জীবন হয়তো কবিতার মতো নয়, বরং অনেকটাই গদ্যময়। তবুও জীবনকে ছন্দে বেঁধে রাখতে পারলেই অনেকটা হাসিখুশিতে থাকা যায়। কারণ জীবন কোন খাতে কখন বয়ে চলে, তা আমরা কেউই জানি না। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকে না, সে এগিয়ে চলে তার নিজস্ব ছন্দে। অতএব সময় এবং নদীর মতো জীবনও বহমান। তাই প্রতিকূলতা কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারলেই আসবে সাফল্য। কিন্তু কীভাবে, কোন পথে, কোন কৌশলে এগোলে সাফল্যলাভ সম্ভব— তা হয়তো সবার জানা নেই।
সম্পর্ক অটুট রাখুন
জীবনকে সুন্দর করে তুলতে, বড়ো ভূমিকায় থাকে সম্পর্ক। যার সম্পর্কের বাঁধন যত মজবুত, সে জীবনে ততই সফল। মনে রাখবেন, যার যতই অর্থবল থাকুক না কেন, বিপদে পড়লে বোঝা যায় অর্থের পাশাপাশি লোকবলও কতটা প্রয়োজন। আসলে একা মানেই বেশিরভাগ সময় আমরা বোকা হয়ে যাই, বিশেষত বিপদের সময়। তখন সবকিছু জেনেও যেন কেমন অসহায় ভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। অর্থাৎ, একা থাকলে ঘাবড়ে গিয়ে সঠিক সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না অনেকসময়। শুধু তাই নয়, অসুখ হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে আন্তরিক সেবাদান নিজের পরিবারের লোকজন ছাড়া প্রায় সম্ভব নয় বললেই চলে। টাকা দিয়ে লোক রেখে চব্বিশ ঘণ্টা সঠিক ভাবে সেবা নেওয়া সম্ভব হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
অবশ্য শুধু এই বিষয়টিই নয়, আর্থিক কষ্টের দিনে কিংবা কোনও জটিল পরিস্থিতির সময় মাথা ঠান্ডা রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের সাহায্য লাগে। তবে মনে রাখবেন, একতরফা ভালোবাসা পাওয়া যায় না। অন্যের থেকে ভালোবাসা পেতে হলে আপনাকেও আন্তরিক ভাবে ভালোবাসতে হবে অন্যকে। অন্যের বিপদের দিনে অর্থ এবং শ্রম দিয়ে নির্দ্বিধায় সাহায্য করতে হবে আপনাকেও। মনে রাখবেন, সম্পর্ক-ই সবচেয়ে বড়ো সম্পদ জীবনে। সম্পর্কের ভিত যত মজবুত হবে, জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতাও তত সহজেই দূর হয়ে যাবে।
কোনও অসাধু লোক আপনার ক্ষতি করার আগে দু’বার ভাববে এবং ভয় করবে। কারণ সে জানে, আপনার লোকবল আছে। শুধু তাই নয়, ভালোবাসার লোকজন থাকলে আপনার মনের জোরও অনেক বেড়ে যাবে, কোনও অসহায়তাই দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাছাড়া, সবাই মিলে কাজ করলে সব কাজই অনেক সহজ হয়ে যাবে। আর এই সম্পর্কের ভিত শক্ত করার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন সবার সঙ্গে এবং মাঝেমধ্যে দেখা করে উপহার সামগ্রীও দিন।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন কোনওরকম দূরত্ব না রেখে। সাধ্যমতো পরস্পরকে সময় দিন, ভালোমন্দ ভাগ করে নিন, মেতে থাকুন হইহুল্লোড়ে।
সঞ্চয় করুন
জীবনে সুসম্পর্কের পর সবচেয়ে বড়ো ভূমিকায় থাকে সঞ্চয়ের বিষয়টি। সম্পূর্ণ না হলেও, অনেক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে অর্থ। তাই টাকা জমান সাধ্যমতো। কর্মজীবনের পর থেকে মাথায় রাখুন অর্থ সঞ্চয়ের বিষয়টি। প্রথমে দেখে নিন আপনার মাসিক আয় কত, তারপর সেইমতো ব্যয় করুন। কোন খাতে কত খরচ করতেই হবে তা প্রথমে লিখুন। এরপর মোট খরচের সঙ্গে মিসলেনিয়াস খাতে আরও কিছু টাকা ধরে নিয়ে আয়ের পরিমাণ থেকে সেই টাকা বাদ দিয়ে দেখুন কত টাকা বাঁচাতে পারছেন। যতটুকু টাকা বাঁচাতে পারবেন, সেই টাকা বাড়িতে না রেখে ব্যাংক-এ রাখুন। কারণ, ব্যাংক-এ টাকা রাখলে তা যেমন সুরক্ষিত থাকবে অনেকটাই, ঠিক তেমনই মাসে মাসে সুদের টাকাও হবে বাড়তি পাওনা।
অবশ্য শুধু ব্যাংক-এ টাকা জমানোই নয়, সোনার গয়নাও কিনে রাখতে পারেন। বিপদের দিনে এই স্বর্ণালঙ্কার খুব কাজে লাগবে। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, কিছুদিন টাকা জমিয়ে জমি কিংবা বাড়িও কিনে রাখতে পারেন। কারণ, জমি-বাড়িও একরকম সঞ্চয়। শুধু তাই নয়, পিএফ বা পিপিএফ-ও বড়ো সঞ্চয়ের মাধ্যম। যারা চাকরি করেন, তারা এই সুবিধা নিতে পারেন। তবে শেয়ারবাজার কিংবা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করার আগে ভালো ভাবে খোঁজখবর নেওয়া উচিত।
একটু বিচক্ষণতার সঙ্গে চলতে পারলেই দেখবেন সুস্থ-সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। এই যেমন আমাদের এখন অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া উচিত, ঠিক তেমনই অনেকটা সাশ্রয়ীও হওয়া উচিত।
সন্তানের জন্য সঞ্চয়
যে যত বিচক্ষণ, সে ততই আগাম পরিকল্পনার পথ বেছে নেয়। এই যেমন সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। প্রথমেই প্রতি মাসে কিছু টাকা রেখে দিন সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য। এখন অনেক ব্যাংক এমন বিশেষ কিছু যোজনা যুক্ত করেছে, যা খুবই লাভদায়ক। প্রতি মাসে যদি ৫০০ টাকা করেও জমাতে পারেন সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য, তাহলে আপনিও যেমন ভবিষ্যতে চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন, ঠিক তেমনই আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ-ও অনেকটাই সুরক্ষিত থাকবে। অবশ্য শুধু ব্যাংক-ই নয়, পোস্ট অফিসেও এমন অনেক যোজনা রয়েছে, যা আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ করবে আপনাকে।
সুরক্ষা বিমা
এই জীবন সুরক্ষা বিমার দুটি ভাগ আছে। প্রথমটি স্বাস্থ্যবিমা এবং অন্যটি জীবনবিমা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট টাকা জমা দিতে হবে বিমা কোম্পানিতে। জমা দেওয়া টাকার পরিমাণ নির্ভর করবে বয়স এবং বিমারাশির পরিমাণের উপর। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে যেমন আপনার জীবন বাঁচবে, ঠিক তেমনই হঠাৎ যদি পরিবারের কোনও সদস্যের মৃত্যু ঘটে তাহলে জীবিত সদস্যরা মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে যাবেন বিমা কোম্পানির থেকে। তাই পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীর জীবনবিমা করিয়ে রাখা উচিত। এতে তার উপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বিপদে পড়বেন না উপার্জনকারীর মৃত্যু ঘটলেও।
আর মনে রাখবেন, প্রতিদিন যেভাবে চিকিৎসার খরচ বেড়ে চলছে, তাতে মেডিকেল ইনশিয়োরেন্স করিয়ে রাখা জরুরি। অনেক দেশ আছে যেখানে চিকিৎসাবিমা বাধ্যতামূলক। এই বিমা না থাকলে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যায় না। তাই মেডিকেল ইমারজেন্সির সময় যাতে বিপদে না পড়েন, তার জন্য স্বাস্থ্যবিমা করিয়ে রাখা-ই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এছাড়া, আপনার গাড়ি-বাড়ির বিমাও করিয়ে রাখুন। এই সুরক্ষা বিমার মধ্যে এখন ট্রাভেলিং ইনশিয়োরেন্স এবং ওয়েডিং ইনশিয়োরেন্সও যুক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিলে আরও বিশদে জানতে পারবেন।
সাশ্রয়
মনে রাখবেন, সঞ্চয় বাড়াতে হলে সাশ্রয়ী হতে হবে। সচেতন থেকে যত বেশি খরচ কমাতে পারবেন, তত বেশি সঞ্চয় করতে পারবেন। এর জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। অপ্রয়োজনে আলো, পাখা, গিজার, এগজস্ট ফ্যান কিংবা এয়ারকন্ডিশনার বন্ধ রাখতে হবে। কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট-এর খরচ ইত্যাদিও কমাতে হবে। এছাড়া ঘনঘন রেস্তোরাঁয় খাওয়া বন্ধ করতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে অপ্রয়োজনীয় শপিং।
প্রতিদিন পাঁচরকম রান্নার আয়োজন না করে মাঝেমধ্যে ভালো কিছু খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করলেও রান্নার গ্যাস এবং রান্নার সামগ্রীর খরচ বাঁচানো যাবে। সেইসঙ্গে, খুব প্রয়োজন না হলে যাতাযাতের জন্য ক্যাব ভাড়া না করে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করলেও প্রতি মাসে অনেক টাকা বাঁচাতে পারবেন। আর কাছাকাছি কোথাও যাওয়ার জন্য সাইকেল ব্যবহার করলে তাও সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে।
স্বাস্থ্য
সবাই জানেন যে, স্বাস্থ্য-ই অন্যতম সম্পদ। শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে জীবনের অনেক সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায় সহজে। তাই, নিয়মিত শরীরচর্চা করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো পুষ্টিকর খাবার খান। শাকসবজি এবং অন্যান্য ফলমূল ইত্যাদি ফাইবারজাতীয় খাবার খেয়ে স্বাস্থ্যরক্ষা করুন। প্রতিদিন পরিমাণ মতো (তিন থেকে চার লিটার) জল পান করুন এবং রাতে অন্তত ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমান।
একটানা মোবাইল ফোন-এ চোখ রাখবেন না কিংবা একটানা ল্যাপটপ-এ বসে কাজ করবেন না, মাঝেমধ্যে হাঁটাচলা করুন। রাতে মশারি টাঙিয়ে শোবেন। ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখুন। বাড়ির আশেপাশে কোথাও জল জমতে দেবেন না কিংবা ময়লা জমিয়ে রাখবেন না।
মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটান এবং মাঝেমধ্যে বাইরে কোথাও সুন্দর জায়গায় বেড়িয়ে আসুন। কোনও কাজ জমিয়ে রাখবেন না। কারণ, কাজ জমিয়ে রাখলে মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। সর্বদা পজিটিভ ভাবুন। কোনও সমস্যায় পড়লে শুভাকাঙ্ক্ষীর সাহায্য এবং পরামর্শ নিন।