অনুসন্ধান এবং…

কালো রংয়ের পালিশ দরজায় সোনালি নেমপ্লেট। বিজয় পাণিগ্রাহী। তার নীচে সবিতা পাণিগ্রাহী। আর একবার নিজের মনের প্রস্তুতিটা সেরে নিল নীলমণি পরিদা। কলিংবেলে তর্জনী রাখতেই পাখি ডাকার শব্দ ভেসে এল বাইরে।

—আপনাকে ঠিক চিনলাম না। যদি নামটা বলেন…

—আমি নীলমণি পরিদা। আগন্তুক বটে, কিন্তু আততায়ী কিংবা প্রতারক নই।

—আরে না না, আপনি ওসব কেন হতে যাবেন। তাছাড়া বেলা এগারোটার সময় আবাসনের সিকিউরিটি চেক টপকে ওসব লোকেদের আসার কোনও প্রশ্নই নেই। আসুন ভিতরে আসুন। সবিতা পাণিগ্রাহী নীলমণি পরিদাকে আহ্বান জানালেন। থ্যাঙ্ক ইউ। আসলে আমি এসেছি আমার নিজের একটা প্রয়োজনে।

—আশ্চর্য, আমার কাছে আবার কীসের প্রয়োজন? আপনি জল খাবেন?

—হ্যাঁ, তা একটু খেতে পারি। ভদ্রমহিলা ঘরে যেতেই নীলুর চোখ চলে গেল দেয়ালে অয়েল পেইন্টিং-এর দিকে। ঠিক এইরকম একটা পেইন্টিং মাস চারেক আগে অলকানন্দা এনেছে।

—এই নিন জল।

আধ গেলাস জল খাওয়ার পর রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিল নীলু পরিদা।

—পেইন্টিংটা খুব সুন্দর।

—হ্যাঁ, ওটা আমার স্বামী প্রায় মাসচারেক আগে দিল্লির একটা এক্সিবিশন থেকে কিনে এনেছেন। ঘর সাজানোর জিনিস সাধারণত আমিই কিনে থাকি। জীবনে এই প্রথম তিনি এই শৌখিন কাজটা করলেন। ভালোই লেগেছে তাঁর পছন্দটা। আপনি কী একটা বলছিলেন নিজের প্রয়োজনের কথা ।

—আসলে আমার স্ত্রী অলকানন্দা আর আপনার স্বামী একই কোম্পানিতে কাজ করেন। তাই কিছু কথা বলতে এসেছি। বিজয়বাবু নিশ্চয়ই অফিসে গেছেন?

—না, কোম্পানির কাজে বাইরে মানে কানপুরে গেছেন তিনদিন আগে। পরশু ফিরবেন।

—জানেন অলকানন্দাকেও ঠিক তিনদিন আগেই কোম্পানি তার কাজে ট্যুরে পাঠিয়েছে। আর ওরও পরশু ফেরার কথা। কি আশ্চর্য তাই না?

—এতে আশ্চর্যের কী আছে? দু’জনেই হয়তো একই প্রোজেক্টে আছে। তাই…

—সে হতে পারে। আমি কিন্তু সিওর নই যে প্রোজেক্টটা পাঁচদিনেরই।

—আপনি কী বলতে চাইছেন?

—আমি শুধু অনুমান করছি। নাও হতে পারে। আজকাল আমার স্ত্রী সব কথা সঠিক বলে না। এমনকী জায়গার নামও ভুল বলে। এই তো মাসছয়েক আগে ভুবনেশ্বর যাওয়ার নাম করে বেরিয়েছিল। কিন্তু সে ভুবনেশ্বর যায়নি।

—আপনি তো আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করছেন। কী করে বুঝলেন যে, উনি ভুবনেশ্বর না গিয়ে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন?

—তাহলে শুনুন, ও ভুবনেশ্বর থেকে একটা শাড়ি কিনে এনেছিল। ভুল করে শাড়িটা আমার জামাকাপড়ের তাকে রেখেছিল। অবশ্য প্যাকেট ছাড়াই। শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ি। আচ্ছা বলুন তো, ভুবনেশ্বরে তাঁতের শাড়ি কেউ কেনে?

—এখানে আমার স্বামীর ভূমিকা কোথায়?

—আপনার স্বামী হয়তো তাঁতের কিংবা গরদের শাড়ি ভালোবাসেন। কিন্তু আপনার হয়তো সিল্ক, জর্জেট শাড়ি ভালো লাগে। তাছাড়া আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে,আপনি শাড়ির পরিবর্তে সালোয়ার কামিজ কিংবা জিন্স টপেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ।

—কোনও কিছুর বিনিময়েই আমি আমার স্বাধীনতা ছাড়তে রাজি নই। আমি আমার পছন্দ নিয়ে থাকতেই ভালোবাসি। কারও পছন্দ মতো চলব কেন?

—জানেন, আমার স্ত্রী-কে আমি ‘অলকা’ নামেই ডাকি, কিন্তু ও কখনও আমার পছন্দের মূল্য দেয়নি। একসময় স্মিতা পাতিল ছিলেন আমার প্রিয় নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর মার্জিত পোশাক আর বাইরের একটা পেলব আবরণ আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করত। একবার আমি আমার পছন্দের হালকা নীল রঙের সম্বলপুরী তাঁতের শাড়ি এনেছিলাম। সেই শাড়ি একদিনও ওকে পরতে দেখিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই আটমাস যাবৎ ও তাঁত কিংবা সুতির শাড়ি পরা ধরেছে। এখন আর চলাফেরা করতে কোনও অসুবিধা হয় না।

—তাহলে তো বলতে হয়, উনি দেরিতে হলেও আপনার পছন্দের সম্মান আর মর্যাদা দিচ্ছেন। কী বলেন?

—না, আমার মনে হয় ওর এই পরিবর্তনের পিছনে অন্য কারও উৎসাহ কিংবা পছন্দ আছে।

—আচ্ছা, এখন আপনার স্বামী নিশ্চয়ই খুব কম কথা বলেন, তাই না? আগের মতো ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে কথায় কথায় ঝগড়াও করেন না।

হয়তো কাজের চাপ আছে তাই। দেখি তো, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর এক কাপ কোল্ড কফি নিয়ে ল্যাপটপে কাজ সারেন অনেক রাত পর্যন্ত।

—এই অভ্যাসটা কি ওনার বরাবরের?

—না, এই অভ্যাসের বয়স ছয় থেকে আট মাস হবে। কেন বলুন তো? আপনি তো দেখছি, সিআইডি সিরিয়ালের এসিপি প্রদ্যুম্ন স্যারের মতো জেরা করছেন।

—আসলে আমি আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ জোগাড় করতে চাইছি। অলকানন্দা বরাবর রাতে শোওয়ার আগে কোল্ড কফি খায়। এই নিয়ে আমার সঙ্গে প্রথমদিকে অনেক কথা কাটাকাটি হতো।

—এখনও হয়?

একদম না। আপনার স্বামীর কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত অলকা আমাকেও মেনে নিয়েছিল। আমি সুগার মিলের একজন সাধারণ কর্মী। মাস গেলে স্যালারি আর বছরে একটা করে ইনক্রিমেন্ট— এই হল আমার স্ট্যাটাস। আপনার স্বামীর সঙ্গে পরিচয়ের পর ও যেন খাঁচা ভেঙে উড়তে চাইল। এখন আর এসব নিয়ে ভাবি না। না, আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন, আমার যেটুকু জানার ছিল জেনে নিয়েছি। এখন আমি উঠব।

—যাওয়ার আগে আমি একটা কথা জানতে চাইছি, আপনি কি এই সম্পর্ক ভেঙে দিতে চান?

—গায়ের জোরে কোনও সম্পর্ক বিশেষ করে বিবাহিত জীবনের, ধরে রাখা সম্পূর্ণ অর্থহীন।

—আর একবার ভেবে দেখলে হয় না?

—প্রশ্নই ওঠে না।

—যাওয়ার আগে আমার কিছু কথা শুনবেন না?

—আপনার কাছ থেকে কিছু শোনার জন্যই তো এতগুলো কথা বললাম।

—আপনি এতক্ষণ ধরে আমার স্বামী আর আপনার স্ত্রীকে জড়িয়ে যে কথাগুলো বললেন, তার সবটাই সত্যি। বছরখানেক আগেই আমি বুঝেছি, বিজয় আর আমার কাছে নেই। অনেক দূরে সরে গেছে। আপনি পুরুষ মানুষ, আপনার পক্ষে যে-কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যতটা সহজ, আমাদের মেয়েদের একটু ভাবতে হয়। তাছাড়া আমাদের ছেলেটা বড্ড ছোটো। ও বাবাকে খুব ভালোবাসে। এখন যদি আমি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাই, তাহলে ওর মনের উপর ভীষণ চাপ পড়বে। এতদিন আমি মেয়েটার নামধাম, পরিচয় এসব কিছুই জানতাম না। অফিসে গিয়ে অনুসন্ধান করতে নিজের আত্মসম্মানবোধে লেগেছিল। বাইরের কারও কাছে হেয় হতে কার ভালো লাগে? কী আশ্চর্য, আজ আপনি যেচে তার সন্ধান আনলেন। মিস্টার পরিদা, আজ আপনি আমার বড়ো উপকার করলেন। এতক্ষণ পর সবিতা পাণিগ্রাহীর ঝলমলে মুখের উপর ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ল। বুকের ভিতর এতদিনের জমে থাকা মেঘগুলো এইবার বুঝি ঝরে পড়বে তার অস্তিত্বের উঠোনে, কার্নিশে আর ব্যালকনিতে।

পাত্রপক্ষ

পিসিমা হাই সুগারের রুগি, তাই মিষ্টি খাওয়া একেবারে মানা। এটা শুনে পাত্রীর বাবা দৌড়ে গিয়ে পাড়ার হরি ময়রার দোকানের বিখ্যাত হিংয়ের কচুরী নিয়ে এলেন। লোভে পড়ে পিসিমার দ্বারা গোটা পাঁচেক কচুরী সাবাড়। আর তারপরই শুরু হল পিসিমার পেটে মোচড় দেওয়া। সে ভয়ংকর মোচড়, কোনও বাধা মানতে চায় না। পিসিমা প্রমাদ গুনলেন।

পিঠ সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের বাথরুমটা কোথায় দেখান। আর একটা গামছা দেন আমারে।” পিসিমার ভাইঝি অর্থাৎ আমার শ্যালিকা পিসিমার এই কাণ্ড দেখে লজ্জায় মরে যায় আর কী। এরপর ওই বিবাহের প্রস্তাবের গাড়ি সে যে কারণেই হোক বেশি দূর এগোয়নি। শ্যালিকাও পিসিমার সাথে আর কোনও পাত্রী দেখতে যায়নি।

আমার এক খুড়শ্বশুর ভীষণ রসিক মানুষ। এবার শোনাই ওনার মুখে শোনা গল্প। আগেকার দিনে কিছু ছেলে থাকত ভীষণ লাজুক। বাবা মাকে বলত, ‘মেয়ে তোমরাই দেখে পছন্দ করো। আমার যাওয়ার দরকার নেই।”

জলপাইগুড়িতে এরকমই একটি ছেলে আমার খুড়শ্বশুরের বন্ধু, তার সম্বন্ধ এল জলপাইগুড়ির এক বিত্তশালী পরিবার থেকে। ছেলেটি দিল্লিতে চাকরি করে। বাড়িতে আসবে বিয়ের আগে। বাবা, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে গিয়ে প্রচুর ধারদেনা করেছেন। দেনা তখনও সব মিটিয়ে উঠতে পারেননি। ছেলে এসে বিয়ের আগে বন্ধুদের আড্ডাতে পৌঁছল। বন্ধুদের মধ্যে ফিসফিসানি! এক বন্ধু বলেই ফেলল, “হ্যাঁ রে তুই মেয়ে দেখেছিস!”

ছেলে বলল, “ওসব বাবা-মা সেরেছেন। ওনাদের পছন্দ ই আমার পছন্দ।”

এরপর ছেলে বহুবন্ধু পরিবৃত হয়ে টোপর পরে ছাদনাতলায় উপস্থিত হল। কনে এল পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে জামাইবাবুদের ধরা পিঁড়িতে চড়ে। ঘনিয়ে এল শুভদৃষ্টির সময়। মুখের সামনে থেকে হাতের পান সরল। ছেলে অতি আকাঙ্ক্ষিত দর্শনের পরই আমার খুড়শ্বশুরের কাঁধে মাথা দিয়ে জ্ঞান হারাল।

কনের সামনের দিকের তিনটি দাঁত বিসদৃশ ভাবে উঁচু হয়ে ছিল। তখনকার দিনে উঁচু দাঁত নীচু করে স্বাভাবিক করার চিকিৎসা আসেনি। সব শোনার পর খুড়শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তারপর।ত

উনি বললেন, ‘তারপর আর কী! জ্ঞান ফিরতে ওই বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরেছিল। বিয়ের জন্য মেয়ের বাবার থেকে অনেক টাকা পণ নিয়েছিলেন ছেলের বাবা। ধমকে ছেলেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসালেন।”

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর!’

শ্বশুরমশাই বললেন, ‘তারপর আর কী, তিনটে বাচ্চা হল। সব ঠিক হয়ে গেল।”

এর বেশি আর ‘তারপর শ্বশুরমশাইকে জিজ্ঞেস করা যায় না। তার উপর রসিকবাচন পারদর্শী শ্বশুরমশাই।

এক আত্মীয়র আন্দামানে মারাঠি মেয়ের সাথে প্রেম হয়। মেয়েটি বাংলা ভাষা খুব তাড়াতাড়ি ভালোরকম শিখে ফেলে। এতে অবশ্য তার বাঙালি প্রেমিকেরও অবদান ছিল। বিয়ের আগে মেয়ের বাড়িতে এসে মেয়েটির ভবিষ্যতের নন্দাই মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘গুঁতোর মানে জানেন’

স্মার্ট উত্তর দেয়, ‘একটু এদিকে আসলেই বুঝিয়ে দিতে পারব।’

নন্দাইমশাই উত্তর দেন, ‘যাওয়ার দরকার নেই, বুঝেছি বাংলা শেখা অনেক দূর এগিয়েছে।”

মেয়ে দেখতে আসার আগে কমজোর মেয়েদের আগে ভালো করে ট্রেনিং দেওয়া হতো। প্রথম সতর্কবাণী, বেশি কথা বলবে না। দ্বিতীয় সতর্কবাণী, আজ অন্তত লাজুক ভাবে বসে থাকবে। তৃতীয় সতর্কবাণী, গুরুজন সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। ঠাকুমার মুখে শুনেছি কোনও একটি মেয়েকে পছন্দ হওয়ার পর সম্বন্ধ ভেঙে যায়। কারণ বেরনোর সময় মেয়েটির কথায় নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ হওয়াতে।

মেয়েটি দরজায় দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে বলেছিল, ‘এখানে সম্বন্ধ পাকা না হলেও আপনারা আবার আসবেন।’ কথাটা খারাপ কিছুই বলেনি, লোকজন খারাপ ভাবে নিয়ে নেয়।

আর আরেক জায়গায় পাত্রী অতিরিক্ত মাথা নীচু করে প্রণাম করতে করতে পাত্রপক্ষের সাথে বসে থাকা নিজের ছোটো বোনকেও প্রণাম করে ফেলেছিল।

আমার এক পরিচিতা সাত তাড়াতাড়ি বিয়ের পিড়িতে বসবে না বলে জেদ করে কোনও মেক-আপ ছাড়াই, হাওয়াই চটি পরে, গায়ে কালো শাল জড়িয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গিমাতে পাত্রপক্ষের সামনে এসে বসে। সেই পরিচিতা যথেষ্ট সুন্দরী এবং ভালো মনের মেয়ে ছিল। জহুরির চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে। পাত্র বাবা-মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই মেয়েকে ওখানেই পছন্দ করে জানিয়ে দেয়। পরবর্তী জীবনে শ্বশুরবাড়িতে পুরো পরিবারের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠে মেয়েটি।

আগেকার দিনে মেয়ে গান গাইতে জানে কিনা সেটা সবচেয়ে আগে জিজ্ঞেস করা হতো। একটু আধটু গান গাইতে জানলেই চলত। মোটা মেয়ে হলে গান ধরত— আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে… আর তারপর আমার এই দেহ খানি তুলে ধর…।

আর কালো মেয়ে গাইত আপনারা ভাবছেন— কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, মোটেই না। আগ বাড়িয়ে নিজের উইক পয়েন্টের ঢাক কেউ পেটায় নাকি?

একটু বিনয়ী কালো মেয়েরা গাইত— তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে/ তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে। অর্থাৎ আমি যেরকমই দেখতে হই না কেন, তুমি তোমার অন্তরের মহানুভবতা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।

আবার একটু উদ্ধত কালো মেয়েরা গাইত — আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব / আমি হাত দিয়ে দ্বার খোলাব না, গান দিয়ে দ্বার খোলাব।

শেষ করি একটি মিষ্টি প্রেমের মিষ্টি পরিণতি দিয়ে। একই পাড়াতে থাকত একটি সুদর্শন ছেলে এবং অতি সুন্দরী একটি মেয়ে। দুজনেরই দু’জনকে খুব ভালো লাগত। আসতে যেতে একজন আরেকজনের দিকে না তাকিয়ে পারত না। দু’জনে সমবয়সি ছিল। ছেলেটি ভীষণ লাজুক, মেয়েটিকে গুছিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটির সম্বন্ধ দেখে দিল্লিতে বিয়ে হয়ে গেল।

এরপর কর্মসূত্রে ছেলেটিও দিল্লি চলে যায়। সংসার হয় এবং পাকাপাকি ভাবে দিল্লিবাসী হয়ে যায়। এর অনেক দিন পর নিজের বিবাহযোগ্য ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে দিল্লিতে সেই মেয়েটির বাড়িতেই পৌঁছোয় ছেলেটি পাত্রর বাবা হয়ে। আর পাত্রী ছিল অল্প বয়সের প্রেম নিবেদন করতে না পারা সেই মেয়েটিরই কন্যা। এক দেখাতেই বিয়ে পাকা।

সবার আগে লাফিয়ে পড়ে ছেলের বাবা মেয়ে পছন্দ হওয়ার সম্মতি জানিয়ে দিল। দুজনেই সযত্নে এড়িয়ে গেল নিজেদের পূর্ব পরিচয়ের ঠিকানা। আইনি জীবনসঙ্গী হিসেবে জীবনে পাওয়ার প্রাপ্তি অপূর্ণ থাকলেও, ‘বেয়াইন’ হিসেবে প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার প্রাপ্তির মূল্য কম কীসে?

সম্বন্ধ বিভ্রাট

আজকাল ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে মানুষ নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। যারা নিজেরা ঠিক করে নিচ্ছে, সেই ছেলেমেয়েদের গল্প এখানে নয়। এখানে তাদের নিয়ে গল্প যারা সুবোধ ছেলে বা মেয়েটির মতো পাত্রী বা পাত্র নির্বাচনের দায় বাবা-মার হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

সম্বন্ধ আনা এবং বিয়ে করিয়ে দেওয়া কাজটি বড়োই কঠিন। সফল হলেও একটা কিন্তু লোক লাগিয়েই দেবে। আর বিফল হলে তার গুষ্টির তুষ্টি একদিন দু’দিন নয়, দীর্ঘদিন চলবে। আজকাল এই কাজটা কিছু ব্যবসায়ী সংস্থা হাতে নিয়েছে। তাতে হতাশ হয়ে ফিরে আসার লাইন অবশ্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

আগেকার দিনে ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে পাত্রের বাড়ির থেকে দল বেঁধে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতো। এটা ছিল এক সম্মানজনক প্রতিনিধিত্ব। মনে যাই থাকুক না কেন ভাবটা থাকত- – মশাই আপনার ঘাড়ের বোঝা কমাতে এলাম, নির্ভর করছে আপনার কৃতকর্মের উপর। তাতে ছেলের বাবা-মা ছাড়া থাকত পরিবারের বা বন্ধুবর্গের মধ্যের একজন বিচক্ষণ ব্যাক্তি।

গুষ্টিশুদ্ধ নিয়ে এসেও নীতিবাগীশ পাত্রপক্ষের বয়ঃজ্যেষ্ঠর কড়া নির্দেশ আসত— কন্যা পছন্দ না হলে সেই বাড়ির অন্ন ধ্বংস করা অনুচিত হবে। কিন্তু এটা ভুলে যেত পাড়ার মিষ্টির দোকানদার, মিষ্টি আর ফেরত নেবে না। সব ক্ষেত্রে এই আদেশ অবশ্য কার্যকারী হতো না। বিশেষ করে খাদ্যরসিক পেটমোটা পিসেমশাই যদি থাকতেন।

মেয়ে পাত্রপক্ষের পছন্দ হলে, সবচেয়ে আগে বদলে যেত পাত্রীর বাবার শারীরিক ভঙ্গিভাবটা, খুব সস্তায় ভালো মাল ছেড়ে দেওয়া ব্যাপারীর মতন।

আমার মা যেচে পড়ে অনেক সমাজসেবা করতেন। প্রায়ই আবেগমথিত হয়ে পরোপকারিকতার ভূত মাথায় চাগাড় দিত। পাড়ার এক অতি ফোঁড়ে লোক কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে যেতেন, আর তার খেসারত দিতেন ওনার স্ত্রী। বেচারিকে প্রচুর টিউশন পড়িয়ে কোনওমতে সংসারের হাল ধরতে হতো। ঘরে চার চারটি অবিবাহিত মেয়ে। খুব নিরীহ এক পুরোহিতমশাই আসেন তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য বড়ো মেয়েটিকে নির্বাচন করতে। সমাজসেবার অঙ্গ হিসেবে আমার মা সম্বন্ধটা এনেছিলেন।

মাড়োয়ারিদের বাড়িতে জজমানি করে পুরোহিতমশাই ভালোই উপার্জন করেন। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে নিজের সাদামাটা পাকা বাড়িতে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। পত্নি অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। ছেলেকে কাপড়ের দোকান খুলে দিয়েছেন বেহালা চৌরাস্তায়। মেয়েটি ক্লাস সিক্সের বেড়াও ডিঙোতে পারেনি। দেখতেও সাদামাটা, তবে মনটা খুব ভালো। এর আগে অনেক সম্বন্ধ এসেছে ও গেছে। এহেন পাত্রীকে ছেলের বউ হিসাবে পছন্দ করার পর পুরোহিতমশাই যারপরনাই বিপদের সামনে পড়লেন।

পাত্রীর বাবা হঠাৎ করে তাঁকে ইংরেজিতে ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করেন। বেচারা পুরোহিত তখন সবে পাত্রী নির্বাচন করে রসগোল্লার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। রসগোল্লা হাতে নিয়ে তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাত্রীর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি করলেন, ‘আপনি কী কন বুঝি না আমি।’ আমার মাতৃদেবী দেখলেন হাতে পাওয়া সাফল্য ছিটকে গেল বলে! সাকসেস রেট নীচে চলে যাবে… ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি সামলে দিয়ে ডিল পাকা করলেন।

আমার এক পিসি ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে ছেলের উপর রাগ করে উঠে এসেছিলেন এই বলে, “তুই এক কাজ কর একটা বরমালা এনে এখনই পরিয়ে দে, আমি চললাম।’

ভাইটি খুব অল্প বয়সে চাকরি নিয়ে বাইরে যায়, হাত পুড়িয়ে খায়। বেচারার আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছিল না। না পারত সন্ধ্যাবেলার পার্টিতে বসতে। চাকরি পাওয়ার আট বছর বাদে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ভাইটির মা দু’বছর ধরে ছত্রিশটি পাত্রী দেখেছেন, আর সব ক’টা না করার অকাট্য যুক্তি দিয়ে সম্বন্ধ বানচাল করেছেন।

এই প্রথম ভাইটি নিজে গেছিল দেখতে। পাত্রী দেখতে ভালো, বাড়িঘর ভালো, পড়াশোনাতেও মন্দ নয়। আট মাস বাদে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। আর এইখানেতেই বাঁধল মুশকিল।

মা বললেন, ‘পরীক্ষাটা দিয়ে পাস করে নিক, তারপরে পাকা কথা হবে।’ ছেলে দেখল সমূহ বিপদ, আবার একটা অজুহাত মা পেয়ে গেছে।

ছেলের মাসি মেয়ে দেখতে এসে ছেলেকে আড়ালে ডেকে বলেছিলেন, “শোনো বাবু, যদি সারাজীবন ব্যাচেলর না থাকতে চাও, নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজেই নিও।’

বাবু ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘পরীক্ষা হতে এখন অনেক দেরি। বিয়ের পর অনেক সময় পাবে।’ ব্যস, এতেই আগুনে ঘি পড়ল।

—আমি থাকতে এত বড়ো কথা। তোর বিয়ে তুই কর, বলে আমার পিসি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যান। বিয়ে সেই পাত্রীর সাথেই হয়েছিল এবং একমাসের মধ্যে। ছেলের জেদের কাছে হার মেনে মা অবশেষে রণে ভঙ্গ দেন।

এবার শোনাই আমার এক মাসতুতো শ্যালিকার মুখ থেকে শোনা গল্প। মাসতুতো শ্যালিকার ছিল এক বিধবা পিসিমা। পিসিমা এক ছেলে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হন। জীবনের অনেক ঝড় ঝাপটা একাই সামলে ছেলেকে মানুষ করেন। ছেলে বিখ্যাত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। যাদবপুরে কচুরিপানা ভর্তি জমি রাত জেগে জবরদখল করে তার উপর বাড়ি তুলেছেন পিসিমা। সেই জায়গা এখন উঠতি বনেদি পাড়া, আর সেই টালির চালের বাড়ি এখন তিন তলা আলিশান অট্টালিকা। পিসিমা কর্পোরেশন স্কুলে চাকরি করেন। এইমত অবস্থায় উপযুক্ত পাত্রর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলেন পিসিমা।

পিসিমার আপন বলতে দাদা, বউদি আর ভাইঝি। যেখানেই পিসিমা পাত্রী দেখতে যান, সাথে যান দাদা, বউদি ও ভাইঝি। জীবন যুদ্ধে প্রচুর লড়াই করে পিসিমার রসবোধ কমে কথাবার্তায় বেপরোয়া ভাব এসে গেছিল। মেয়ে দেখা হয়েছে, মেয়ে পছন্দও হয়েছে। ঠিক হল এবার ছেলে এসে দেখলেই বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে।

একটা ঘরে ফেরার গল্প (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অর্জুন কে চুপ হয়ে যেতে সাঞ্ঝা আবার প্রশ্ন করল, ‘কেন স্কুল থেকে পালালে?’

—যার বাপ-মা নেই, সে তো অনাথ। অনাথের আবার ঘর কীসের! পরিবার কীসের! বাপ-মায়ের পদবি, নিজের নাম থেকে মুছে দিলাম। ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছোলাম এই হাওড়া স্টেশনে। সাথে ছিল আমার স্কুলের বইপত্র ভর্তি একটা স্কুলব্যাগ। রাতে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে একা একা বসে, সেই বইগুলো পড়তাম। খিধে পেলে এর ওর কাছ থেকে খাবার চাইতাম। কেউ কেউ কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। কেউ আবার দয়া পরবেশ হয়ে আধ-খাওয়া খাবার ছুড়ে দিত। ধীরে ধীরে রেল পুলিশ থেকে শুরু করে, অনেক নিত্যযাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপকদের নজরে পড়লাম আমি। আসা যাওয়ার পথে, তাদের অনেকেই যেচে এসে আমার সাথে কথা বলতেন। পড়াশোনা করে, পরীক্ষা দিয়ে, বড়ো হয়ে যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, তার জন্য উৎসাহ দিতেন তাঁরা। এইরকমই একজনের অনুপ্রেরণায়, উদ্যোগে ন্যাশনাল ওপেন স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলাম। মাঝেমধ্যে হাওড়া স্টেশনে কোনও গণ্ডগোল হলে, পুলিশের তাড়া খেয়ে, কলকাতার দিকে পালিয়ে যেতাম। তখন কোনওদিন ধর্মতলায় মেট্রো-সিনেমার নীচে, কোনওদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সামনের ফুটপাথে শুয়ে রাত কাটাতাম। এইরকম ভাবে চলতে চলতে একদিন মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে গেলাম। ইতিহাসে মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম। বড়ো এক সরকারি অফিসারের পরামর্শে কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসারের চাকরির পরীক্ষায় বসলাম। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, কলকাতার এক অফিসে অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হলাম। কিন্তু হাওড়া স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতে মন চায়নি কোনওদিন। গত তিন বছর ধরে, এদেরকে নিয়েই আছি এইখানে। আমাকে নিয়ে মোট একুশজনের বাস এখানে। তুমি থাকতে চাইলে, আমরা বাইশজন হব…!

ওর পোষ্যদের সারাদিনের দায়িত্ব শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝা’র উপরে চাপিয়ে দিয়ে, এর পরে আরও বছর তিনেক বেশ নিশ্চিন্তে কলকাতায় তার অফিস-কাছারির কাজ সামাল দিয়েছে অর্জুন। রোজ সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মে ফিরে এসে হ্যাজাক জ্বেলে পোষ্যদের নিয়ে যথারীতি রাতস্কুল চালিয়েছে সে। ইত্যবসরে শ্রাবণী যেমন হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে, সাঞ্ঝাও মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে। বিল্টু আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। কিন্তু অর্জুনের মাথায় ঘুরছে, আরও অনেক বড়ো পরিকল্পনা। গত এক বছরে অফিসের বড়ো কর্তাদের কাছে বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছে সে— রাঁচি শহরে তার ‘বদলি’ প্রার্থনা করে।

নতুন বছরের শুরু থেকেই শ্রাবণী, সাঞ্ঝা ও অর্জুন— তিনজনের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে; বিল্টুকে দিয়ে যে করেই হোক মাধ্যমিকে ভালো ফল করাতেই হবে। সেই দিনটা ছিল, বিল্টুর মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। বিল্টুকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে, অর্জুন অফিসে ঢুকতেই, বড়োকর্তা অর্জুনের হাতে ওর বহু-প্রার্থিত ‘রাঁচি-বদলির’ অর্ডারটা ধরিয়ে দিলেন।

অগত্যা রাঁচি যাওয়ার আগে, শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝার উপর তার পোষ্যদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, অর্জুন ওদেরকে জানাল, ‘সামনে আমাদের অনেক বড়ো দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি থাকতে হবে। এখন সবার আগে আমাকে রাঁচিতে গিয়ে চাকরিতে জয়েন করতে হবে। তারপরে আমার সব পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ করতে পারলেই, এখানে ফিরে এসে তোদের সবাইকে নিয়ে রাঁচি চলে যাব। ততদিন তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই রাত-স্কুল চালানোর সব দায়িত্ব তোদের উপরেই রইল।”

এর প্রায় বছর খানেক বাদে, একদিন ঝাড়খণ্ডের রাজরাপ্পার মন্দিরে ছিন্নমস্তা দর্শন সেরে, অর্জুনের কলকাতা অফিসের প্রাক্তন বড়োকর্তা অম্বরীশবাবু ট্রেকারে করে, রামগড় সদর মোড়ে এসে নামলেন। সেখান থেকে ট্রেকার পালটে রাঁচি যেতে হবে। ট্রেকার স্ট্যান্ডে পৌঁছে, রাঁচি যাওয়ার একটা ট্রেকারে উঠে বসতেই, অম্বরীশবাবুর সাথে অর্জুনের দেখা হয়ে গেল।

অর্জুনই প্রথমে কথা বলল, ‘স্যার, আপনি এখানে?’

—এই তো কাল এসেছি এখানে। রাজরাপ্পা গিয়েছিলাম; ছিন্নমস্তা দর্শনে। আজ রাতেই রাঁচি থেকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেন ধরব। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ? তোমার তো এখন রাঁচিতে থাকার কথা, অম্বরীশবাবু জানতে চাইলেন অর্জুনের কাছে। অর্জুন এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, তার পাশে বসা দুই মহিলার সাথে অম্বরীশবাবু’র পরিচয় করিয়ে দিল।

—এদের কথা আপনাকে আমি আগে অনেকবার বলেছি; আজ এদের সাথে দেখা হয়ে গেল আপনার। এর নাম শ্রাবণী, আর এ হচ্ছে সেই সাঞ্ঝা। আপনি তো জানেন, ও ভুটকি গ্রামের মেয়ে। সেই ভুটকি গ্রামে একটা বাড়ি বানিয়ে, সেখানে মেয়েদের একটা স্কুল চালু করেছি। সেটা এখন সাঞ্ঝাই চালায়। আশপাশের গ্রাম থেকে আপাতত জনা পঞ্চাশেক ছাত্রী পাওয়া গিয়েছে। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে সকলের। সাঞ্ঝাকে ফিরে পেয়ে, শুধু ওর পরিবার নয়, গোটা মহকুমার মানুষ উল্লসিত, গর্বিত। বিডিও, মহকুমা শাসক থেকে শুরু করে জেলা শাসক পর্যন্ত, সকলেই সাঞ্ঝার এই ঘুরে দাঁড়ানোকে, ওর এই কৃতিত্বকে সাধুবাদ জানিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

অর্জুনের কথা শুনে অম্বরীশবাবু’র চোখেমুখে খুশির ঝলক। অর্জুনের কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, “বাঃ! এ তো দারুণ খবর! তবে এ তো গেল সাঞ্ঝার কথা। শ্রাবণী কী করছে এখন?”

—এই রামগড়ে আপাতত একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, অনাথ শিশুদের সেখানে রেখে, তাদের পড়াশোনার একটা বন্দোবস্ত করেছি। তবে আমি আমার অফিস সামলে, ওদের দেখাশোনা করার জন্য কতটুকুই বা আর সময় পাই! অনাথ আশ্রমের সবটা শ্রাবণী’ই দেখাশোনা করে।

—আর তোমার হাওড়া স্টেশনের পোষ্যদের কী খবর? তাদেরকে তুমি রামগড়ে নিয়ে এসেছ না-কি!

—না, না! ওরা ওদের জায়গাতেই আছে। প্রতি শনি-রবিবার দুটো দিন হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পোষ্যদের কাছে ছুটতে হয় আমাকে। সারা সপ্তাহ ধরে বিল্টুই ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব সামলায়। তবে সম্প্রতি ও আবার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগামী বছর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে সে। ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে, ওদের সবাইকে রামগড়েই নিয়ে আসার কথা ভাবছি। কিন্তু এতজনকে রাখতে গেলে, নিজেদের একটা বড়ো বাড়ি হলে ভালো হয়।

কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে অর্জুন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আবার কথায় ফিরে আসে সে, ‘এই দেখুন, কথা বলতে বলতে আসল লোকের সাথেই তো আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছি। এ হচ্ছে, আমাদের সেই শান্তা। ও এখন এখানকার স্থানীয় একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি’তে পড়ছে। এই রামগড়ের আশ্রমে, শ্রাবণীর হেফাজতেই থাকে ও। শান্তা এখনও একই রকমের শান্ত। তবে ও শুধু আমাকে জানিয়েছে যে, ও বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চায়।’ শান্তাকে আদর করতে করতে অম্বরীশবাবুর সঙ্গে শান্তারও পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলল না অর্জুন।

সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে, মুখে একগাল হাসি নিয়ে, অম্বরীশবাবু অর্জুনের কাছে জানতে চাইলেন, “কিন্তু এই ছুটির দিনের সকালে, এমন সদলবলে তুমি কি হাওড়ায় চললে না-কি?’

না, না, এই সপ্তাহে আমার আর হাওড়া যাওয়া হচ্ছে না। তবে আমার বদলে এই সপ্তাহে শ্রাবণী হাওড়া যাচ্ছে আজ। দু’দিন থেকে, পরশু দিন ফিরে আসবে ও।

অর্জুন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, অম্বরীশবাবু ফিরে জানতে চাইলেন, “তাহলে তুমি চললে কোথায়!”

—সম্প্রতি দাদু’র সাথে চিঠির আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই জানলাম, ইদানীং দাদুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দাদুকে আমার বর্তমান কর্মকাণ্ডের কথা সব জানিয়েছি!

—সব! অম্বরীশবাবু’র গলায় এবার অন্য রকমের সুর!

—হ্যাঁ, সব! তাই দাদুর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে, দীর্ঘদিন বাদে আজই প্রথম ঘরে ফিরতে চলেছি আমি। অম্বরীশ চ্যাটার্জীর সাথে কথা বলতে বলতে মুচকি হেসে এবার সাঞ্ঝার দিকে একবার তাকাল অর্জুন!

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (১-পর্ব)

সকালে ঘুম থেকে উঠে টয়লেটে যেতে, আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে অর্জুনের। ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে, কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল সাতটা বাজে। এইসময় টয়লেটে ঢুকতে গেলে, লম্বা লাইনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। রোজ সাধারণত ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যে টয়লেটে ঢুকে, একেবারে প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে নেয় অর্জুন। এর থেকে বেশি দেরি হয়ে গেলেই, হাওড়া স্টেশনের তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এই টয়লেটে সহজে ঢোকার সুযোগ পাওয়াটা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে।

দূরপাল্লার ট্রেনগুলো ভোরবেলায় ঠিক এই সময় থেকেই একের পর এক ঢুকতে শুরু করে হাওড়া স্টেশনে। যেসব প্যাসেঞ্জারদের ট্রেন থেকে নেমে, ট্রেন পালটাতে হয়, তারা এইসময় টয়লেটে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সবাই। এদের পিছনে লাইন দিতে হলে, সেদিনকার মতো সব কাজ যে মাথায় উঠবে, তা খুব ভালো করে জানে অর্জুন।

অর্জুন মনে মনে ভাবে, আজকের এই গণ্ডগোলের মূলে হচ্ছে গতকাল রাতের কালবৈশাখীর ঝড়। গতকাল রাত আটটা নাগাদ শুরু হয়ে, কয়েক দফায় যে ভীষণ বেগে এবছরের প্রথম কালবৈশাখীর ঝড় আছড়ে পড়েছিল, তাতেই তো সমস্ত রেল-যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। ওই ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গী ছিল অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি। সেই ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব যখন থামল, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা পার হয়ে গিয়েছে।

হাজার হাজার প্যাসেঞ্জার অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। তারা কেউ লোকাল ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবে, কেউ আবার বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন ধরবে বলে হাজির হয়েছে হাওড়া স্টেশনে। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা, সবার সে এক নিদারুণ অসহায় অবস্থা! সেই ঝড়-বৃষ্টির পর থেকে সারারাত, না আর কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশনে ঢুকেছে; না কোনও ট্রেন হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে বেরোতে পেরেছে।

গতকাল রাতে ঝড় যখন উঠল, অর্জুন তখন ওর দলবল নিয়ে হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন গোডাউনের পাঁচিলের কোল ঘেঁষে বসেছিল। ওর দলবল বলতে এক পাঁচ বছর বয়সি থেকে শুরু করে, আঠারো-ঊনিশ বছর বয়স পর্যন্ত কয়েক জন কিশোর-কিশোরী মিলিয়ে জনা বিশেকের একটা দল। এদের সবাইকে এককথায় ‘অনাথ’ বলা চলে। কিন্তু অর্জুন তা মানতে রাজি নয়। অর্জুন বলে, ‘এরা সবাই আমার পরিবারের!” রোজ সন্ধ্যায়, মাঝখানে একটা হ্যাজাক জ্বেলে বসে অর্জুন। তাকে ঘিরে গোল করে বসে থাকে বাকি সকলে। অর্জুন ওদের গুরু। গুরুর কাছে পাঠ নিতে, সন্ধ্যা সাতটা বাজতে না বাজতেই যে যেখানে থাকুক না কেন, সকলেই এসে হাজির হয় হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই গোডাউন লাগোয়া পাঁচিলের গোড়ায়।

ওদের প্রত্যেককে একটা করে পিঠব্যাগ কিনে দিয়েছে অর্জুন। সঙ্গে দিয়েছে বই, খাতা, কলম, পোশাক; যার যেমন প্রয়োজন। পড়াশোনার স্তরও একেক জনের একেকরকম। সবচেয়ে বড়ো যে ছেলেটি, তার নাম বিল্টু; বয়স সতেরো আঠারো হবে। ওর ব্যাগে রয়েছে ক্লাস সিক্সের বইপত্র। বিল্টু কীভাবে এই হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তা অর্জুন অনেকবার বিল্টুর কাছে জানতে চেয়েছে। কিন্তু বিল্টু কিছুতেই তার জবাব দিতে পারে না। শুধু ওর কথাবার্তা থেকে অর্জুন বুঝতে পারে— ও কোনও সাঁওতাল মা-বাবার সন্তান। বিল্টুর পড়াশোনায় আগ্রহ থাকলেও, ভিতটা খুব দুর্বল হওয়ায়, অর্জুন ওকে গত দু’বছর আগে ক্লাস ফোরের স্তর থেকে সব বইপত্র কিনে দিয়ে, তালিম দিতে শুরু করেছিল। বয়স অনুপাতে অনেকটা পিছন থেকে শুরু করলেও, বিল্টুর অধ্যাবসায় যথার্থভাবেই ওকে ক্লাস সিক্স স্তর পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে।

আর বিল্টুর সমবয়সি যে-মেয়েটি, সে হল শ্রাবণী। আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। শ্রাবণীর মা-বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ত। ওর কতই বা আর বয়স হবে তখন; বছর এগারো হবে। মেদিনীপুর জেলার শ্যামচকে ওদের বাড়ি ছিল। একরাতে ঘুমের মধ্যেই শ্রাবণী টের পায়, ওদের গ্রামের সেই খড়ের চালের ঘরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ভয়ে আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবণী একরাশ ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। মালপত্র বের করতে গিয়ে, চালচাপা পড়ে ঘরের মধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে ওর মা-বাবা মারা গিয়েছিল সেদিন।

ক্রমশ…

 

ভুলের মাশুল (২-পর্ব)

(পর্ব-২)

টেকো ওসি রামদাস টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে কথোপকথন শুরু করলেন।

—কী মশাই একেবারে রসের ভাণ্ডার হয়ে বসে রয়েছেন যে!

—হে, হে, তা যা বলেছেন, রস ছাড়া তো জীবন অচল। পৃথিবী তো রসেরই ভাণ্ডার। ফলের রস, তালের রস, আখের রস, খেজুর রস, রসগোল্লার রস…।

—থামুন, এইবার আমি আপনার দুটো রসগোল্লার রস বার করব!

ঘাড় নাড়লেন মোহিত দাস। অমিত সেন এবং আশেপাশের বাড়ির দু-চারজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।

—মনিকা কে? একেবারে বাজখাঁই গলায় খেঁকিয়ে উঠলেন পাঁচতলা থানার ওসি। নামটা শোনার পর মোহিত দাসের চেহারায় কোনও ভাবগতিক লক্ষ্য করা গেল না। সেটা দেখে আরও সুর চড়ালেন ওসি।

—স্পিক আউট, স্পিক আউট, টেল মি হু ইজ মনিকা। কিন্তু যাঁকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা, সে ফ্যালফ্যাল করে শুধু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এইবার রামদাসবাবু পুলিশি বিক্রম দেখাতে তার হাতের লাঠিটা মোহিতবাবুর চিবুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘মনিকা, মাই ডার্লিং, শালা আপনার পিছনে এই লাঠি …!’ মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “স্যরি, ভেরি স্যরি, আসলে…।’ অন্য ছন্দে ফিরলেন তিনি।

মোহিতবাবুর আয়াকে আলাদা করে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, অয়ন দাসের বাড়ির পজিশন ইত্যাদি দেখে ফিরে গেলেন ওসি রামদাস মণ্ডল। যাওয়ার সময় তার সনাক্তকরণ রিপোর্টও প্রকাশ করে গেলেন। এটা বয়সজনিত মানসিক দুর্বলতা। জীবনের চলার পথে এসব এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

অমিতবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে উত্তর করলেন ওসি, ‘ভুল তো মানুষ মাত্রই করে, মিঃ সেন, না কি?’ বাদী পক্ষের অয়ন দাস নীচে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে এ ব্যাপারে আর বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ দিয়ে আসল নাটকের মঞ্চ ছেড়ে জিপে উঠলেন ওসি।

মোহিতবাবুর সেই ঘটনা অনেক রজনী অতিক্রান্ত করেছে। কিন্তু আমিতবাবুর এইরকম ভুল মাঝে মাঝেই কেন হয়, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না। ওসি রামদাসের কথা মতো মোহিতবাবুর সঙ্গে তুলনা করতে থকেন তিনি। কিন্তু অমিতবাবুর তো করোনা হয়নি। তাহলে? অমিতবাবুর স্ত্রী বিমলাও স্বামীর নানাবিধ অস্বাভাবিক ব্যবহারে নাজেহাল হয়ে যান। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তিনি নিরুপায়।

আজকের ঘটনাটাই ধরা যাক। বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটাপথে ভগবানদাস পার্কে প্রত্যেকদিন সকালে একেবারে নিয়ম করে প্রাতভ্রমণে বেরোন অমিত সেন। সকালে টয়লেটে গিয়ে দেখেন জল নেই। তার মানে, মিউনিসিপালিটির কলের জল গতকাল রাতে আসেনি। এখন একমাত্র ভরসা ভূগর্ভস্থ জল। অমিতবাবু চাবি নিয়ে একতলায় পাম্প ঘরে সুইচটা অন করে হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের পেল্লাই ট্যাঙ্ক ভরতে প্রায় এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। ততক্ষণে তিনি বাড়ি ফিরে আসবেন। কিন্তু ঘটনাটা যে এরকম ঘেঁটে বর্ণপরিচয়ের সব অক্ষর ধারণ করবে তা তিনি বুঝতে পারেননি। তাহলে কি তার মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কার্যক্ষমতা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। তিনি কি অ্যালজাইমার রোগের শিকার! আজকাল কিছুই বুঝতে পারেন না অমিতবাবু। সেদিন মোহিবাবুর বাড়িতে এসে কেমন যেন একটা উপলব্ধি হল।

ভগবানদাস পার্কে দু-পাক চক্কর মেরে নিত্যদিনের মতো পার্কের বাঁধানো পাথরের বেঞ্চে বসে কপালভাতি প্রাণায়ম করছিলেন অমিত। কেষ্ট দাস আর তারক সিং এসে পাশে বসে পড়ল। কপালভাতি চটকে গেল। বিহারের ছাপরা থেকে কলকাতায় এসে একটা ওষুধের দোকানে কাজ করে তারক সিং।

ক্রমশ…

ভুলের মাশুল (১-পর্ব)

এখন সকাল। রোদ্দুরের তেজটা সেরকম বোধ হচ্ছে না। প্রিন্সেপ ঘাটের উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে আছেন অমিত সেন। ফোর্ট উইলিয়ামে কাজ করার সুবাদে আগে এখানে কতবার এসেছেন। এখন আর সেরকম ভাবে আসা হয় না। ঘাটের চারপাশজুড়ে আকাশ কমলা হওয়ার দৃশ্যটা কতদিন দেখেননি তিনি! চার দিকের ভিড় কমে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। এটাই স্বাভাবিক। বাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে প্রায় সবাইকে নিজের কাজে বেরুতে হবে। সে তাড়া অমিত সেনের নেই। আজ তাঁর একটু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করবার দরকার ছিল। তাই সটান চক্র রেলে চেপে এখানে এসেছেন।

আজ আবার ঘটনাটা ঘটল। এই নিয়ে কতবার যে হল আর মনে করতে পারছেন না অমিত সেন। কিছুদিন আগে বাসে উঠে মনে পড়ল দরজাটা লক করা হয়নি। মাঝরাস্তায় বাস থেকে নেমে রিকশা করে বাড়ির সামনে এসে দেখেন তার ধারণা ভুল। দরজা বন্ধ। ব্যাংক-এ পাশবই আপ ডেট করতে গিয়ে দেখেন পাশবইটা সঙ্গে আনা হয়নি। এসব তো ঠিক আছে। কিন্তু আজকেরটা একেবারে সাংঘাতিক ভুল। কথায় বলে ভুলের মাশুল। কড়ায় গণ্ডায় একেবারে বারো হাজার টাকা বেরিয়ে গেল। এরপর চলবে জলকষ্ট। তাঁদের চার-পাঁচটা বাড়ির পরে থাকেন মোহিত দাস। তিনি কিছুদিন করোনা রোগের শিকার হয়েছিলেন। যমে-মানুষে টানাটানি করে বাড়ি এলেন কিন্তু ব্রেন-এর অবস্থা খুব খারাপ। কিছুই মনে রাখতে পারেন না। উলটোপালটা বকেন। মোহিতবাবু-র একমাত্র মেয়ে বিদেশে। আয়া-নির্ভর জীবন। আয়ার চড়-চাপট খেয়ে জীবন কাটে। সেই মোহিত দাসের বাড়িতে কিছুদিন আগে পুলিশ এল। দীর্ঘদিন একই পাড়ায় থাকার সুবাদে মোহিত দাসের সঙ্গে অমিত সেনের ভালোই সখ্যতা আছে। আজকাল অবশ্য দেখা সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। অভিযোগ মারাত্মক। মহিলার শ্লীলতাহানি।

আশেপাশের বাড়ি থেকে গুঞ্জন উঠল, তাহলে কি আয়ার সঙ্গে! এই বয়েসে! ছিঃ ছিঃ ইত্যাদি। পরের ঘরের কুৎসা পেয়ে যে যত পারে বেলুন ফোলাতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার এইসব ঘটনাকে মোহিতবাবুর সাময়িক যৌন উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আখ্যায়িত করল। অমিতবাবুর এইসব ন্যাস্টি কথাবার্তা মোটেই ভালো লাগল না। তিনি নিজে মোহিতবাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন ব্যাপারটা অন্য। এক্কেবারে রোমান্টিক।

অয়ন দাস তাঁর স্ত্রী মনিকাকে নিয়ে মোহিতবাবুর পাশের বাড়িতেই থাকেন। উত্তর কলকাতার বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে লাগানো। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ঝপাং ঝপাং করে লাফিয়ে চুরি করতে চোরেদের এখানে খুব মজা। এখন অবশ্য এসব ঘটনা শোনা যায় না। তবে উঁকি ঝুঁকি মারলে প্রতিবেশীর বেডরুমে চোখ পৌঁছে যায়। সেই চোখই হয়েছে ভিলেন।

মোহিতবাবু নাকি প্রায়শই অয়নবাবুর বাড়িতে উকিঝুঁকি মারেন। মনিকাকে নাম ধরে ডাকেন। বয়সে বড়ো, তাছাড়া ভুলো মনের মানুষ এইসব ভেবে অয়ন বা মনিকা খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু শেষ কয়দিন মোহিবাবুর মাথার ব্যামো একেবারে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রায়ই কলতলায় যাওয়ার সময় জানলার ফাঁক দিয়ে ‘মনিকা, মনিকা’ বলে হাঁক পেড়ে চলে যান। এতেও ঠিক ছিল। তিন দিন আগে দু’তিনবার, ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’ সুর ভেঁজেছেন। ব্যস আর যায় কোথায়! রাহুল দেব বর্মনের এই কীর্তিকে একেবারে খাটো করে দেখতে রাজি নন তারা। একটা এসপার ওসপার করে ছাড়বেন। তাই সহ্য করতে না পেরে অবশেষে অয়ন-রা পুলিশের দারস্থ হয়েছেন। পুলিশ যদি বুড়োকে একটু আচ্ছা করে কড়কে দেয়।

পাঁচতলা থানার ওসি রামদাস মণ্ডল একজন রসিক এবং সমপরিমাণ বদমেজাজি ব্যক্তি। নিজে মাঝেমধ্যে পাড়ার গজিয়ে ওঠা শখের থিয়েটারে ছোটোখাটো পার্ট করে প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছেন। খুব সহজেই সমস্যার সমাধান করেন বলে পুলিশমহলে বেশ ওজনদার। রামদাস ওসি যখন মোহিত বাবুর কাঁটাপুকুরের বাড়িতে এলেন, তখন অমিতবাবু একটু অবাকই হলেন। সিনেমার শুটিং-এর মতো ক্যামেরার পরিবর্তে হাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করে চোখের সামনে এনে বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করে মোহিত বাবুকে মাপতে লাগলেন। হি ইজ পারফেক্টলি অল রাইট। তার কথা শুনে মোহিতবাবু দেঁতো হাসি হাসলেন। অমিতবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ক্রমশ…

 

 

দুর্গা (পর্ব-৩)

পর্ব – ৩

আজও বেশ মনে আছে দুর্গার লালকালিতে লেখা প্রথম প্রেমপত্রটি দলমঘাটা বাস রাস্তায় এসে লাইট পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে শুভায়ু প্রায় তিরিশবার পড়েছিল। ইচ্ছে করেছিল, তার সেই পবিত্র নিষ্পাপ ভালোবাসার কথা পৃথিবীর সবাইকে জানাতে। সে কারণে সে সন্ধেবেলা প্রেমপত্রটি দেখাতে শোভনের বাড়ি ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও দুর্গার লেখা প্রেমপত্র শোভনকে সে দেখাতে পারেনি। একটা অপরাধবোধ তার মনকে সতর্ক করে দিয়েছিল।

সে এক পা এগিয়ে আবার দু’পা পিছিয়ে এসেছিল। তার কারণ হল দুর্গা শোভনের দাদার শালি। শোভনের দৌলতেই শুভায়ু দুর্গাদের বাড়িতে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে। শোভনকে চিঠিটা দেখালে যদি সে রাগ করে, যদি তাকে ঘেন্না করে, তা হলে তো শুভায়ুর সব আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই সে দিন শোভনকে চিঠিটার কথা বলতে পারেনি।

ইতিমধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। দুর্গার সঙ্গে শুভায়ুর প্রেম যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল, শুভায়ু ভালো ভাবেই পাস করেছে। কিন্তু শোভন কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছে। শোভনের কম্পার্টমেন্টাল পাওয়ার কারণ হল লেখাপড়ায় তার যতটা না মন ছিল, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল ছাত্র রাজনীতিতে। রাজনীতি করতে গিয়েই তার লেখাপড়ার এই হাল হয়েছিল।

যাই হোক, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে শোভন যখন মনে প্রাণে ক্ষতবিক্ষত, তখনই সে ঠিক করল যে-দিকে দু’- চোখ যায় চলে যাবে। এ পোড়া মুখ নিয়ে বারড্রোন গ্রামে সে আর থাকতে রাজি নয়। একটা কিছু কাজ জোগাড় করে তবেই সে গ্রামে ফিরবে, নচেৎ নয়। শোভনের মনের কথা জানতে পেরে শুভায়ু তখন তাকে বলেছিল, ‘আমিও তোর সঙ্গে যাব।’

সে কথা শুনে শোভন বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘তুই ভালো ভাবে পাস করেছিস। তুই আমার সঙ্গে জাহান্নামের পথে কেন যাবি? তা ছাড়া তোকে কলেজে ভর্তি হতে হবে। তোর এখানে থাকা দরকার।’

শুভায়ু বলেছিল, ‘তোকে জাহান্নামের পথে একা ঠেলে দিতে পারব না। তা ছাড়া তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। আমি তোর সঙ্গে যাবই।’

শুভায়ু জেদ ধরে থাকায় শোভন আর বারণ করতে পারেনি। তার পর একদিন কাউকে কিছু না বলে হাওড়া স্টেশনে এসে পাটনার টিকিট কেটে গয়া প্যাসেঞ্জারে দু’জনে উঠে বসল। ট্রেনটা যখন ধানবাদ স্টেশনে এসে পৌঁছোল, তখন শুভায়ুর বাড়ির জন্য মন কেমন করে উঠেছিল।

শুভায়ু বলেছিল, ‘বাড়ির লোকেরা যদি তোর খোঁজ না পেয়ে পুলিশে খবর দেয়, তাহলে কী হবে?’

—যা হওয়ার তাই হবে। তবে আমি শুধু পাটনায় যাওয়ার খবর দুর্গাকে জানিয়ে এসেছি। বলে শোভন একটা সিগারেট ধরিয়েছিল।

শুভায়ু আবার প্রশ্ন করেছিল, ‘ও কিছু বলেনি।’

—তখন সে কিছু বলেনি। তবে চলে আসার আগে দুর্গা আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে। এই নে পড়ে দেখ। বলে শোভন ট্রাউজারের পকেট থেকে দুর্গার লেখা চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

শোভনের হাত থেকে চিঠিটা নিতে গিয়ে শুভায়ুর বুকের ভেতর ক্যানেস্তারা পেটানোর মতো দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছিল। তার জন্য তখন হয়তো কোনও অশুভ সংকেত অপেক্ষা করছিল। দুর্গার হাতে লালকালিতে লেখা চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই দেখা গেল তাতে লেখা রয়েছে- -দোহাই শোভনদা, তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে না এলে বুঝব আমাকে তুমি একটুও ভালোবাসো না।

—ইতি দুর্গা

চিঠিটা শোভনকে ফিরিয়ে দিয়ে শুভায়ু ট্রেনের জানলার ধারে বসে দূর আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। অব্যক্ত যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছিল তার দেহ-মন। সেই প্রথম সে বুঝতে পেরেছিল নারী কী বিষম বস্তু। নারী যেমন ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ মানুষকে রাজা বানাতে পারে, তেমনি আবার চূড়ান্ত ছলনা করে পথেও বসাতে পারে। দুর্গা শোভনকে ভালোবাসে বলে তার একটুও দুঃখ হয়নি। দুঃখ হয়েছে শোভনকে ভালোবাসার কথা দুর্গা কেন গোপন করল। নারী যে ছলনাময়ী, এ কথা দুর্গা সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

ক্রমশ…

 

চান (পর্ব ২)

পর্ব ২

“শিল্‌দা শিল্‌দা আইছে। নামবে আস।’ বাসের হেল্পার কাম্ কন্ডাক্‌টর চেঁচিয়ে উঠল। হুড়মুড় করে একগাদা মানুষ হাঁড়িকুড়ি ছানাপোনা, পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে নেমে যায়। আর একদল ওঠে। বাস ছেড়ে দেয়। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে বীণপুরের উদ্দ্যেশে চলে ঝাড়গ্রামগামী বাস। বীণপুরে অনেকটা সময় দাঁড়ায় বাস। চা-জলখাবার খায় ড্রাইভার, যাত্রীরা।

সূর্য উঠে পড়েছে আলসেমি ছেড়ে। কাঁচারাস্তায় বাস হুহু করে এগিয়ে চলেছে। দুপাশে মহুয়া, শাল, বহেড়া গাছ রোদ মাখছে। শীত আর নেই। বেশ ভালো লাগে কুড়ানির। অন্যদিনের মতো সকালে পান্তা খায়নি। আজ উপোস। কিন্তু খিদের কথা মনেই আসছে না আজ। এমনিতে খিদে সইতে পারে না। ভারী শরীর। কাজও যেমন করে, খায়ও গবর গবর। শরীরও তাই বাঁধানো ঘাটের মতো। দিবা বাগ যখন তখন বাঘ হয়ে উঠেও কিছু জৌলুস কমাতে পারেনি। বরং কুড়ানিই শরীর পেতে আশ্রয় দেয়, যথেচ্ছ ব্যবহারের আনন্দ দেয় শান্তভাবে। দিবা উঠে গেলে পালদের পুকুরে একটা ডুব মেরে শরীর ঠান্ডা করে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।

বাসের দুলুনিতে ঝিমুনি এসেছিল। দুটো গরু রাস্তার উপর হঠাৎ উঠে আসায় ড্রাইভার হাওয়া-ব্রেক মারে। বাসশুদ্ধ লোক হুড়মুড় করে এ ওর গায়ে। কুড়ানি পড়ে যাবার আগেই ডানহাত ইঞ্জিনের উপর উঁচু জায়গায় আটকে যায়। হাওয়াই চটি ছিটকে যায়। কুড়ানি লজ্জা পায়। মুখে লাজুক হাসি। এদিক ওদিক তাকায়। পা দিয়ে চটিটা টেনে নিয়ে কোনওক্রমে পায়ে গলিয়ে ফেলে। আসলে এত সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই অনেকদিন। আর রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। সকালে উঠতে হবে, ভোরের প্রথম বাস ধরতে হবে এই ভেবে।

ছেলেবেলায় মার সাথে খুব ভোরে উঠত। উঠে জলা-জায়গায় যেতে হতো খড়িকাঠি চুপিচুপি আনতে। মা-র মুখে শুনেছে বাবা পানু ঘোড়ই খুব বড়ো খড়িয়াল ছিল। বাবারা এখানে থাকত না। সবং-এ থাকত। সেখানে নদী ছিল, চণ্ডী নদী। কেলেঘাই-এর শাখানদী ওটা। বাবাদের গ্রামের নাম ছিল শ্যামসুন্দরপুর। মজা- নদীর চরে খুব সরু সরু খড়িগাছ হতো। গাছ কেটে শুকিয়ে ঝোড়া বুনত ওরা। দেখতে বেতের কাঠির মতো। খুব সুন্দর বুনোট। ঝোড়ার কানার দিকে অনেকটা মোটা বেষ্টনী থাকত, ধরার সুবিধার জন্য। স্থানীয় বাজারে শুধু নয়, বাইরেও চালান যেত সে সব। খুব কদর ছিল। বাবার খুব নামডাক ছিল একাজে। মা গেঁওখালির পাল্টি ঘর। কাজ জানত। বাবা মরে গেলে কেন যে সে কাজ উঠে গেল, কেনইবা এখানে এল ওরা, তা এক রহস্য।

বাসের গতি কমে এসেছে। বীণপুর এসে গেল বোধ হয়। ছেদো অনেকক্ষণ থেকে লটপটে মাথা নামিয়ে একটা আধুলি খুঁজছে। পায়নি। রুক্ষ গলায় আধবসা অবস্থায় চ্যাঁচাতে লাগল— ‘বীণপুর, বীণপুর।’

এখানে একটা বাস এলেই ভ্যানরিকশার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। নানা সুরে ভেঁপু বাজতে থাকে। গম্ভব্য সবই কাসাইঘাট পর্যন্ত।

যত্ন-পায়ে নেমে এদিক ওদিক একবার দেখে কুড়ানি। তারপর কাছের ভ্যানরিকশার সামনের দিকে উঠে পড়ে। আরও অনেকটা পথ। তাছাড়া শুধু যাওয়া তো নয়, ফিরতেও হবে বেলায় বেলায়। ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা। শুধু মজুমদার মশাই-র কাজ নয়। একজোড়া কাপড় আর আলতা-সিঁদুর পাওয়া নয়। তার নিজেরও একটা কাজ আছে। একটু বাঁকা হাসে। ঠোঁট বাঁকে।

বড়ো জাগ্রত এই দেবী। রক্তমুখী, রক্তবর্ণা দেবীকে তুষ্ট করে বর চাইলে অভীষ্ট পূর্ণ হয়। কুড়ানিও চাইবে। আজ পুজোর পরম লগ্নে দেবীর থানে মাথা কুটে বলবে, ‘মহুল বৃক্ষের মতো একটা খোকা দাও ঠাকুর হে।’ ওতো জানেই সন্ধ্যা গায়েন, নন্দীগ্রাম থেকে বিয়ে হয়ে এল, দশ-বারো বছর পার করেও সন্তান নেই। শেষে রঙ্কিণীর থানে মানত করেইতো বছর ঘুরতে ছেলে। এখন নিত্যপুজোয় সে সাহায্য করে।

ভটভটি নৌকোয় ওঠার আগে হাতে জল তুলে কপালে ছোঁয়ায়, মাথায় নেয়, বিড়বিড় করে কুড়ানি। পুরুলিয়ার কপিলা পাহাড়ের বুক চিরে নেমেছে এ নদী। অঞ্চলের মানুষেরা ভক্তি করে খুব। গঙ্গার মতো।

নৌকোয় উঠতে যেয়েই বাধা। দুটো ছোকরা সাইকেল নিয়ে একেবারে মুখেই দাঁড়িয়ে। ওঠবার জায়গা নেই। কুড়ানি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলতেই কিছুটা ভয়ে দুই কিশোর সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ওঠার জায়গা করে দেয়। ভটভটি আড়া কাসাইয়ের বুকে ঢুকে পড়ে। পাশ থেকে হলেও কুড়ানি বুঝতে পারে দুই ছোকরাই তার দিকে ড্যাবডেবে চেয়ে আছে। তাকাবে না! কেন! আজ ব্লাউজের নীচে আরও একটা টাইট, ছোটো জামা পরেছে। এ নিয়ে দুবার পরল। বিয়ের পর দিবার সাথে রেলগাড়ি চড়ে দূরের কুটুমবাড়ি যাবার সময় একবার। আজ নিজেরই লজ্জা লাগছিল। কিছুটা গর্বও। মোষের সিং-এর মতো ফুঁসে আছে, বুক যেন বাঁধ দেয়া বর্ষার কাসাই।

ক্রমশ …

পাথর-প্রতিমা (পর্ব – ১)

হঠাৎ নাকে একটা অদ্ভুত সবুজ গন্ধ এসে লাগল। যদ্দুর মনে হয়, পাহাড়ের গায়ের ভিজে শ্যাওলার গন্ধ। মুখের ওপর ভারি টর্চের আলো। চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। আলোর পিছনে আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আলো আর আমার চোখের মাঝখানে একটা কুয়াশার টুকরো ঝুলে আছে। হঠাৎ দপ করে আলোটা নিভে গেল। আলকাতরার মতো একটা অন্ধকার কে যেন ঢেলে দিল আমার চোখে। তারপরই একটা হিমশীতল ধাতুর স্পর্শ লাগল আমার পিঠে। পরক্ষণেই গুরুগম্ভীর একটা প্রশ্ন কালো রাত ফুঁড়ে আমার দিকে ধেয়ে এল, ‘আপনি কে? কোত্থেকে আসছেন?”

আমার গলা তখন ভয়ে আর মহুয়ার নেশায় পুরো জড়িয়ে গেছে। বেশির ভাগটাই হাতের ইশারায় আর বাকিটা অস্ফুট শব্দে বলে উঠলাম, ‘বাড়ি রাজগাঙপুর। জঙ্গলে পথ হারিয়ে গেছি।’ আমার দুটো হাত দু’জনে ধরল। তারপর মাটিতে হেঁচড়েই ওরা পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠতে লাগল। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।

এবার আমার কথা একটু বলে নেওয়া দরকার। আমার বেড়ে ওঠা উড়িষ্যার রাজগাঙপুরে। রাউরকেল্লা থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে। চারপাশে পাহাড়ের পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল আমাদের এলাকা। পাহাড়ের গায়ে থোকা থোকা শালের জঙ্গল, আবার কোথাও রুক্ষ। তবে সেই শুষ্ক পাথরের বুক ফেটেই নেমে এসেছে একটা রুপোলি ফিতের মতো নদী। নামটি ভারি মিষ্টি, কোয়েল। সেই নদীর গা ঘেঁষেই আমাদের কোয়ার্টার। মাঝেমধ্যে চাঁদের আলোয় দেখতাম সেই পাহাড়ের গা বেয়ে ভাল্লুক নেমে আসতে।

খুব গরমের সময় ভুট্টা খেতে পাহাড়ি জঙ্গল থেকে হাতির পালও নেমে আসতে দেখেছি। ভুট্টা খেয়ে নদীতে দাপিয়ে চান করত তারা। তবে ওই অরণ্যে চিতাবাঘ আছে শুনলেও কোনও দিন দেখিনি। কিন্তু আছে এটা বিশ্বাস করতাম, কারণ মাঝেমধ্যে দু’একটা গরু ছাগল উধাও হয়ে যেত। তবে এখন সবচেয়ে ভয় মানুষের। কেন? সে কথায় একটু পরে আসছি।

গ্রামে মূলত দু’ধরনের মানুষের বাস। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই হল আদিবাসী সম্প্রদায়ের। অনেকেই অভাবের তাড়নায় খ্রিস্টান। ব্রিটিশ সাহেবরা খাবার আর পোশাকের লোভ দেখিয়ে এদের খ্রিস্টান করেছিল। আর কিছু আশেপাশের কারখানায় কর্মজীবী শহুরে মানুষ। যেমন আমরা। আমার বাবা কাজ করতেন কাছেই উড়িষ্যা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। আমি পড়তাম ওখানকার ‘রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়’ স্কুলে। গ্রামের আদিবাসীরাও ওই স্কুলেই পড়ে।

বাবার কারখানার পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার। তার পাশেই বিরাট হাতিশালা। হাতিশালায় দশ বারোটা হাতি ছিল। গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরেই ডলোমাইট খনি। কারখানায় লাইমস্টোন আসত মালগাড়িতে। ইঞ্জিন মালগাড়ি রেখে দিয়ে চলে যেত। হাতি সেসব কামরা ঠেলে আনত। আমরা ছোটোবেলায় খুব মজা করে সেই সব দৃশ্য দেখতাম।

সবার ঘরেই হাঁস মুরগি ছিল। বিকেলে মাঠ থেকে খেলে ফিরে, বাড়ির হাঁস মুরগি চই চই করে ঘরে ঢোকানোর দায়িত্ব ছিল আমার। বিনিময়ে আমি ডিমের বেশি ভাগ পেতাম। সকালবেলা দুধ আনতে গেলে ঝগড়ু ভালোবেসে খেতে দিত পূর্ণ গর্ভবতী গরু মোষের সাঁজো দুধ। ধোঁয়া ওঠা গাঢ় হলুদ রঙের দুধ। ওটা বেচার নয়। এসব খেয়ে আদিবাসীদের মতোই বেশ তাগড়াই হয়েছিল চেহারাটা। তবে গায়ের রংটা শুধু ফরসা ছিল, এই যা! পাহাড়ি গ্রামের ছবি আঁকার ফাঁকে একটু স্কুলবেলার কথা বলে নিই।

আমার সাথে স্কুলে পড়ত যেমন আমাদের কোয়ার্টার-এর চাকুরিজীবীদের ছেলেরা, তেমনি আসত অ্যালেক্স ওঁরাও, জুয়েল মূর্খ, বিরজু মুণ্ডা, শিবু হেমব্রম, এইসব আদিবাসী ছেলেরা। ওদের গ্রাম ছিল পাহাড়ের কোলে মহুয়া গাছ দিয়ে ঘেরা। শীতকালে আদিবাসীরা এই মহুয়া জ্বাল দিয়ে ‘মাহুল’ বানাত। মহুয়ার গন্ধে সারা এলাকা ম-ম করত। সেই গন্ধে অনেক সময়েই পাহাড় থেকে ভাল্লুক নেমে আসত। তারপর দু’হাত দিয়ে মানুষের মতো মহুয়ার হাঁড়ি তুলে ‘মাহুল’ খেত। খাওয়ার পর সে কী হাঁটা! টলতে টলতে মাতাল পায়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে যেত।

এছাড়াও ওরা ভাত পচিয়ে হাঁড়িয়া বানাত। নেশা বেশি হওয়ার জন্য তাতে ‘বাখর’ বলে একরকম গাছের ফল মিশিয়ে দিত। তবে হাঁড়িয়া ফুটিয়ে ঠান্ডা হওয়ার সময়, হাঁড়ির গায়ে যে-বাষ্প জমা হতো, তার নাম ‘রাশি’। এর নেশা মারাত্মক। আদিবাসীরা খেত। আমি কোনও দিন খাইনি। পাকা নেশাড়ু ছাড়া অন্য কেউ সহ্য করতে পারবে না। বুধিয়া বারলা বলে আমার এক বন্ধু ছিল। পাখি মারায় ওস্তাদ। গুলতি দিয়ে কত নানা জাতের পাখি মেরে যে, তার মাংস আমায় খাইয়েছে, এখন ভাবলে প্রায়শ্চিত্ত করতে ইচ্ছে হয়।

আর একটা সাংঘাতিক কথা না বললে গল্প সম্পূর্ণ হবে না। ওরা ঠিক সন্ধে হওয়ার আগে ঘুড়ির সুতোয় বঁড়শি দিয়ে বাদুড় ধরত। বাদুড়ের ডানার চামড়ায় বঁড়শি গেঁথে যেত। তাই বলে আমি কোনও দিন বাদুড়ের মাংস খেয়ে দেখিনি। তবে বাদুড়ের হাড় ফোটানো তেল বাড়ি নিয়ে আসতাম। ব্যথায় বেশ কাজ দেয়। এই সবের ফাঁকেই কখন স্কুল পেরিয়ে গেলাম, বুঝতেই পারলাম না। এবার একটু অন্য কথায় যাব।

আমরা যখন মাঠে বিকেলে ফুটবল খেলতাম, তখন দূরে কবাডি খেলত মুনিয়া, নাচনী, বিজলি। এরা সব আদিবাসী গ্রামেরই মেয়ে। এই বিজলি আবার বিরজুর বোন। ওদের বাবা বীরসা মুণ্ডা হল আদিবাসীদের সর্দার। বিজলির শরীর ছিল কালো পাথরের মতো। যত বড়ো হতে লাগল, মনে হল যেন কোনও ভাস্কর ছেনি হাতুড়ি দিয়ে ওকে কেটে কেটে নির্মাণ করছে। কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো। গোধূলির আবির মাখা আকাশে যখন সূর্যটা কপালের লাল টিপের মতো হয়ে যেত, পাহাড়ের কালো ছায়া এগিয়ে আসত ওদের গ্রামে। কিন্তু ভুট্টা খেতটা তখনও সোনালি বাগিচা। ঠিক যেন কানে মাকড়ি, নাকে নোলক আর হলুদ ফ্রক পরা বিজলি।

আমি এখনও যেন বিজলিকে দেখতে পাই বউবাজারের সোনার দোকানে। কাচের শো-কেসের ভেতর। কালো পাথরের গয়না পরা আবক্ষ মূর্তি, ঠিক যেন বিজলি! এখনও মনে হয় সেই দোলের দিনের আবির মাখানোর আবদার কাচ ভেঙে পূরণ করে দিই। সে এক আমার জীবনের উথালপাথাল ঘটনা। আজও মনে পড়ে সেই দোলের দিনের কথা। মানে ওরা যাকে বলত ‘ফাগুয়া’।

ক্রমশ…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব