হনন (পর্ব ২)

২য় পর্ব

—এ কি! তুমি এত সাজগোজ করে জামা-কাপড় পরে বসে আছ কেন? কোনও অনুষ্ঠানে যাবে বুঝি?

কথার উত্তর না দিয়ে শ্রী বিতানকে জাপটে ধরে খাটে বসিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘কেন আমাকে দেখতে যথেষ্ট সুন্দর লাগছে না বুঝি? দ্যাখো… দ্যাখো… দ্যাখো ভালো করে। তোমার জন্যই তো সাজলাম। এগুলো কেরালার গয়না, জানো? বাবা কেরালার কান্নুরে পোস্টেড ছিলেন। তখন কিনে দিয়েছিলেন এগুলো।’ বিরক্ত হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় বিতান।

—আঃ শ্রী! কী যে ছেলেমানুষি করো না! তোমাকে তো রোজই দেখছি। আমার জন্য এত সাজগোজ করবার তো কিছু নেই! বিতানের আরও কাছে এগিয়ে এসে তার বুকে মুখ গুঁজে শ্রী বলে ওঠে, ‘উঁহু, অনেকক্ষণ দ্যাখোনি তো আমায়। সারাটা দিন। মানে ঠিক আট ঘন্টা, ত্রিশ মিনিট, দশ সেকেন্ড।’ শ্রীর আলিঙ্গনে বিরক্তি যেন জাপটে ধরে বিতানকে।

—আঃ ছাড়ো এখন! সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরেছি। এখন বড্ড ক্লান্ত, শ্রী। কোথায় চা, জলখাবার দেবে তা নয়… কী যে করো না এসব!

ফ্রেশ হতে বাথরুমের দিকে চলে যায় বিতান। পিছনে শ্রীদর্শিনীর মাথায় যে নীরবে ভিসুভিয়াস ফুটছে, তা বেশ বুঝতে পারে সে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা মায়ের ঘরে ঢোকে বিতান। দেখে মা শরৎকাহিনিতে মগ্ন। দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। এতক্ষণ মনে যে-ক্ষোভ, বিরক্তি জমেছিল পুরোটা উগরে দিল মায়ের উপর।

—বেশ ভালোই আছো তোমরা। একজন সাজগোজে বিভোর, আর একজন কাব্য-কাহিনি পড়তে ব্যস্ত। বাহ্! আমি যে সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে এসেছি সে দিকে কারও নজর নেই। বিতান দেখল ছায়া ঘনিয়ে এল মায়ের মুখে। লজ্জিত মুখে মা বলল,

—এইমাত্র সব সেরে এসে একটু বসলুম রে, বাবা। ওবেলার রান্নাটাও সেরে নিলুম। রাতে শুধু গরম গরম ভাত নামিয়ে খেতে দেব তোদের। তা এখন জলখাবারে কী দেব, বল?

গজগজ করতে করতে বিতান বলে, ‘কেন? একা সব কাজ করো কেন? তোমার আদরের বউমাটিকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেও তো পারো! শেখালে কি সে শিখবে না?’ মায়ের মুখটা যেন আরও কালো হয়ে যায়। মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আসলে সে তো এ সংসারের নতুন মানুষ। এখন একটু সাজগোজ-আমোদ-আহ্লাদ করুক না মেয়েটা। ক’দিন পরে তো সংসারের জোয়ার  কাঁধে নিতেই হবে। যাক গে, তোকে একটু মুড়ি মেখে দিই, শসা-পেঁয়াজ দিয়ে?’

—নাঃ, শুধু চা আর বিস্কুট দাও। বলেই গট গট করে ড্রয়িংরুমের দিকে হেঁটে যায় বিতান। যেতে গিয়ে আড় চোখে শোবার ঘরের দিকে তাকায়। সেখানে যেন কঠিন নীরবতা বিরাজ করছে! আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাষ! টিভিটা চালিয়ে অস্থির ভাবে চ্যানেল ঘোরাতে থাকে বিতান।

মা কিছু না বললেও বিতান জানে সারাদিন রূপচর্চায় মত্ত থাকতে চায় শ্রীদর্শিনী। নানারকম রূপটান বা ফেসপ্যাক, হেয়ার প্যাক তৈরির উপকরণ বিতানই তো কিনে আনে শ্রীর ফরমায়েশ অনুসারে।

সকালে উঠে এক কাপ ঈষদুষ্ণ জলে একটা পাতিলেবু আর এক চামচ মধু মিশিয়ে খায় শ্রী। তারপর মুসুরডাল বাটা আর হলুদ দিয়ে একটা প্যাক তৈরি করে মুখে লাগায়। শেষে ঈষদুষ্ণ নারকেল তেলে এক চামচ লবঙ্গ তেল মিশিয়ে ভালো করে স্ক্যাল্পে মাসাজ করে। প্রায় দিনই বিতান দেখে বাড়িতে লবঙ্গ তেল তৈরি করে শ্রী।

লবঙ্গ, মিক্সার গ্রাইন্ডারে গুঁড়ো করে নারকেল তেলে মিশিয়ে একটা কাচের বোতলে ঢেলে খাটের নীচের অন্ধকারে রেখে দেয় এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ পর মসলিন কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে সেই তেল মাথায় লাগায়। বিতান লক্ষ্য করে শ্রীর এইসব রূপচর্চা ও তার উপকরণ তৈরি করা শেষ হতে হতে মায়ের একটা ভাজা, মাছের ঝোল, ডাল নেমে যায়। বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু ও বিরক্তিকর লাগলেও নতুন বউকে কড়া ভাবে কিছু বলতে পারে না সে।

কিছুক্ষণ পরে শোবার ঘরে ঢুকে মনটা ভারী হয়ে ওঠে বিতানের। দেখে ঘরের সারা মেঝে জুড়ে গয়নাগাটি, মেক-আপের জিনিস ছড়ানো। লিপস্টিক, আইলাইনারগুলো ভেঙে কুটিকুটি করে ফেলেছে। আর বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শ্রী। কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখে বিতান। শ্রীর কান্নার তোড় আরও বাড়তে থাকে। মনে মনে অনুশোচনা হতে থাকে বিতানের। এতটা আঘাত না দিলেও হতো মেয়েটাকে। না হয় একটু সেজে তাকে দেখাতেই এসেছিল। একটু অবুঝ মা মরা মেয়েটা, বাবার আদরের। বুঝিয়েসুজিয়ে বললে নিশ্চয়ই একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব। আদর করে শ্রীকে কাছে টেনে নেয় বিতান। শ্রীকে যে সত্যিই সে ভীষণ ভালোবাসে।

কিন্তু কিছুই ঠিক হল না। নিজের রূপচর্চা-সাজগোজ আর বিতানকে ঘিরে শ্রীর ভয়ংকর অবসেশন দিনের পর দিন বাড়তেই লাগল। সবসময় শ্রীর এক অমূলক ভয় যে, সে দেখতে খারাপ হয়ে যাচ্ছে আর বিতান অন্য মেয়েদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে…

—পুজোর দিনগুলোতে নিজের সাজপোশাকে সেরাটা দেওয়া মাস্ট। ভিড়ের মাঝে, বিশেষ করে তোমার অফিসের বিশ্বকর্মা পুজোর দিনের ওই গেট টুগেদারে নজর কাড়তে গেলে পোশাকের কালার, কাট, ফ্যাব্রিক সব হতে হবে একদম এক্সক্লুসিভ। জানো? কীভাবে সাজতে হবে ও ঘরোয়া রূপচর্চার নানা গাইড লাইন দিচ্ছে বহু প্রিন্টেড ও অন-লাইন ফ্যাশান ম্যাগাজিনগুলো। নেইলপলিশ পরতে পরতে এক নাগাড়ে বলে চলে শ্রী।

—সেবার তুমি অফিসের কম্পিউটার সেকশানের মৃদুলার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখছিলে। সেবন্তীর সঙ্গে তোমার সে কী হাহা হিহি! এবার আমি আর কোনও রিস্ক নেব না বাবা। এবার আমার ড্রেস হবে এক্কেবারে হটকে! আর জানো তো আজকাল পুরো মুখের সাজে একই রঙের আধিক্য। এই মনোক্রোম মেক-আপ এখন রীতিমতো ভাইরাল।

শ্রীর স্বরে যেন একেবারে কোনও ক্লান্তি নেই! শুনতে শুনতে মাথা ধরে যায় বিভানের।

—জীবনটা শুধু সাজগোজ আর গয়নাগাটি নয়, শ্রী। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো লক্ষ্মীটি! এ তো মানসিক অসুখ! চলো তোমাকে নিয়ে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই। তিনি হয়তো তোমাকে কোনও ভাবে হেল্প করতে পারবেন।

—কী বললে? আমি পাগল? আমি পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব? হাউ ডেয়ার ইউ! রাগে হাতের কাছে যা থাকে বিতানের দিকে ছুড়তে থাকে শ্রী!

 

 

হনন (পর্ব ১)

বিতানদের বাড়িটা সাবেকি আমলের। বাবার তৈরি বাংলো প্যাটার্নের কাঠের বাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট্ট একখানি বাগানের বুক চিরে হাঁটাচলা করার সরু একটা মোরামের পথ। বাবা চলে যাবার পর একবার ভেবেছিল বাড়িটাকে রি-মডেলিং করবে। কিন্তু মা একদম রাজি হয়নি। আর ছোটোবেলার গন্ধমাখা এই বাড়িটা বিতানেরও খুব প্রিয়।

আজ অফিস থেকে ফিরে সামনের গেট দিয়ে ঢুকে বাগান পেরোতে পেরোতে নানান ফুলের একটা ককটেল সুবাস যেমন বিতানের নাকে এসে লাগে, সেই সঙ্গে কান ছুঁয়ে দেয় শ্রীদর্শিনীর গান— সাজনা হ্যায় মুঝে সজনা কে লিয়ে…। ভারি সুরেলা গলা তার।

শ্রীদর্শিনী বিতানের স্ত্রী। মাত্র তিনমাস আগে এক মাঘীপূর্ণিমার সন্ধেতে শ্রীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। বিতান আর শ্রীদর্শিনীর পরিচয় হয়েছিল এক বছর আগে একটি সোশ্যাল ম্যাট্রিমোনি সাইটে। তিন মাস তারা একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর, মেলামেশা করবার পর দু’জনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারপর চলেছিল ছ’মাসের কোর্টশিপ।

শ্রীদর্শিনী তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বিতানের চেয়ে অনেক বেশি বৈভবে মানুষ সে। শ্রীর বাবা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। এছাড়াও তাদের পারিবারিক ব্যাবসা আছে। ভারতের নানা প্রান্তের সংস্কৃতি, সাজগোজ সম্পর্কে শ্রী বেশ ওয়াকিবহাল। এছাড়া গণিতে স্নাতকোত্তর শ্রীদর্শিনী পড়াশোনাতেও বেশ মেধাবী। অন্যদিকে, বিতান নিতান্তই সাধারণ। অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক সংস্থায় কোয়ালিটি কনট্রোল ইঞ্জিনিয়র সে।

বাবা ছিলেন ন্যাশনালাইজড ব্যাংকের ক্লার্ক। ছোটোবেলা থেকে তেমন কোনও বিলাসবহুল জীবনযাপন তাদের ছিল না। জীবনটা ছিল আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের মতো অত্যন্ত সাদামাটা। তাই মাঝে মাঝে বিতানের বেশ আশ্চর্য লাগে এটা ভেবে যে, তার মতো একজন সাধারণ ছেলেকে কীভাবে মনে ধরল অত উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে শ্রীদর্শিনীর!

বাগান পেরিয়ে এসে নিজেদের শোবার ঘরে ঢুকতেই ভীষণ চমকে উঠল বিতান। দেখল গা ভর্তি নানারকম সোনার গয়না পরে সেজেগুজে বসে আছে শ্রী। পরনে দামি শাড়ি, গলায় সীতাহার, কানে বড়ো ঝোলাদুল, হাতে মোটা সোনার চুড়ি, খোঁপায় বেলকুঁড়ির মালা। সামনে খোলা মেক-আপ বক্স, লিপস্টিক, আইলাইনার, আই-শ্যাডো — আয়নার সামনে বসে গভীর ভাবে নিজেকে দেখতে দেখতে মিটি মিটি হাসছে শ্রী। দেখেই চলেছে নিজেকে। যেন নিজের প্রেমে নিজেই বিভোর। চারপাশের কোনওকিছু সম্পর্কে তার যেন কোনও চেতনাই নেই।

বিয়ের আগে থেকেই বিতান জানত ভীষণ সাজতে ভালোবাসে শ্রীদর্শিনী। শ্রী সুন্দরী কিন্তু তার সাজগোজের জন্য অপরূপা হয়ে ওঠে সে। বিতানের সঙ্গে যখন দেখা করতে আসত তখন বরাবরই তার রুচিসম্মত সাজগোজ তাকে মুগ্ধ করত। শ্রীর দৌলতেই বিতান জেনেছে মেক-আপের খুঁটিনাটি, বিভিন্ন বিউটি প্রোডাক্টের কার্যকারিতা, ঘরোয়া রূপটানের উপকারিতা ইত্যাদি নানা বিষয়। তখন থেকেই বিতান লক্ষ্য করত তাদের কথোপকথনের বেশ অনেকটা অংশ জুড়েই যেন থাকছে সাজগোজ, রূপচর্চা বিষয়ক আলোচনা।

বিতান ছোটোখাটো সোনার গয়না বা জাংক জুয়েলারি, কিংবা লিপস্টিক, নেলপলিশ এসব উপহার দিলে ভীষণই খুশি হতো শ্রী। তাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে বিতানের কাছ থেকে এমন কমপ্লিমেন্ট পেলে শিশুর মতো আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠত। এমন কি পথ চলতি কোনও সুন্দরী মেয়ের দিকে বিতানের চোখ গেলে, ভারি অভিমানী গলায় শ্রী জিজ্ঞেস করত, ‘ওকে কি আমার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে দেখতে, বিতান? আমি কি তেমন সুন্দরী নই?’

বিতান খুব আনন্দিত হতো। মেতে উঠত খুনশুটিতে। ভাবত শ্রী তাকে এত ভালোবাসে যে সবসময় তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চায়। ভাবলেই বুক ভরে উঠত তার। কিন্তু কথায় আছে একজনের সঙ্গে এক ছাদের নীচে চাল-ডাল-তেল- হলুদের আটপৌরে জীবন শুরু না হলে তাকে সম্পূর্ণ চেনাই যায় না। বিতানের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটেছিল।

 

অচেনা নারী (শেষ পর্ব)

সুচরিতার কথা

অতনু গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। ওকে শেষবারের মতো ফ্লাইং কিস দিলাম। এখন আমার অনেক কাজ। ঘরে গিয়ে ল্যাপটপে দেখতে হবে কত কম খরচে ফিউনারাল করা যায়। কোথায় দেখেছিলাম — এমনি খরচ ২,৫০০ ডলার, ভিউইং যোগ করলে ৪,০০০ ডলার। তাড়াতাড়ি দেখতে হবে। এরপর লোকজন আসতে শুরু করলে তো শোকে পাথর হয়ে যাবার অভিনয় করতে হবে।

সত্যি গুগুল-এর জবাব নেই। কাল মাত্র দশ মিনিটে বার করে ফেললাম একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে কী করে গাড়ির ফ্রন্ট ব্রেক নষ্ট করে দেওয়া যায়। আবার ওরা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যেন রিভার্স না করতে হয়। তাই তো কাল আগে গাড়ি রাস্তার দিকে মুখ করে রেখেছিলাম। সকালে উঠে গিয়েছিলাম, ও কিছু সন্দেহ করে কিনা দেখতে। অতনু কিছু বোঝেইনি। আমাকে খুব বোকা ভেবেছে। ভুলে গেছে যে, রীতেশের জুনিয়র যে সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়েটা কাজ করে, লতা, ও ছোটোবেলায় আমার বোনের ক্লাসমেট ছিল দিল্লিতে। তাই তো আমাকে কাল দুপুরে ফোন করে জানাল, ‘সুচরিতাদি, সামথিং ইজ ফিশি। ইওর হাজব্যান্ড কেম টু রীতেশ উইথ টু বেঙ্গলি ফ্রেন্ডস। দে ওয়ার টকিং ইন বেঙ্গলি বাট ইট সিম্স লাইক এ কন্সপিরেসি টু সেন্ড ইউ টু অ্যান অ্যাসাইলাম সুন। বি কেয়ারফুল।”

অতনু আমাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে তারপর কী ডিভোর্স নিত? নিয়ে কাকে বিয়ে করত? ওই মুটকি বনানীকে? যার বাড়ি গেলে দহিবড়া নিয়ে এসে ‘অতনুদা, আরেকটা নাও, আরেকটা নাও’ করে অতনুর গায়ে ঢলে পড়ে?

এই রাস্তাটা আমার বাড়ির সামনে থেকে সোজা গিয়ে একটা টি জংশনে পড়েছে। সেখানে স্টপ সাইন। ক্রস স্ট্রিট দিয়ে এ সময় প্রচুর গাড়ি যায়। স্টপ সাইনে ব্রেক কষবে, গাড়ি সোজা রাস্তার মধ্যে গিয়ে পড়বে ট্রাফিকের মাঝে। শুক্রবার রীতেশের কাছে আমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে না? সরি, তার বদলে রীতেশই আসবে তোমায় দেখতে, কাসকেটে শোয়া অবস্থায়।

অতনু, তুমি কেন আমার কিসটা লুফতে গেলে সেই অনেকদিন আগের মতো? তখন রাকা বোধহয় বছর দুই। সামারে গাড়ি নিয়ে চলে যেতাম কোনও পাহাড়ে। রাকার পিছনে দাঁড়িয়ে আমি ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিতাম। তুমি ডান হাত বাড়িয়ে লুফে নিতে। রাকা বুঝতে না পেরে তোমায় জিজ্ঞেস করত, ‘বাবা কী লুফলে?” তুমি হেসে বলতে ‘একটা প্রজাপতি’। তারপর মুঠো খুলে বলতে, ‘যা, উড়ে গেল।’

রাকার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে। রাকা খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলত, ‘বাবা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না।’ আমি হেসে গাছটা দেখিয়ে দিতাম। এখন কী হবে?

আজ যখন রাকা এসে কাঁদতে কাঁদতে বলবে ‘বাবা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না’ আমি কী উত্তর দেব? এটা আমি কী করলাম! এটা আমি কী করলাম! এটা আমি কী করলাম…! আমি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি? ওই যে ফোন বাজছে! ওদিকে কি অতনু?

‘সু, আজ ভীষণ জোর বেঁচে গিয়েছি। ব্রেক কাজ করছিল না, স্টপ সাইনে না থেমে গাড়ি সোজা রাস্তার ওপারে ফুটপাথে। ভাগ্যিস কোনও গাড়ি ছিল না।’

নাকি পুলিশ? “ইস দিস অটনু রে’স রেসিডেন্স? সরি ম্যাম, অটনু ইজ নো মোর, স্পট ডেড ইন আ কার অ্যাক্সিডেন্ট।’ ফোনটা বেজেই চলেছে। আমি কেন উঠতে পারছি না সোফা থেকে? মনে হচ্ছে পা দুটো যেন কার্পেটের সঙ্গে পেরেক দিয়ে জুড়ে দিয়েছে কেউ। অতনু না পুলিশ। পুলিশ না অতনু? ভগবান যেন অতনু হয়, অতনু, অতনু, অতনু।

* এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক।

 

অচেনা নারী (৩-পর্ব)

অতনুর কথা

আজ মঙ্গলবার। মনটা বড্ড খারাপ। মনে পড়ে ছোটোবেলায় মায়ের হাত ধরে কালীঘাটের কালীমন্দিরে যেতাম শনি বা মঙ্গলবারে। বড়ো হয়ে ভাবতাম ওসব কুসংস্কার, মন্দির, পুজো থেকে শত হাত দূরে থাকতাম। কিন্তু আজ ভীষণ ইচ্ছা করছে মা কালীর ওই শান্ত শীতল মূর্তির সামনে গিয়ে বসে থাকি। বলি আমার সবকিছু নিয়ে শুধু শান্তি দাও।

সকালে অফিসে প্রবাল আর অভ্র এসেছিল। প্রায় জোর করেই আমাকে নিয়ে গেল রীতেশের চেম্বারে। রীতেশ আমাদের থেকে বেশ ছোটো। কিন্তু এই বয়সেই সাইকায়াট্রিস্ট বলে নাম করেছে। সকালে ওর এক ঘন্টা খালি ছিল। ওরা কুহকিনীর সব ই-মেইলগুলোর প্রিন্ট আউট নিয়ে এসেছিল। রীতেশ সব শুনে বলল, এটা এক ধরনের স্ক্রিৎজফ্রেনিয়া। যারা মানসিক ভাবে দুর্বল, তাদের মনের ক্ষোভ অনেক সময় আক্রোশে পরিণত হয়।

অতনুদা, ছোটোবেলায় দেশে দেখেননি, রাস্তাঘাটে পাগল বা পাগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে— আর যাকে দেখছে গালাগালি দিচ্ছে। এটাও তাই। শুধু এক্ষেত্রে, গালাগালি দিচ্ছে ই-মেইলে। সবাইকে খারাপ কল্পনা করতে করতে একদিন কল্পনাটাই সত্যি বলে মনে হয়। তবে চিন্তা করবেন না। সবকিছুরই চিকিৎসা আছে। ফ্রাইডে ইভিনিং-এ সুচরিতাদিকে নিয়ে আসুন। কতগুলো টেস্ট করব। তবে হ্যাঁ, সময় সময় এরা কিন্তু ডেনজারাস হতে পারে। বিশেষ করে ট্রিটমেন্ট শুরু হলে। তখন এক বাড়িতে থাকা ঠিক নয়। রাত্রে যখন ঘুমোবেন তখন আপনারও ক্ষতি করে দিতে পারে। তাই মানসিক হাসপাতালে রাখতে হবে কিছুদিন। একদম ভাববেন না। এখানকার মানসিক হাসপাতাল খুব ভালো। ক’দিন পরেই দেখবেন ভালো হয়ে গেছেন।

সু মানসিক হাসপাতালে? না, অসম্ভব। প্রবালরা বোঝাল, দ্যাখ, রূপম আর সুমিত খুব রেগে আছে। ওরা চাইছিল ই-মেইলগুলো নিয়ে পুলিশের কাছে যেতে। আইপি অ্যাড্রেস থেকে ওরা লোকেট করে দেবে কোন কম্পিউটার থেকে মেইলগুলো এসেছে। তারপর তোর বাড়ির সার্চ ওয়ারেন্ট বার করতে পারলে তোদের দু’জনের হাতেই হাতকড়া পড়ত। আমরা জানি তোর কোনও দোষ নেই। তুই শুধু একটু বেশি ভালোমানুষ। বউকে সময়মতো কন্ট্রোল করতে পারিসনি। তাই আইনি ঝামেলার থেকে এটা ভালো না? আমরাও চাই সুচরিতা আবার আগের মতো ভালো হয়ে যাক। ক’দিনের তো ব্যাপার। কিন্তু সু রাজি হবে রীতেশের কাছে যেতে?

সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে ওকে বললাম, ‘তোমার শরীরটা বোধহয় ভালো যাচ্ছে না, একটুতেই আজকাল মাথা গরম করো। এই শুক্রবার একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেব।”

সু খুব শান্ত ভাবে আমার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কোন ডাক্তার?’

একটু ভয়ে ভয়ে রীতেশের নাম বললাম। অবাক হয়ে দেখলাম সু রেগে গেল না। শুধু বলল ‘আচ্ছা।’

আজ বুধবার। রোজকার মতো খুব ভোরে অফিস যাব বলে তৈরি হয়ে বেরিয়েছি, দেখি গাড়িটা ড্রাইভওয়েতে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমি তো বরাবর গ্যারাজের দিকে মুখ করে রাখি। কাল কি রিভার্স করে রেখেছিলাম? মনে তো হচ্ছে না। কী জানি সু-র সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাটাও বোধহয় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় স্কুল যাওয়ার সময় মা বলতেন, ‘সাবধানে যাস।’ মা তো কবেই উপরে চলে গেছেন। অথচ আশ্চর্য, ঠিক যেন ফিশফিশ করে মা-র গলা শুনলাম, ‘খোকা, সাবধানে যাস।’

অনেকদিন আগে মিহিরদার গলায় শোনা হেমন্তর একটা গান মনে পড়ল— আসব না ফিরে আর / আসব না। ফিরে কোনওদিন। মিহিরদা কী অপূর্ব গান করেন। ইশ বেচারার এখনও বোধহয় চাকরি নেই। দেশে থাকলে নামকরা গায়ক হতে পারতেন।

গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি সু এসে দাঁড়িয়েছে। ও তো এত ভোরে ওঠে না। চোখাচোখি হতে সু ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিল। মুখে মৃদু হাসি। আমিও অনেকদিন আগের মতো ডান হাত বাড়িয়ে লুফে নিলাম। এই মেয়েকে আমি কী করে পাগলা গারদে পাঠাব? না না, কিছুতেই পারব না।

গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। সেই গানটা মাথার মধ্যে এখনও ঘুরছে। একেক দিন এরকম হয়। ‘যাবার পথে পথিক যখন পিছন ফিরে চায়/ ফেলে আসা দিনকে দেখে মন যে ভেঙে যায়। চোখের আলো নিভল যখন মনের আলো জ্বেলে/একলা এসেছি আমি, একলা যাব চলে।’

সু এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ও কি বুঝতে পেরেছে আমরা কী প্ল্যান করছি? উঃ ভগবান! এই দোটানা থেকে আমায় মুক্তি দাও, মুক্তি দাও।

 

অচেনা নারী (২-পর্ব)

সুচরিতার কথা

আজ অনেকক্ষণ দত্ত মাসিমার সঙ্গে ফোনে কথা হল। ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন শিকাগোর এক বাঙালি মেয়ের সঙ্গে। বারবার বলছিলেন বিয়ের বরযাত্রী যাবার কথা শিকাগোতে। যা হাসি পাচ্ছিল। মাসিমা তো জানেন না ওনার মেয়ে বনানী আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। যখন শুনবে ওর মা ওর ভাইয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছে আমাদের, একেবারে তুলকালাম লাগিয়ে দেবে৷ ইশ, দৃশ্যটা যদি দেখতে পেতাম! এইসব বাঙালি মেয়েগুলোকে দেখলে আজকাল আমার পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যায়। সবকটা হিংসুটে, অহংকারী, স্বার্থপর। ভাবতে অবাক লাগে, এত বছর ওদের সঙ্গে মিশতাম কী ভাবে।

এই যে বনানী! মেয়ে রিমলি হাইস্কুলে গেল কি না গেল, ওর গান শুরু হয়ে গেল। আমার মেয়ে তো বলে দিয়েছে স্টানফোর্ড, ইয়েল, হার্ভার্ড, এমআইটি — কোথাও যাবে না। এ মেয়েকে নিয়ে কী যে করব!

আরে কোথায় চান্স পায় আগে দ্যাখ। তাও তো চার বছর দেরি। আর যা সব পাকা মেয়ে, এই বয়স থেকেই বয়ফ্রেন্ড। হয়তো দেখব হাইস্কুল ছাড়ার আগেই কারও গলায় ঝুলে পড়েছে। যা একখান ই-মেইল ঝেড়েছি, খেপে আগুন।

আজকাল যে-মেয়েগুলো বিয়ে করছে, সেগুলো তো আরও অসহ্য। বেশিরভাগ বিয়ের আগেই এদেশে এসেছে পড়তে বা চাকরি নিয়ে। আমাদের এমন ভাবে দেখবে যেন আমরা বরের ঘাড়ে চেপে এদেশে এসেছি। নিজেদের যোগ্যতায় ভারতবর্ষের সীমানা পার হতে পারতাম না। তেমনি ন্যাকা ন্যাকা কথা। ওই এক আছেন মিহিরদা। নিজেকে ভাবেন হেমন্ত। কোথাও গান বাজনা হলেই প্রথমে অনেক বাহানা করেন — আবার আমাকে কেন, আমি তো সব জায়গাতেই গাই। আর মেয়েগুলো শুরু করবে — একদম না বলবেন না মিহিরদা। গান না গেয়ে এখান থেকে যান দেখি। তখন যেন উপায় না দেখে মিহিরদা গান ধরবেন। আর আমাকে দেখলে ওই গানটা গাইবেনই — ‘কী গান শোনাব বলো, ওগো সুচরিতা’।

আগে বোকা ছিলাম, ওনার কথায় হাসতাম, এখন বুঝি সবক’টা পারভার্ট। অরুণিমা তো আরেক। তার গর্ব কী না, তার বর কোনও ক্যাসিনো থেকে কখনও খালি হাতে ফেরে না। বলতে ইচ্ছা করে তোর শ্বশুর বোধহয় মহাভারতের শকুনির বংশধর। জাত জুয়াড়ি। শকুনি নয়, বলা উচিত শকুন। এই বয়সেও রূপমদার চোখ ঘোরে হাঁটুর বয়সি মেয়েদের উপর।

অজন্তার তো বর আবার স্টক মার্কেটে পয়সা করেছে বলে এত গর্ব, যেন নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। সব থেকে ভালো দিয়েছি রাধাকে। বাবা ও শাশুড়ি গা ঘ্যাঁসাঘেঁসি করে দাঁড়িয়ে নায়াগ্রা ফলসের সামনে ছবি তুলেছেন উদ্ভাসিত মুখে। আবার সেই ফোটো পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। এমন ই-মেইল দিয়েছি যে, পরের দিনই ফেসবুক থেকে ফটো ডিলিট। একটাই আফশোস। ই-মেইল পড়ার সময় ওদের চোখ মুখের ভাব কী হল দেখতে পাই না।

অতনুটাও আজকাল কেমন হয়ে যাচ্ছে। বোকাটে ধরনের। এতদিন আমেরিকায় থেকেও সেই ভেতো বাঙালি হয়ে রয়ে গেল। এখন মনে হয় অল্পবয়সে ওকে ছেড়ে কোনও সাদা ছেলেকে ধরা উচিত ছিল। এখন টু লেট। যাই এবার ল্যাপটপে বসে কুহকিনীকে ঘুম থেকে তুলি।

 

অচেনা নারী (১-পর্ব)

অতনুর কথা

সকালবেলা ম্যানহাটনের অফিসে পৌঁছে ল্যাপটপ ডকিং স্টেশন-এ লাগিয়েছি— অমনি মোবাইল বেজে উঠল। সতেরো তলা থেকে দেখা যায় দূরে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। কিন্তু সে সব দেখে অভিভূত হওয়ার দিন আর নেই। এখন ফোন এলেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। কোনও বাঙালির ফোন নয় তো? ঠিক তাই। রূপম। ইচ্ছা না হলেও ফোনটা ধরলাম।

—অতনু?

—বলছি।

—কী ব্যাপার বল তো? তোরা কি আর আমাদের শান্তিতে থাকতে দিবি না?

—না মানে… কী হয়েছে?

—কী হয়েছে? অরুণিমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। দেশ থেকে ফোন পেয়ে ও তো খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তিনদিনের মাথায় ই-মেইল এল ‘কী রে খুব তো গর্ব করছিলি মেয়ে এমআইটি-তে চান্স পেয়েছে বলে, এখন কেমন লাগছে? মায়ের জন্য দেশে যাবি, না মেয়ের জন্য পার্টি দিবি?”

—ই-মেইল… মানে।

—থাক আর ন্যাকামি করতে হবে না। দেখ ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম’ তোর না তোর বউয়ের ই-মেইল আইডি, তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তবে ওটা যে তোদের বাড়ি থেকেই আসছে তা এখানকার সব বাঙালিরা জানে। তবে আমরাও ছাড়ব না। এর একটা বিহিত করবই। ফোনটা কেটে দিল রূপম।

“তোর বউ’। ওরা আজকাল সুচরিতার নাম উচ্চারণ করতে ঘৃণা বোধ করে। অথচ এই রূপম – অরুণিমা, মিলন-অজন্তা, প্রবাল-মিতা, সুমিত-রাধা, অভ্র-বনানী, মিহিরদা-অঞ্জনাদি – এদের সঙ্গে এত বছর কত আড্ডা, শনিবারের ডিনার, রবিবার লাঞ্চ, ছেলেমেয়েদের জন্মদিনের পার্টি, পিকনিক, বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, দুর্গাপুজো— কী না করেছে এত দিন। আজ মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

এসবের শুরু বছর দুয়েক আগে। আমাদের একমাত্র মেয়ে রাকা যখন হাইস্কুল পাস করে কোনও ভালো কলেজে চান্স পেল না, তখন থেকেই দেখি সুচরিতার মুখ গম্ভীর। বন্ধুদের ফোন করা বন্ধ, কাউকে বাড়িতে ডাকে না, কেউ আসতে বললে এড়িয়ে যায়। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল তোমার? মেলামেশা বন্ধ করে দিচ্ছ নাকি?’

সু উত্তর দিল— আজকাল ওদের সঙ্গে মিশতে গেলে মাথা গরম হয়ে যায়। আমিও আর কথা বাড়াইনি।

এর ক’দিন পরে হঠাৎ এক সন্ধ্যায় মিলনরা ফোন করে বলল, ‘আসছি, জরুরি কথা আছে।’ মিলন আর অজন্তা এলে সু চা করে নিয়ে এল। ওরা দেখছিলাম বেশ গম্ভীর। হঠাৎ অজন্তা সু-কে জিজ্ঞেস করল, ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম কী তোর ই-মেইল আইডি।’

সু বলল, “না তো৷’ কিন্তু ওর মুখচোখ দেখে মনে হল, অবাক হওয়ার বদলে খুশির আভা।

—দ্যাখ বাজে কথা বলবি না। ইংলিশ অক্ষরে বাংলা কথা— দেশ থেকে পনেরো হাজার টাকা দামের শাড়ি কিনে দেখি খুব ডাঁট! নিজের চেহারা কি ভুলে গেছিস? দ্যাখ আবার ওই শাড়ি পরে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করিস না! দেশের লোকেরা বলবে, তোদের ওখানে আজকাল কাজের লোক পাওয়া যায় বুঝি?

—আমি যে পাঠিয়েছি তোকে কে বলল? সুচরিতার গলায় রীতিমতো খুশির ঝলক।

—দ্যাখ শাড়ির দামটা খালি তোকেই বলেছিলাম। ছেড়ে দেবার পাত্রী নয় অজন্তা।

—সে তো কলকাতার দোকানদারও দামটা জানে। এবার সত্যিই হেসে গড়িয়ে পড়ল সুচরিতা।

ওরা আর বসল না। চা না খেয়েই চলে গেল। আমি স্তম্ভিত। সু-কে বললাম ‘তুমি সত্যিই ওই ই-মেইলটা পাঠিয়েছিলে?’

সু চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ করেছি।’ উঠে শোওয়ার ঘরে চলে গেল সু। সেদিন আর এ নিয়ে কোনও কথা হয়নি।

এর প্রায় এক মাস বাদে, একদিন সকালে অভ্র-র ফোন অফিসে। ‘জরুরি কথা আছে, লাঞ্চের সময় তোকে অফিস থেকে তুলে নেব।”

অভ্র গাড়ি নিয়ে এসেছিল। কাছাকাছি চাইনিজ বাফেতে গিয়ে দেখি চাঁদের হাট — রূপম, মিলন, প্রবাল, সুমিত, মিহিরদা, অরুণিমা, অজন্তা, মিতা, রাধা, বনানী, অঞ্জনাদি সবাই হাজির। আগেকার মতো চেঁচিয়ে উঠলাম ‘একি! সারপ্রাইজ পার্টি নাকি?’ ওরা কেউ হাসল না। শুধু বনানী বলল, ‘চলো অতনুদা, খাবার নিয়ে নাও, তারপর কথা বলা যাবে।’

দশ ডলারে অল ইউ ক্যান ইট। খিদেও পেয়েছিল। সবাই যে যার ভর্তি প্লেট নিয়ে এসে বসলাম। তখনও জানি না আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে।

প্রথমে মিতা শুরু করল। অতনুদা, তুমি কতটা জানো আমরা জানি না, গত কয়েক দিন আমরা সবাই ‘কুহকিনী@ইয়াহু.কম’ থেকে ভীষণ বাজে বাজে ই-মেইল পাচ্ছি। আমরা জানি এগুলো সবই সুচরিতার লেখা। আমার বাবা কলকাতায় থাকেন, বয়স আশির উপর। জীবনে কখনও মদ ছোঁননি। একদিন রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে গিয়ে গর্তে পড়ে পা ভেঙেছেন। মেইল এল ‘আর এখান থেকে বাবার জন্য স্কচ নিয়ে যাস না, রাস্তায় বেরিয়ে মাতলামি করে লোকের মার খেয়ে একটা পা ভেঙেছে, এরপর আরেকটাও যাবে।’

—কিন্তু তোমাদের সঙ্গে অনেকদিন তো সুচরিতার যোগাযোগ নেই। ও এত সব জানবে কী করে? আমার গলা নিজের কাছেই অন্যরকম লাগল! আমি কি সুচরিতার হয়ে ওকালতি করছি?

—সে কথা আমরাও ভেবেছি। আসলে আমাদের ছেলেমেয়েদের নেটওয়ার্ক খুব স্ট্রং। মিতা বলে চলল

—তোমার মেয়ে রাকাকে একদিন ফোন করেছিলাম। ও বলল রোজ ওর মা ওকে ফোন করে সব মাসিদের কথা জিজ্ঞেস করে। ও বন্ধুদের কাছে যা শোনে তা-ই মাকে বলে। রাকাকে অবশ্য আমি আর কিছু বলিনি।

—আমি বয়সে বড়ো বলে বোধহয় তুই তোকারি করেনি। কিন্তু যা লিখেছে তা তোমাদের সামনে বলতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে, অঞ্জনাদি বলে উঠলেন। তবে চুপ করে থাকতে তো পারব না, তাহলে এটা চলতেই থাকবে। জানো বোধহয় তোমাদের মিহিরদার চাকরি নেই। ও তো আবার গান বাজনা ভালোবাসে৷

মেইল এল ‘এবার মুখে রং মেখে রেড লাইট এরিয়ায় গিয়ে লাইন দাও, সংসার চালাবে কী করে? বরকে বলো তুমি যখন খদ্দের সামলাচ্ছ, তখন টুপি খুলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইতে— কিছু বাড়তি রোজগার হবে।”

—আমার বাবা ও শাশুড়িকে এক সঙ্গে গত সামারে দেশ থেকে এনেছি, রাধা বলল। মেইল এল, ‘তোদের তো একটাই গেস্টরুম, বাবা ও শাশুড়ি কি একই ঘরে? এবার ইস্কনের মন্দিরে গিয়ে মালাবদল করিয়ে নে। ওটাই বা বাকি থাকে কেন?’

—ছেলেদেরও বাদ দেয়নি, মিলন বলে উঠল৷ আমাকে আজকাল প্রায়ই টুরে যেতে হয়। তোর কুহকিনী লিখেছে ‘বউ তো মাত্র একশো ডলারে ঘরে লোক নিচ্ছে, রেটটা একটু বাড়াতে বলো। প্রসাদেরও তো স্টেটাস থাকে।’

—আমার ননদের ছেলে টুবাই এমএস করতে এখানে এসেছে দেশ থেকে, অরুণিমা বলল। ক’দিন আগে আমার মেয়ে পৃথার সঙ্গে শপিং মলে গিয়ে সুচরিতার সঙ্গে দেখা। পৃথা তো কিছুই জানে না। ‘মাসি মাসি’ করে অনেক গল্প করেছে। বাড়ি এসে আমায় বলতেই আমি ভয়ে কাঁটা। ঠিক যা ভেবেছি। রাত্রেই মেইল এল, “তুই কি তেলুগু হয়ে গেছিস? মেয়েকে পিসতুতো দাদার সঙ্গে ডেট করতে পাঠাচ্ছিস?’

—এ তো তবু ভালো৷ বনানী এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার বলে উঠল— রিমলিকে তো তোমরা জন্ম থেকে দেখছ অতনুদা। এখন গ্রেড নাইন। সেদিন স্কুলে হঠাৎ পেটে ব্যথা। ওরাই নাইন ওয়ান ওয়ান ডেকে হসপিটালে পাঠিয়েছে। ডাক্তার বলল অ্যাপেনডিসাইটিস। অপারেশনের পর দু’দিন হসপিটালে থেকে বাড়ি এসেছে। পরের সপ্তাহে কুহকিনীর মেইল, ‘অ্যাবরশন হয়ে গেল? বাচ্চাটার বাবা কে? চিনা না কাল্লু?’

ওরা আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। আমার কানে আর কিছু ঢুকছিল না। সুচরিতা এত নীচ? এত কদর্য? ওদের ঠোঁটগুলো নড়ছে দেখতে পাচ্ছিলাম। শব্দগুলো বেরিয়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল। আমার কানে কিছুই আসছিল না।

 

এমএনসি-র প্রেম (দ্বিতীয় পর্ব)

জন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, অবনীবাবু এইচআর হেড, মিস্টার বিনয় রাজদান-কে ডেকে পাঠান। মিস্টার রাজদান অবনীবাবুর কেবিনে এসে প্রবেশ করলে, অবনীবাবু বলা শুরু করেন— আচ্ছা, মিস্টার রাজদান, যদি কোনও কর্মচারীকে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়, তবে কত তাড়াতাড়ি আপনি তাঁকে বের করতে পারবেন আমাকে বলতে পারেন?

রাজদান— স্যার, দু’-তিন ঘণ্টা লাগবে সব ফর্মালিটি পুরো করতে। তবে তেমন আপৎকালীন অবস্থায় পাঁচ মিনিটেও বের করা যেতে পারে।

অবনীবাবু— আগামীকাল প্রয়োজন হতে পারে। তবে এ খবরটা যেন কেউ জানতে না পারে আগে থেকে।

রাজদান— ওকে, তাই হবে স্যার।

অবনীবাবু— আচ্ছা, স্নেহা গুপ্তা-কে আপনি চেনেন? মেয়েটি কাজেকর্মে কেমন?

রাজদান— স্যার, ভালোই কাজ করছিল, তবে কিছুদিন ধরে ওর প্রোজেক্ট ম্যানেজার বলছে যে, মেয়েটা যেন কেমন উদাস হয়ে গেছে।

অবনীবাবু— কোনও প্রেমে-ট্রেমে পড়েনি তো? ওর কোনও প্রেমিক থাকলে তার থেকেই জেনে নিন না ব্যাপারটা কী? কারণ মেয়েটা আগে কাজের জন্য অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। এমন একজন কর্মচারীর কাউন্সেলিং তো খুবই প্রয়োজন, তাই না? আপনি গিয়ে ওকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দিন দেখি, আমাকে কিছু বলে কিনা। চেষ্টা করেই দেখি।

রাজদান বেরিয়ে গেলে অবনীবাবু ভাবতে থাকেন, কীভাবে কথা শুরু করবেন স্নেহার সঙ্গে। কারণ ওর মেজাজ ও হাবভাব দেখে খুবই হতাশ লাগছে আজকাল। নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছে যা ও আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছে না। দেখা যাক কী করা যায়।

স্নেহা গুপ্তা এসে অবনীবাবুর কেবিনে ঢোকে। অবনীবাবু স্নেহাকে বসতে বলে, ফোনে দু’টো চায়ের অর্ডার দেন। অবনীবাবুই প্রথম শুরু করেন—

—আচ্ছা, স্নেহা কেমন আছো বলো?

—ঠিক আছি স্যার।

—না, মোটেই তুমি ঠিক নেই। কয়েকদিন ধরেই দেখছি তুমি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকো। কোনও সমস্যা হলে আমাকে অনায়াসেই বলতে পারো। এর আগেও তুমি দেখেছ অনেকের ক্ষেত্রেই আমি সমস্যার সমাধানে সাহায্য করেছি।

–না স্যার, এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত। এ ব্যাপারে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।

—বলেই দ্যাখো না, পারি কিনা? আরে বাবা, আমার চুলগুলো তো এমনি পাকেনি? তুমি আমাকে বলতে পারো। সমস্যার সমাধান আমার কাছে না থাকলে আমি তোমাকে সোজাসুজি বলে দেব।

—স্যার, এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। তবুও আপনি যখন জানতে চাইছেন বলছি, যেহেতু আমি আপনাকে অন্য চোখে দেখি। তবে কারও সঙ্গে এই কথাগুলো শেয়ার করবেন না প্লিজ।

—ঠিক আছে, বলো।

—স্যার, আমি সংক্ষেপে আপনাকে বলছি। আমি একটি ছেলেকে ভালোবাসতাম কলেজ জীবনে। ওর সঙ্গে ঘর বাঁধব বলে ঠিকও করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি এই শহরে চলে আসার পর ওর সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ কমতে থাকে। এর পর ও আমেরিকাতে অন সাইটে চলে যায়। সেখান থেকে মাঝে মাঝে কথাবার্তা হতো কিন্তু ধীরে ধীরে তা কমে আসতে থাকে। যাকে ‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ বলে আর কী। এই কোম্পানিতে এসে রোহন বলে একটি ছেলের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা ও বন্ধুত্ব বেড়ে যায়। একদিন সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসতে থাকি। দু’জনে বিয়ে করব বলে ঠিক করি। কিন্তু আমাদের ভাগ্য মনে হয় সেটা মেনে নিল না। রোহনের বদলি হয়ে গেল বেঙ্গালুরু। এই ক্ষেত্রেও প্রায় তাই হচ্ছিল, দেখা শোনা কম হওয়ায় দূরত্বটা একটু বাড়ছিল। কিন্তু আমরা নিজেরাই ঠিক করলাম আর দেরি নয়। বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলব। আমাদের দু’বাড়ির মধ্যে কথাও প্রায় পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। পাকাদেখার কয়েকদিন আগে আমি ভেবে দেখলাম আমার আগের প্রেমিকের সম্পর্কে রোহনকে সব খুলে বলা উচিত এবং সব কথা ওকে বললাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, ও সে সব কথা শুনে পিছিয়ে গেল! বলল – তোমার মনে হয় আগের জনকেই বিয়ে করা ঠিক হবে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! এটাকে আমার সরলতা বলব না বোকামি বুঝতে পারলাম না। এর পরে বহু চেষ্টা করেও যখন রোহনকে রাজি করাতে পারলাম না, তখন ফিরে গেলাম আবার ওই আগের প্রেমিকের কাছে অর্থাৎ অভিজিৎ-এর কাছে।

এমএনসি-র প্রেম (প্রথম পর্ব)

অবনীবাবু অফিস থেকে ফিরে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চায়ের কাপটা মুখে তুলতে তুলতে অফিসের বিভিন্ন সমস্যার কথা ভাবছিলেন। তিনি যেহেতু কোম্পানির উচ্চপদে আছেন তাই সকলের সুবিধে অসুবিধের কথা তাঁকেই ভাবতে হয়। তাঁর কাজটাই এরকম। তাঁর ওপর কর্পোরেট অফিস বলে কথা।

মনে মনে ভাবেন এই কর্পোরেট গাল ভরা কথাটা শুনতে যেমন ভালো লাগে, আসলে তেমন নয়। আজকাল মাল্টিন্যাশানাল, কর্পোরেট এসব কথাগুলো শুনতে মন্দ লাগে না। এমনকী খবরের কাগজে ‘পাত্র-পাত্রী’ কলমেও এর ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনদাতারা নিজের কুলীন গোত্রের নিদর্শন তুলে ধরতে চান।

অবনীবাবু বহুদিন ধরেই একটি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকরি করছেন। নানান সমস্যার সমাধান করতে করতে এখন আর সমস্যাগুলোকে সমস্যা বলেই মনে হয় না। তবে দু’-একটি সমস্যা যে তাঁকে ভাবিয়ে তোলে না এমন নয়! গতকাল স্নেহা গুপ্তা-কে কাউন্সেলিং করতে গিয়েই বেশ মুশকিলে পড়েছিলেন। কীভাবে সমস্যাটার সমাধান করবেন ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না, কারণ এই সমস্যার সমাধান তাঁর হাতে নেই। আর সে বয়সও তাঁর নেই।

স্নেহা-কে ক’দিন খুব ম্রিয়মাণ দেখে তাঁর প্রজেক্ট ম্যানেজার, মনদীপ জ্বলি, অবনীবাবুকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন— স্নেহার কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজন আছে। যে-মেয়েটা ক’দিন আগেও হাসি-খুশিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখত, হঠাৎই কী এমন হল যে, সে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

অবনীবাবু এর আগেও বহু কর্মচারীরই কাউন্সেলিং করেছেন কিন্তু স্নেহা-র কথা শুনে উনিও আজকাল বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। চিন্তা শুধু এজন্য— এর সমাধান তাঁর হাতে নেই। কারণ এই সমস্যাটি একান্তই প্রেমঘটিত এবং ব্যক্তিগত। যদিও এর আগে এই কর্পোরেট সেক্টরে উনি বহু প্রেমেরই সাক্ষী হয়ে আছেন।

একবার মনে আছে গভীর রাতে অফিসে শিফট চলাকালীন ইলেকট্রিকের ফোরম্যান পরেশবাবু এসে বললেন— স্যার চলুন, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই। বেশ কিছুদিন ধরে আমি এটা লক্ষ্য করছি। কোনওদিন কোনও বিপদ হয়ে গেলে আপনি আমাকেই চাকরি থেকে বের করে দেবেন।

অবনীবাবু— কী এমন হল যে আমাকে ডেকে দেখাতে হবে?

পরেশ বাবু— চলুনই না স্যার। দেখলেই বুঝতে পারবেন।

এর পরের ঘটনা অবনীবাবুকে সত্যিই খুব অবাক করেছিল। তখন তিনি নতুন ছিলেন এই ইন্ডাস্ট্রিতে তাই অদ্ভুত লেগেছিল। আজকাল অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। সেদিন ইলেকট্রিক সুইচরুমের ভেতর থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে আপত্তিজনক অবস্থায় উদ্ধার করেছিলেন।

অন্য এক ঘটনা— অবনীবাবু খবর পেয়েছিলেন যে এক ম্যানেজার নাকি তাঁর অধস্তন মহিলা কর্মচারীদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করছেন। কিন্তু এর কারণ তিনি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে এক মহিলা-র সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলেন, সেই ম্যানেজার প্রথমে কাজের চাপ ও ভয় দেখিয়ে তাঁকে বশবর্তী করেন এবং পরে তাঁর সঙ্গে অশ্লীলতা করেন।

অবনীবাবুর আর বুঝতে বাকি রইল না, কীভাবে এর অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। অবনীবাবু প্রথমেই ডেকে পাঠালেন সিকিউরিটি সুপারভাইজার মিস্টার তিওয়ারি-কে। বললেন— মি. তিওয়ারি, আমি মি. সন্দীপ চাড্ডার সম্পর্কে বিস্তারিত সব খবর জানতে চাই। কখন সকালে আসেন, কখন কোথায় যান এবং ক’টা অবধি রাতে থাকেন?

মি. তিওয়ারি— স্যার, উনি তো বড়ো পোস্টে আছেন তাই ওনার সব খবরাখবরই আমরা লিখে রাখি। আপনি কী জানতে চান বলুন, আমি জানিয়ে দিচ্ছি।

—উনি রাত ক’টা অবধি অফিসে থাকেন?

—স্যার, কোনও ঠিক নেই। মাঝে মাঝে রাতে থেকেও যান কাজের জন্য, আবার কখনও কখনও রাত বারোটায় বেরিয়ে যান।

-ওঁর সঙ্গে কি অন্য কেউ থাকে?

–হ্যাঁ স্যার, থাকেন। মিস ডলি থাকেন।

—আপনি কি ওদের দু’জনের পরিবারের সম্পর্কে কিছু জানেন?

—স্যার, মি. চাড্ডার স্ত্রী একটি নামি কাগজের রিপোর্টার এবং তাঁর ডিউটি রাতেই থাকে, সেই কারণেই হয়তো মি. চাড্ডা রাতে অনেকদিনই বাড়ি যান না। মিস ডলি এই শহরে একাই থাকেন কারণ তাঁর মা-বাবা অন্য শহরে থাকেন।

—এদের সম্পর্কে কি আপনার কোনও কিছু বলার আছে?

—স্যার, আমাদের সিকিউরিটি গার্ডরা এদের নিয়ে নানারকম অশ্লীল কথাবার্তা বলে থাকে। রাতে নাকি এরা একই বন্ধ কেবিনে বসে কাজ করেন। আমাদের অফিসের একজন নাকি একদিন দু’জনকে রাতে পাশের শিপ্রা হোটেলে একসঙ্গে বসে বিয়ার খেতেও দেখেছেন।

—ঠিক আছে আপনি যান। ইলেক্ট্রিশিয়ান জন-কে একটু পাঠিয়ে দিন তো।

একটু পরেই জন এসে কেবিনের দরজায় টোকা দিয়ে প্রবেশ করে।

জন— স্যার আপনি আমাকে ডেকেছেন?

অবনীবাবু— হ্যাঁ। আচ্ছা আমাদের ক্লোজসার্কিট ক্যামেরাগুলো সব ঠিকমতো চলছে তো? আগামীকাল আমি কিন্তু সবগুলো চেক করতে চাই। শোনো, মি. চাড্ডা-র কেবিনে আমার ঘরের সামনের ক্যামেরাটা খুলে নিয়ে গিয়ে লাগাবে, তবে এখন নয়। সকলে অফিস থেকে চলে যাবার পর। আর এটা তুমি আর আমি ছাড়া কিন্তু কেউ জানবে না। জানলে তোমার চাকরি যাবে। ওটা লাগানো হয়ে গেলে তুমি রাতে আমাকে ফোনে কনফার্ম করবে।

জন— ঠিক আছে স্যার।

 

নরদেহ পর্ব-২

সিদ্ধার্থ জানেন হরিশের ছেলেরা ওঁকে খুব একটা ভালোবাসে না। বিশেষ করে ছোটো ছেলে তপনের সঙ্গে একদমই বনিবনা হতো না। বড়ো দুজনেরও যেটুকু আছে সেটা অন্তরের নয়, কেজো আর লোক দেখানি ভালোবাসা। মাঝে মাঝেই বাবা-মাকে নিয়ে টাগ অফ ওয়ার চলে। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর মতো কথাও ওরা বলে, সিদ্ধার্থের কানে এসেছে। হরিশও সব জানত।

বৈঠক বসেছে সামনের ঘরে। হরিশের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনার জন্য।

হরিশের বড়ো ছেলে তাপস বলল, ‘বাবা গলদা চিংড়ি খুব ভালোবাসতেন। আমার ইচ্ছে ছিল মৎসমুখীতে গলদা চিংড়ি হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে তাতে খাওয়ানো তো দূরের কথা, অনুষ্ঠান করা যাবে কিনা সেটাই সন্দেহ। পুলিশ পঁচিশ-ত্রিশের বেশি লোকের পারমিশন দেবে না।”

সিদ্ধার্থ বললেন, “কী দরকার? নিষ্ঠা নিয়ে শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্ম কর, তাহলেই তোর বাবার আত্মা শান্তি পাবে। গলদা চিংড়ি খাওয়ালেই আত্মা শান্তি পাবে, কে বলেছে তোদের? গুরুদশা পার হল, এবার বাকি কাজগুলো কীভাবে করা যায় সেটা ভাব৷’

মেজ নীলু বলল, ‘তবুও লোকে ঠিক বলবে ছেলেগুলো কিপটে…।’

“কেন বলবে? লোকে পরিস্থিতি জানে না? ওটা তোর মনের ভুল ধারণা। বরং উলটোটা হবে, ডাকলেও কেউ আসবে না। আর যদি এতই খাওয়ানোর ইচ্ছে থাকে তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে না হয় খাইয়ে দিস।’

ছোটো ছেলে তপন বলল, ‘আমাদের কপালটাই খারাপ। কী ট্রিটমেন্ট হল কে জানে, গুচ্ছের টাকা খেয়ে লোকটাকেও মেরে ফেলল। শালা হারামির…।’

তপনের বউ রীতা কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল, ‘হচ্ছেটা কী? সবাই রয়েছে এখানে। মুখের ভাষা কি তোমার কোনওদিনই ভালো হবে না?”

হরিশের মেয়ে নীপা বলে, ‘ছোড়দার মুখের ভাষা হয়তো খারাপ কিন্তু অন্যায্য তো কিছু বলেনি। ব্যাবসা করার একটা ভালো সুযোগ পেয়েছে মানুষের জীবন নিয়ে। তাও যদি বেঁচে ফিরত।’

সিদ্ধার্থ বিরক্ত গলায় বললেন, “তোরা কি আবার ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে চাস? তবে একটা কমপেনসেশন কেস ঠুকে দে৷ জিতে গেলে অনেক টাকা ফেরত পাবি ৷ ‘

“সেটাই তো উচিত ছিল।’ রাগে গজগজ করতে করতে বলল তপন।

মনে মনে হাসলেন সিদ্ধার্থ। এসব কি বাবার প্রতি ভালোবাসা, নাকি পাহাড় প্রমাণ বিলের জন্য হতাশা? যতদূর জানেন সিদ্ধার্থ, হরিশ নিজের চিকিৎসার জন্য একটা বড়ো অ্যামাউন্ট সব সময় রেডি রাখত। হয়তো তার বাইরে কিছু দিতে হয়েছে তাই রাগ সামলাতে পারছে না এরা। কিন্তু একদিক থেকে এদের আনন্দিত হওয়ারই কথা। কারণ বৃদ্ধ বাবাকে আমৃত্যু টানার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে হরিশ। কতটা পেলে মানুষ সন্তুষ্ট হয় এখনও বুঝে উঠতে পারেন না সিদ্ধার্থ। মানুষের মনোভূমিতে চাহিদার বিষবৃক্ষ কতটা বেড়ে উঠলে সম্পর্কগুলোকে নস্যাৎ করে শুধু চাহিদার কথাই ভাবতে থাকে— তার পরিমাপ আজও শিখলেন না। হরিশের মৃত্যুশোক ধীরে ধীরে টাকার শোকে পরিণত হচ্ছে। এই তো মানুষের অস্তিত্ব!

‘এসব কথা মায়ের সামনে বারবার তুললে তাঁর মনে কতটা আঘাত লাগে তোরা বুঝতে পারিস? বাবা গেল, মাকেও খুঁচিয়ে মারতে চাস? এমন করলে আমাকে আর ডাকিস না। সত্যি কথা বলতে এ বাড়িতে আমার আসার আর কোনও কারণ রইল না।”

তাপস কাঁচুমাচু করে বলল, ‘ওদের কথায় কিছু মনে করবেন না কাকু। আপনি এরকম বললে আমরা খুব কষ্ট পাব। বাবা নেই, এখন আপনিই আমাদের গার্জিয়ান।’

হাসতে গিয়েও কোনওরকমে নিজেকে সামলালেন সিদ্ধার্থ। এই মুহূর্তে হাসলে বড্ড বেমানান দেখাত। বেড়ে মিথ্যে কথাটা বলেছে ছোকরা! মরার ক’দিন আগেই হরিশ ফোনে চরম এক স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘জানি না আমি আর ফিরতে পারব কিনা, তোকে একটা গোপন কথা বলতে চাই।’ তারপরে সংকোচ ভরে বলেছিলেন, “জানি না বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, তবুও বলছি কারণ একজন মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে যুক্তিতর্কের চেয়ে সত্যটা স্বীকার করার মধ্যে প্রাণের আরাম বেশি মনে হয়। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হচ্ছে। শোন সিদ্ধার্থ, আমার মৃত্যু হলে তুই আর আমাদের বাড়ি আসিস না। একদিন এক ঝগড়ার সূত্রে তাপস কি বলেছিল জানিস? বলেছিল, তোমরা যাকে এত প্রশ্রয় দাও সে তো আসলে লম্পট, চরিত্রহীন। ছোটো থাকতে ও নাকি দেখেছে, তুই নাকি ওর মার সঙ্গে একই বিছানায়… আমি বিশ্বাস করিনি। আমি জানি ওটা ওর বানানো গল্প। ও সব পারে। আমি বেঁচে থাকতে যেটা পারেনি সেটা আমার অবর্তমানে ঠিক করে দেখাবে।”

শোনার পর কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি সিদ্ধার্থ। সুতীব্র গ্লানিতে ভরে গিয়েছিল মন। এটা শুনতেও বাকি ছিল তাঁর! দু’দিন এতটাই তোলপাড় ছিল মন, হরিশের বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত মাড়াননি। পরে হরিশের অনুরোধেই আবার গিয়েছিলেন। হরিশ আকুতি মিশিয়ে বলেছিলেন, “আমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত অন্তত আসিস।”

 

 

 

নরদেহ পর্ব-১

“এখন সবাই একটু কিছু মুখে দাও।’’ গম্ভীর মুখে কথাটা বললেন সিদ্ধার্থ।

ঘরের সবাই অবাক চোখে তাকাল তাঁর দিকে। বলে কী লোকটা! মাথার ঠিক আছে তো? বাবার মৃত্যুর পর তিন ঘন্টাও কাটেনি। কোভিডে মৃত্যু, তাই ছুঁয়ে দেখারও সুযোগ পায়নি কেউ। শুধু ওখানে উপস্থিত তাপস আর নিলু দূর থেকে প্ল্যাস্টিকের মোড়কে আটকানো বাবার মুখটা দেখতে পেয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল ওদের লোকেরাই। কাঁদতেও পারেনি ওখানে। বাড়িতে ফিরে আসার পর একচোট কান্নার রোল উঠেছিল। সময় কান্নার জল শুষে নেয়। অন্তর গুমরে উঠলেও জল সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একসময়। মাঝে মাঝে একটু নাক মোছা চলছিল, ঠিক তখনই সিদ্ধার্থ কাকুর এই কথা!

কান্না পর্ব শেষ। এখন চলছে শোক স্তব্ধতার পর্ব। পর্বের সমাহারই জীবন। অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলেনি। মনে মনে হয়তো সিদ্ধার্থকে তুলোধনা করছিল। এইসময় এরকম একটা কথা বলা যায়? লোকটা মানুষ না জানোয়ার? অথচ যিনি মারা গিয়েছেন তিনি তো তাঁরই বাল্যবন্ধু। একটা মানুষ মরে গেল আর ওর কাছে খাওয়াটাই বড়ো হল? তিনি বিচক্ষণ, তিনি আবার একজন অধ্যাপক!

সময় আর কিছুক্ষণ সময় নিল, তারপরেই নিজের খেল দেখিয়ে দিল। সিদ্ধার্থ মনে মনে কষ্ট পেলেও জানতেন এটাই হবে। শোক আসলে একটা ঝোড়ো হাওয়া, সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না।

তাপসদের মিনু মাসি খবর পেয়েই চলে এসেছেন লকডাউন উপেক্ষা করে। খুব বেশি দূরে থাকেন না বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বললেন, “যে গেল সে তো আর ফিরে আসবে না। ভাবলেই বুক ফেটে কান্না আসছে। কী ভালোমানুষ ছিলেন জামাইবাবু। সবই নিয়তি। তোরা চেষ্টার তো কোনও ত্রুটি করিসনি। কিন্তু দাদার কথাটাও মানতে হবে। সবশুদ্ধু খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলে কেমন করে চলবে? সামনে কত কাজ। আমি বরং ফ্রিজ থেকে কিছু ফল বের করে রাখি, একটু গরম হবে।’

সময় আর শোকের খেলা জমে উঠছে। এতক্ষণ শোক একচেটিয়া মাঠ দখল করে খেলছিল, এবার শিথিল হচ্ছে তার আধিপত্য, খেলা ধরছে সময়।

তাপসের বউ অপর্ণা বলল, ‘ফলগুলো ভালো করে স্যানিটাইজ করতে হবে। আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে, চলুন।

শোকের চেয়ে বড়ো কর্তব্য। জীবন থাকলে কর্তব্য থাকবে। যে মরে যায় তার সঙ্গে সবাই তো একসঙ্গে মরতে পারে না। জীবন-মৃত্যুর টানাটানিতে যে যেদিকে থাকবে, তাকে সেখানেই লড়াই করতে হবে।

সিদ্ধার্থ সে অর্থে এ বাড়ির কেউ নন। আবার অন্যদিক থেকে অনেক কিছু। মৃত হরিশ মুখার্জির বাল্যবন্ধু তিনি। অকৃতদার। নিজের পরিবার বলতে এক আধপাগল ভাই, একটা পোষা কুকুর, আর রান্নার কাজের লোক রামের মা। রামের মায়ের আসল একটা নাম আছে বটে কিন্তু সেটা ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড আর আধার কার্ডের বাইরে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করার সুযোগই পায় না। মজার ব্যাপার, তিনি নিজেও সেটা মাঝে মাঝে ভুলে যান।

সিদ্ধার্থ ফিলোজফির অধ্যাপক ছিলেন। বছর পাঁচেক হল রিটায়ার করেছেন। বন্ধু হরিশের পরিবারকে নিজের পরিবারের মতো ভালোবাসেন। তার কারণও আছে একটা। সিদ্ধার্থের মা মারা গিয়েছিলেন শৈশবেই। সেই সময় থেকে হরিশের মা তাকে মাতৃস্নেহ দিয়েছিলেন। সখির ছেলে বলে কথা! সবাইকে বলতেন, ওরা দুজন আমার দুই সন্তান। ওদের বলতেন— আমি যখন থাকব না, তোরা দুজনে দুজনকে দেখে রাখবি।

হরিশের ডায়াবেটিস ছিল। কিছুদিন আগে হার্টের কিছু মাইনর সমস্যাও ধরা পড়েছিল। ইদানীং একটুতেই হাঁপিয়ে যেতেন। তবুও থেমে থাকেননি। বয়সের সিম্পটম বলে দিব্যি ইগনোর করে যাচ্ছিলেন। তবে করোনার আবির্ভাবে সবার মতো হরিশও ভয় পেয়েছিলেন। যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করে চলার চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার, ঘরবন্দি হয়ে থাকা, নিয়ম করে গার্গেল করা, প্রোটিন, ভিটামিন সি, কোনও কিছুই বাদ দেননি। তবুও তিনি করোনা আক্রান্ত হলেন। প্রথমে সর্দি, কাশি, গা-হাত-পা ব্যথা, তারপরে এল জ্বর। হাউজ ফিজিশিয়ান ডাক্তার মিত্র বললেন, ‘টেস্টটা করিয়ে নিন।’

টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ। হালকা শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। পুরো এলাকা তখন কনটেইনমেন্ট জোন। কেউ কোথাও যেতে পারে না, কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে না, সে এক মহা বিড়ম্বনা। এক একটা বাড়ি যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সন্ধ্যা হতেই কোলাহলের শহরে মৃত্যুপুরীর নির্জনতা নামে। টিভি আর মোবাইল বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

দশ দিন লড়াই করার পর হেরে গেলেন হরিশ। হেরে গেলেন জীবনের কাছে। মাঝখানে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তখন দু’বেলা ফোন করতেন সিদ্ধার্থকে। বাড়ির খবরাখবর নিতেন। আর বলতেন, এবার ফিরলে এটা করব সেটা করব, কত প্ল্যান! আসলে আইসোলেশন পর্বে হরিশ পিছনের জীবনটাকে দেখার, মূল্যায়ন করার অখণ্ড অবকাশ পেয়েছিলেন ওখানে। দূরে গেলে কাছটাকে দেখা যায়, একদম খাঁটি সত্য। কাছ থেকে কাছটাকে দেখাই হয়ে ওঠে না! হঠাৎ করে একটা লোক আবার অতটা সিরিয়াস হয়ে গেল কী করে কে জানে, চলে গেলেন হরিশ। হরিশের ছেলেরা হসপিটালের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু এই ডামাডোলে ধোপে টেকেনি।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব