কালো পেন

কালীপদবাবু ছাপোষা মানুষ, একটা ছোটোখাটো প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানির চাকরি করেন। বিয়ে করেননি, একা মানুষ। থাকেন বাগবাজারের পৈতৃক বাড়িটাতে আর থাকে এক ঘর ভাড়াটে। শরিকি বিবাদে দীর্ঘদিন বাড়িটাতে কোনও রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। শুধু একটা দিক কোনওমতে এখনও টিকে আছে।

ওর শখের মধ্যে শুধু পুরোনো গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করা। খুঁজে পেতে নানা পুরোনো রেকর্ড কিনে আনেন ওয়েলিংটন, সদর স্ট্রিট বা ফ্রি স্কুল স্ট্রিট থেকে। প্রায় সারাদিনই বাবার আমলের পুরোনো রেকর্ড-প্লেয়ারটায় সেসবই চালান। ভীমসেন যোশী, পাহাড়ী সান্যাল, গীতা দত্ত, পিট সিগার বা পালুসকরের গান তাকে নিয়ে যায় কোনও না-পাওয়া স্বর্গরাজ্যে।

আজ মাসের প্রথম দিন। মাইনে পেয়েই কালীপদবাবু ঠিক করলেন লেনিন সরণিতে একবার ঢু মারবেন জামালউদ্দিনের দোকানে। যদি কিছু মণিমুক্তো পাওয়া যায় কম দামে। দু-তিন হাজার টাকা খরচা করে দুর্লভ অ্যান্টিক রেকর্ড কেনার সামর্থ্য তার নেই। তবু চোখের দেখা। গিয়ে দেখেন জামালের দোকান সেদিন বন্ধ। ওরও বাপ ঠাকুরদার ব্যাবসা। আজকাল সব পেন ড্রাইভ, মোবাইল আর ইউটিউবের যুগ। বিক্রিবাটা প্রায় নেই বললেই চলে। তবুও কী যে মায়া-ভালোবাসা জড়িয়ে আছে পুরোনো দিনের স্মৃতি ঘিরে, ওই জানে, আর জানেন কালীপদবাবু।

যা হোক চলেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা ফ্যান্সি আইটেমের দোকানে চোখ পড়ল রাস্তায়। কত সুন্দর সুন্দর ঘড়ি, শোপিস, সিগারেট কেস, টর্চ, লাইটার, নানারকম বিদেশি জিনিস ধরে থরে সাজানো দেখে, বেশ লোভ লেগে গেল কালীপদবাবুর। একটা পেনের দিকে তার নজর পড়ল, হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হল। চকচকে কালো মেটালিক ফিনিশ, সঙ্গে গোল্ডেন টিপ আর হ্যান্ডেল। কিন্তু যেখানে চোখ আটকে গেল সেটা আর কিছুই নয়, কালোর উপরে গোল্ডেন কালারে খোদাই করা ইংরেজিতে ‘কালি’ নামটা, তার নামের সঙ্গে তো বেশ মিলে যাচ্ছে। হতে পারে কোম্পানির নাম।

দোকানিকে জিজ্ঞেস করতে বলল জাপানি পেন, দেড়শো টাকা দাম। কিন্তু ওই চকচকে কালো রঙের পেন আর ওই স্বর্ণাক্ষরে লেখা ‘কালি’র মোহে ততক্ষণে পড়ে গেছেন কালীপদবাবু। দরদাম আর বেশি না করে, পেনটি পকেটস্থ করলেন। মনটা তার বেশ প্রফুল্ল হয়ে গেল, এতদিনে মনের মতো একটা পেন পেলেন। এমন একটা মহার্ঘ জিনিস যে হঠাৎ করে এইভাবে হস্তগত হয়ে যাবে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি। ঠিক করলেন, এবার থেকে এই পেনটাই সবসময় ব্যবহার করবেন, অফিসের কাজে হোক বা বাড়িতে শখের কবিতা লেখাতেই হোক৷

পাড়ায় ঢুকতেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পুরোনো বন্ধু অনুপের সঙ্গে। “কি রে কালী, কোথায় গেছিলি?’ নিজেই এগিয়ে এসে কথা বলল অনুপ৷

একবার শ’পাঁচেক টাকা ধার নিয়ে আর এ তল্লাট মাড়ায়নি অনুপ, কথাবার্তাও হয়নি দীর্ঘদিন। পথে-ঘাটে দু’একবার দেখা হলেও এড়িয়ে চলত। সেই অনুপই আজ নিজে এসে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা ফেরত দিয়ে দেঁতো হেসে বলল, “কিছু মনে করিস না রে ভাই, সেই কবে থেকে তোকে টাকাটা দেব দেব করেও দেওয়া হয়নি। একটি ফাস্ট ফুডের স্টল দিয়েছি, ভালোই চলছে।”

—তাই নাকি? ভালোই করেছিস, তা আসিস একদিন বাড়িতে। যা দিনকাল পড়েছে। আজ আছি, কাল নেই। বলে এগোলেন কালীপদবাবু।

বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই চমক, একটা বড়োসড়ো খাম এসে পড়ে আছে। খুলে দেখেন, সেই কবে একটা কবিতা পাঠিয়েছিলেন নামী পত্রিকায়। এতদিন কোনও খবরই ছিল না। ভেবেছিলেন হয়তো মনোনীত হয়নি। হঠাৎ সেই পত্রিকাই আজ এতদিন পরে ছেপেছে কবিতাটা। আজকাল ফেসবুকের যুগে বাংলা বই পড়ার লোকজন এত কমে গেলেও, এই পত্রিকাটি ছাপা পত্রিকা বের করছে কষ্ট করে। পত্রিকার সঙ্গে একটা হাজার টাকার চেকও পাঠিয়ে দিয়েছে। পরপর এতগুলো প্রাপ্তিযোগে কালীপদবাবু একেবারে দিশাহারা হয়ে গেলেন। হাওয়ায় যেন তিনি ভাসছিলেন!

বিকেলে ইজিচেয়ারে বসে, তিনি একটা কবিতা লিখে ফেলবেন ঠিক করলেন। মনটা আজ বেশ উড়ু উড়ু। কথারা ঝাঁক বেঁধে আসছে। তার উপর নতুন পেন। পেনটা বের করেই খেয়াল হল, আচ্ছা পেনটা বেশ পয়া তো!

সবে ভাবটা এসেছে, দু-এক লাইন লিখেছেন, তখনই সবিতা আসে চা নিয়ে, সঙ্গে আজ পিঁয়াজি-মুড়ি। ওপাশে ভাড়া থাকে ওরা। সবিতার মা-ই মাঝেমধ্যে বিকেলে চা-টা পাঠিয়ে দেয়। তবে আজকাল এ বাড়ি ও বাড়ি মানুষজনের যাওয়া আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে, সবাই মোবাইলে ব্যস্ত।

—কী রে আজকে দারুণ ব্যাপার যে, দে দে। হঠাৎ পেঁয়াজি ভাজল তোর মা! বলেই ফেলেন তিনি।

—না গো জেঠু, আজ বাবা ফিরেছে না দিল্লি থেকে বোনাস পেয়ে, তাই বাড়ির সবাই খুব খুশি। তোমার ছ’মাসের বাকি বাড়িভাড়াও পাঠিয়ে দিয়েছে মা। এই নাও। বলে একটা খাম বাড়িয়ে দেয় সবিতা।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বাক্যহারা কালীপদবাবু। কী সব হচ্ছে আজকে! এত সব ভালো ভালো ব্যাপার একদিনেই ঘটছে কী করে? তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? চিমটি কাটতে গিয়ে বিস্তর লাগল, বুঝলেন সব সত্যি। সবিতা চলে যেতে তিনি সকাল থেকে হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো পরপর ভাবতে লাগলেন। সবই তার পাওনা ছিল কিন্তু আটকে ছিল। একদিনে সব একসঙ্গে হওয়াটা কি স্রেফ কাকতালীয়? ভাগ্যের চাকা হঠাৎ এইভাবে ঘুরে গেল? কালীপদবাবু আদর করে পেনটায় হাত বোলাতে লাগলেন, সঙ্গে পিঁয়াজিতে কামড়। হঠাৎ দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল।

—কে? বলে গেঞ্জিটা পরে দরজাটা খুলতে গেলেন। ওদিক থেকে কে যেন বলে উঠল ‘মামা, আমি’।

দরজা খুলে দেখেন বড়দির ছেলে সুবিমল। ওদের সঙ্গেই তো শরিকি মামলাটা চলছে। বাড়িটা এতদিন এভাবে পড়ে আছে, না বিক্রি হচ্ছে, না সারানো যাচ্ছে। সেই সুবিমল এই সময়!

—কীরে, কী ব্যাপার? হঠাৎ ?

—না গো মামা। এই এলাম আর কী। অনেকদিন আসা হয় না তো। তা বাড়িটার কী দশা হয়েছে গো? সুবিমল বলে।

—হবে না? কী করব বল।

কোর্ট-কাছারি, মামলাতেই তো সব আটকে আছে, জানিস তো।

—সেই জন্যই তো এলাম মামা। আমরা মামলা তুলে নিয়েছি। এই নাও কোর্টের কাগজ। বাড়ি এখন থেকে তোমার, তুমি যা করার করবে। সুবিমল এক নিঃশ্বাসে বলে কথাগুলো।

—সে কী রে? হঠাৎ কী মনে করে! আয় আয় ঘরে এসে বোস। কালীপদবাবুর গলায় উৎফুল্লতা।

—না গো মামা, ভিতরে আর ঢুকব না। আজ রাতেই ফ্লাইট। জানো, আমার ইউকেতে পোস্টিং হয়ে গেছে। বাবাও মারা গেল, কোর্ট কাছারি করে কী আর হবে! আর এইসব মামলা-মোকদ্দমা ভালো লাগছে না। মা যতদিন বেঁচেছিল, মা-ও তো চায়নি। সুবিমল সব কাগজপত্র দিয়ে চলে গেল।

—এ-ও হয়! এ যে মেঘ না চাইতেই জল। বাড়ির মামলা তাহলে মিটল। এবারে বাড়িটাকে মনের মতো করে সারানো যাবে। তিনিই এখন মালিক, বিক্রিও করে দিতে পারেন, করলে অবশ্য সবাইকে ভাগ দেবেন। অনেকদিন ধরে তেওয়ারি বলে একটা প্রোমোটার ছুঁকছুঁক করছে। তিনি ভালো করেই জানেন এ বাড়ি বিক্রি করলে কোটি খানেকের বেশি টাকা পাওয়া যাবে।

খুশিমনে কালীপদবাবু আবার ইজি চেয়ারটায় এসে বসলেন। সামনে সাদা পাতাটা খোলা আর তার উপর পেনটা রাখা। আর কবিতা লেখা হল না। আলগোছে পেনটাকে হাতে তুলে নেন তিনি, অদ্ভুত তো পেনটা! এটার মধ্যে কি জাদু আছে? কেনার পর থেকেই তো একের পর এক সুখবর! পেনটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকেন কালীপদবাবু।

পরদিন সকালে কাজের মেয়ে কলি বারবার দরজা ধাক্কা দিয়েও কোনও সাড়া পেল না। একা থাকে মানুষটা, কী হল! লোকজন ডেকে আনল সে। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতেই খাটে শোওয়া অবস্থায় কালীপদবাবুকে পাওয়া গেল। শরীরটা প্রাণহীন, ঠান্ডা অথচ মুখে কী সুন্দর একটা হাসির রেখা লেগে আছে।

ডাক্তার এসে দেখে বলল, ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক। মৃত্যুকে যেন তিনি আলিঙ্গন করে নিয়েছেন খুশি মনে, হাসতে হাসতেই। ডান হাতে তখনও মুঠো করে কী একটা ধরা… কলি দেখে একটা কালো পেন। ইভিনিং স্কুলে পড়ে কলি, পেন সে-ও ভালোবাসে। কৌতূহলবশত চুপিচুপি পেনটা নিজের হাতে নিয়ে দেখে ওরই নাম লেখা আছে পেনটাতে ‘কলি’। অদ্ভুত তো! লোভ সামলাতে পারে না কলি। এ মাসের মাইনেটা তো গেল, কলি পেনটা ব্লাউজে গুঁজে বিলাপ করে কেঁদে ওঠে।

ওদিকে ঘরে তখনও লং প্লেয়িং রেকর্ডটা কীসের যেন দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে কেটে গিয়ে, বেজে চলেছে নজরুলের গাওয়া গানখানি ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’।

মিষ্টি গল্প

জানলার কার্নিশে চুপটি করে বসে আছে দিতি। ও বাড়ির ছাদে মিনু বউদির চার বছরের ছেলেটি খেলছে। অন্যদিন দিতি ডেকে ডেকে ওর সাথে কথা বলে। কিরে শুটকি কী করিস, কী খেলিস? ভারি মিষ্টি লাগে শুনতে আধো আধো কথা। আজ দিতি চুপ করেই রইল। ওর মনে আজ অন্য সুর।

কত কী ভেবেছিল! আজকের দিনটি স্পেশাল হবে সবার জন্য! বিশেষ করে কাকাই-এর জন্য একটা সারপ্রাইজ থাকবে, সারপ্রাইজটা পেয়ে কাকাই ওকে জিজ্ঞেস করবে, ‘কী খাবি বল তো দিতি মা!’ দিতি ফস করে বলবে, “আম সন্দেশ, নলেন গুড়ের রসগোল্লা, ফুচকা, আইসক্রিম।’ খুব মজা হবে হই-হুল্লোড় হবে। কিন্তু হিসেব গরমিল হয়ে গেল। কাকাই যে ওর উৎসাহে এমন ভাবে… কাকাই ওর রোল মডেল, অথচ…!

বাবা, মা বাড়িতে কেউ নেই, থাকলেই বা কী হতো! আকাশ পাতাল কত কী ভাবছে দিতি। হঠাৎ হাওয়ায় সরসর করে টেবিলের উপর থেকে পেনটা ঠকাস করে মেঝেতে পড়ল। বড্ড বিরক্ত দিতি। এক লাফে মেঝেতে নেমে কলমটা তুলে প্রায় ছুঁড়ে ড্রয়ারে রেখে দিল। খাতাটাও ড্রয়ারে রেখে দিল। যাহ! সব বাদ, সব বন্ধ! এখন ওর একটাই চিন্তা হবে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কোনওরকমে ঢুকে, ডিগ্রি নিয়ে চাকরি জোগাড় করা। দেয়ালে ওর হাতে আঁকা রোনাল্ডিনহোর মুখ। পেনসিল স্কেচ আঁকা রোনাল্ডিনহোর মুখে মিষ্টি একটা হাসি, একেবারে যেন জীবন্ত। ও এঁকেছিল। কাকাই দেখে অবাক, খুব খুশি হয়ে কাকাই ছবিটাকে বাঁধিয়ে রেখেছে। আরিব্বাস এ মেয়ে তো ভার্সেটাইল জিনিয়াস।

মাকে বলেছিল, ‘বউদি, আমি ওকে গড়েপিটে তুলব। দেখবে দারুণ হবে তোমার মেয়ে, দশের মধ্যে এক।”

অথচ সেই কাকাই! মানুষের কত রূপ, কত পরিবর্তন। মানুষও যেন ক্যামিলিয়ানের মতো রং বদলায়।

ক’দিন ধরেই দিতির মনে খুশির হিল্লোল ছিল তবে কাউকে বুঝতে দেয়নি, জানতে দেয়নি। সারপ্রাইজটা সেইদিনই দেবে ঠিক করে রেখেছিল। ওর লেখা একটি গল্প এক জনপ্রিয় পত্রিকায় ছাপা হবে। সম্পাদকমশাই নিজে ফোন করে জানিয়েছেন, শুনেই খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছে দিতি।

ওহ, এত আনন্দ! এত আনন্দ! এমন একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত পত্রিকা! কাকাইও লিখত। খুব শখ ছিল ওই পত্রিকা কাকা-র লেখা নেবে, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। দিতির এই গল্পটা কাকাই এডিট করেছিল। পড়ে বলেছিল ভারি মিষ্টি গল্পটি। দিতি গল্পটির নাম দে, ‘মিষ্টি গল্প’। সেই মিষ্টি গল্পটিই ছেপে বেরোচ্ছে। কাকাই খুব খুব খুশি হবে।

গতরাতে তো ঘুমই হয়নি দিতির। কখন যে সকাল হবে! একটু চোখ লাগতে না লাগতেই ঘুম ভেঙে যায়। বারান্দায় যাচ্ছে আর আসছে। ঘর বার করছে, কখন পেপার দাদু আসবে! সাত সকালে টিং টিং বেল বাজতেই ছুটে এসেছে,

—বইটা এনেছ পেপার দাদু?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার জিনিস ভুলি কী করে দিদি? সেই হিম্মত কি আমার আছে!

পেপারের সাথে পত্রিকাটি হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ময়ূরের মতো কিছুক্ষণ নেচে নিল। খুলে নিজের লেখাটির উপর হাত বোলাল। দুই পাতার ‘মিষ্টি গল্প’। বাহ, কেমন সুন্দর ছবি দিয়েছে। মন ভরে গেল। আনন্দে উত্তেজনায় বুকের ভিতর ধুকপুকুনিটা বেড়েই চলছে। বই বুকে জড়িয়ে দে ছুট দোতলায় কাকাইয়ের ঘরে। ঘরের সামনে এসে থমকে গেল, দরজা বন্ধ। ঘুমোচ্ছে? ডেকে তোলা ঠিক হবে না। কাল অনেক রাত পর্যন্ত এই ঘরে লাইট জ্বালানো ছিল। কাকাই অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে, কাম্মা অবশ্য ঘুমিয়ে পড়ে। থাকুক ডেকে কাজ নেই, বরং ঘরে গিয়ে অন্য লেখাগুলো দেখা যাক৷ ভালো করে পড়া যাক।

ঘরে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল দিতি। অনেকগুলো গল্প প্রবন্ধ কবিতা! হঠাৎ কান্নার ডাকে হুশ ফিরল,

—কিরে ন’টা যে বেজে গেল কখন উঠবি? আজ এত দেরি কেন রে? কলেজ ছুটি তাই?

হুড়মুড় করে উঠে বসল দিতি। সত্যি অনেক বেলা হয়ে গেল। বইটা দেখতে দেখতে ঘুমিয়েই পড়েছিল।

–কাম্মা, কাকাই উঠেছে?

—উঠেছে মানে! বাজার করে পর্যন্ত ফিরে এসেছে। একটু আগে তোর মায়ের ফোন এসেছিল, ওরা খুব ভালো আছে আর খুব ঘুরছে।

বইটা বুকে চেপে ছুট লাগাল। কাম্মা চিৎকার করে উঠল, “ওরে পাগলি ধীরে ধীরে, পড়বি তো! দেখিস যেন হাত পা না ভাঙে।’ একদমে ছুটে এসে কাকাই-এর সামনে দাঁড়াল। দুই হাতে বুকের উপর বইটা পরম সোহাগে জড়ানো। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ কাকাইয়ের দিকে। চোখে পলক পড়ে না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। কাকাই কী বলবে এবার! দারুণ সারপ্রাইজ! ফিস ফিস করে বলল, “কাকাই সেই, মিষ্টি গল্প দেখো পত্রিকায়…।’ কাকাই কেমন যেন ভাবলেশহীন।

—কিছু বলবি? কী হয়েছে?

—সেই মিষ্টি গল্প। তুমি এডিট করেছিলে। দেখো ছবিটাও কেমন মিষ্টি। তোমার প্রিয় পত্রিকায় আজ বেরিয়েছে।

—তাই নাকি। আচ্ছা। বেশ।

—কখন পড়বে কাকাই?

—আজ খুব ব্যস্ত আছি রে মা। রেখে দে টেবিলে, পরে দেখব।

—তোমার সবচাইতে প্রিয় পত্রিকা কাকাই।

—হ্যাঁ আগে খুব পড়তাম, এখন আর সে মান নেই। এখন লেখাগুলো আগের মতো ধারালো নয়, শাঁসালো নয়। যা পায় তাই ছাপে। রেখে দে, রেখে দে, পরে দেখব।

দিতির দুই চোখের উজ্জ্বল দ্যুতি হঠাৎ নিভে গেল। একেবারে কেমন পালটি খেল কাকাই! ওর উৎসাহে এমন ভাবে জল ঢেলে দিল! ওর লেখার মান নেই! যেই না ওর লেখা বেরোল সেই সঙ্গে পত্রিকার মান নেমে গেল! ধোপা যেমন পাথরে কাপড় বাড়ি মারে ঠিক তেমনই ওর বুকে কেউ যেন ঠাস ঠাস করে মারল। এত কান্না পাচ্ছে, পা আর সরছে না।

নিজের ঘরে এসে বসল, খুব কান্না পাচ্ছে। দু’ফোঁটা জল গড়িয়েই পড়ল, আটকাতে পারল না দিতি। এত আনন্দ, উত্তেজনা, এক ফুৎকারে একেবারে নিভে গেল। অথচ কাকাই …! বাবা-মাকে জানায়নি এখনও দিতি। আর জানাবেও না। কী হবে! মা তো বলেই বসবে, “লিখে কি আর তোমার পেট ভরবে? মন দিয়ে পড়াশোনা করো। ভালো নম্বরে ভালো চাকরি। এখন এসব শখ ছাড়ো। লিখে পেট ভরবে না।’

মা একেবারে মিছে অবশ্য বলে না। ঠিকই, রোজগার তো করতেই হবে নইলে উদরপূর্তি হবে কী করে? সবাই কেবল উদরপূর্তির কথাই ভাবে। মনের ফুর্তির কথা কেউ ভাবে না। একজন লেখকই জানে লিখে তার কতটা মনের ফুর্তি হয়। সেটির কি কোনও দাম নেই! ঠিকই, লেখক-এর যেন কোনও পাত্তাই নেই! এক একটি লেখার পিছনে এত এত পরিশ্রম থাকে অথচ কারও হুঁশ নেই, সবার-ই টাকার চিন্তা। কত পেলে? যখন শোনে খুবই সামান্য কিংবা কিছুই হয়তো পায় না, তখন বলতে তাদের মুখে এতটুকু বাধে না— তবে তো এ সবই ভুতের বেগার খাটা, নাই কাজ তো খই ভাজ। লেখা যেন সহজলভ্য জল-ভাতের মতো হয়ে দাঁড়ায়।

আজ মনে অনেক উথাল-পাথাল হচ্ছে। ভাবছে লেখাটা ছেড়েই দেবে। কিন্তু ছেড়ে দিতে চাইলেই কি আর ছেড়ে দেওয়া যায়? এ তো দমকা হওয়ার মতো মনের ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ছুটে আসে। কেউ কি আটকাতে পারে নাকি আটকানো যায়? না আটকানো উচিত? জোর করে বন্ধ করা মানে, লেখক সত্তাকে গলা টিপে হত্যা করা। একটি সুস্থ মানুষের সুচিন্তিত সুস্থ ভাবুক মন পঙ্গু করে দেওয়া।

সারাটা দিন বড়ো ম্যাড়মেড়ে কাটল। সন্ধের আগে একটু বেরোল দিতি। একাই চক্কর কেটে এল খানিকক্ষণ। বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মণিদা আর লিনি পিসির সাথে দেখা হল। কাউকেই ওর লেখার কথা কিছু বলল না। কাকাই-এর কাছ থেকে এত বড়ো আঘাত পাওয়ার পর আর ওর মুখে রা-টি নেই। মন ভেঙে গেছে, বড়ো হতাশ লাগছে। সন্ধের পর ছাদে মাধবীলতার পাশটিতে গিয়ে দাঁড়াল। চারিদিকে গভীর অন্ধকার। মাধবীলতার দিকে খানিক তাকিয়ে রইল, একটু হাত বুলিয়ে দিল সোহাগে। আহারে এই মাধবীলতা ওর গল্পে বেশ কয়েকবার উঠে এসেছে, কত ভাবে বর্ণনা করেছে। ওরও কপাল মন্দ। ভেবেছিল মাধবীলতাকে গল্পে বাঁচিয়ে রাখবে, ওর প্রিয় গাছ।

দুই চোখে জল টলটল করছে এমন সময় কান্নার কথা কানে এল। পাশেই কাকাই-এর ঘর। দিতি মোটেই আড়ি পাতেনি, আড়ি পাতা ওর স্বভাব নয়। তবে কথাগুলো স্পষ্ট ওর কানে বাতাসের সাথে ভেসে এল।

কাম্মা বলছে, “কী গো তুমি মেয়েটাকে অমন আঘাত দিলে কেন? সারাদিন মনমরা হয়েছিল? ঠিক যেন চাবুকের বাড়ি মেরেছ। এত আনন্দ নিয়ে এসেছিল! মনটাই খারাপ করিয়ে দিলে।’

—গিন্নি, জানো তো ঘোড়াকে চাবুক মারতে হয়। শুধু চাবুক নয়, যোদ্ধাদের পায়ের জুতোর সামনে লোহার একটা ভোঁতা পেরেক থাকে। দরকারে ওটা দিয়ে মারে।

—সেই তো! কেন যে এত নিষ্ঠুরতা!

—গিন্নি, ঘোড়াকে যত চাবুক মারবে, যত আঘাত করবে, তত ছুটবে। তত সে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছোবে এবং পৌঁছোতে পারে। নইলে ঘোড়া বিন্দাস হাওয়া খেতে খেতে এলোমেলো ঘুরতে থাকে।

—তার সাথে এর কী সম্পর্ক?

—আরে বাবা তুমি উকিলের বউ হয়েও কিছুই বুঝলে না। এখনই যদি দিতি-কে অনেক বাহবা দিই, “দারুণ’, ‘দারুণ’ বলি, ওর লেখার মান একই জায়গায় থেমে থাকবে। ও বেশি দূর এগোতে পারবে না। ও অতটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকবে।

—তাই বলে…!

—হ্যাঁ, তাই এমন আঘাত দিলাম। দেখবে ওর জেদ আরও বাড়বে, এই আঘাতই ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। তুমি কী ভেবেছ? গতকাল রাতেই আমি পত্রিকাটি কিনে এনে বারে বারে পড়েছি। চমৎকার লিখেছে আমার দিতি। যেমন শব্দ চয়ন, তেমনই সহজ সরল, তেমনই আবেগ। দারুণ দারুণ দারুণ, অফিসে সবাইকে দেখালাম। গর্বে আমার বুক ভরে উঠেছে। ওর গল্পগুলো যেন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সহজ সরল মিষ্টি গল্প।

—কিন্তু ও কি বুঝবে! দিতি কিন্তু ভারী অভিমানী। পরে যদি সেই অভিমানটাই মনে ধরে বসে থাকে!

—আরে দাঁড়াও না, দু’দিন দেখি। পরে ঠিক আমি ওকে বুঝিয়ে বলব। তুমি চিন্তা কোরো না। দিতি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।

মাধবীলতার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিতির হঠাৎ আকাশ সমান আনন্দ হল। মনটা ভালো হয়ে গেল। উফ দারুণ খুশি। মাধবীলতাকে আরেকবার ছুঁয়ে নিল। ছুটে নিজের ঘরে পা বাড়াতেই, উহ মাগো। ওর লম্বা একগুচ্ছ কালো চুল মাধবীলতায় পেঁচিয়ে গেছে। দিতির লেখক মন বুঝে নিল মাধবীলতাও মনের আনন্দে ওকে পেঁচিয়ে ধরেছে। কোনওরকমে চুল ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘরে এল। উত্তেজনায় থরথর! কী করবে! কাকাই-কে আজ আরেকবার নতুন করে জানল, নতুন করে চিনল, আরও যেন শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

টেবিলের ড্রয়ারের ফাঁক দিয়ে কলমটা উঁকি দিচ্ছে, ওর প্রিয় অস্ত্র। হাতে চেপে ধরল, কলমটায় চুমু খেল। লিখবে ও আবার লিখবে, অনেক অনেক লিখবে। নিজের মনকে উজাড় করে দেবে। ভরে উঠবে সাদা কাগজ একের পর এক। কিন্তু কী লিখবে! আচ্ছা আজকের এই হাসি-কান্না ভরা খুশির দিনটাই না হয় লেখা যাক, মিষ্টি একটা গল্প হবে।

অনুসন্ধান এবং…

কালো রংয়ের পালিশ দরজায় সোনালি নেমপ্লেট। বিজয় পাণিগ্রাহী। তার নীচে সবিতা পাণিগ্রাহী। আর একবার নিজের মনের প্রস্তুতিটা সেরে নিল নীলমণি পরিদা। কলিংবেলে তর্জনী রাখতেই পাখি ডাকার শব্দ ভেসে এল বাইরে।

—আপনাকে ঠিক চিনলাম না। যদি নামটা বলেন…

—আমি নীলমণি পরিদা। আগন্তুক বটে, কিন্তু আততায়ী কিংবা প্রতারক নই।

—আরে না না, আপনি ওসব কেন হতে যাবেন। তাছাড়া বেলা এগারোটার সময় আবাসনের সিকিউরিটি চেক টপকে ওসব লোকেদের আসার কোনও প্রশ্নই নেই। আসুন ভিতরে আসুন। সবিতা পাণিগ্রাহী নীলমণি পরিদাকে আহ্বান জানালেন। থ্যাঙ্ক ইউ। আসলে আমি এসেছি আমার নিজের একটা প্রয়োজনে।

—আশ্চর্য, আমার কাছে আবার কীসের প্রয়োজন? আপনি জল খাবেন?

—হ্যাঁ, তা একটু খেতে পারি। ভদ্রমহিলা ঘরে যেতেই নীলুর চোখ চলে গেল দেয়ালে অয়েল পেইন্টিং-এর দিকে। ঠিক এইরকম একটা পেইন্টিং মাস চারেক আগে অলকানন্দা এনেছে।

—এই নিন জল।

আধ গেলাস জল খাওয়ার পর রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিল নীলু পরিদা।

—পেইন্টিংটা খুব সুন্দর।

—হ্যাঁ, ওটা আমার স্বামী প্রায় মাসচারেক আগে দিল্লির একটা এক্সিবিশন থেকে কিনে এনেছেন। ঘর সাজানোর জিনিস সাধারণত আমিই কিনে থাকি। জীবনে এই প্রথম তিনি এই শৌখিন কাজটা করলেন। ভালোই লেগেছে তাঁর পছন্দটা। আপনি কী একটা বলছিলেন নিজের প্রয়োজনের কথা ।

—আসলে আমার স্ত্রী অলকানন্দা আর আপনার স্বামী একই কোম্পানিতে কাজ করেন। তাই কিছু কথা বলতে এসেছি। বিজয়বাবু নিশ্চয়ই অফিসে গেছেন?

—না, কোম্পানির কাজে বাইরে মানে কানপুরে গেছেন তিনদিন আগে। পরশু ফিরবেন।

—জানেন অলকানন্দাকেও ঠিক তিনদিন আগেই কোম্পানি তার কাজে ট্যুরে পাঠিয়েছে। আর ওরও পরশু ফেরার কথা। কি আশ্চর্য তাই না?

—এতে আশ্চর্যের কী আছে? দু’জনেই হয়তো একই প্রোজেক্টে আছে। তাই…

—সে হতে পারে। আমি কিন্তু সিওর নই যে প্রোজেক্টটা পাঁচদিনেরই।

—আপনি কী বলতে চাইছেন?

—আমি শুধু অনুমান করছি। নাও হতে পারে। আজকাল আমার স্ত্রী সব কথা সঠিক বলে না। এমনকী জায়গার নামও ভুল বলে। এই তো মাসছয়েক আগে ভুবনেশ্বর যাওয়ার নাম করে বেরিয়েছিল। কিন্তু সে ভুবনেশ্বর যায়নি।

—আপনি তো আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করছেন। কী করে বুঝলেন যে, উনি ভুবনেশ্বর না গিয়ে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন?

—তাহলে শুনুন, ও ভুবনেশ্বর থেকে একটা শাড়ি কিনে এনেছিল। ভুল করে শাড়িটা আমার জামাকাপড়ের তাকে রেখেছিল। অবশ্য প্যাকেট ছাড়াই। শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ি। আচ্ছা বলুন তো, ভুবনেশ্বরে তাঁতের শাড়ি কেউ কেনে?

—এখানে আমার স্বামীর ভূমিকা কোথায়?

—আপনার স্বামী হয়তো তাঁতের কিংবা গরদের শাড়ি ভালোবাসেন। কিন্তু আপনার হয়তো সিল্ক, জর্জেট শাড়ি ভালো লাগে। তাছাড়া আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে,আপনি শাড়ির পরিবর্তে সালোয়ার কামিজ কিংবা জিন্স টপেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ।

—কোনও কিছুর বিনিময়েই আমি আমার স্বাধীনতা ছাড়তে রাজি নই। আমি আমার পছন্দ নিয়ে থাকতেই ভালোবাসি। কারও পছন্দ মতো চলব কেন?

—জানেন, আমার স্ত্রী-কে আমি ‘অলকা’ নামেই ডাকি, কিন্তু ও কখনও আমার পছন্দের মূল্য দেয়নি। একসময় স্মিতা পাতিল ছিলেন আমার প্রিয় নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর মার্জিত পোশাক আর বাইরের একটা পেলব আবরণ আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করত। একবার আমি আমার পছন্দের হালকা নীল রঙের সম্বলপুরী তাঁতের শাড়ি এনেছিলাম। সেই শাড়ি একদিনও ওকে পরতে দেখিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই আটমাস যাবৎ ও তাঁত কিংবা সুতির শাড়ি পরা ধরেছে। এখন আর চলাফেরা করতে কোনও অসুবিধা হয় না।

—তাহলে তো বলতে হয়, উনি দেরিতে হলেও আপনার পছন্দের সম্মান আর মর্যাদা দিচ্ছেন। কী বলেন?

—না, আমার মনে হয় ওর এই পরিবর্তনের পিছনে অন্য কারও উৎসাহ কিংবা পছন্দ আছে।

—আচ্ছা, এখন আপনার স্বামী নিশ্চয়ই খুব কম কথা বলেন, তাই না? আগের মতো ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে কথায় কথায় ঝগড়াও করেন না।

হয়তো কাজের চাপ আছে তাই। দেখি তো, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর এক কাপ কোল্ড কফি নিয়ে ল্যাপটপে কাজ সারেন অনেক রাত পর্যন্ত।

—এই অভ্যাসটা কি ওনার বরাবরের?

—না, এই অভ্যাসের বয়স ছয় থেকে আট মাস হবে। কেন বলুন তো? আপনি তো দেখছি, সিআইডি সিরিয়ালের এসিপি প্রদ্যুম্ন স্যারের মতো জেরা করছেন।

—আসলে আমি আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ জোগাড় করতে চাইছি। অলকানন্দা বরাবর রাতে শোওয়ার আগে কোল্ড কফি খায়। এই নিয়ে আমার সঙ্গে প্রথমদিকে অনেক কথা কাটাকাটি হতো।

—এখনও হয়?

একদম না। আপনার স্বামীর কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত অলকা আমাকেও মেনে নিয়েছিল। আমি সুগার মিলের একজন সাধারণ কর্মী। মাস গেলে স্যালারি আর বছরে একটা করে ইনক্রিমেন্ট— এই হল আমার স্ট্যাটাস। আপনার স্বামীর সঙ্গে পরিচয়ের পর ও যেন খাঁচা ভেঙে উড়তে চাইল। এখন আর এসব নিয়ে ভাবি না। না, আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন, আমার যেটুকু জানার ছিল জেনে নিয়েছি। এখন আমি উঠব।

—যাওয়ার আগে আমি একটা কথা জানতে চাইছি, আপনি কি এই সম্পর্ক ভেঙে দিতে চান?

—গায়ের জোরে কোনও সম্পর্ক বিশেষ করে বিবাহিত জীবনের, ধরে রাখা সম্পূর্ণ অর্থহীন।

—আর একবার ভেবে দেখলে হয় না?

—প্রশ্নই ওঠে না।

—যাওয়ার আগে আমার কিছু কথা শুনবেন না?

—আপনার কাছ থেকে কিছু শোনার জন্যই তো এতগুলো কথা বললাম।

—আপনি এতক্ষণ ধরে আমার স্বামী আর আপনার স্ত্রীকে জড়িয়ে যে কথাগুলো বললেন, তার সবটাই সত্যি। বছরখানেক আগেই আমি বুঝেছি, বিজয় আর আমার কাছে নেই। অনেক দূরে সরে গেছে। আপনি পুরুষ মানুষ, আপনার পক্ষে যে-কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যতটা সহজ, আমাদের মেয়েদের একটু ভাবতে হয়। তাছাড়া আমাদের ছেলেটা বড্ড ছোটো। ও বাবাকে খুব ভালোবাসে। এখন যদি আমি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাই, তাহলে ওর মনের উপর ভীষণ চাপ পড়বে। এতদিন আমি মেয়েটার নামধাম, পরিচয় এসব কিছুই জানতাম না। অফিসে গিয়ে অনুসন্ধান করতে নিজের আত্মসম্মানবোধে লেগেছিল। বাইরের কারও কাছে হেয় হতে কার ভালো লাগে? কী আশ্চর্য, আজ আপনি যেচে তার সন্ধান আনলেন। মিস্টার পরিদা, আজ আপনি আমার বড়ো উপকার করলেন। এতক্ষণ পর সবিতা পাণিগ্রাহীর ঝলমলে মুখের উপর ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ল। বুকের ভিতর এতদিনের জমে থাকা মেঘগুলো এইবার বুঝি ঝরে পড়বে তার অস্তিত্বের উঠোনে, কার্নিশে আর ব্যালকনিতে।

পাত্রপক্ষ

পিসিমা হাই সুগারের রুগি, তাই মিষ্টি খাওয়া একেবারে মানা। এটা শুনে পাত্রীর বাবা দৌড়ে গিয়ে পাড়ার হরি ময়রার দোকানের বিখ্যাত হিংয়ের কচুরী নিয়ে এলেন। লোভে পড়ে পিসিমার দ্বারা গোটা পাঁচেক কচুরী সাবাড়। আর তারপরই শুরু হল পিসিমার পেটে মোচড় দেওয়া। সে ভয়ংকর মোচড়, কোনও বাধা মানতে চায় না। পিসিমা প্রমাদ গুনলেন।

পিঠ সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের বাথরুমটা কোথায় দেখান। আর একটা গামছা দেন আমারে।” পিসিমার ভাইঝি অর্থাৎ আমার শ্যালিকা পিসিমার এই কাণ্ড দেখে লজ্জায় মরে যায় আর কী। এরপর ওই বিবাহের প্রস্তাবের গাড়ি সে যে কারণেই হোক বেশি দূর এগোয়নি। শ্যালিকাও পিসিমার সাথে আর কোনও পাত্রী দেখতে যায়নি।

আমার এক খুড়শ্বশুর ভীষণ রসিক মানুষ। এবার শোনাই ওনার মুখে শোনা গল্প। আগেকার দিনে কিছু ছেলে থাকত ভীষণ লাজুক। বাবা মাকে বলত, ‘মেয়ে তোমরাই দেখে পছন্দ করো। আমার যাওয়ার দরকার নেই।”

জলপাইগুড়িতে এরকমই একটি ছেলে আমার খুড়শ্বশুরের বন্ধু, তার সম্বন্ধ এল জলপাইগুড়ির এক বিত্তশালী পরিবার থেকে। ছেলেটি দিল্লিতে চাকরি করে। বাড়িতে আসবে বিয়ের আগে। বাবা, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে গিয়ে প্রচুর ধারদেনা করেছেন। দেনা তখনও সব মিটিয়ে উঠতে পারেননি। ছেলে এসে বিয়ের আগে বন্ধুদের আড্ডাতে পৌঁছল। বন্ধুদের মধ্যে ফিসফিসানি! এক বন্ধু বলেই ফেলল, “হ্যাঁ রে তুই মেয়ে দেখেছিস!”

ছেলে বলল, “ওসব বাবা-মা সেরেছেন। ওনাদের পছন্দ ই আমার পছন্দ।”

এরপর ছেলে বহুবন্ধু পরিবৃত হয়ে টোপর পরে ছাদনাতলায় উপস্থিত হল। কনে এল পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে জামাইবাবুদের ধরা পিঁড়িতে চড়ে। ঘনিয়ে এল শুভদৃষ্টির সময়। মুখের সামনে থেকে হাতের পান সরল। ছেলে অতি আকাঙ্ক্ষিত দর্শনের পরই আমার খুড়শ্বশুরের কাঁধে মাথা দিয়ে জ্ঞান হারাল।

কনের সামনের দিকের তিনটি দাঁত বিসদৃশ ভাবে উঁচু হয়ে ছিল। তখনকার দিনে উঁচু দাঁত নীচু করে স্বাভাবিক করার চিকিৎসা আসেনি। সব শোনার পর খুড়শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তারপর।ত

উনি বললেন, ‘তারপর আর কী! জ্ঞান ফিরতে ওই বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরেছিল। বিয়ের জন্য মেয়ের বাবার থেকে অনেক টাকা পণ নিয়েছিলেন ছেলের বাবা। ধমকে ছেলেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসালেন।”

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর!’

শ্বশুরমশাই বললেন, ‘তারপর আর কী, তিনটে বাচ্চা হল। সব ঠিক হয়ে গেল।”

এর বেশি আর ‘তারপর শ্বশুরমশাইকে জিজ্ঞেস করা যায় না। তার উপর রসিকবাচন পারদর্শী শ্বশুরমশাই।

এক আত্মীয়র আন্দামানে মারাঠি মেয়ের সাথে প্রেম হয়। মেয়েটি বাংলা ভাষা খুব তাড়াতাড়ি ভালোরকম শিখে ফেলে। এতে অবশ্য তার বাঙালি প্রেমিকেরও অবদান ছিল। বিয়ের আগে মেয়ের বাড়িতে এসে মেয়েটির ভবিষ্যতের নন্দাই মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘গুঁতোর মানে জানেন’

স্মার্ট উত্তর দেয়, ‘একটু এদিকে আসলেই বুঝিয়ে দিতে পারব।’

নন্দাইমশাই উত্তর দেন, ‘যাওয়ার দরকার নেই, বুঝেছি বাংলা শেখা অনেক দূর এগিয়েছে।”

মেয়ে দেখতে আসার আগে কমজোর মেয়েদের আগে ভালো করে ট্রেনিং দেওয়া হতো। প্রথম সতর্কবাণী, বেশি কথা বলবে না। দ্বিতীয় সতর্কবাণী, আজ অন্তত লাজুক ভাবে বসে থাকবে। তৃতীয় সতর্কবাণী, গুরুজন সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। ঠাকুমার মুখে শুনেছি কোনও একটি মেয়েকে পছন্দ হওয়ার পর সম্বন্ধ ভেঙে যায়। কারণ বেরনোর সময় মেয়েটির কথায় নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ হওয়াতে।

মেয়েটি দরজায় দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে বলেছিল, ‘এখানে সম্বন্ধ পাকা না হলেও আপনারা আবার আসবেন।’ কথাটা খারাপ কিছুই বলেনি, লোকজন খারাপ ভাবে নিয়ে নেয়।

আর আরেক জায়গায় পাত্রী অতিরিক্ত মাথা নীচু করে প্রণাম করতে করতে পাত্রপক্ষের সাথে বসে থাকা নিজের ছোটো বোনকেও প্রণাম করে ফেলেছিল।

আমার এক পরিচিতা সাত তাড়াতাড়ি বিয়ের পিড়িতে বসবে না বলে জেদ করে কোনও মেক-আপ ছাড়াই, হাওয়াই চটি পরে, গায়ে কালো শাল জড়িয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গিমাতে পাত্রপক্ষের সামনে এসে বসে। সেই পরিচিতা যথেষ্ট সুন্দরী এবং ভালো মনের মেয়ে ছিল। জহুরির চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে। পাত্র বাবা-মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই মেয়েকে ওখানেই পছন্দ করে জানিয়ে দেয়। পরবর্তী জীবনে শ্বশুরবাড়িতে পুরো পরিবারের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠে মেয়েটি।

আগেকার দিনে মেয়ে গান গাইতে জানে কিনা সেটা সবচেয়ে আগে জিজ্ঞেস করা হতো। একটু আধটু গান গাইতে জানলেই চলত। মোটা মেয়ে হলে গান ধরত— আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে… আর তারপর আমার এই দেহ খানি তুলে ধর…।

আর কালো মেয়ে গাইত আপনারা ভাবছেন— কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, মোটেই না। আগ বাড়িয়ে নিজের উইক পয়েন্টের ঢাক কেউ পেটায় নাকি?

একটু বিনয়ী কালো মেয়েরা গাইত— তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে/ তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে। অর্থাৎ আমি যেরকমই দেখতে হই না কেন, তুমি তোমার অন্তরের মহানুভবতা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।

আবার একটু উদ্ধত কালো মেয়েরা গাইত — আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব / আমি হাত দিয়ে দ্বার খোলাব না, গান দিয়ে দ্বার খোলাব।

শেষ করি একটি মিষ্টি প্রেমের মিষ্টি পরিণতি দিয়ে। একই পাড়াতে থাকত একটি সুদর্শন ছেলে এবং অতি সুন্দরী একটি মেয়ে। দুজনেরই দু’জনকে খুব ভালো লাগত। আসতে যেতে একজন আরেকজনের দিকে না তাকিয়ে পারত না। দু’জনে সমবয়সি ছিল। ছেলেটি ভীষণ লাজুক, মেয়েটিকে গুছিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটির সম্বন্ধ দেখে দিল্লিতে বিয়ে হয়ে গেল।

এরপর কর্মসূত্রে ছেলেটিও দিল্লি চলে যায়। সংসার হয় এবং পাকাপাকি ভাবে দিল্লিবাসী হয়ে যায়। এর অনেক দিন পর নিজের বিবাহযোগ্য ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে দিল্লিতে সেই মেয়েটির বাড়িতেই পৌঁছোয় ছেলেটি পাত্রর বাবা হয়ে। আর পাত্রী ছিল অল্প বয়সের প্রেম নিবেদন করতে না পারা সেই মেয়েটিরই কন্যা। এক দেখাতেই বিয়ে পাকা।

সবার আগে লাফিয়ে পড়ে ছেলের বাবা মেয়ে পছন্দ হওয়ার সম্মতি জানিয়ে দিল। দুজনেই সযত্নে এড়িয়ে গেল নিজেদের পূর্ব পরিচয়ের ঠিকানা। আইনি জীবনসঙ্গী হিসেবে জীবনে পাওয়ার প্রাপ্তি অপূর্ণ থাকলেও, ‘বেয়াইন’ হিসেবে প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার প্রাপ্তির মূল্য কম কীসে?

সম্বন্ধ বিভ্রাট

আজকাল ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে মানুষ নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। যারা নিজেরা ঠিক করে নিচ্ছে, সেই ছেলেমেয়েদের গল্প এখানে নয়। এখানে তাদের নিয়ে গল্প যারা সুবোধ ছেলে বা মেয়েটির মতো পাত্রী বা পাত্র নির্বাচনের দায় বাবা-মার হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

সম্বন্ধ আনা এবং বিয়ে করিয়ে দেওয়া কাজটি বড়োই কঠিন। সফল হলেও একটা কিন্তু লোক লাগিয়েই দেবে। আর বিফল হলে তার গুষ্টির তুষ্টি একদিন দু’দিন নয়, দীর্ঘদিন চলবে। আজকাল এই কাজটা কিছু ব্যবসায়ী সংস্থা হাতে নিয়েছে। তাতে হতাশ হয়ে ফিরে আসার লাইন অবশ্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

আগেকার দিনে ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে পাত্রের বাড়ির থেকে দল বেঁধে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতো। এটা ছিল এক সম্মানজনক প্রতিনিধিত্ব। মনে যাই থাকুক না কেন ভাবটা থাকত- – মশাই আপনার ঘাড়ের বোঝা কমাতে এলাম, নির্ভর করছে আপনার কৃতকর্মের উপর। তাতে ছেলের বাবা-মা ছাড়া থাকত পরিবারের বা বন্ধুবর্গের মধ্যের একজন বিচক্ষণ ব্যাক্তি।

গুষ্টিশুদ্ধ নিয়ে এসেও নীতিবাগীশ পাত্রপক্ষের বয়ঃজ্যেষ্ঠর কড়া নির্দেশ আসত— কন্যা পছন্দ না হলে সেই বাড়ির অন্ন ধ্বংস করা অনুচিত হবে। কিন্তু এটা ভুলে যেত পাড়ার মিষ্টির দোকানদার, মিষ্টি আর ফেরত নেবে না। সব ক্ষেত্রে এই আদেশ অবশ্য কার্যকারী হতো না। বিশেষ করে খাদ্যরসিক পেটমোটা পিসেমশাই যদি থাকতেন।

মেয়ে পাত্রপক্ষের পছন্দ হলে, সবচেয়ে আগে বদলে যেত পাত্রীর বাবার শারীরিক ভঙ্গিভাবটা, খুব সস্তায় ভালো মাল ছেড়ে দেওয়া ব্যাপারীর মতন।

আমার মা যেচে পড়ে অনেক সমাজসেবা করতেন। প্রায়ই আবেগমথিত হয়ে পরোপকারিকতার ভূত মাথায় চাগাড় দিত। পাড়ার এক অতি ফোঁড়ে লোক কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে যেতেন, আর তার খেসারত দিতেন ওনার স্ত্রী। বেচারিকে প্রচুর টিউশন পড়িয়ে কোনওমতে সংসারের হাল ধরতে হতো। ঘরে চার চারটি অবিবাহিত মেয়ে। খুব নিরীহ এক পুরোহিতমশাই আসেন তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য বড়ো মেয়েটিকে নির্বাচন করতে। সমাজসেবার অঙ্গ হিসেবে আমার মা সম্বন্ধটা এনেছিলেন।

মাড়োয়ারিদের বাড়িতে জজমানি করে পুরোহিতমশাই ভালোই উপার্জন করেন। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে নিজের সাদামাটা পাকা বাড়িতে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। পত্নি অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। ছেলেকে কাপড়ের দোকান খুলে দিয়েছেন বেহালা চৌরাস্তায়। মেয়েটি ক্লাস সিক্সের বেড়াও ডিঙোতে পারেনি। দেখতেও সাদামাটা, তবে মনটা খুব ভালো। এর আগে অনেক সম্বন্ধ এসেছে ও গেছে। এহেন পাত্রীকে ছেলের বউ হিসাবে পছন্দ করার পর পুরোহিতমশাই যারপরনাই বিপদের সামনে পড়লেন।

পাত্রীর বাবা হঠাৎ করে তাঁকে ইংরেজিতে ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করেন। বেচারা পুরোহিত তখন সবে পাত্রী নির্বাচন করে রসগোল্লার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। রসগোল্লা হাতে নিয়ে তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাত্রীর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি করলেন, ‘আপনি কী কন বুঝি না আমি।’ আমার মাতৃদেবী দেখলেন হাতে পাওয়া সাফল্য ছিটকে গেল বলে! সাকসেস রেট নীচে চলে যাবে… ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি সামলে দিয়ে ডিল পাকা করলেন।

আমার এক পিসি ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে ছেলের উপর রাগ করে উঠে এসেছিলেন এই বলে, “তুই এক কাজ কর একটা বরমালা এনে এখনই পরিয়ে দে, আমি চললাম।’

ভাইটি খুব অল্প বয়সে চাকরি নিয়ে বাইরে যায়, হাত পুড়িয়ে খায়। বেচারার আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছিল না। না পারত সন্ধ্যাবেলার পার্টিতে বসতে। চাকরি পাওয়ার আট বছর বাদে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ভাইটির মা দু’বছর ধরে ছত্রিশটি পাত্রী দেখেছেন, আর সব ক’টা না করার অকাট্য যুক্তি দিয়ে সম্বন্ধ বানচাল করেছেন।

এই প্রথম ভাইটি নিজে গেছিল দেখতে। পাত্রী দেখতে ভালো, বাড়িঘর ভালো, পড়াশোনাতেও মন্দ নয়। আট মাস বাদে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। আর এইখানেতেই বাঁধল মুশকিল।

মা বললেন, ‘পরীক্ষাটা দিয়ে পাস করে নিক, তারপরে পাকা কথা হবে।’ ছেলে দেখল সমূহ বিপদ, আবার একটা অজুহাত মা পেয়ে গেছে।

ছেলের মাসি মেয়ে দেখতে এসে ছেলেকে আড়ালে ডেকে বলেছিলেন, “শোনো বাবু, যদি সারাজীবন ব্যাচেলর না থাকতে চাও, নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজেই নিও।’

বাবু ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘পরীক্ষা হতে এখন অনেক দেরি। বিয়ের পর অনেক সময় পাবে।’ ব্যস, এতেই আগুনে ঘি পড়ল।

—আমি থাকতে এত বড়ো কথা। তোর বিয়ে তুই কর, বলে আমার পিসি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যান। বিয়ে সেই পাত্রীর সাথেই হয়েছিল এবং একমাসের মধ্যে। ছেলের জেদের কাছে হার মেনে মা অবশেষে রণে ভঙ্গ দেন।

এবার শোনাই আমার এক মাসতুতো শ্যালিকার মুখ থেকে শোনা গল্প। মাসতুতো শ্যালিকার ছিল এক বিধবা পিসিমা। পিসিমা এক ছেলে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হন। জীবনের অনেক ঝড় ঝাপটা একাই সামলে ছেলেকে মানুষ করেন। ছেলে বিখ্যাত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। যাদবপুরে কচুরিপানা ভর্তি জমি রাত জেগে জবরদখল করে তার উপর বাড়ি তুলেছেন পিসিমা। সেই জায়গা এখন উঠতি বনেদি পাড়া, আর সেই টালির চালের বাড়ি এখন তিন তলা আলিশান অট্টালিকা। পিসিমা কর্পোরেশন স্কুলে চাকরি করেন। এইমত অবস্থায় উপযুক্ত পাত্রর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলেন পিসিমা।

পিসিমার আপন বলতে দাদা, বউদি আর ভাইঝি। যেখানেই পিসিমা পাত্রী দেখতে যান, সাথে যান দাদা, বউদি ও ভাইঝি। জীবন যুদ্ধে প্রচুর লড়াই করে পিসিমার রসবোধ কমে কথাবার্তায় বেপরোয়া ভাব এসে গেছিল। মেয়ে দেখা হয়েছে, মেয়ে পছন্দও হয়েছে। ঠিক হল এবার ছেলে এসে দেখলেই বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে।

একটা ঘরে ফেরার গল্প (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অর্জুন কে চুপ হয়ে যেতে সাঞ্ঝা আবার প্রশ্ন করল, ‘কেন স্কুল থেকে পালালে?’

—যার বাপ-মা নেই, সে তো অনাথ। অনাথের আবার ঘর কীসের! পরিবার কীসের! বাপ-মায়ের পদবি, নিজের নাম থেকে মুছে দিলাম। ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছোলাম এই হাওড়া স্টেশনে। সাথে ছিল আমার স্কুলের বইপত্র ভর্তি একটা স্কুলব্যাগ। রাতে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে একা একা বসে, সেই বইগুলো পড়তাম। খিধে পেলে এর ওর কাছ থেকে খাবার চাইতাম। কেউ কেউ কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। কেউ আবার দয়া পরবেশ হয়ে আধ-খাওয়া খাবার ছুড়ে দিত। ধীরে ধীরে রেল পুলিশ থেকে শুরু করে, অনেক নিত্যযাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপকদের নজরে পড়লাম আমি। আসা যাওয়ার পথে, তাদের অনেকেই যেচে এসে আমার সাথে কথা বলতেন। পড়াশোনা করে, পরীক্ষা দিয়ে, বড়ো হয়ে যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, তার জন্য উৎসাহ দিতেন তাঁরা। এইরকমই একজনের অনুপ্রেরণায়, উদ্যোগে ন্যাশনাল ওপেন স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলাম। মাঝেমধ্যে হাওড়া স্টেশনে কোনও গণ্ডগোল হলে, পুলিশের তাড়া খেয়ে, কলকাতার দিকে পালিয়ে যেতাম। তখন কোনওদিন ধর্মতলায় মেট্রো-সিনেমার নীচে, কোনওদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সামনের ফুটপাথে শুয়ে রাত কাটাতাম। এইরকম ভাবে চলতে চলতে একদিন মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে গেলাম। ইতিহাসে মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম। বড়ো এক সরকারি অফিসারের পরামর্শে কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসারের চাকরির পরীক্ষায় বসলাম। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, কলকাতার এক অফিসে অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হলাম। কিন্তু হাওড়া স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতে মন চায়নি কোনওদিন। গত তিন বছর ধরে, এদেরকে নিয়েই আছি এইখানে। আমাকে নিয়ে মোট একুশজনের বাস এখানে। তুমি থাকতে চাইলে, আমরা বাইশজন হব…!

ওর পোষ্যদের সারাদিনের দায়িত্ব শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝা’র উপরে চাপিয়ে দিয়ে, এর পরে আরও বছর তিনেক বেশ নিশ্চিন্তে কলকাতায় তার অফিস-কাছারির কাজ সামাল দিয়েছে অর্জুন। রোজ সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মে ফিরে এসে হ্যাজাক জ্বেলে পোষ্যদের নিয়ে যথারীতি রাতস্কুল চালিয়েছে সে। ইত্যবসরে শ্রাবণী যেমন হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে, সাঞ্ঝাও মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে। বিল্টু আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। কিন্তু অর্জুনের মাথায় ঘুরছে, আরও অনেক বড়ো পরিকল্পনা। গত এক বছরে অফিসের বড়ো কর্তাদের কাছে বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছে সে— রাঁচি শহরে তার ‘বদলি’ প্রার্থনা করে।

নতুন বছরের শুরু থেকেই শ্রাবণী, সাঞ্ঝা ও অর্জুন— তিনজনের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে; বিল্টুকে দিয়ে যে করেই হোক মাধ্যমিকে ভালো ফল করাতেই হবে। সেই দিনটা ছিল, বিল্টুর মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। বিল্টুকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে, অর্জুন অফিসে ঢুকতেই, বড়োকর্তা অর্জুনের হাতে ওর বহু-প্রার্থিত ‘রাঁচি-বদলির’ অর্ডারটা ধরিয়ে দিলেন।

অগত্যা রাঁচি যাওয়ার আগে, শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝার উপর তার পোষ্যদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, অর্জুন ওদেরকে জানাল, ‘সামনে আমাদের অনেক বড়ো দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি থাকতে হবে। এখন সবার আগে আমাকে রাঁচিতে গিয়ে চাকরিতে জয়েন করতে হবে। তারপরে আমার সব পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ করতে পারলেই, এখানে ফিরে এসে তোদের সবাইকে নিয়ে রাঁচি চলে যাব। ততদিন তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই রাত-স্কুল চালানোর সব দায়িত্ব তোদের উপরেই রইল।”

এর প্রায় বছর খানেক বাদে, একদিন ঝাড়খণ্ডের রাজরাপ্পার মন্দিরে ছিন্নমস্তা দর্শন সেরে, অর্জুনের কলকাতা অফিসের প্রাক্তন বড়োকর্তা অম্বরীশবাবু ট্রেকারে করে, রামগড় সদর মোড়ে এসে নামলেন। সেখান থেকে ট্রেকার পালটে রাঁচি যেতে হবে। ট্রেকার স্ট্যান্ডে পৌঁছে, রাঁচি যাওয়ার একটা ট্রেকারে উঠে বসতেই, অম্বরীশবাবুর সাথে অর্জুনের দেখা হয়ে গেল।

অর্জুনই প্রথমে কথা বলল, ‘স্যার, আপনি এখানে?’

—এই তো কাল এসেছি এখানে। রাজরাপ্পা গিয়েছিলাম; ছিন্নমস্তা দর্শনে। আজ রাতেই রাঁচি থেকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেন ধরব। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ? তোমার তো এখন রাঁচিতে থাকার কথা, অম্বরীশবাবু জানতে চাইলেন অর্জুনের কাছে। অর্জুন এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, তার পাশে বসা দুই মহিলার সাথে অম্বরীশবাবু’র পরিচয় করিয়ে দিল।

—এদের কথা আপনাকে আমি আগে অনেকবার বলেছি; আজ এদের সাথে দেখা হয়ে গেল আপনার। এর নাম শ্রাবণী, আর এ হচ্ছে সেই সাঞ্ঝা। আপনি তো জানেন, ও ভুটকি গ্রামের মেয়ে। সেই ভুটকি গ্রামে একটা বাড়ি বানিয়ে, সেখানে মেয়েদের একটা স্কুল চালু করেছি। সেটা এখন সাঞ্ঝাই চালায়। আশপাশের গ্রাম থেকে আপাতত জনা পঞ্চাশেক ছাত্রী পাওয়া গিয়েছে। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে সকলের। সাঞ্ঝাকে ফিরে পেয়ে, শুধু ওর পরিবার নয়, গোটা মহকুমার মানুষ উল্লসিত, গর্বিত। বিডিও, মহকুমা শাসক থেকে শুরু করে জেলা শাসক পর্যন্ত, সকলেই সাঞ্ঝার এই ঘুরে দাঁড়ানোকে, ওর এই কৃতিত্বকে সাধুবাদ জানিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

অর্জুনের কথা শুনে অম্বরীশবাবু’র চোখেমুখে খুশির ঝলক। অর্জুনের কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, “বাঃ! এ তো দারুণ খবর! তবে এ তো গেল সাঞ্ঝার কথা। শ্রাবণী কী করছে এখন?”

—এই রামগড়ে আপাতত একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, অনাথ শিশুদের সেখানে রেখে, তাদের পড়াশোনার একটা বন্দোবস্ত করেছি। তবে আমি আমার অফিস সামলে, ওদের দেখাশোনা করার জন্য কতটুকুই বা আর সময় পাই! অনাথ আশ্রমের সবটা শ্রাবণী’ই দেখাশোনা করে।

—আর তোমার হাওড়া স্টেশনের পোষ্যদের কী খবর? তাদেরকে তুমি রামগড়ে নিয়ে এসেছ না-কি!

—না, না! ওরা ওদের জায়গাতেই আছে। প্রতি শনি-রবিবার দুটো দিন হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পোষ্যদের কাছে ছুটতে হয় আমাকে। সারা সপ্তাহ ধরে বিল্টুই ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব সামলায়। তবে সম্প্রতি ও আবার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগামী বছর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে সে। ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে, ওদের সবাইকে রামগড়েই নিয়ে আসার কথা ভাবছি। কিন্তু এতজনকে রাখতে গেলে, নিজেদের একটা বড়ো বাড়ি হলে ভালো হয়।

কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে অর্জুন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আবার কথায় ফিরে আসে সে, ‘এই দেখুন, কথা বলতে বলতে আসল লোকের সাথেই তো আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছি। এ হচ্ছে, আমাদের সেই শান্তা। ও এখন এখানকার স্থানীয় একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি’তে পড়ছে। এই রামগড়ের আশ্রমে, শ্রাবণীর হেফাজতেই থাকে ও। শান্তা এখনও একই রকমের শান্ত। তবে ও শুধু আমাকে জানিয়েছে যে, ও বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চায়।’ শান্তাকে আদর করতে করতে অম্বরীশবাবুর সঙ্গে শান্তারও পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলল না অর্জুন।

সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে, মুখে একগাল হাসি নিয়ে, অম্বরীশবাবু অর্জুনের কাছে জানতে চাইলেন, “কিন্তু এই ছুটির দিনের সকালে, এমন সদলবলে তুমি কি হাওড়ায় চললে না-কি?’

না, না, এই সপ্তাহে আমার আর হাওড়া যাওয়া হচ্ছে না। তবে আমার বদলে এই সপ্তাহে শ্রাবণী হাওড়া যাচ্ছে আজ। দু’দিন থেকে, পরশু দিন ফিরে আসবে ও।

অর্জুন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, অম্বরীশবাবু ফিরে জানতে চাইলেন, “তাহলে তুমি চললে কোথায়!”

—সম্প্রতি দাদু’র সাথে চিঠির আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই জানলাম, ইদানীং দাদুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দাদুকে আমার বর্তমান কর্মকাণ্ডের কথা সব জানিয়েছি!

—সব! অম্বরীশবাবু’র গলায় এবার অন্য রকমের সুর!

—হ্যাঁ, সব! তাই দাদুর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে, দীর্ঘদিন বাদে আজই প্রথম ঘরে ফিরতে চলেছি আমি। অম্বরীশ চ্যাটার্জীর সাথে কথা বলতে বলতে মুচকি হেসে এবার সাঞ্ঝার দিকে একবার তাকাল অর্জুন!

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (১-পর্ব)

সকালে ঘুম থেকে উঠে টয়লেটে যেতে, আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে অর্জুনের। ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে, কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল সাতটা বাজে। এইসময় টয়লেটে ঢুকতে গেলে, লম্বা লাইনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। রোজ সাধারণত ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যে টয়লেটে ঢুকে, একেবারে প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে নেয় অর্জুন। এর থেকে বেশি দেরি হয়ে গেলেই, হাওড়া স্টেশনের তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এই টয়লেটে সহজে ঢোকার সুযোগ পাওয়াটা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে।

দূরপাল্লার ট্রেনগুলো ভোরবেলায় ঠিক এই সময় থেকেই একের পর এক ঢুকতে শুরু করে হাওড়া স্টেশনে। যেসব প্যাসেঞ্জারদের ট্রেন থেকে নেমে, ট্রেন পালটাতে হয়, তারা এইসময় টয়লেটে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সবাই। এদের পিছনে লাইন দিতে হলে, সেদিনকার মতো সব কাজ যে মাথায় উঠবে, তা খুব ভালো করে জানে অর্জুন।

অর্জুন মনে মনে ভাবে, আজকের এই গণ্ডগোলের মূলে হচ্ছে গতকাল রাতের কালবৈশাখীর ঝড়। গতকাল রাত আটটা নাগাদ শুরু হয়ে, কয়েক দফায় যে ভীষণ বেগে এবছরের প্রথম কালবৈশাখীর ঝড় আছড়ে পড়েছিল, তাতেই তো সমস্ত রেল-যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। ওই ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গী ছিল অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি। সেই ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব যখন থামল, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা পার হয়ে গিয়েছে।

হাজার হাজার প্যাসেঞ্জার অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। তারা কেউ লোকাল ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবে, কেউ আবার বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন ধরবে বলে হাজির হয়েছে হাওড়া স্টেশনে। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা, সবার সে এক নিদারুণ অসহায় অবস্থা! সেই ঝড়-বৃষ্টির পর থেকে সারারাত, না আর কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশনে ঢুকেছে; না কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে বেরোতে পেরেছে।

গতকাল রাতে ঝড় যখন উঠল, অর্জুন তখন ওর দলবল নিয়ে হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের কোল ঘেঁষে বসেছিল। ওর দলবল বলতে এক পাঁচ বছর বয়সি থেকে শুরু করে, আঠারো-ঊনিশ বছর বয়স পর্যন্ত কয়েক জন কিশোর-কিশোরী মিলিয়ে জনা বিশেকের একটা দল। এদের সবাইকে এককথায় ‘অনাথ’ বলা চলে। কিন্তু অর্জুন তা মানতে রাজি নয়। অর্জুন বলে, ‘এরা সবাই আমার পরিবারের!” রোজ সন্ধ্যায়, মাঝখানে একটা হ্যাজাক জ্বেলে বসে অর্জুন। তাকে ঘিরে গোল করে বসে থাকে বাকি সকলে। অর্জুন ওদের গুরু। গুরুর কাছে পাঠ নিতে, সন্ধ্যা সাতটা বাজতে না বাজতেই যে যেখানে থাকুক না কেন, সকলেই এসে হাজির হয় হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই গোডাউন লাগোয়া পাঁচিলের গোড়ায়।

ওদের প্রত্যেককে একটা করে পিঠব্যাগ কিনে দিয়েছে অর্জুন। সঙ্গে দিয়েছে বই, খাতা, কলম, পোশাক; যার যেমন প্রয়োজন। পড়াশোনার স্তরও একেক জনের একেকরকম। সবচেয়ে বড়ো যে ছেলেটি, তার নাম বিল্টু; বয়স সতেরো আঠারো হবে। ওর ব্যাগে রয়েছে ক্লাস সিক্সের বইপত্র। বিল্টু কীভাবে এই হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তা অর্জুন অনেকবার বিল্টুর কাছে জানতে চেয়েছে। কিন্তু বিল্টু কিছুতেই তার জবাব দিতে পারে না। শুধু ওর কথাবার্তা থেকে অর্জুন বুঝতে পারে— ও কোনও সাঁওতাল মা-বাবার সন্তান। বিল্টুর পড়াশোনায় আগ্রহ থাকলেও, ভিতটা খুব দুর্বল হওয়ায়, অর্জুন ওকে গত দু’বছর আগে ক্লাস ফোরের স্তর থেকে সব বইপত্র কিনে দিয়ে, তালিম দিতে শুরু করেছিল। বয়স অনুপাতে অনেকটা পিছন থেকে শুরু করলেও, বিল্টুর অধ্যাবসায় যথার্থভাবেই ওকে ক্লাস সিক্স স্তর পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে।

আর বিল্টুর সমবয়সি যে-মেয়েটি, সে হল শ্রাবণী। আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। শ্রাবণীর মা-বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ত। ওর কতই বা আর বয়স হবে তখন; বছর এগারো হবে। মেদিনীপুর জেলার শ্যামচকে ওদের বাড়ি ছিল। একরাতে ঘুমের মধ্যেই শ্রাবণী টের পায়, ওদের গ্রামের সেই খড়ের চালের ঘরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ভয়ে আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবণী একরাশ ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। মালপত্র বের করতে গিয়ে, চালচাপা পড়ে ঘরের মধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে ওর মা-বাবা মারা গিয়েছিল সেদিন।

ক্রমশ…

 

ভুলের মাশুল (২-পর্ব)

(পর্ব-২)

টেকো ওসি রামদাস টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে কথোপকথন শুরু করলেন।

—কী মশাই একেবারে রসের ভাণ্ডার হয়ে বসে রয়েছেন যে!

—হে, হে, তা যা বলেছেন, রস ছাড়া তো জীবন অচল। পৃথিবী তো রসেরই ভাণ্ডার। ফলের রস, তালের রস, আখের রস, খেজুর রস, রসগোল্লার রস…।

—থামুন, এইবার আমি আপনার দুটো রসগোল্লার রস বার করব!

ঘাড় নাড়লেন মোহিত দাস। অমিত সেন এবং আশেপাশের বাড়ির দু-চারজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।

—মনিকা কে? একেবারে বাজখাঁই গলায় খেঁকিয়ে উঠলেন পাঁচতলা থানার ওসি। নামটা শোনার পর মোহিত দাসের চেহারায় কোনও ভাবগতিক লক্ষ্য করা গেল না। সেটা দেখে আরও সুর চড়ালেন ওসি।

—স্পিক আউট, স্পিক আউট, টেল মি হু ইজ মনিকা। কিন্তু যাঁকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা, সে ফ্যালফ্যাল করে শুধু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এইবার রামদাসবাবু পুলিশি বিক্রম দেখাতে তার হাতের লাঠিটা মোহিতবাবুর চিবুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘মনিকা, মাই ডার্লিং, শালা আপনার পিছনে এই লাঠি …!’ মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “স্যরি, ভেরি স্যরি, আসলে…।’ অন্য ছন্দে ফিরলেন তিনি।

মোহিতবাবুর আয়াকে আলাদা করে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, অয়ন দাসের বাড়ির পজিশন ইত্যাদি দেখে ফিরে গেলেন ওসি রামদাস মণ্ডল। যাওয়ার সময় তার সনাক্তকরণ রিপোর্টও প্রকাশ করে গেলেন। এটা বয়সজনিত মানসিক দুর্বলতা। জীবনের চলার পথে এসব এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

অমিতবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে উত্তর করলেন ওসি, ‘ভুল তো মানুষ মাত্রই করে, মিঃ সেন, না কি?’ বাদী পক্ষের অয়ন দাস নীচে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে এ ব্যাপারে আর বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দিয়ে আসল নাটকের মঞ্চ ছেড়ে জিপে উঠলেন ওসি।

মোহিতবাবুর সেই ঘটনা অনেক রজনী অতিক্রান্ত করেছে। কিন্তু আমিতবাবুর এইরকম ভুল মাঝে মাঝেই কেন হয়, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না। ওসি রামদাসের কথা মতো মোহিতবাবুর সঙ্গে তুলনা করতে থকেন তিনি। কিন্তু অমিতবাবুর তো করোনা হয়নি। তাহলে? অমিতবাবুর স্ত্রী বিমলাও স্বামীর নানাবিধ অস্বাভাবিক ব্যবহারে নাজেহাল হয়ে যান। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনি নিরুপায়।

আজকের ঘটনাটাই ধরা যাক। বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটাপথে ভগবানদাস পার্কে প্রত্যেকদিন সকালে একেবারে নিয়ম করে প্রাতভ্রমণে বেরোন অমিত সেন। সকালে টয়লেটে গিয়ে দেখেন জল নেই। তার মানে, মিউনিসিপালিটির কলের জল গতকাল রাতে আসেনি। এখন একমাত্র ভরসা ভূগর্ভস্থ জল। অমিতবাবু চাবি নিয়ে একতলায় পাম্প ঘরে সুইচটা অন করে হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের পেল্লাই ট্যাঙ্ক ভরতে প্রায় এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। ততক্ষণে তিনি বাড়ি ফিরে আসবেন। কিন্তু ঘটনাটা যে এরকম ঘেঁটে বর্ণপরিচয়ের সব অক্ষর ধারণ করবে তা তিনি বুঝতে পারেননি। তাহলে কি তার মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কার্যক্ষমতা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। তিনি কি অ্যালজাইমার রোগের শিকার! আজকাল কিছুই বুঝতে পারেন না অমিতবাবু। সেদিন মোহিবাবুর বাড়িতে এসে কেমন যেন একটা উপলব্ধি হল।

ভগবানদাস পার্কে দু-পাক চক্কর মেরে নিত্যদিনের মতো পার্কের বাঁধানো পাথরের বেঞ্চে বসে কপালভাতি প্রাণায়ম করছিলেন অমিত। কেষ্ট দাস আর তারক সিং এসে পাশে বসে পড়ল। কপালভাতি চটকে গেল। বিহারের ছাপরা থেকে কলকাতায় এসে একটা ওষুধের দোকানে কাজ করে তারক সিং।

ক্রমশ…

ভুলের মাশুল (১-পর্ব)

এখন সকাল। রোদ্দুরের তেজটা সেরকম বোধ হচ্ছে না। প্রিন্সেপ ঘাটের উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে আছেন অমিত সেন। ফোর্ট উইলিয়ামে কাজ করার সুবাদে আগে এখানে কতবার এসেছেন। এখন আর সেরকম ভাবে আসা হয় না। ঘাটের চারপাশজুড়ে আকাশ কমলা হওয়ার দৃশ্যটা কতদিন দেখেননি তিনি! চার দিকের ভিড় কমে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। এটাই স্বাভাবিক। বাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে প্রায় সবাইকে নিজের কাজে বেরুতে হবে। সে তাড়া অমিত সেনের নেই। আজ তাঁর একটু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করবার দরকার ছিল। তাই সটান চক্র রেলে চেপে এখানে এসেছেন।

আজ আবার ঘটনাটা ঘটল। এই নিয়ে কতবার যে হল আর মনে করতে পারছেন না অমিত সেন। কিছুদিন আগে বাসে উঠে মনে পড়ল দরজাটা লক করা হয়নি। মাঝরাস্তায় বাস থেকে নেমে রিকশা করে বাড়ির সামনে এসে দেখেন তার ধারণা ভুল। দরজা বন্ধ। ব্যাংক-এ পাশবই আপ ডেট করতে গিয়ে দেখেন পাশবইটা সঙ্গে আনা হয়নি। এসব তো ঠিক আছে। কিন্তু আজকেরটা একেবারে সাংঘাতিক ভুল। কথায় বলে ভুলের মাশুল। কড়ায় গণ্ডায় একেবারে বারো হাজার টাকা বেরিয়ে গেল। এরপর চলবে জলকষ্ট। তাঁদের চার-পাঁচটা বাড়ির পরে থাকেন মোহিত দাস। তিনি কিছুদিন করোনা রোগের শিকার হয়েছিলেন। যমে-মানুষে টানাটানি করে বাড়ি এলেন কিন্তু ব্রেন-এর অবস্থা খুব খারাপ। কিছুই মনে রাখতে পারেন না। উলটোপালটা বকেন। মোহিতবাবু-র একমাত্র মেয়ে বিদেশে। আয়া-নির্ভর জীবন। আয়ার চড়-চাপট খেয়ে জীবন কাটে। সেই মোহিত দাসের বাড়িতে কিছুদিন আগে পুলিশ এল। দীর্ঘদিন একই পাড়ায় থাকার সুবাদে মোহিত দাসের সঙ্গে অমিত সেনের ভালোই সখ্যতা আছে। আজকাল অবশ্য দেখা সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। অভিযোগ মারাত্মক। মহিলার শ্লীলতাহানি।

আশেপাশের বাড়ি থেকে গুঞ্জন উঠল, তাহলে কি আয়ার সঙ্গে! এই বয়েসে! ছিঃ ছিঃ ইত্যাদি। পরের ঘরের কুৎসা পেয়ে যে যত পারে বেলুন ফোলাতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার এইসব ঘটনাকে মোহিতবাবুর সাময়িক যৌন উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আখ্যায়িত করল। অমিতবাবুর এইসব ন্যাস্টি কথাবার্তা মোটেই ভালো লাগল না। তিনি নিজে মোহিতবাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন ব্যাপারটা অন্য। এক্কেবারে রোমান্টিক।

অয়ন দাস তাঁর স্ত্রী মনিকাকে নিয়ে মোহিতবাবুর পাশের বাড়িতেই থাকেন। উত্তর কলকাতার বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে লাগানো। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ঝপাং ঝপাং করে লাফিয়ে চুরি করতে চোরেদের এখানে খুব মজা। এখন অবশ্য এসব ঘটনা শোনা যায় না। তবে উঁকি ঝুঁকি মারলে প্রতিবেশীর বেডরুমে চোখ পৌঁছে যায়। সেই চোখই হয়েছে ভিলেন।

মোহিতবাবু নাকি প্রায়শই অয়নবাবুর বাড়িতে উকিঝুঁকি মারেন। মনিকাকে নাম ধরে ডাকেন। বয়সে বড়ো, তাছাড়া ভুলো মনের মানুষ এইসব ভেবে অয়ন বা মনিকা খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু শেষ কয়দিন মোহিবাবুর মাথার ব্যামো একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রায়ই কলতলায় যাওয়ার সময় জানলার ফাঁক দিয়ে ‘মনিকা, মনিকা’ বলে হাঁক পেড়ে চলে যান। এতেও ঠিক ছিল। তিন দিন আগে দু’তিনবার, ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’ সুর ভেঁজেছেন। ব্যস আর যায় কোথায়! রাহুল দেব বর্মনের এই কীর্তিকে একেবারে খাটো করে দেখতে রাজি নন তারা। একটা এসপার ওসপার করে ছাড়বেন। তাই সহ্য করতে না পেরে অবশেষে অয়ন-রা পুলিশের দারস্থ হয়েছেন। পুলিশ যদি বুড়োকে একটু আচ্ছা করে কড়কে দেয়।

পাঁচতলা থানার ওসি রামদাস মণ্ডল একজন রসিক এবং সমপরিমাণ বদমেজাজি ব্যক্তি। নিজে মাঝেমধ্যে পাড়ার গজিয়ে ওঠা শখের থিয়েটারে ছোটোখাটো পার্ট করে প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছেন। খুব সহজেই সমস্যার সমাধান করেন বলে পুলিশমহলে বেশ ওজনদার। রামদাস ওসি যখন মোহিত বাবুর কাঁটাপুকুরের বাড়িতে এলেন, তখন অমিতবাবু একটু অবাকই হলেন। সিনেমার শুটিং-এর মতো ক্যামেরার পরিবর্তে হাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করে চোখের সামনে এনে বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করে মোহিত বাবুকে মাপতে লাগলেন। হি ইজ পারফেক্টলি অল রাইট। তার কথা শুনে মোহিতবাবু দেঁতো হাসি হাসলেন। অমিতবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ক্রমশ…

 

 

দুর্গা (পর্ব-৩)

পর্ব – ৩

আজও বেশ মনে আছে দুর্গার লালকালিতে লেখা প্রথম প্রেমপত্রটি দলমঘাটা বাস রাস্তায় এসে লাইট পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে শুভায়ু প্রায় তিরিশবার পড়েছিল। ইচ্ছে করেছিল, তার সেই পবিত্র নিষ্পাপ ভালোবাসার কথা পৃথিবীর সবাইকে জানাতে। সে কারণে সে সন্ধেবেলা প্রেমপত্রটি দেখাতে শোভনের বাড়ি ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও দুর্গার লেখা প্রেমপত্র শোভনকে সে দেখাতে পারেনি। একটা অপরাধবোধ তার মনকে সতর্ক করে দিয়েছিল।

সে এক পা এগিয়ে আবার দু’পা পিছিয়ে এসেছিল। তার কারণ হল দুর্গা শোভনের দাদার শালি। শোভনের দৌলতেই শুভায়ু দুর্গাদের বাড়িতে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে। শোভনকে চিঠিটা দেখালে যদি সে রাগ করে, যদি তাকে ঘেন্না করে, তা হলে তো শুভায়ুর সব আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই সে দিন শোভনকে চিঠিটার কথা বলতে পারেনি।

ইতিমধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। দুর্গার সঙ্গে শুভায়ুর প্রেম যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল, শুভায়ু ভালো ভাবেই পাস করেছে। কিন্তু শোভন কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছে। শোভনের কম্পার্টমেন্টাল পাওয়ার কারণ হল লেখাপড়ায় তার যতটা না মন ছিল, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল ছাত্র রাজনীতিতে। রাজনীতি করতে গিয়েই তার লেখাপড়ার এই হাল হয়েছিল।

যাই হোক, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে শোভন যখন মনে প্রাণে ক্ষতবিক্ষত, তখনই সে ঠিক করল যে-দিকে দু’- চোখ যায় চলে যাবে। এ পোড়া মুখ নিয়ে বারড্রোন গ্রামে সে আর থাকতে রাজি নয়। একটা কিছু কাজ জোগাড় করে তবেই সে গ্রামে ফিরবে, নচেৎ নয়। শোভনের মনের কথা জানতে পেরে শুভায়ু তখন তাকে বলেছিল, ‘আমিও তোর সঙ্গে যাব।’

সে কথা শুনে শোভন বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘তুই ভালো ভাবে পাস করেছিস। তুই আমার সঙ্গে জাহান্নামের পথে কেন যাবি? তা ছাড়া তোকে কলেজে ভর্তি হতে হবে। তোর এখানে থাকা দরকার।’

শুভায়ু বলেছিল, ‘তোকে জাহান্নামের পথে একা ঠেলে দিতে পারব না। তা ছাড়া তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। আমি তোর সঙ্গে যাবই।’

শুভায়ু জেদ ধরে থাকায় শোভন আর বারণ করতে পারেনি। তার পর একদিন কাউকে কিছু না বলে হাওড়া স্টেশনে এসে পাটনার টিকিট কেটে গয়া প্যাসেঞ্জারে দু’জনে উঠে বসল। ট্রেনটা যখন ধানবাদ স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তখন শুভায়ুর বাড়ির জন্য মন কেমন করে উঠেছিল।

শুভায়ু বলেছিল, ‘বাড়ির লোকেরা যদি তোর খোঁজ না পেয়ে পুলিশে খবর দেয়, তাহলে কী হবে?’

—যা হওয়ার তাই হবে। তবে আমি শুধু পাটনায় যাওয়ার খবর দুর্গাকে জানিয়ে এসেছি। বলে শোভন একটা সিগারেট ধরিয়েছিল।

শুভায়ু আবার প্রশ্ন করেছিল, ‘ও কিছু বলেনি।’

—তখন সে কিছু বলেনি। তবে চলে আসার আগে দুর্গা আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে। এই নে পড়ে দেখ। বলে শোভন ট্রাউজারের পকেট থেকে দুর্গার লেখা চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

শোভনের হাত থেকে চিঠিটা নিতে গিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর ক্যানেস্তারা পেটানোর মতো দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছিল। তার জন্য তখন হয়তো কোনও অশুভ সংকেত অপেক্ষা করছিল। দুর্গার হাতে লালকালিতে লেখা চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই দেখা গেল তাতে লেখা রয়েছে- -দোহাই শোভনদা, তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে না এলে বুঝব আমাকে তুমি একটুও ভালোবাসো না।

—ইতি দুর্গা

চিঠিটা শোভনকে ফিরিয়ে দিয়ে শুভায়ু ট্রেনের জানলার ধারে বসে দূর আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। অব্যক্ত যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছিল তার দেহ-মন। সেই প্রথম সে বুঝতে পেরেছিল নারী কী বিষম বস্তু। নারী যেমন ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ মানুষকে রাজা বানাতে পারে, তেমনি আবার চূড়ান্ত ছলনা করে পথেও বসাতে পারে। দুর্গা শোভনকে ভালোবাসে বলে তার একটুও দুঃখ হয়নি। দুঃখ হয়েছে শোভনকে ভালোবাসার কথা দুর্গা কেন গোপন করল। নারী যে ছলনাময়ী, এ কথা দুর্গা সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

ক্রমশ…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব