রিমঝিম সেদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল। স্বভাবতই বাড়ির সকলেই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ছোট্ট মেয়েটির গায়ে হাত ভুলিয়ে মা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আট বছরের রিমঝিম কেঁদে বলল, “মা, আমি কি ভাল্লুকের মেয়ে? তুমি কি আমাকে চিড়িয়াখানা থেকে নিয়ে এসেছ?”
রিমঝিমের মা মেয়ের চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললেন, ‘না সোনামণি, তুমি আমারই মেয়ে। কে বলেছে তুমি ভাল্লুকের মেয়ে?’
‘সবাই তাই বলে। আজকে তো হিন্দি শিক্ষিকাও বললেন, আমাকে ভাল্লুলুকের মতো দেখতে।’ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছোট্ট মেয়েটি বলল।
স্পষ্টতই মেয়ের মুখে এরকম কথাবার্তা শুনে মা ভীষণই চিন্তিত হলেন। তিনি মেয়েকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওনারা তোমাকে কেন এমন বলেন তুমি কি কিছু জানো ?
জবাবে রিমঝিম বলল, ‘মা, এই দ্যাখো, আমার হাতে ও পায়ে কত লোম রয়েছে। এজন্যই আমাকে ভাল্লুকের মতো দেখতে লাগে।’ এই বলে রিমঝিম মায়ের সামনে দু’হাত প্রসারিত করল।
এদিকে মেয়ের কথা শুনে আঁতকে উঠলেন মা। আসলে, রিমঝিমের মুখ সহ সারা শরীরে বেশ ঘন লোম রয়েছে। এ কারণে তার গায়ের রং-ও খানিকটা কালো লাগে। এদিকে এত অল্প বয়সে ওকে পার্লারে নিয়ে গিয়ে ওয়াক্স করানোও সম্ভব নয়।
ছোট্ট রিমঝিম পড়াশোনায় খুব মেধাবী। নাচ এবং অভিনয়ও ভালো করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে সুযোগ পায় না। শিক্ষিকারা যদিওবা রিমঝিমকে নাচের ক্লাসে নিয়ে যান, কিন্তু ভালো নাচের পরও তাকে পিছনের সারিতে রেখে দেন। কারণ, তার মুখমণ্ডল এবং হাত-পা এমন লোম দ্বারা আবৃত যা মেক-আপ করেও লুকানো যায় না।
জন্মের পর মালিশের প্রয়োজনীয়তা
আসলে রিমঝিমের জন্মের পরে তার শরীরে যে মালিশ করার প্রয়োজন ছিল তা কখনও করা হয়নি। আমরা জানি, নবজাতকদের জন্মের পর শরীরে কিছু লোম থাকে, যা ছয় মাস বা এক বছর টানা মালিশ করলে পরিষ্কার হয়ে যায়। আপনারা প্রায়শই দেখেছেন যে, গ্রামের মহিলারা তাদের নবজাতককে তাদের দু’পায়ে শুইয়ে সরষের তেল, হলুদ ও বেসনের পেস্ট তৈরি করে তা দিয়ে মালিশ করেন।
শহুরে মায়েরা তাদের বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের বেবি অয়েল দিয়ে মালিশ করেন— যা তাদের বাচ্চাদের শরীর শক্ত ও পরিষ্কার করে। মালিশের ফলে বাচ্চাদের শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া উন্নত হয় এবং ওরা আরও শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু রিমঝিমের জন্মের পর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ওর মা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং প্রায় দু’বছর শয্যাশায়ী ছিলেন। তার শরীরের অর্ধেক অংশ অবশ হয়ে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপির পর তিনি বর্তমানে হাঁটাচলা করতে সক্ষম হয়েছেন।
ঘটনাচক্রে জন্মের পর থেকে প্রায় চার বছর রিমঝিমকে তার দিদিমার কাছে থাকতে হয়েছিল। ওদিকে দিদিমার বয়সও হয়েছিল অনেক। তাই, নবজাতকদের সাধারণত যে ধরনের যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন হয়, দিদিমার পক্ষে রিমঝিমের সেরকম ভালো যত্ন নেওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকী ওর শরীরে ঠিকমতো মালিশও করা হয়নি। এই কারণেই জন্মের সময় তার শরীরে লোম ছিল, যেগুলি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও ঘন এবং শক্ত হয়ে উঠেছে। আর এজন্যই ওকে কুৎসিত দেখাচ্ছে।
শিশুদের সঠিক বিকাশ
নানা কারণে শিশুদের শরীরে মালিশ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, মালিশ শুধুমাত্র শরীরকে অবাঞ্ছিত লোম থেকে মুক্ত করে না, এটি শরীরের হাড়কেও যথেষ্ট মজবুত করে। এছাড়া মালিশের ফলে যেহেতু সারা শরীরে ভালো রক্ত সঞ্চালন হয়, তাই শিশুর বিকাশও সঠিক মাত্রায় ঘটে।
মনে রাখবেন, শিশুদের ত্বক ফুলের মতো নরম হয় এবং তাই ওদের ত্বকের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। এরই সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে যে, শিশুদের ত্বকের যত্ন নেওয়া মানে শুধুমাত্র তাদের মুখমণ্ডলের ত্বকের যত্ন নিলেই হবে না। মুখমণ্ডলের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র শরীরের ত্বকের যত্ন নেওয়াও অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুদের মালিশের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে বাজারে বিভিন্ন ধরনের বেবি স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। আজ শুধু শহুরে মায়েরাই নন, গ্রামাঞ্চলের মায়েরাও তাঁদের সন্তানের মালিশের জন্য এই পণ্যগুলি অধিক মাত্রায় ব্যবহার করছেন।
পণ্য কেনার আগে মনে রাখবেন
আপনার শিশুর সূক্ষ্ম ও নরম ত্বকের জন্য কোনও পণ্য কেনার আগে বিশেষ ভাবে সচেতন ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখবেন, এই পণ্যগুলিতে অনেক ধরনের রাসায়নিক, সুগন্ধি, কাপড় রঙ করার জন্য ব্যবহৃত পদার্থ, ডিটারজেন্ট প্রভৃতি মেশানো থাকে— যা নবজাতকের ত্বকে দাগ, ফুসকুড়ি, রুক্ষতা, জ্বালাভাব এবং শুষ্কতার কারণ হতে পারে। তাই, শিশুর ত্বকের উপযোগী পণ্যগুলি বেছে নেওয়ার সময় কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত—
সাধারণত, শিশুদের শরীরের সঠিক যত্নের জন্য যে জিনিসগুলি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল— বেবি ক্রিম, শ্যাম্পু, বেবি সোপ, হেয়ার অয়েল, ম্যাসাজ অয়েল, পাউডার এবং শিশুর পোশাক।
শিশুদের ত্বক খুবই সংবেদনশীল। যদি তাদের ত্বকের যত্নে সামান্যও গাফিলতি হয়, তবে ত্বকে ফুসকুড়ি-জাতীয় সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে ত্বকে জ্বালাভাব সৃষ্টি হয় এবং শিশুটি অস্বস্তি বোধ করে। পরিণতিতে দিনরাত কাঁদে। এমন পরিস্থিতিতে আপনি যদি প্রথমবার বাবা-মা হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার সন্তানের ত্বকের বিশেষ যত্ন নিতে শেখা আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের জন্য জানা জরুরি
জন্মের পর প্রথম দিকে শিশুর ত্বক ও চুলে ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে। নবজাতকের শরীর থেকে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত সাদা রঙের আস্তরণ বেরিয়ে আসে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একে বলে ভারনিক্স। তেল দিয়ে আলতো করে শরীরে মালিশ করলে এই আস্তরণটি সম্পূর্ণ দূর হয়। এরই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় লোমও দূর হয়।
কিন্তু তা দ্রুত দূর করার জন্য কেউ কেউ শিশুকে অতিরিক্ত রগড়ে স্নান করান, যা সঠিক নয়। শিশুর ত্বকের যত্নের জন্য আমাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয় তা জানা একজন নতুন মায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ত্বককে পুষ্ট করা
শিশুর ত্বকের পুষ্টির প্রয়োজন হয়। এজন্য দিনে দু’বার ওকে মালিশ করুন। নারকেল তেল, বাদাম তেল, অলিভ অয়েল ইত্যাদি মালিশের জন্য বেছে নিতে পারেন। উল্লেখ্য, বাজরে বিক্রি হওয়া সেইসব বেবি-প্রোডাক্ট থেকে দূরে থাকুন যে সব পণ্যে তীব্র গন্ধ, রং এবং রাসায়নিক পদার্থ থাকে।
হালকা ধরনের সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহার করুন
শিশুর ত্বকে কোনও রাসায়নিক-মিশ্রিত পণ্য ব্যবহার করলে ত্বক শুষ্ক হতে পারে। এমনকী ফুসকুড়িও বেরোতে পারে। তাই শিশুর চুল এবং ত্বকের জন্য হালকা ধরনের সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহার করুন।
খুব বেশি পাউডার লাগাবেন না
শিশুর ত্বকে খুব বেশি পাউডার লাগানো ঠিক নয়। স্নানের পর একটি নরম সুতির কাপড় দিয়ে ওর ত্বক ভালো ভাবে মুছুন। এরপর পাউডার লাগান। মনে রাখবেন, পাউডারটিতে যেন খুব বেশি গন্ধ না থাকে, আর তা যেন ভালো কোম্পানির হয়।
পরিষ্কার পোশাক পরান
সবসময় আপনার শিশুকে পরিষ্কার পোশাক পরাবেন। মনে রাখবেন, নোংরা পোশাক থেকে ত্বকে ফুসকুড়ি, চুলকানি প্রভৃতি সমস্যা হতে পারে।
নখ পরিষ্কার রাখুন
শিশুদের নখ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। নখ নিয়মিত ভাবে কাটবেন। নয়তো নখের আঁচড় লেগে শিশুর মুখে বা শরীরের যে কোনও জায়গায় কেটে যেতে পারে।
সুতির ডায়পার ব্যবহার করুন
আজকাল মায়েরা শিশুদের নিয়মিত ডায়পার পরিয়ে থাকেন। মনে রাখবেন, ডায়পার ব্যবহারের কারণে বাচ্চার ত্বকে ফুসকুড়ি-জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভিজে থাকার কারণে বাচ্চার ত্বকে ফুসকুড়ির পাশাপাশি চুলকানিও হতে পারে। এমনকী ত্বকে লাল-ভাবও দেখা দিতে পারে। এই সমস্যা এড়াতে চেষ্টা করবেন বাচ্চাকে যতটা সম্ভব কম ডায়পার পরাতে। আর পরাতেই হলে সুতির ডায়পার ব্যবহার করাই ভালো ।
কুসংস্কার ত্যাগ করুন
শিশুদের ত্বক খুবই নরম প্রকৃতির হয়। তাই সংস্কারবশতঃ ওদের ত্বকে কাজল, সিঁদুর, হলুদ, চন্দন প্রভৃতি লাগাবেন না। মনে রাখবেন এসব পণ্যে রাসায়নিক পদার্থ থাকতে পারে।
সান বার্ন থেকে দূরে রাখুন
কখনওই আপনার সন্তানকে সরাসরি প্রখর সূর্যের তাপে রাখবেন না। ওদের জন্য সকালের সূর্যের তাপই সবথেকে ভালো। যদি এরপরও শিশুর ত্বকে ফুসকুড়ি কিংবা লাল-ভাব দেখা যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। হতে পারে এটা অ্যালার্জির সমস্যা।