেই বঞ্চনা করেছি, প্রতারণা করেছি নিজের সঙ্গে। সত্যিকার সুখের স্বাদ পাইনি জীবনে।”
অবাক হল পূজারিনি। ঠাকুমার ছোটোকাকু এত উদার মনের মানুষ ছিল? দু’একবার ঠাকুমার মুখে শুনেছে তার এক কাকা কলেজে পড়তে পড়তে মেতে উঠেছিল ষাটের দশকের বিপ্লবী আন্দোলনে, তারপর কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল কেউ জানে না। আরও অবাক হল ঠাকুমার নাচগান আর লেখালেখির নেশার কথা জেনে। ছোটোবেলা থেকে কখনও তো ঠাকুমাকে এসব করতে দেখেনি! কিন্তু লেখালেখি করলে তো সবকিছু যত্ন করেই কোথাও রাখবে, ফেলবে না। অমনি ঠাকুমার খাটের নীচ থেকে টিনের পুরোনো তোরঙ্গটা টেনে বের করল। খুলে দেখে কয়েকটা পুরোনো শাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। এমনকী পুরোনো ডায়ারিগুলোও নেই। নিরাশ হল পূজারিনি। কোথায় গেল সব? তবে কি ঠাকুমা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিল, নাকি দাদুর ভয়ে সব নষ্ট করে ফেলেছে?
(চলবে)