পিরামিড (প্রথম পর্ব)

অঘটন বিভিন্ন রকমের হয়। সবই যে শরীর ধ্বংস করে বা হাত পা মাথা কাটে এমন নয়, মাঝে মাঝে এই অঘটন একটা অদ্ভুত আনন্দও দেয়। আনন্দের ধারণাটাও আপেক্ষিক, তাই একই ঘটনা এক পরিবারের একজনকে আনন্দিত করলেও অন্য আরেকজনকে দুঃখিত করে। সমস্যা হল এই দুঃখ আবার প্রকাশ করা যায় না, ঠিক যেমন রূপার হল।

ক্লাস টুয়েলভে পড়বার সময় একদিন রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে বাবার গুজুরফুসুর কানে এল। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোনওদিন এইভাবে বাবা-মা আড়ালে ফিসফাস করেছে বলে কোনও কিছু চোখে পড়েনি। আর পড়বেই বা কী করে— তিনজনের সংসারে ঝামেলা বলতে শুধুমাত্র স্কুল আর অফিসের ভাত দেওয়া নিয়ে। তাও তো অর্ধেক দিন বাবাকে আগের দিনের রান্নাই গরম করে দেয়। বাবা অম্লান মুখে খেয়ে নেয়। মায়ের টুকটাক ঠুসঠাস যা হয়, তা রূপার সঙ্গে।

সরাসরি মা বা বাবাকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না, তোমরা কী সব চুপিচুপি আলোচনা করছিলে? বাবা চুপ থাকলেও মা হয়তো রেগে যাবে। তাই জানার ইচ্ছে থাকলেও চুপ করেই থাকতে হল। কয়েকদিন পরেই অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।

স্কুল থেকে ফেরবার সময় কমার্স সেকশনের অমৃতা বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল, কী রে খবরটা দিসনি তো?

কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল রূপা। চয়ন মানে চাঙ্কির সঙ্গে ঘোরাঘুরি নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করে। রূপা উত্তরও দেয় আবার দেয়ও না। তবে অমৃতাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে, কোন খবরটা রে?

—সে কী রে, তোর নাকি ভাই বা বোন হবে? বেশ ভালো, তবে এজ গ্যাপটা একটু বেশি হয়ে যাবে।

রূপা এবার বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, কী বাজে বকছিস?

—বাজে নয় কাজের কথাই বলছি, তুই খবর না দিলেই বা কী! আমি ঠিক খবর পেয়ে গেছি। কবে ট্রিট দিবি বল?

আকাশ থেকে পড়ল রূপা, চারপাশটা দেখে গম্ভীর ভাবেই বলে উঠল, তোকে কে বলল?

—মা-বাবা আলোচনা করছিল, আমি শুনেছি। তোর মা আমার মাকে বলেছে।

সব শুনেও রূপা কিছু সময় কোনও কথা বলতে পারল না। রাস্তার একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তাহলে গুজুরফুসুর মানে এইসব। কয়েক সপ্তাহ আগে বাবা অফিস কামাই করে মা-কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিল, তার মানে ভিতরে ভিতরে এতদূর সবকিছু হয়ে গেল, আর কিছুই জানা গেল না। নিজের ওপরেই রাগ হল রূপার। অমৃতাকে বলল, আমার একটু তাড়া আছে। তারপরেই তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।

বাড়ি পৌঁছে নিজের ঘরে ঢুকতেই চোখ ফেটে জল এল। কারওর সঙ্গে কোনও কথা না বলে দরজা বন্ধ করে সন্ধে পর্যন্ত বসে রইল। মাঝে মা কয়েকবার এসে, কী হয়েছে? কেন এমন করছিস? এসব জিজ্ঞেস করল। স্কুলে বা টিউশনে কোনও কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল। রূপম নামের সেই ছেলেটা আর বিরক্ত করছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করল।

সব প্রশ্নেরই এক উত্তর, না, কিছু হয়নি। কেউ কিছু করেনি। তুমি যাও। সন্ধের পর বাবা এসেও জিজ্ঞেস করল কিন্তু এবারেও উত্তর পেল না।

সমস্যা আরও বাড়ল। খেতে বসবার সময়। রূপা প্রথমে তো আসতেই রাজি হচ্ছিল না। পরে বাবার কথা শুনে খাবার টেবিলে এলেও খাবার নিয়ে বসে রইল। বাবা-মা দুজনে গিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, রূপার দুচোখ দিয়ে জল নেমে এল।

কিছুসময় পর রূপা কাঁদতে কঁদতেই বলে উঠল, আমার নাকি ভাই-বোন কিছু একটা হবে?

—কে বলল তোকে? কথাটা মা কিছুক্ষণ চুপ থাকবার পর বলল।

—কে বলল জানতে হবে না। সত্যি না মিথ্যা সেটা বলো।

বাবা এবার লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল, হ্যাঁ, চারমাস চলছে।

—আর ইউ ম্যাড, অর স্যাভেজ ইললিটারেট?

মা কোনও উত্তর না দিয়ে গালে এক চড় কষিয়ে দিল। আচমকা আসা এই আঘাতে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও কিছুসময় পরেই গালে হাত বোলাতে বোলাতে রূপা বলে উঠল, আমাকে চড় মারলে কিন্তু পাড়ার সবাই, ফ্ল্যাটের সবাই? ছিঃ ছিঃ করছে তোমাদের। কজনকে চড় মেরে মুখ বন্ধ করবে।

সেই রাতে আর কারওরই খাওয়া হল না। পরেরদিন সকালে উঠেই বাবা রূপাকে চায়ের টেবিলে ডেকে বলল, দেখ তুই বড়ো হয়ে গেছিস। আজকের যুগের মেয়ে তুই, আসলে ঘটনাটা খুবই সাডেন। এমনকী তোর মা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি।

—বোকা বোকা কথা বোলো না বাবা। তুমি বুঝতে পারোনি দ্যাটস ওকে, বাট মা!

—তোর মায়ের একটা প্রবলেম আছে সেটা তো জানিস। তোর সঙ্গে ডাক্তারও দেখাতে গেছিল।

—আমি বুঝতে পেরেছি কি পারিনি, সেটা তোকে বলব না। তোর আমি ইয়ার দোস্ত না। আমরা মা-কাকিমাদের কখনও এইসব কথা বলবার সাহস পেতাম না। কথাগুলো একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল মা।

—তোমাদের কথা আলাদা মা।

—আলাদা মানে কি? মা-বাবার সঙ্গে এইসব কথা বলা?

—তোমরা কি এইসব কথা বলবার জন্য আমাকে ডাকলে, তাহলে আমি আসছি, কাজ আছে।

—কাজ মানে তো ফোনে ফটর ফটর করা।

—আমার এটাই বয়স। যে-বয়সে যেটা মানায়, সেটাই করতে হয়।

বাবা কিছুসময় চুপ থেকে মা-মেয়ের কথা শুনছিল। রূপার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠল, ঠিক আছে, এবার বল তোর মতামত কী?

—হোয়াই শুড আই বাবা? ইউ হ্যাভ নট আস্কড মি বিফোর ডুইং দ্যাট।

—তা না, আমরা তো, মানে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।

—দুর্ঘটনা! হাউ ফানি বাবা, দুর্ঘটনা মেড মাই মাদার প্রেগন্যান্ট।

—শোন ব্যাপারটা ঠিক ওইরকম নয়। আসলে আর বছর তিন পরে তোকে বিয়ে দিতে হবে, তার পরে তো আমরা একা।

—ইজ ইট এনি এক্সকিউজ? আমার বিয়ের পরে তোমার জামাই আসবে। কোথাও তো লেখা নেই বিয়ের পর মেয়েরা বাবা-মা-কে দেখবে না। তাছাড়া আমি বিয়ে করব কিনা সেটাও ঠিক নেই। তোমরা এত কিছু ভেবে এই বয়সে এরকম করে ফেললে?

—শোনো, মেয়ের কথা শোনো, তোমার প্রশ্রয়ে আজ এইরকম অবস্থা। আমার না হয় ভাই বোন নেই কিন্তু তোমার তো আছে। বুগি তোমার থেকে কত ছোটো?

—মা, ননসেন্সের মতো কথা বলো না। বুগি বাবার থেকে এগারো বছরের ছোটো, না জ্যাঠা বাবার থেকে বারো বছরের বড়ো, এটা নিয়ে কোনও কমপ্যারিজন হয় কি?

—ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে বলে কথা, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলবার বহর শোনো।

—মা, আমার শিক্ষা আমাকে তোমাদের সামনে এইভাবে কথা বলতে শিখিয়েছে। আর পৃথিবীর কোথাও লেখা নেই সন্তান হলে বাবা-মায়ের ভুল বলা যাবে না।

শেষের কথাগুলো বলেই ব্রেকফাস্টের টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রূপা। বাবা একভাবে দরজার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে আবার একটা জোরালো শ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়ে গেল বলো তো?

—তুমি বলো। তখন বারবার বারণ করেছিলাম, এখন সামলাও।

 

মাঙ্কি ক্যাপ (২য় পর্ব)

(৩)

সাতসকালেই ঝিলমিলের এসএমএস— আই নিড এ মাঙ্কি ক্যাপ ইমিডিয়েটলি। ইমন মেসেজ পড়ে বিস্মিত হয়। ঝিলমিলের হনুমান টুপির আবার কি দরকার? ক’দিন আগেও দেখা হয়েছে। সকালবেলায় আরকেটি-র বাড়িতে লাইফ সায়েন্স পড়তে গিয়ে। কিছু তো বলেনি। মাফলার দিয়ে মাথা গলা ঢেকে ছিল। তেমন অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। অবশ্য ওপর থেকে বোঝা যায় না ভিতরে কী হয়েছে? কী ধরনের অসুবিধা? তবে এবারের হাড় হিম করা কনকনে শীত সত্যিই অসহনীয়। ঝিলমিলের কি তাহলে এক্সট্রা লার্জ প্রোটেকশনের দরকার এখন?

ইমনও এসএমএস পাঠাল— এক্সকিউজ মি। আই হ্যাভ ওনলি ওয়ান।

ঝিলমিলের চট্‌জলদি মেসেজ— ইফ ইউ লাভ মি, শেয়ার ইট। এতো ভারি বিপদ! নো ডাউট ঝিলমিলকে ইমন ভালোবাসে। কিন্তু তাদের বংশপরম্পরাগত মাঙ্কি ক্যাপ ভালোবাসার নামে উৎসর্গ করলে বাড়িতে তাণ্ডব থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। টুপিদাদু জানতে পারলে ইমনকে আর আস্ত রাখবে না। তার বাবাও কি তাকে মার্সি করবে? যে টুপি পরিয়ে ইমনের বাবা তার মা-কে হাসিল করেছে ইমনও কি পারবে এই সুযোগে ঝিলমিলকে টুপি পরাতে?

ঝিলমিলের তবু বেপরোয়া আবদার— টুপি আমায় দিতেই হবে।

—টুপি ছাড়া আমি তোমায় সব দিতে পারি। প্লিজ মাইরি টুপি চেয়ো না।

—আমার টুপিই চাই।

—কী করে সম্ভব? টুপি আমাদের বাড়িতে একটাই। দাদু থেকে বাবা, বাবা থেকে আমি গসাগু-র মতো ব্যবহার করছি।

—গসাগু মানে?

—গরিষ্ঠ সাধারণ গুননীয়ক অর্থাৎ বড়ো থেকে ছোটো। এক্কেবারে কেসি নাগের ফর্মুলা।

—ওসব গ.সা.গু. ল.সা.গু. ছেড়ে ঝেড়ে কাশো তো চাঁদু। টুপি দেবে কি না?

—একি মামার বাড়ির আবদার নাকি?

—সামান্য টুপি দিতে পারো না, তুমি বাসবে ভালো?

—কি বলছ ঝিলমিল? ভালোবাসার জন্য আমার প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু টুপি দিতে পারব না। তুমি অন্য কিছু চাও, আমার আই ফোন, ল্যাপটপ, মানিব্যাগ…..

—আমার টুপিই চাই।

—বাজার থেকে কিনে নিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

—তুমি হয়তো জানো না এবারের কনকনে শীতে আলু পেঁয়াজের মতো বাজার থেকে মাঙ্কি ক্যাপও ভ্যানিশ। হাতে-গোনা দু-একটা যাও পাওয়া যাচ্ছে, তার দামও আকাশছোঁয়া। পঞ্চাশের হনু ব্ল্যাকে পাঁচশো হাঁকছে।

—কি বলছ?

—যা বলছি মার্কেট স্টাডি করেই বলছি। ভাবলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো। টুপি ছাড়া আমি বাঁচব না। আমার মান- সম্মান লাজ-লজ্জা সব ওই হনুমান টুপির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ইমন বোকার মতো জানতে চায়— এসব তুমি কী বলছ? আমি তোমার মাথামুণ্ডু কিছুই ছাই বুঝতে পারছি না।

—তোমায় অতশত বুঝতে হবে না। যা বলছি সেটা করতে পারবে কিনা বলো?

—আমি চেষ্টা করব ঝিলমিল। কিন্তু যদি না পারি? ঝিলমিলের সটান জবাব— আমাদের ভালোবাসার —দি এন্ড।

(8)

ইমনের দাদু স্বদেশ হালদার বিদ্যুৎ চমকানোর মতো বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলেন— চোর শেষপর্যন্ত আর কিছু না নিয়ে মাঙ্কি ক্যাপ নিয়ে চম্পট দিল?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— আপদ গেছে। এখন ক’দিন শান্তিমতো ঘুমোতে পারব। বাব্বা কয়েক রাত্তির যা ধকল গেল।

—মহিম তুই একথা বলতে পারলি?

—আগের গান্ধিটা ট্রাই করছ না কেন?

—হনুমানটা বেশ সেট হয়ে গিয়েছিল। দারুণ গরম হতো। শরীরে মনে বেশ চাঙ্গা বোধ করতাম। গান্ধি বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। আধুনিক ছেলেছোকরার দল যেন মানতেই চায় না। আমাকে টুপি দাদু বলে খেপাত— তোর মনে নেই?

—না পাওয়া গেলে কী করবে? ক’দিন পুরোনোটা দিয়ে চালাও। তারপর সময়মতো পেলে কিনে দেব। অন্তত মাথাটা তো বাঁচবে। সঙ্গে মাফলার, শাল জড়িয়ে নিলে দিব্যি ক’দিন কেটে যাবে। বরং বলি কি তুমি ক’দিন রেস্ট নাও। মর্নিং ওয়াকে না গেলেই নয়?

—আমায় জ্ঞান দিস না মহিম। আমি বিপ্লবী, চুটিয়ে স্বদেশি করেছি। আমাদের অভিধানে রেস্ট বলে কোনও শব্দ লেখা নেই। কিন্তু আমি ভাবছি এত সাধের মাঙ্কি ক্যাপটা মিসিং হল কী করে? চোর, সোনাদানা-টিভি-ফ্রিজ-ল্যাপটপ চুরি না করে শেষপর্যন্ত হনুমান টুপি? ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—এই প্রচণ্ড শীতে মনে হয় চোরের কাছে ওটাই মস্ত জরুরি, মহা মূল্যবান। আরে বাবা চোরও তো মানুষ নাকি? চোরেরও ঠান্ডা লাগে।

—ডোন্ট টক ননসেন্স, মহিম। এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপারকে লঘু করে দেখা উচিত না।

—তুমিও পারো বাবা। সামান্য একটা টুপি নিয়ে কি কাণ্ডটাই না তুমি করছ।

—এটা সামান্য নয়। আমার কাছে বেশ রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। প্রেস্টিজ ইস্যুও বলতে পারিস।

ক’দিন বাদে দাদুই আবিষ্কার করলেন ইমনদের পারিবারিক ঐতিহ্যশালী মিসিং লিংক মাঙ্কি ক্যাপটি। দাদু ইমনকে জরুরি তলব করলেন, পার্ক থেকে মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে আসার পর। দাদু কি শেষ পর্যন্ত ইমনকে সন্দেহ করছেন? ইমন কি ধরা পড়ে গেল? ইমনের বুকের ভিতর হাজারটা অশ্বখুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঝিলমিলকে ইমনই যে টুপিটা দিয়েছিল, দাদু জানল কী করে?

তার দাদু গলার মাফলার আলগা করে চাদরটা গা থেকে খুলে মায়ের দেওয়া এক কাপ গরম চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বললেন— জানিস দাদুভাই হনুমানটাকে খুঁজে পেয়েছি।

ইমন অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল— কোথায়?

—পার্কে রংগন গাছের ঝোপের আড়ালে। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। হালকা হলুদ রঙের, মাথায় কালো উলের বল।

ইমন আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বলে– ধ্যাৎ দাদু কী যে বলো না। তোমার চোখে নির্ঘাত ছানি পড়েছে। এরকম কালার কম্বিনেশন অনেক টুপির হতে পারে।

—আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। আমার বিপ্লবীর চোখ। দূর থেকে দেখেই কত ইংরেজের দুরভিসন্ধি ফাঁস করে দিয়েছি। ঝোপের আড়ালে টুপিতে মুখ ঢেকে মেয়েটা এমনভাবে বসেছিল যাতে কেউ চিনতে না পারে আর তার গা ঘেঁষে ছেলেটি অশোভন অবস্থায়…। পার্কটা ক্রমশ দূষিত হয়ে যাচ্ছে রে দাদুভাই। আর বোধহয় মর্নিং ওয়াকে যাওয়া যাবে না।

ইমন দারুণ বিস্ময়ে হতবাক। তার চোখের সামনে সবকিছু এখন জলের মতো পরিষ্কার। আসলে ঝিলমিল তাকে ঠকিয়েছে। তাকেই মস্ত টুপি পরিয়েছে।

 

মাঙ্কি ক্যাপ (১ম পর্ব)

শীত এলেই সবার নজরে পড়ে মাঙ্কি ক্যাপটির উপর। প্রথমে ইমনের দাদু এক্স বিপ্লবী স্বদেশ হালদারের। একসময় চুটিয়ে স্বদেশি করেছেন। সার্থক তাঁর নাম আর কাম। মাথায় গান্ধি ক্যাপ। মনে হতো তিনিই মহাত্মা। স্বাধীনতার পরও টুপি মাথায়। গান্ধি যেন তাঁর তেলা নি-কেশ মাথায় চেপে বসেছে। পাড়ার উঠতি ছেলেছোকরার কাছে তিনি টুপিদাদু। কিন্তু দাদুরও বয়স বাড়ছে। সঙ্গে জাঁকিয়ে পড়ছে শীত। গান্ধি টাক মাথা সামলালেও কান আর নাকের ফুটোয় গোঁজ মারা তার কম্মো নয়। ফলত হিমেল হাওয়ার দাপটে ইমনের টুপি দাদু একেবারে কুপোকাত। গলায় ঘর্ঘর, নাকে সরসর আর কানের ভিতর কড়কড় অনবরত বেজেই চলেছে। তবু দাদু টুপি খুলবেন না। ডাক্তার সনাতন হাজরা ইমনের মাকে উপদেশ দিলেন— এমনটা কখনওই বরদাস্ত করা যাবে না। আরে বাবা বয়স তো হচ্ছে নাকি? কত চলছে?

ইমনের মা আঙুলের কড় গুনে বলেন— আশি ছুঁই ছুঁই।

ডাক্তার হাজরা চমকে উঠে বলেন— এই ভয়ংকর শীতে এখনও হাফ নেকেড ফকির হয়ে থাকতে চান। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—বাবা তো সচিনের মতো সেঞ্চুরির পাহাড় গড়বেন বলে শপথ করেছেন।

—বলবেন, ওসব গান্ধিগিরি চলবে না। বুড়ো বয়সে যত্তসব ভিমরতি। নিউমোনিয়ায় একেবারে টেসে যাবে।

—তাহলে উপায় ডাক্তারবাবু?

—হনুমান ডট কমের যুগ। ছবিতে দেখেছেন বিশুর ছেলেটা মাথায় কী পরে আছে? ইমনের মা মাথা নাড়ে।

ডাক্তার হাজরা বিজ্ঞের মতো বলেন— আইসল্যান্ডে ওসব গান্ধি-টান্ধি এক্কেবারে অচল। হনুমানই পারে ওরকম রাবণের মতো ভয়ংকর প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে।

—তার মানে, আপনি বলছেন মাঙ্কি ক্যাপ।

—গান্ধির বদলে হনুমান। ঠিক ধরেছেন।

—কিন্তু হনুমান টুপি যদি মাথায় না পরতে চান? আমার শ্বশুরমশাইয়ের যা জেদ।

ডাক্তার হাজরা খানিকক্ষণ গুম হয়ে কিসব চিন্তা করলেন। তারপর স্মিতহাস্যে বললেন— কুছ পরোয়া নেই। যে রোগের যেমন ওষুধ।

ইমনের মা বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন— সেটা আবার কী?

—কথা না শুনলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।

—আপনি কী করবেন?

—ঘুমের ওষুধ গিলিয়ে গান্ধি খুলিয়ে হনুমান পরিয়ে দেব।

—কতক্ষণ লাগবে?

—মাত্র সাড়ে সতেরো মিনিট।

—বলেন কী টুপি পরানো এত সোজা? এত তাড়াতাড়ি?

—আমার নাম…।

ইমনের মা সামান্য রসিকতা করে বলে— মুন্না ভাই এমবিবিএস। তাই না?

—ধ্যাৎ, কী যে বলেন। আমার নাম সনাতন হাজরা। রোগীদের টুপি পরানোই আমার কাজ। বিফলে মূল্য ফেরত।

ইমনের মা বিড়বিড় করে বলে— মুন্নার বদলে সনাতন। গান্ধির বদলে হনুমান। দুয়ে দুয়ে চার।   ভালোই মিলেছে।

ডাক্তার হাজরার চেম্বার পর্যটন করে ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপের স্বাদ টের পেয়েছেন এখন হাড়ে হাড়ে। তাঁর মুখে দিনরাত হনুমান চালিশা। হনুমান ভক্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। টুপির এত গুণ, আগে জানা ছিল না। শীত এলেই তিনি বাহুবলী হয়ে যান। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহে যখন সবাই লেপের ভিতর জবুথবু, ঘুম আর ভাঙতেই চায় না, তখন ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপে মুখ ঢেকে স্বপ্নবীথি পার্কের ভিতর তিন রাউন্ড মর্নিং-ওয়াক সেরে অবলীলায় বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর সোজা ইমনের বাবার ঘরে ঢুকে এক ঝটকায় লেপ সরিয়ে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলেন— যা আর দেরি করিস না। পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। ইমনের বাবার মুখে বিরক্তির সুর— আঃ আমাকে আবার টুপি পরাতে এলে কেন? দাদু নাছোড়বান্দা। টুপি পরানোয় তিনি জেনারেশন ধরে অভ্যস্ত করাবেনই। সবশেষে যে ইমনের পালা, তা আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। সে জানে লেপের তলায় ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থাকলেও রেহাই নেই। দাদু ইমনের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন – শোন মহিম, মাঙ্কি ক্যাপ পরে শীতের সকালে মর্নিং ওয়াকের মজাই আলাদা। ইমনের বাবা যেন তার দাদুর কথা শুনতেই পায় না। লেপের ভিতর শামুক হয়ে থাকতে চায়। দাদু তবু ছাড়ে না ইমনের বাবাকে। বলেন— কিরে উঠবি নাকি বউমাকে বলব গায়ে জল ঢেলে দিতে। ইমনের বাবা মুখ বিকৃত করে বলে— আঃ কি জ্বালাতন! শান্তিমতো ঘুমোতেও দেবে না নাকি?

—ব্যাটা কুম্ভকৰ্ণ। এত ঘুম আসে কী করে? রাতে ঘুমোসনি? হঠাৎ দাদু বাজখাই গলায় ইমনের মাকে চিৎকার করে ডেকে বলেন— বউমা, মহিম কি রাতে ঘুমায় না? তোমরা করো কী? মা আমতা আমতা করে বলে— আপনার গুণধর ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করুন। আমি পই পই করে বলি, যা ঠান্ডা পড়েছে তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর…। দাদু মাকে সমর্থন করে বলেন— ইউ আর রাইট বউমা। বাট মহিম…।

—সাত তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর ঢুকলে ওর নাকি জ্বর আসে।

—হোয়াট ডু ইউ মিন বাই জ্বর?

—মানে গরম হয়ে গেলে আর ঘুম আসে না। —কই আমি তো এসবের বিন্দুবিসর্গ জানি না।

—আপনি গুরুজন। আপনাকে কি সব খুলে বলা যায়?

—তুমি কাছে থাকো না?

—আমি থাকলে জ্বর আরও বাড়ে।

—সে কি কথা! কেমন ব্যাধি?

—আপনার ছেলেই ভালো বলতে পারবে।

—ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

—আপনার ছেলে না যেতে চাইলে আমি কি আর করতে পারি?

—আঃ বউমা হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমার হাতেই ওর কলকব্জা।

—শীত এলেই ও এরকম বিগড়ে যায়। মেশিন ঠিক থাকে না।

—না না এতো ভালো কথা নয়। এর একটা আশু বিহিত প্রয়োজন।

—দেখুন চেষ্টা করে। আপনার মধ্যস্থতায় যদি কাজ হয়। আমি তো অলরেডি ফেড-আপ।

এইবার দাদু ইমনের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন— কী’রে বউমা যা বলছে সত্যি?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— হুম।

—রাতে ঘুমোস না?

—হুম।

—বউমার কথা শুনিস না?

—হুম।

—কী তখন থেকে হুম হুম করছিস?

—আঃ বিরক্ত কোরো না তো। লেট মি হ্যাভ এ সাউন্ড স্লিপ।

—রাতে না ঘুমিয়ে সকালে কেন ঘুমোচ্ছিস মহিম?

—ক’দিন ধরে অফিসের কিছু জরুরি ফাইল রাতে দেখতে হচ্ছে। তাই শুতে দেরি হচ্ছে। আর কোনও গল্প নেই।

ইমনের মার দিকে তাকিয়ে দাদু বলেন— ও তাই বল। আমরা তো অন্য কিছু সন্দেহ করছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন -ওরে বাবা সাতটা বেজে গেল। নে আর দেরি না করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপটা চাপিয়ে পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। দেখবি মন-মেজাজ একেবারে ঝরঝরে হয়ে যাবে।

ইমনের বাবার সেই এক বিরক্তিকর জবাব— আজ টুপি না পরলেই নয়?

— টুপি না পরলে ইউ মাস্ট ক্যাচ কাফ্ অ্যান্ড কোল্ড। আজকের টেম্পারেচার কত জানিস? অলমোস্ট এইট ডিগ্রি। ‘জয় হনুমান’ বলে বেরিয়ে পড়।

—আজ আমি টুপি পরব না।

—ছেলেমানুষি করিস না মহিম। টুপি তোকে পরতেই হবে।

—কিছুতেই না।

—অবাধ্য হোস না। তুই ভালো করেই জানিস। আমি এক সময় স্বদেশি করেছি। কতজন গোরাকে চ্যাংদোলা করে ছুড়ে মাটিতে আছড়ে ফেলেছি। গান্ধি ছেড়ে এখন আমি হনু হয়েছি। আমার এখন মহাবলী শক্তি।

হঠাৎ ‘জয় বজরংবলী’ বলে একলাফে ইমনের টুপিদাদু তার বাবাকে চ্যাংদোলা করে তুলে বাইরে এনে ফেলে। তারপর মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ পরিয়ে বলেন— মহিম তুই এখনও আমার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু রে।

(২)

সেদিনটাও ছিল এমনই এক ভয়ংকর শীতের সকাল। হনুমান টুপি মাথায় ইমনের বাবা বেরিয়েছে মর্নিং ওয়াকে। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে তখন পড়ত বাবা। সঙ্গে চাকরির পরীক্ষা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বডি ফিট। বাইসেপস, ট্রাইসেপস, সিক্স প্যাকস সবই তার স্বাস্থ্যবান শরীরে সুসজ্জিত ও সুশোভিত। কিন্তু শীতকাল এলেই কেমন জবুথবু হয়ে যায় ইমনের বাবা। সামান্য ঠান্ডা যেন সহ্য হয় না। হাঁচি একবার শুরু হলে তিন কুড়িতে গিয়ে থামত। নাকের ট্যাপ কলে প্যাঁচ বিকল। অনবরত জল পড়েই চলেছে। ইমনের ঠাম্মা বুকে গরম তেল মালিশ করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলত— যা মর্নিং ওয়াকটা সেরে আয়। তোর বাবা আগেই বেরিয়েছে। আমি গরম জল চাপাচ্ছি। চা খেয়ে বাজারে যাবি। ইমনের বাবা ঠাম্মার কথা শিরোধার্য করে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।

আড়াই রাউন্ড মারার পর হঠাৎ ইমনের বাবার বোধোদয় হয় কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। একেই ভয়ংকর ঠান্ডা। তার উপর পার্ক প্রায় জনমানবশূন্য। যে দু-চারজন সিনিয়র সিটিজেন হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করছিল তারাও একবার কোনওক্রমে রাউন্ড মেরেই সটকেছে। কেবল ইমনের নির্ভীক স্বাস্থ্যবান বাবা একা শীতের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

পিছনে না তাকিয়েই জোরে পা চালায় তার বাবা। ভাবে, নির্ঘাৎ কোনও চোর-ডাকাত। তার পকেটে বাজারের টাকা। আঙুলে জন্মদিনের সোনার আংটি। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। সব কেড়ে নিলে, খুলে নিলে তার যাবতীয় বীরত্ব ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। ওর হাতে নিশ্চয়ই অস্ত্র আছে।

এরকম ভাবে বেশ কিছুক্ষণ পিছু-নেওয়া আগন্তুকের সঙ্গে ছোটাছুটি লুকোচুরি খেলার পর অকস্মাৎ এক মেয়েলি কন্ঠস্বরে ইমনের বাবার সম্বিৎ ফেরে। তার বাবা শুনতে পায়— প্লিজ হেল্প মি…. আর পারছি না… ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি… আমাকে বাঁচান।

মেয়েলি কেসে তার বাবা কোনওদিনই পাশ করতে পারেনি। বরাবরই শূন্য পেয়েছে মেয়ে পটানোর পরীক্ষায়। অথচ কলেজ ইউনিভার্সিটিতে তার বন্ধুরা ক্যান্টিনে বাথরুমে-সিঁড়িতে- ব্যালকনিতে— যত্রতত্র নির্ভয়ে টুকলি করে পাশ করে যাচ্ছে। ইমনের বাবার কানে ফের সেই করুণ আর্ত কন্ঠস্বর — আমাকে বাঁচান… আমি জমে যাচ্ছি… মরে যাচ্ছি। ইমনের বাবা মনে মনে ভাবে— কেসটা জন্ডিস নয় তো? বাঁচাতে গিয়ে যদি ফেঁসে যায়? মেয়েরা সব পারে। ইমনের বাবা তবু সাহস সঞ্চয় করে ‘জয় বজরং বলী’ বলে একলাফে মেয়েটির সম্মুখীন হয়— আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কী চান বলুন তো? মেয়েটি তার কথার জবাব না দিয়ে ইমনের বাবার মুখের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। বাবা থতমত খেয়ে যায়। মনে মনে বলে— কী মেয়েরে বাবা, কথা নেই বার্তা নেই। প্রথম সাক্ষাতেই মুখ দেখাচ্ছে। এরপর না জানি কী করতে বলবে। এদিকে মেয়েটি প্রচন্ড ঠান্ডায় প্রায় বাকরুদ্ধ। আঙুল দেখিয়ে কোনওক্রমে বলে — টুপি। ইমনের বাবা চমকে উঠে বলে— টুপি কেন?

—বাইটিং কোল্ড। বুঝিনি বাইরে এতটা ঠান্ডা। টুপি না জড়ালে কানের যন্ত্রণায়…।

—কিন্তু আমার টুপি আপনাকে জড়ালে আমার হাঁচি, কাশি, নাকের জল…।

—আপনি কি চান না একটা অসহায় মেয়েকে এই নিষ্ঠুর আবহাওয়া থেকে বাঁচাতে, উদ্ধার করতে। আপনি সু-পুরুষ স্বাস্থ্যবান। আপনি নিশ্চয়ই চান না চোখের সামনে অসহায় মেয়েটি শীতের প্রচন্ড কামড়ে ফালাফালা হোক। ইমনের বাবার মনে হল, কে যেন তার জামা-প্যান্ট-মাফলার-সোয়েটার-হনুমান টুপি সব খুলে নিয়ে প্রায় অর্ধনগ্ন দেহে এক বালতি জল ঢেলে দিল।

মাথার মাঙ্কি ক্যাপটা একটানে খুলে ইমনের বাবা মেয়েটির মাথায় পরিয়ে দিল। উষ্ণতা পেয়ে মেয়েটি ক্রমশ স্বাভাবিক হতে থাকল। তার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি। কিন্তু টুপি খসিয়ে হাড়-কামড়ানো কনকনে শীতে ইমনের বাবা টানা এক মাস বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছিল। মেয়েটি এর মধ্যে বার কয়েক এসে তার বাবাকে উষ্ণ করে দিয়ে গেছে। এরপর তার বাবার চাকরি, তার বাবার বিয়ে সবই সম্ভব হয়েছে মেয়েটির চিরস্থায়ী সঙ্গলাভ এবং ভালোবাসার হাতের-গরম স্পর্শে। মাঙ্কি ক্যাপের আড়ালে সুজাতা সরকার নামের সেই মেয়েটি এইভাবেই ইমনের বাবার অর্ধাঙ্গিনি এবং ইমনের গর্ভধারিণীরূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।

রঘু

মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি। একদম দুয়ে নিয়ে ছাড়ে। রোজ রোজ অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয় খুব। তাই ‘স্লিপ ডেট’ কাটাতে রবিবারই ভরসা। সেখানেও জ্বালা। ন’টা বাজলেই গামলা মুখে বউয়ের গর্জন। চলো বাজার, বাজার চলো! এপাশ ওপাশ করে যে আরও আধঘন্টা ল্যাদ খাবো তার উপায় নেই। আজ যেমন গরম চায়ের কাপে আমার আঙ্গুল দিল ডুবিয়ে। ড্যাশের নাম খগেন। একলাফে বাথরুম গজগজ করতে করতে।

রবিবার বাজার সেরে আমাদের বন্ধুদের একটা আড্ডা হয় কাকার চায়ের দোকানে। জনা পনেরো থাকি। বাজার ফেলেই দে দৌড়। প্রথমে মাছ মাংস কিনে তারপর সবজি বাজার সারি। ক’দিন ধরেই চিংড়ি চিংড়ি করছে ছেলেটা। একটু বড়ো সাইজের কয়েকটা নিলাম। বাটা মাছ বাবার জন্য। কাতলা কিছুটা নিলাম বাড়ির বাকিদের জন্য। চিকেন নিয়ে সবজি বাজারে ঢুকতেই দেখি পল্টুর ফলের দোকানের সামনে খুব ভিড়। পল্টু জুতো খুলে কাউকে মারছে আর “চোর চোর” বলে চিৎকার করছে। উৎসাহী কয়েকজন বেশ সোচ্চার। তাদের হুলোর মতো মুখগুলো, যেন এখনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাকিয়ে দেখলাম সব মুখগুলোয় অপরের রাগ অন্যকে ঝাড়ার চেষ্টা।

একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম পল্টু জুতো নিয়ে একটা সাত-আট বছরের বাচ্চাকে মারছে। ছেলেটার জামা ছিঁড়ে গেছে। সারা মুখ লাল মারের চোটে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। খুব মায়া হলো। এইটুকু বাচ্চাকে কেউ ওভাবে মারে! ছুটে গিয়ে পল্টুর হাতটা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম, “মেরে ফেলবি নাকি বাচ্চাটাকে”। আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে লাগল। নাটকের যবনিকা এতো তাড়াতাড়ি হবে ওরা ভাবতে পারেনি। এর মধ্যে তাপসদা হাজির।

তাপসদা অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার। বিশাল চেহারা ও মোটা পাকানো গোঁফ ভয় ধরায়। তাপসদা পিছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। পল্টুর হাতে একটা আপেল। মারার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “ছেলেটা আপেল চুরি করে ছুটে পালাচ্ছিল”। এর মধ্যে বাচ্চা ছেলেটা উঠে বসেছে। সারা শরীরে লাল লাল মারের দাগ।

হঠাৎ তাপসদা গম্ভীর গলায় বাচ্চাটাকে জিঞ্জাসা করল, “কি করেছিলিস সত্যি করে বল।”

তাপসদার চেহারা দেখেই ছেলেটা ভয় পেয়েছে খুব বোঝা গেল। একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘একটা আপেল কিনতে চেয়েছিলাম। পাঁচ টাকা আমার কাছে ছিল। দোকানদার বলল, দশটাকা দাম। আমি একটা ছোট আপেল দেখিয়ে বলি, এটা পাঁচ টাকায় দাও না। ও তখন আমাকে গালাগাল করে। বলে অতো কম দামে আপেল হয় না। তারপরও একটা নোংরা কথা বলে।’

‘আমি বলি ‘ওরকম খারাপ কথা কেন বলছো?’ বলতেই ও চিৎকার করতে থাকে আর বলে চোর চোর। আমি ভয় পেয়ে ছুটতেই ও ধরে মারতে শুরু করে। আরও কয়েকজন মারতে থাকে। আমি আপেল চুরি করিনি। আপেলে হাতই দিইনি।’ রিক্সা চালায় হারু সব দেখেছে। সে বলল, ‘বাচ্চাটা ঠিকই বলছে।’ পল্টু এমনি এমনি মারছে বাচ্চাটাকে। ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল যেন।

তাপসদা পল্টুকে শূন্যে তুলে ধরে ছুড়ে ফেলল দূরে রাস্তার ওপর। তারপর আগুন চোখে মিলিটারি মার শুরু করল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলে দেখছে। যারা এতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে পল্টুর সঙ্গ দিচ্ছিল তারা পগারপার। তাপসদাকে থামানো যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর নিজের পায়ের জুতো খুলে বাচ্চাটার হাতে দিয়ে বলল, ‘তুই মার এবার ওর মুখে তোকে যেমন মারছিল।’

সকলকে অবাক করে বাচ্চাটা বলে উঠল, ‘মা বলে, বড়োদের অসম্মান করতে নেই। গায়ে হাত দিতে নেই’। স্তম্ভিত সকলে। বাচ্চার কথাটা সকলের হৃদয় ছুঁয়ে গেল যেন। পল্টুকে ছেড়ে হাসিমুখে তাপসদা বাচ্চাটাকে কাকার চায়ের দোকানে নিয়ে গেল।

বাচ্চাটার নাম রঘু। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, সকাল থেকে সে কিছু খায়নি। ওর মা এক বাড়িতে কাজ করে। তারা সকালে চা আর বাসি রুটি দেয়। ওর মা ওই রুটি নিয়ে এলে ওরা সকলে খাবে। বাড়িতে ওরা তিনজন। মা, বোন আর ও। বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। চা আর বিস্কুট হাতে চুপ করে বসে রইল রঘু। খেতে বলতেই কেঁদে ফেলল। বলল, ওর বোনের ক’দিন ধরে জ্বর। ও না খেয়ে আছে। এক বাবুর গাড়ি ধুয়ে পাঁচ টাকা পেয়েছিল কাল। ওই টাকা নিয়ে বোনের জন্য আপেল কিনতে এসেছিল। ক’দিন ধরেই রঘুর কাছে আপেল খাবার বায়না করছিল বোন। বোন না খেয়ে আছে, তাই ও চা বিস্কুট খেতে পারবে না!

তাপসদা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রঘুর দিকে। বোনের জন্য ওর ভালোবাসায় মুগ্ধ সকলে। তাপসদা হঠাৎ চিৎকার করে পল্টুকে ডাক দিল। মাথা নিচু করে পল্টু হাজির। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে তাপসদার দিকে। তাপসদা হাসতে হাসতে পল্টুকে কাছে ডাকল। বলল, এক কেজি আপেল আর এক ছড়া কলা নিয়ে আয়। দৌড়ে গেল পল্টু দোকানে। আপেল আর কলা আনতেই একটা পাঁচশো টাকার নোট রঘুকে দিয়ে বলল, টাকাটা দে কাকুর হাতে। তুই তোর বোনের জন্য আপেল আর কলা কিনলি।

রঘু কিছুতেই নেবে না। ওর মা বলেছে, ‘এভাবে কেউ দয়া করলে নিবি না’। হো হো করে হেসে উঠল তাপসদা।

পল্টুকে বলল, ‘দেখলি এই ছেলেটাকে তুই চোর বলে মারলি। তোর ছেলেকে কখনও তুই এই শিক্ষা দিয়েছিস? এ ছেলে অনেক দূর যাবে, দেখে নিস।’ তাপসদা জোর করতেই রঘু বলে উঠল, তাহলে আমি বড়ো হয়ে চাকরি করলে তখন ফেরত নিতে হবে কিন্তু। উপস্থিত সকলে রঘুর কথায় হেসে উঠল। কয়েকটা কেক আর বিস্কুটের প্যাকেট আমি দিয়ে দিলাম ফলের ব্যাগে।

আনন্দে রঘু দে দৌড়। আমিও রঘুর মতো দৌড় লাগালাম সবজি বাজারের দিকে। দেরিতে বাজার নিয়ে ঢুকলেই বৌয়ের গামলা মুখের অগ্নিবান কল্পনা করতে করতে।

 

আজি ঝড়ের রাতে…

আঠারো বছর বয়সের সময় যখন আমি কলকাতায় পালিয়ে যাই, তখন নন্দিনীর বয়স ছিল পনেরো। আজ তিন বছর পর আমি বাড়ি ফিরলাম। এখন আমার বয়স একুশ আর নন্দিনীর আঠারো। মা বললেন, দুজনের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে এবার চারহাত এক করতে হবে।

ওই যে কথায় আছে না, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। কেউ জানে না কার ভাগ্য কার সঙ্গে লেখা হয়ে আছে। কিন্তু শুরুটা তো এমন ভাবে হয়নি, হয়েছিল এক প্রাণবন্ত ছন্দে। নন্দিনী যে কখনও অন্য কারও হয়ে যাবে সে কথা তো কোনওদিন ভেবেই দেখিনি।

নন্দিনীর সঙ্গে ছোটোবেলায় স্কুলে গেছি। পুতুল খেলেছি। পুতুলের বাবা মা সাজার সময় আমি বাবা হয়েছি ও মা হয়েছে। কখনও আবার বর-বউ খেলেছি। ওদের বাড়িতে গেলে নন্দিনীর মা আমাকে খুব আদর যত্ন করতেন। স্কুল ছুটি থাকলে দুপুরবেলা প্রায়ই ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন এবং দস্তুর মতো দুজনকে পাশে বসিয়ে হাত দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন। আবার আমাদের দুজনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে আপনা-আপনি বলাবলি করতেন, আহা, বেশ মানিয়েছে দুটিকে।

তখন ক্লাস টু-তে পড়ি। অনেক ছোটো ছিলাম তাই হয়তো কথাটার মানে বুঝতে পারতাম না। শুধু এটুকু বুঝতাম আমাদের দুজনকে ওনারা খুব পছন্দ করতেন। নন্দিনীর প্রতি আমার একটু বেশিই দাবি ছিল অন্যান্য বন্ধুবান্ধব বা ওর আত্মীয়স্বজনের থেকে এবং সেই ধারণা ক্রমশই বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিল আমার মনের মধ্যে। সেই অধিকারে আমি কখনও তাকে শাসন করতাম এবং সেও আমার সব শাসন মাথা পেতে নিত সহিষ্ণু ভাবে।

মাঝে মাঝে তাকে উপদ্রব করতাম, শাস্তি দিতাম কিন্তু কোনওদিন টুঁ-শব্দটি করেনি। নির্দ্বিধায় সব মাথা পেতে নিত। খুব সুন্দরী বলব না তবে বেশ ভালোই দেখতে ছিল। পাড়ার বখাটে ছেলেদের কাছে সে সৌন্দর্যের কোনও দাবি ছিল না। তবে আমি জানতাম আমার আদেশ পালন করার জন্যেই তার জন্ম এবং হয়তো সেই কারণে আমি অনেকটাই তাকে অবহেলা করতাম।

বাবাকে হারিয়েছি বছর দুই আগে। শুনেছি বাবা বলতেন, বাড়ুজ্জ্যে মশাই ওর হাত দেখে বলেছেন আমার রাজা একদিন সত্যি-সত্যিই দেশের রাজা হবে। বাবার ইচ্ছা আমি পড়াশোনা করে অনেক বড়ো হই। তাঁর মতো কলমপেশার চাকরি যেন না করি। ছোটোবেলায় আমি কিন্তু মনে মনে তা, কোনওদিন চাইতাম না। আমি চাইতাম সারাদিন ধরে শুধু খেলাধুলা করব। তাই জীবনে আমি হয়তো কোনও খেলাই বাদ দিইনি।

মার্বেলগুলি, ডাংগুলি, সিগারেট-এর প্যাকেট কেটে তাস, পিট্টু ছাড়াও মেয়েদের সঙ্গে গোল্লাছুট, আরও কত বলব। ফুটবল, ক্রিকেট তো একটা ইতিহাস। দুপুর রোদে ঘর থেকে পালিয়ে যেতাম ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্যে। মা আবার আমাকে খোঁজ করে ঘরে এনে বেঁধে রাখতেন। কখনও মার সবে একটু তন্দ্রা এসেছে, সেই ফাঁকে বাঁধন খুলে, দরজার খিল খুলে আবার পালিয়ে গিয়েছি। পরে দাদাদের হাতে মার খেয়েছি কিন্তু খেলা থেকে কখনও পিছপা হইনি।

প্রতিদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে এসে কোনওমতে নাকেমুখে গুঁজে সোজা অরবিন্দ স্কুলের মাঠে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এদিকে মা ছাতা নিয়ে যখন আমাকে মাঠে খুঁজতে গেছে তখন আমি স্ট্রাইকার রোলে সররা খাচ্ছি।

যাইহোক ধীরে ধীরে খেলাধুলার জগৎ থেকে ইতি টানলাম। শৈশব থেকে কৈশোরে পা বাড়াতেই দেখলাম আমার বন্ধু রঞ্জন ডাক্তার হওয়ার বাসনায় তেড়েফুঁড়ে লেগেছে। হঠাৎ একদিন এও শুনলাম যে, সে কলকাতায় পালিয়ে গেছে। উঠেছে কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে থেকে সে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সফল করবে।

আমার জীবনেও সেরকম অনেক উচ্চাশা ছিল। ওর মতো ডাক্তার না হতে পারি (যদিও মনে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বাসনা ছিল) নিদেনপক্ষে একটা সরকারি চাকুরে অর্থাৎ সরকারি অফিসের বড়োবাবু হওয়ার জন্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম।

ছোটোবেলার কথা আবছা মনে পড়ে। বাবাকে দেখতাম হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ পদ্ধতি কত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। তাছাড়া বাবার আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই উঁচু পোস্টের ইঞ্জিনিয়ার। বাড়িতে তাঁরা এলে বাবা তাঁদের অনেক সম্মান করতেন। সেদিন যেন বাড়িতে উৎসব আনন্দের ঢেউ উঠত। কত পদ যে-মাকে রান্না করতে হতো তার হিসাব নেই।

আমিও শিশুকাল থেকে সেই ইঞ্জিনিয়ার আত্মীয়দের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে সম্ভ্রমের আসন দিয়েছিলাম। যেন আমার ভারতবর্ষের পূজ্য দেবতা। তেত্রিশ কোটি দেবতার ছোটো ছোটো সংস্করণ। যেন বাবা বিশ্বকর্মার সন্তান, নাতি, পুতি এঁরা। বাবা বিশ্বকর্মা কী কী খেতে ভালোবাসতেন জানি না, তবে এদের খাতির আরও বেশি ছিল।

আমিও রঞ্জনের মতো একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম কলকাতায়। যাই হোক বালিগঞ্জে একটা চেনা লোক পেয়ে গেলাম। তার বাড়িতেই উঠলাম। ভদ্রলোকের নাম বীরেন দাস। তাঁর আবার তিন মেয়ে, বড়োজন ভালো গান গাইতে পারে অনেক মেডেলও পেয়েছে। সে আমার চেয়ে বছর দু-তিনেক বড়ো। আবার প্রেমও করে। ছেলে সাধারণ কারখানায় কাজ করে।

বীরেনবাবুর আপত্তি ওই ছেলের সঙ্গে বড়ো মেয়ের বিয়ে দিতে। সেই দুঃখে বড়ো মেয়ে কন্টিনিউয়াস সাতদিন অনশনে। বীরেনবাবু অনেক কষ্টে বিয়েতে রাজি হলেন এবং তারপর বড়ো মেয়ে অনশন ভঙ্গ হল। মেজটার বিয়ে হবে হবে করছে। ছেলে আর্মিতে চাকরি করে। ছোটোটা স্কুলে পড়ে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল ছোটোটাকে পড়ানোর।

মাথায় গোবর আছে বললেও বেশি বলা হবে। আমি পড়াব কী, সে উলটে আমায় পড়িয়ে দেয়। জানি না ওনারা কী ভেবেছিলেন বা আমার ছাত্রীর মনে কী মনোভাব ছিল। তবে ওদের পাড়ায় কানাঘুষো চলত আমি ওই বাড়ির ছোটো জামাই। যাই হোক মা কেঁদেকেটে যখন খবর পেলেন যে, আমি কোথায় আছি তখন দাদাদের হাত দিয়ে পড়াশোনার জন্য কিছু কিছু দক্ষিণা পাঠাতে লাগলেন।

পড়াশোনাও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। আর টিউশানির পয়সা আমি নিতাম না, ওটা বীরেনবাবুর কাছে জমা থাকত। ওনার রেফারেন্সে গ্রাজুয়েশনের পরে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গেলাম। কারণ উনি বলেছিলেন সাধারণ গ্রাজুয়েট হয়ে কিচ্ছু হবে না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই শুধু বাড়বে। খরচা ম্যানেজ করেছিলাম ওই জমা টিউশানির পয়সা আর ওনার সামান্য কিছু সাহায্য দিয়ে। বীরেনবাবুকে কোনওদিন ভুলব না!

মাঝে মাঝে কলকাতার মিছিল-মিটিং-এ যোগ দিতাম। সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভযংকর ছিল। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা অবিলম্বে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এবং সে সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সেই দুঃসাধ্য কাজটা কীভাবে করব, লোকে উপদেশ দিত কিন্তু দৃষ্টান্ত কেউ দেখাত না।

সেই শহরে তখন নীলুদা, রূপকদার পাল্লায় পড়ে দেশের কাজে লেগে পড়লাম। বদমাস ছিলাম ঠিকই, তবে সেই কাজে উৎসাহের কোনও ঘাটতি ছিল না। আমরা পাড়াগাঁয়ের ছেলে হতে পারি, কলকাতার ওই ইঁচড়ে-পাকা ছেলেদের মতো সব জিনিস নিয়ে পরিহাস করতে শিখিনি। সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল।

আমাদের সভায় নেতা-নেত্রীরা বক্তৃতা দিতেন, আর আমরা চাঁদার বই হাতে নিয়ে না-খেয়ে দুপুর-রৌদ্রে টো-টো করে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াতাম। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে লিফলেট-পত্রিকা বিলি করতাম। সভার জন্য চেয়ার-বেঞ্চি সাজাতাম। আমাদের নেতার নামে কেউ একটা খারাপ মন্তব্য করলে মারামারি পর্যন্ত করতে এগিয়ে যেতাম। শহরের ছেলেরা এসব দেখে আমাদের নিয়ে মজা করত।

আসলে পার্টির লোকেরা যে আমার ব্রেন ওয়াশ করে রেখেছে। দেশের এখন দুরবস্থা, তাই দেশের জন্য লড়তে হবে। মনে মনে আমি প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম, আজীবন বিয়ে না করে দেশের জন্য লড়ে যাব। মাকেও তাই বললাম, পড়াশোনা শেষ না করে আমি বিয়ে করব না।

এসব ভাবনা যখন চলছিল, তার ঠিক ছমাস পরেই খবর পেলাম, এলআইসি-তে কর্মরত অবিনাশবাবুর সাথে নন্দিনীর বিয়ে হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ডামাডোলে অসহায় ভারতের চাঁদা-আদায়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম, নন্দিনীর বিয়ের খবর তখন অত্যন্ত তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। পরে শুনেছিলাম দুজনের বয়সের অনেকটাই পার্থক্য, বছর পনেরো তো হবেই।

বন্ধুরা বলেছিল বিয়ের দিন নন্দিনী নাকি খুব কান্নাকাটি করেছিল। বারবার বলছিল রাজা আমাকে ভীষণ ঠকাল। সেই ছোটোবেলা থেকে ওকে আমি ভালোবাসি। সে কথা শুনে আমার চোখের কোণাটা একটু ভিজেছিল ঠিকই আর ঠিক সেই সময়ে রবিঠাকুরের কবিতাটা কোথা থেকে যেন উড়ে এসে আমার দিকে বুকের মধ্যে তার তির নিক্ষেপ করে বলতে চাইল, যে আছে অপেক্ষা করে তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।

ম্যানেজমেন্ট পড়া সবে শুরু করেছি এমন সময় দাদা বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। সংসারে আমি আর মা। কলেজ থেকে ফিরে রাত্রে দুটো টিউশানি ধরলাম। এর ফাঁকে চাকরির সন্ধানও চলতে লাগল। ম্যানেজমেন্ট পড়ার পাঠ অনেক লড়াই ও কষ্টে শেষ হল। রেজাল্ট ভালোই করলাম। অনেক ইন্টারভিউ দেওয়ার পর একটা বিদেশি কোম্পানিতে ট্রেনিং অফিসার-এর কাজ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম মাঠে-ঘাটে পার্টির জন্য লেকচার দেওয়াটা এখন বেশ কাজে লাগবে। কাজও যেমন শেখাতে পারব, উপদেশ আর উৎসাহ দিয়ে এক একটা ছাত্রকে আগামী ভারতবর্ষের সৈনিক করে গড়ে তুলতে পারব।

ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। দেখলাম আগামী ভারতবর্ষের চেয়ে প্রোজেক্ট-এর কাজের ধারণা ও প্রোগ্রেস নিয়ে তাদের তাড়া বেশি। প্রোজেক্ট-এর সিলেবাসের বাইরে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে ম্যানেজারবাবু রাগ করেন। ধীরে ধীরে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হতে লাগল।

আমাদের বেশির ভাগ লোকেদেরই বোকা বুদ্ধি বেশি, আর কাজের বুদ্ধি কম। তাছাড়া বেশির ভাগই প্রতিভাহীন। ঘরে বসে নানান কল্পনা করতেই ব্যস্ত। কার্যক্ষেত্রে নেমে ঘাড়ে লাঙল নিয়ে পশ্চাত্দেশে ল্যাজমলা খেয়ে নতশিরে সহিষ্ণু ভাবে প্রত্যেকদিন মাটি-ভাঙার কাজ করে, সন্ধ্যাবেলায় একপেট জাবনা খেতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকে। লম্ফেঝম্ফে আর উৎসাহ থাকে না।

যাই হোক প্রোজেক্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ট্রান্সফার হয়ে গেলাম ভুবনেশ্বর। যে-গ্রামের মধ্যে আমাদের প্রোজেক্ট শুরু হবে তার প্রায় কাছাকাছিই সমুদ্র। ওখানেই একটা গ্রামে মেস ভাড়া করে থাকলাম। চারিদিকে সুপুরি, নারকেল এবং মাদারের গাছ। মেস-বাড়িটার প্রায় গায়ে দুটো প্রকাণ্ড বৃদ্ধ নিমগাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হয়ে ছায়া দান করছে।

অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি। আসলে আমি নিজেই সেই কথাটাকে বেশি প্রাধান্য দিতে রাজি ছিলাম না। সেই যে অবিনাশবাবু, এলআইসি-তে চাকরি করেন, যার সঙ্গে আমার ছোটোবেলার বান্ধবী নন্দিনীর বিয়ে হয়েছিল তিনিও এই সুদূরে ভুবনেশ্বরে আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকেন।

অবিনাশবাবুর সঙ্গে দেখা হল, আলাপ হল। আসলে আমরা দুই বাঙালি কলকাতা থেকে এসেছি। আশেপাশের বাড়িতে উড়িষ্যাবাসীরাই বেশি থাকেন। ভাষার অজ্ঞানতায় তাই কথা বলতে একটু অসুবিধা হয়। নন্দিনীর সাথে ছোটোবেলায় আমার যে জানাশোনা ছিল সেটা অবিনাশবাবু জানতেন কি না জানি না, তবে আমিও নতুন পরিচয়ে সে সম্বন্ধে কোনও কথা বলা উচিত হবে বলে মনে করলাম না। এবং নন্দিনী যে কোনওদিন আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল, সে কথাগুলোও আমি ভাবতে চাইছিলাম না। যাই হোক উনি সস্ত্রীক এখানে আছেন আমাকে বললেন, নিমন্ত্রণও জানালেন ওনার বাড়িতে যাওয়ার জন্য।

এক রবিবার প্রোজেক্টে না গিয়ে অবিনাশবাবুর বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। অনেকরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হল। আলোচনার ইতি টানা হল বর্তমান ভারতবর্ষের দুরবস্থা প্রসঙ্গে। তিনি যে সেজন্য বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মান সেটা কিন্তু নয়। কিন্তু বিষয়টা এমন যে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এ সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক অনর্গল শখের দুঃখ করা যেতেই পারে।

আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে শুনতে পাই পাশের ঘরে অত্যন্ত হালকা বাসন পড়ার আওয়াজ, দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ, আর হাওয়াই চটির খসখস। বুঝতে দেরি হল না, জানলার ফাঁক দিয়ে কোনও কৌতূহলী চোখ আমার দিকে ইশারা করছে।

সেই মুহুর্তে চোখে চোখ পড়তেই আমার মনে পড়ে গেল সেই সরলতা, সেই নিবেদিত প্রাণ এবং শৈশবের প্রেমের ঢলঢল দুটো বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থিরস্নিগ্ধ দৃষ্টি। হঠাৎ আমার হৃদপিণ্ডটাকে কে যেন তার ডান হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল আর অব্যক্ত বেদনায় বুকের ভিতরটা টন টন করে উঠল।

সেই বুকের ব্যথা সঙ্গে নিয়ে অবশেষে মেসে ফিরলাম। রাত্রে যখন লিখতে বসি কিংবা কোনও ম্যাগাজিন পড়তে বসি সেই চিন চিন ব্যথাটা শরীরটাকে কেমন যেন অবসন্ন করে রাখে। মনের মধ্যে একটা ভারী বোঝার সঙ্গে শিরা-উপশিরার রক্তগুলো দ্রুতলয়ে ছুটতে থাকে। গভীর রাতে একটু স্থির হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম এমনটা কেন হল? বিবেক যেন জিজ্ঞেস করল, তোমার নন্দিনী কোথায় গেল?

বিবেকের প্রশ্নে আমার মনের ভেতর থেকে উত্তর এল, কই তাকে তো আমি ভালোবাসিনি। কবেই তো তাকে মন থেকে মুছে দিয়েছি। সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে কেন? বিবেক আবার প্রত্যুত্তরে বলল, নন্দিনীকে তুমি ইচ্ছা করলেই পেতে পারতে। আজ শত চেষ্টা করলেও, মাথা খুঁড়ে মরলেও তাকে আর দেখতে পাবে না।

সেই ছোটোবেলার নন্দিনী যতই তোমার চারপাশে ঘুরে বেড়াক, আজ হয়তো তুমি দূর থেকে তার পায়ের নুপূরের ধ্বনি শুনতে পাবে, দূর থেকে তার শরীর থেকে মিষ্টি সুগন্ধ অনুভব করতে পারবে কিন্তু মাঝখানে চিনের প্রাচীরের মতো একটা দেয়াল থাকবে বরাবর।

মনের অব্যক্ত বেদনাকে চেপে রেখে বিবেককে উত্তর দিলাম, তা থাক না, নন্দিনী আমার কে? প্রত্যুত্তরে বিবেক বলল, নন্দিনী আজ হয়তো তোমার কেউ নয়, কিন্তু এই নন্দিনী তোমার মনের অনেক কিছু হতে পারত।

কথাটা হয়তো সে সত্যি বলেছে। নন্দিনী আমার জীবনে, মননে অনেক কিছুই হতে পারত। আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ, আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী, আমার সমস্ত জীবনের সুখদুঃখের অংশীদার ছিল সে। আজ অনেক দূরে, কত আপন ছিল, আজ পর হয়ে গেছে, আজ তাকে দেখার অবকাশ নেই। একটু দেখার চেষ্টা করলে লোকে পরকীয়ার বদনাম দেবে। সেটা হয়তো নন্দিনীর শান্তির জীবনে অশান্তি ডেকে আনবে। আর আমিও সেটা চাই না। তার সঙ্গে কথা বলা তো দূর অস্ত, তাকে নিয়ে চিন্তা করাও পাপ। আর ওই ভদ্রলোক, কোথা থেকে যে উড়ে এসে জুড়ে বসল, শুধু কটা মন্ত্র উচ্চারণ করে নন্দিনীকে আমার কাছ থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে পালিয়ে গেল।

তবু স্বামীর সুখের সংসারে যে-নন্দিনী বিরাজ করছিল সে যে ওই মানুষটার চেয়ে বেশি করে আমার, এ কথা আমি কিছুতেই মন থেকে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। জানি এরকম চিন্তা করা নিতান্ত অন্যায় এবং সেটা আমি স্বীকার করি। তবে নিজের মনের কাছে সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তারপর থেকে আর কোনও কাজে মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না। লাঞ্চের পরে যখন সুপারভাইজাররা ট্রেনিং-এর ক্লাসে বসে সোরগোল করতে থাকত, বাইরে প্রখর রোদ ঝাঁ ঝাঁ করত, গরম বাতাস নিমগাছের ফুলের গন্ধ বহন করে আনত, তখন ইচ্ছা করত… জানি না কী ইচ্ছা করত! এই পর্যন্ত বলতে পারি, ভারতবর্ষের শিল্পের এই সমস্ত ভাবী অফিসারদের প্রযুক্তিগত উপদেশ দিয়ে এই ইট-কাঠ-বালির জীবনযাপন করতে ইচ্ছা করত না।

অফিসের ছুটি হয়ে গেলে আমার ছোট্ট ওই মেসবাড়িতে একলা থাকতে মন টিকত না, অথচ কোনও অফিসের স্টাফ দেখা করতে এলেও অসহ্য লাগত। রাত্রে যখন পাশের একটা পুকুর ধার দিয়ে হাঁটতাম, তখন সুপারি-নারকেলের হেলেদুলে ওঠা অর্থহীন মর্মরধ্বনি শুনতে শুনতে ভাবতাম, মানুষ জাতটা মাকড়সার জালের মতো ভুলগুলিকে বুনতে থাকে। আবার ঘুরে ঘুরে ফিরে এসে কবে যে তাকে শোধরাবে সে নিজেই জানে না। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতে মনে পড়ে না, তার পরে প্রয়োজনে মনের বাসনা চরিতার্থ করতে টেনশন নিয়ে মরে।

অবচেতন মনে বিবেকের খোঁচা মারা ভাষণ শুনতে পাই, তুমি নন্দিনীর স্বামী হয়ে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেশ সুখে থাকতে পারতে, আর তুমি কিনা প্রথমে হতে গেলে দেশপ্রেমী এবং শেষে ইট-বালি-চুন-সুরকি কোম্পানির ট্রেনিং অফিসার। আর, অবিনাশবাবু একজন অফিসার, আর তার কি বিশেষ করে নন্দিনীর স্বামী হবার কোনও জরুরি আবশ্যকতা ছিল? বিয়ের আগে পর্যন্ত তার কাছে নন্দিনীও যেমন, রানী লক্ষ্মীবাঈও তেমন। সে কিনা কিছু না ভেবে না চিন্তা করে বিয়ে করে বসলেন আর সরকারি কর্মচারী হয়ে হাজার হাজার টাকা কামিয়ে যাচ্ছেন। যেদিন তরকারিতে বেশি নুন পড়ে যায় সেদিন তিনি নন্দিনীকে গালিগালাজ করেন, আর যেদিন মন প্রসন্ন থাকে সেদিন নন্দিনীর জন্য উপহার কিনে আনেন। গোলগাল শরীর, সু্ট-টাই পরেন, মনের মধ্যে কোনও টেনশন নেই। যাকে পুকুরের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের তারা গুনতে গুনতে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবসর সময় কাটাতে হয় না।

যাই হোক, ভদ্রলোক অফিসের কাজে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় গেছেন। অবশ্য যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছেন। আমি হাঁটছি আর ভাবছি, এই মেসবাড়িতে আজ আমি যেরকম একা আছি নন্দিনীও সেরকম বোধহয় তার ঘরে একাই আছে।

মনে পড়ে, সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার। সকাল থেকেই আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। সকাল আটটা থেকেই টুপটুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিভির খবরে বলছে ভযংকর এক ঘুর্ণিঝড় ফণী, উড়িষ্যার উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে। আকাশের ভাবগতিক দেখে আশেপাশের সব স্কুল ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে। প্রোজেক্টের কাজও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। খণ্ড খণ্ড কালো কালো মেঘগুলো যেন আকাশের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝড় আরম্ভ হল। যত রাত বাড়ছে বৃষ্টি আর ঝড়ের বেগ ভযংকর ভাবে বাড়তে লাগল। প্রথমে পূর্ব দিক থেকে বাতাস বইছিল, ক্রমে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বইতে লাগল।

ওই দুর্যোগের রাতে ঘুমোবার চেষ্টা করা বৃথা। মনে পড়ল, এই দুর্যোগে নন্দিনীও ঘরে একলা আছে। আমাদের মেসবাড়ি তাদের একতলা ঘরের থেকে অনেক মজবুত। কতবার মনে করলাম, তাকে মেসবাড়িতে বসিয়ে রেখে আমি না হয় পুকুর পাড়ে গ্রামের কোনও চালাঘরের নীচে দাঁড়িয়ে বিধ্বংসী ঝড়ের রূপ উপভোগ করব। কিন্তু কিছুতেই মন স্থির করে উঠতে পারলাম না। অনেকটা মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আটকে গেলাম।

রাত যখন একটা-দেড়টা হবে হঠাৎ আরও প্রবল বেগে ঝড়ের সোঁ সোঁ ডাক শোনা গেল। সমুদ্র যেন উথাল পাতাল হয়ে ছুটে আসছে। ঘর থেকে ছাতা হাতে বাইরে বেরোলাম। দেখি একটা রক্তকরবী গাছ ঝড়ের দাপটে একদম শিকড় থেকে উপড়ে পড়েছে। আমার খুব পছন্দের ফুল। মনে পড়ে কতদিন নন্দিনী তার ওড়নায় বেঁধে আমার জন্য নিয়ে এসেছে। সে কথা মনে পড়তেই কটা ফুল কুড়িয়ে নিলাম। নন্দিনীর বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। পথে যে-পুকুরের পাড়, সে পর্যন্ত যেতে না যেতেই দেখি হাঁটুজল হয়ে গেছে। পুকুরের পাড়ের উপর যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন দ্বিতীয় আর একটা জলের স্রোত এসে আছড়ে পড়ল।

পুকুর পাড়ের একটা অংশ প্রায় দশ-এগারো হাত উঁচু। পাড়ের উপর আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম, বিপরীত দিক থেকে আরেকজন লোকও উঠে দাঁড়াল। লোকটা যে কে সেটা আমার সমস্ত অন্তরাত্মা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমার সমস্ত শরীর অনুভব করতে পারল। এবং সেও যে আমাকে চিনতে পারল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম রাজা, তুমিও এখানে?

সমস্ত জলমগ্ন হয়ে গেছে কেবল হাত-পাঁচ-ছয় দূরত্বে দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী এসে দাঁড়ালাম। তখন প্রলয় চলছে, আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ যেন নিভে গেছে। তখন একটা কথা বললেও বলতে পারতাম। হাতে ধরা সিক্ত রক্তকরবী ওর পায়ের কাছে পড়ে গেল কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেউ কাউকেও একটা কুশল প্রশ্নও করল না। শুধু দুজনে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে রবিঠাকুরের গান গেয়ে উঠলাম, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার।

আজ সমস্ত বিশ্বসংসার ছেড়ে নন্দিনী আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ এই বিপদের দিনে আমি ছাড়া নন্দিনীর পাশে কেউ নেই। সেই কবে শৈশবে, কোন এক জন্মান্তর, কোন এক পুরোনো রহস্য অন্ধকার থেকে ভেসে, এই সূর্য‌্য আর চন্দ্রের আলোকে আলোকিত হয়ে এই পৃথিবীর কোলে আমারই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল; আর, আজ বহুদিন পরে সেই আলোকিত পৃথিবী ছেড়ে এই ভযংকর জনশূন্য প্রলয় অন্ধকারের মধ্যে নন্দিনী একাকিনী আমারই পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। জন্মের পরে সেই ফুলের কলিকে যেমন বিধাতা আমার হাতে সমর্পণ করেছিল, আজও প্রকৃতির তাণ্ডবে জীবনমৃত্যুর মাঝখানে সেই বিকশিত পুষ্পকে আমারই কাছে এনে দাঁড় করিয়েছে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে আর একটা ঢেউ আসলেই পৃথিবীর এই সীমানা থেকে বিচ্ছেদের শেষ বৃন্তটুকু ছিঁড়ে, আবার আমরা দুজনে এক হয়ে যেতে পারি।

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সে ঢেউ যেন আর না আসে। স্বামী সংসার নিয়ে নন্দিনী যেন বাকি জীবন সুখে থাকে। ওই রাতে ফণীর তাণ্ডবে হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তবু এই মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে নন্দিনীকে ফিরে পেয়ে এক অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পেয়েছি।

রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। ঝড় থামল, জলও নেমে গেল। নন্দিনী কোনও কথা না বলে বাড়ির পথে পা বাড়াল। তার পায়ের সামনে পড়ে থাকা রক্তকরবী ফুলগুলো কি বলল জানি না, তবে আমিও কোনও কথা না বলে মেসবাড়ির দিকে রওনা হলাম। কোনওদিন কবিতা লিখিনি, কিন্তু আজ বিবেকের দংশন খেয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে কয়েকটা লাইন লিখে ফেললাম,

আজ এই প্রলয়ে দিনে,

মেঘে মেঘে গুরু গর্জনে

ধেয়ে আসে ঘুর্ণিঝড় ফণী,

তুমি এসে দাঁড়ালে নন্দিনী।

নূপুর ছিল না ওই পায়,

এভাবে কেউ অভিসারে যায়?

পায়ে পায়ে বাজে না কিঙ্কিণী,

কেন এসে দাঁড়ালে নন্দিনী?

এলে যদি কেন গেলে একা?

আর কি হবে না তবে দেখা?

শৈশবের কৈশোরের রানি

সব ভুলে গেলে নন্দিনী?

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মেসে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আমি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমীও হতে পারলাম না, ইঞ্জিনিয়ারও হতে পারলাম না, আমি সামান্য এক ইট-বালি-চুন-সুরকি কোম্পানির ট্রেনিং অফিসার। সাধারণ মেস বাড়িতে থাকি। শুধু ক্ষণিকের অবকাশে এক প্রলয়রাত্রির উদয় হয়েছিল আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে। সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে, একমাত্র সেই প্রলয়রাত্রিতে আমার তুচ্ছ জীবনে নন্দিনীকে ফিরে পাওয়াই আমার জীবনের চরম সার্থকতা।

 

জীবন-নদী

অদিতি এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। অদিতি এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে তাও অকল্পনীয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে এত রূপ রস, সব আমার জন্য!

‘আমি তোমার সাথে দেখা করব।’ অচেনা স্বর, কিন্তু আওয়াজে বোঝা যায় কিশোরী কণ্ঠ। দ্বিধাহীন ভাবে ‘তুমি’ সম্বোধনে সে কথা বলল।

‘কে কথা বলছ?’

‘নয়না।’

ভেবে পেলাম না এমন নামে আমি কাউকে চিনি কি না। গম্ভীর হয়ে তাই জবাব দিলাম, ‘আমার কোনও আগ্রহ নেই তোমার সাথে দেখা করায়।’ ওধার থেকে ধীরে জবাব এল, ‘আপনি আমায় মানে নয়নাকে চেনেন না কিন্তু আমার মাকে চেনেন।’ মেয়েটা হঠাৎ ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে উঠে এল। বোধহয় আমার বলাটা একটু বেশিই রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল।

সকালবেলা একটা উটকো ফোন। চা খাওয়া হয়নি এখনও। বাসি মুখেই এমন ঝামেলা। দিনটা কেমন যাবে কে জানে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না,’ বলেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোনও দিশা খুঁজে পেলাম না। কার মেয়ে! আমার কাছে কী চায়? ‘মেয়ে’ শব্দটাই আমার কাছে অতীত মাত্র। সেই স্মৃতি– যা আমায় রুক্ষ, একা করে দিয়েছে। জীবনবোধে বিতৃষ্ণা এলেও জীবনকে ছাড়তে পারিনি। মেয়েটা কে? অদিতির চলে যাওয়া, আমার মাথার উপর ছাদ উড়ে যাওয়ার সমান। আমি ফিরে গেলাম চল্লিশ বছর আগের স্মৃতির পাতায়।

মফসসলের ছেলে আমি। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় বাবা পাঠিয়ে দিল কলকাতায়, কাকার বাড়ি। ভর্তি হলাম আশুতোষ কলেজে। কাকার বাড়ি থেকে কলেজ হাঁটা পথ। একদিন এমনই একা একা হেঁটে ফিরছি রবীন্দ্রসরোবর লেকের ভিতর দিয়ে হঠাৎ কেউ ডাকল ‘হাই অলোক।’ তাকিয়ে দেখি আমাদেরই সাইকোলজি ক্লাসের একটি মেয়ে। অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি। বেশ ভালো লাগল কিন্তু ও আমার নাম জানল কী করে? ওই বয়েসে বেশ গর্ব-ও হল ক্লাসমেট আমার নাম জানে বলে। আমি হেসে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমার নাম অলক, অলোক নয়।’ ও পরিচয় দিল, ‘আমি অদিতি। তুমি কোথায় থাকো? আমি কি তোমার সাথে একটু হাঁটতে পারি? আমার বাড়ি কাঁকুলিয়া রোড। বাড়িতে…।’ বেশ অনেকক্ষণ একা একাই বকবক করে গেল। হঠাৎ কী মনে হতে নিজেই চুপ করে হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কই কথার জবাব দিলে না তো?’ আমি ওর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম– ‘সময় দিলে কোথায় কথা বলার?’ এইভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব। অদিতি কবে যে আমার কাছে ‘দিতি’ হয়ে গেল তা নিজেই জানি না। এই আমার দিতি। অদিতি।

সামাজিকতার ধার আমি কোনওদিন ধারিনি। নিজের ইচ্ছেতেই চলেছি।

আমি এই বয়েসে নিজের কাজকর্ম নিয়ে বেশ আনন্দে আছি। জীবনে তেমন উচ্চাশা নেই, কেউকেটা হতেও চাইনি। তাই কলেজ জীবনে যখন, কলেজের মধ্যে সবথেকে সুন্দরী, মেধাবী মেয়েটি আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ছিল, আমার সহপাঠীরা বেশ ঈর্ষান্বিতই হয়েছিল। আমার কিন্তু কোনও হেলদোল নেই, আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। অদিতিও বেশ স্বাভাবিক। আমাদের মেলামেশা দিনের আলোর মতো সহজই ছিল কিন্তু অদিতি ধীরে ধীরে সেই সীমা ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে এল। আমি বারণ করেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম ‘দিতি তোমার সমাজ আর আমার সমাজে অনেক তফাত। প্লিজ, তুমি এমন কোরো না, পরে কষ্ট পাবে।’ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। অদিতি আমার কোনও কথাই শুনল না। ও দুর্দম, আমিও ভেসে গেলাম ওর সাথে। জানতাম অদিতির জীবনে আমি প্রথম পুরুষ নয়, তবু নিজের মধ্যে একটু দোটানা থাকলেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। আমরা স্বপ্নে ভেসে গেলাম– ছোট্ট সংসার, টলোমলো পা।

সত্যি আমরা ভেসে গেলাম। যেদিন দিতি জানাল তার শরীরের নতুন অনুভবের, সেদিন আমি আনন্দের পরিবর্তে বেশ ভীত হয়ে উঠলাম। মুখে হাসলেও দিতি ঠিক বুঝতে পারল, আমি ভয় পেয়েছি। দুজনের বাড়িতে কে কী বলবে? কীভাবে সামলাব? আমার শুকনো মুখ দেখে অদিতি কি বুঝল, কে জানে! বারবার একই কথা জোরের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করতে থাকল, ‘আমাদের ভালোবাসার ফসল, নতুন মানুষ আসবেই। আমাদের উত্তাপ ওর মধ্যেই। আমি পারবই।’ আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। খটকা লাগল ওর কথায় ‘আমি পারবই,’ তবে কী ‘আমরা’ নয়? হঠাৎ অনুভব করলাম আমি ঘেমে উঠেছি। এমনই হয়েছিল যেদিন প্রথম অদিতিকে আমি চুমু খেয়েছিলাম, ফাঁকা কলেজ করিডোর-এ। ভুল বললাম, আমি নয়, ও এগিয়ে এসে সপাটে জাপটে ধরে…। আমি ছটফট করে ওকে ঠেলে দিতেই ওর বাঁধভাঙা হাসি। ভয়, ভালোলাগা মিলেমিশে… এমনটাই হয়। হয়তো বা সকলের জীবন-সন্ধিক্ষণে। সেই শুরু। এতদিন পরে অদিতির সন্তানসম্ভাবনার কথা শুনে আবার তেমন ভয় আমায় চেপে ধরল।

সময় এগিয়ে চলে। অদিতির আড়ষ্টতাহীন চলাফেরা আমায় আবার স্বাভাবিক করে তুলল। আমি প্রায় ভুলেই গেলাম ওর শরীরের নতুন অঙ্কুরোগদ্মের কথা। আমি মেতে উঠলাম ওকে নিয়ে। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, হইচই করা, ঘুরে বেড়ানো সব আগের মতোই। ধীরে ধীরে আমি ধাতস্থ হয়ে গেলাম। দুজনের আনন্দের জীবনে শুধু নিস্তরঙ্গ জোয়ারের খেলা। অদিতি কিছু বুঝতে দেয়নি।

জোয়ারের পর ভাটা অনিবার্য। তা এল, কিন্তু এমনভাবে যা আমার কল্পনার অতীত। দিতি একদিন এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘আজ আমার লাঞ্চ আছে, স্পেশাল ব্যাপার।’ আমি শান্ত চোখ তুলে তাকালাম। কোনও প্রশ্ন নেই মুখে। শুধুই তাকিয়ে থাকলাম। ও আশা করেছিল আমি কিছু জিজ্ঞাসা করব। দিতিই নীরবতা ভাঙল, ‘আমার পুরোনো প্রেমিক। লন্ডন থেকে এসেই যোগাযোগ করেছে। সোহম সেন।’ আমি জানতাম, অদিতি বলেছিল, দুম করে সোহমের লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ চান্স পেয়ে যাওয়ার কথা। অদিতির খুব মন খারাপ হয়েছিল। তবে ওর মতন হুল্লোড়বাজ মেয়ের সব কিছু ভুলে যেতে সময় লাগেনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় অদিতি খুবই ক্যাজুয়াল। জামাকাপড় বদলানোর মতো বয়ফ্রেন্ড বদল করে। ভাবতেও ভালো লাগে না এভাবে। আসলে ও তো ধনী পরিবারের দুলালি। আমারও কখনও কখনও সংশয় হয়। সত্যি ভালোবাসে তো মেয়েটা আমায়! আচ্ছা ও কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট! তাই ওর সাথে দেখা করা। আমার মনের মধ্যে যাই-ই হোক, আমি ‘না’ বলতে পারিনি ওর মুখ দেখে।

সেদিন দিতি কলেজে এলেও ক্লাস করল না, তারপর দিনও এল না। পরপর চারদিন এল না। ওর ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ সদুত্তর দিতে পারল না। যেখানে যেখানে খোঁজ নেওয়া যায় নিলাম, কিন্তু কোথাও দিতির খোঁজ পেলাম না। হতাশা কেমন যেন আমায় গ্রাস করে নিল। আমি কলেজে আসতাম, শুধু আমার শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে। মনটা সারাক্ষণ অদিতি-অদিতি করে ওকেই খুঁজে চলত।

গাছতলায় মাথা হেঁট করে বসে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছি, মাটি খুঁটছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম সামনে একটা ছায়া। মুখ তুলে দেখি অদিতি। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে, ঝলমল করছে ও। আমি বুঝলাম না, কারণটা কী? আমি রাগে-দুঃখে ওকে দেখে চিৎকার করে উঠলাম ‘কী ব্যাপার তোমার? তুমি বোঝো না, তোমার সাথে একদিন দেখা না হলে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাই। কোথায় ছিলে? এত দায়িত্বজ্ঞানের অভাব কেন?’ অন্য সময় আমি চিৎকার করলেই দিতিও সমানতালে ঝগড়া করত। সব সময় আমিই পরাজিত হতাম এবং হেসে সারেন্ডার করতাম। আজ এ কোন দিতি, আমার সামনে? আমি চিৎকার করছি, ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকল। আমি হতভম্ব। দিতি চুপ করেই থাকল, তারপর যেন বহু কষ্টে নীরবতা ভেঙে অস্ফূটে বলল, ‘সরি অলক, এই ক’দিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে আমার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। আমার মতামত নিয়ে, সোহমের সাথে।’ অর্থাৎ অদিতির প্রাক্তন প্রেমিক, লন্ডন ফেরত, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় পূর্ণ সেই সোহম সেনই দিতির মনোনীত পাত্র। দিতির কথা শুনে আমি প্রায় হিংস্র বাঘের মতন হয়ে উঠেছিলাম। আমি হিস হিস করে বলে উঠলাম, ‘অসম্ভব, আমার দিতি অন্যের হতে পারে না। আমি তোমার বাড়িতে যাব, মা-বাবার সাথে কথা বলব, তুমি এভাবে আমায় ছেড়ে…।’

‘চুপ অলক’, আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দিতির শানিত স্বর আমায় থামিয়ে দিল। ‘কত উপার্জন তোমার? তোমার স্ট্যাটাস কী? কী খাওয়াবে? সবার আগে বলো, আজ বিয়ে করলে কোথায় রাখবে আমায়?’ আমি ঝড়ে ধাক্বা খাওয়া পাখির মতন যেন কিছুটা টাল খেয়ে গেলাম ওর কথায়, একটু সামলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। সত্যিই তো, অদিতির কথাগুলো বাস্তব-যুক্তিপূর্ণ। আমার কী আছে?

অদিতি সত্যিই চলে গেল আমায় ছেড়ে। আমার অনেক কিছু বলার ছিল, করার ছিল। কিন্তু আমি পারলাম না। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম শামুকের মতন। দিতির শেষ কথাগুলো ‘তোমার স্ট্যাটাস কী? কোথায় রাখবে?…’ আমায় যেন এক নতুন আমি-তে রূপান্তরিত করল। আমি নিজেকে নিয়ে একটা ব্যূহ রচনা করে ফেললাম। নিজেরই অজান্তে। দিতি-সোহম, চলে গেল গোয়ায়। ও বিয়েতে নিমন্ত্রণও করে গিয়েছিল। কলেজ সহপাঠীরা জোরজবরদস্তি করে আমায় নিয়ে গিয়েছিল। ওরা সব কিছু জানত, তবুও। পরে শুনেছি অদিতি ওদের বারবার বলেছিল আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের বাড়ি গিয়েও আমি অদিতির সামনে দাঁড়াতে চাইনি। ঢুকেই কোল্ড-ড্রিংকস নিয়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম। অদিতি খুঁজে পেতে ঠিক আমার সামনে হাজির। অদিতি– না স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরি! আমার চোখের পলক পড়ে না। আমি মূর্তির মতো নিথর। নিজের না পাওয়া আকাঙ্খাগুলো, ক্ষোভ-যন্ত্রণা আবার যেন সামনে এসে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। অদিতি আমার। কেন অন্যের বিছানায় ও শোবে! কেন? কেন? একটা কথাও অদিতিকে বলতে পারলাম না। অথবা ওই অবস্থাতেও সে আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘অলক আমি তোমারই থাকব।’

মেয়েদের প্রতি আমার এক অদ্ভুত বিতৃষ্ণা সেই থেকে। আমি নিজের লেখাপড়ার মধ্যেই পুরোপুরি ডুবে গেলাম। নিজের শরীর, খাওয়াদাওয়া, কোনও দিকে দৃষ্টি নেই। বাবা-মা এসেছিলেন, আমায় বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আমি নারাজ। এভাবে মাস গড়াল, ফুরোল বছর।

স্মৃতির জালে যেন খাবি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় কলিংবেল শুনে আমার চমক ভাঙল। আমি স্খলিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার বেল, ভাবার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে? মাথা কাজ করল না। প্রায় অবশ হাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। এ কে! প্রায় কুড়ি বছর আগের দিতি এতটুকুও বদলায়নি! এ কী করে সম্ভব! আমি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়েই রইলাম। দিতি না, দিতির প্রতিচ্ছবি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমারই ঘরে বিনা অনুমতিতে গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। বিছানায় ছড়ানো আমার পুজো সংখ্যার উপন্যাসের খসড়া। দিতি নয়, নয়না মেয়েটি আমার কোনও পরোয়া না করেই ঘরের মধ্যে এটা ওটা ঘুরে দেখতে শুরু করল। বইয়ের তাক, টেবিলে ছড়ানো বই, ঢাকনা না লাগানো পেন, পেনসিল, ফাইল-ক্লিপ সব এলোমেলো। ও শুধু দেখেই গেল। যেমন দিতিকে আমি কখনও বারণ করতে পারতাম না, নয়নাকেও আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার চোখজোড়া ওকে অনুসরণ করে গেল। একসময় ও থামল, আবার চেয়ারে এসে বসল, ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি।’ প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন এসেছ?’ নয়না তক্ষুণি কোনও প্রত্যুত্তর করল না। কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘আমি জানি, আপনি আর মা মেড ফর ইচ আদার ছিলেন। সমাজ, পরিবার আপনাদের এক হতে দেয়নি। আমার মা পারেনি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে। তাই আপনাদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন নিয়ে সে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যে-বীজ বপন হয়েছিল তার শরীরে, তাকে সে বিনষ্ট হতে দেয়নি। ডালপালা মেলে তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করেছে। সোহম সেন সামাজিক দায়িত্ববোধে অবশ্যই আমার বাবা। কিন্তু আমার মা, মানে আপনার অদিতি, দিতি আমায় সব বলেছে অকপটে। আমার স্কুল-গণ্ডি পার হয়ে যাবার পরেই। আমি দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম, কবে আপনার সাথে দেখা হবে।’

আমি স্থবির, নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। একি শুনছি। দিতি এখানেও তুমি আমায় হারিয়ে দিলে! তোমার প্রতি আমার যে ধারণা তা চুরচুর করে ভেঙে তুমি সোহমের সঙ্গে চলে গিয়েছিলে। সেটা যে তোমার অভিনয় ছিল তা বিন্দুমাত্র আমাকে বুঝতে দাওনি। আমার ভালোবাসাকে তুমি অপমানিত হতে দাওনি, দিতি। মেয়েদের প্রতি আমার যত বিষ সব আমি উগরে দিয়েছি, ঘৃণা, জ্বালা সব মিলিয়ে মেয়েরা যে বিশ্বাসঘাতকতার নজির তৈরি করেছিল আমার জীবনে, তা একমুহূর্তের জন্য ভুলিনি। আজ নয়না আমায় সম্পূর্ণরূপে এলোমেলো করে দিল। দিতি আমায় তুমি ক্ষমা করো। নিজেকে অবহেলা অযত্নে শেষ করে দিয়েছি। তুমি চলে যাওয়ার পর নেশা ধরলাম। কিছুদিন বাদে বুঝলাম আমি নেশা না করতে চাইলেও মদ আমার পিছু ছাড়ে না। আমার শরীর পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এই মধ্যচল্লিশে আমায় দেখতে লাগে ষাট বছরের বুড়োর মতো। আজ আমার সামনে আমার আত্মজ– নয়না। আমি কি স্বপ্ন দেখছি!

মা জানত, বাড়িতে জানাজানি হলে দাদু আপনাকে খুন করিয়ে দিতেও দ্বিধা করবেন না। আপনিও জানেন আমার মামার বাড়ির অর্থনৈতিক ক্ষমতা-প্রতিপত্তির কথা। তাই মা নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল। মায়ের জেদ ছিল আমায় পৃথিবীতে আনার। সোহম সেনের প্রতি তার কর্তব্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। শুধু এতগুলো বছর মা অপেক্ষায় ছিল, আপনাকে দেখানোর জন্য মা ও আপনার ভালোবাসায় ফাঁকি ছিল না।’

এ কোনও স্বপ্ন নয়, বড়ো নির্দয় কঠিন বাস্তব, নয়না, নয়নমণি।

 

শহরবাসের কথকতা পর্ব-০১

( ১ )

আজও পাদ্রিপাড়ার গলি দিয়ে যাওয়া হল না।

ব্যাংক থেকে বেরিয়ে টোটোকে বললাম, লালবাগান। ভেতরে ঢুকতে হবে না, মুখেই নেমে যাব।

টোটো টুনু ঘোষ সরণি দিয়ে চলতে শুরু করল।

আসলে যাওয়া হল না নয়, আমিই তাকে বললাম না। ওই পথে যাওয়া হয়নি কত দিন! প্রায় ষোলো কি আঠেরো বছর। সেই যে ছিয়ানব্বইয়ে মাধ্যমিক দিলাম তারপরই যেন লায়েক হয়ে গেলাম। তখনই সাইকেল কেনা হল, অ্যাটলাস। আমার মানে সব বন্ধুদের পথ গেল বদলে। আমরা আর খানাখন্দ গর্তে ভরা এঁকাবেঁকা সরু পথে হাঁটতেই ভুলে গেলাম।

মাধ্যমিক পাশের পর আমাদের শার্টের রং গেল পালটে। প্যান্টের ডিজাইনও। সাইকেল চালাতে চালাতে উড়ি রং-বেরঙের প্রজাপতির সামনে পাশে কিংবা পেছনে। তারপর সেই রঙিন বিকেল মিলিয়ে যাওয়ার সময়ই রঙিন প্রজাপতি এক একটা গলির মুখে এসে মিলিয়ে যায়।

আমরা আবার আপন পথেই ফিরে আসি বাড়িতে।

সেই সমরকাকুর সাম্রাজ্য। বিশাল মাঠ। বাগান। মন্দির। তিনটে বিরাট বিরাট পুকুর। লোকে টিকিট কেটে মাছ ধরত বাগানের পুকুরে। জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। অজস্র ঘর। অনেক ঘরে আমরা ঢুকিইনি।

সমরকাকুর দুই মেয়ে সুমিতা আর অমিতা আমাদের সঙ্গেই প্রাইমারিতে পড়ত। ওদের বাড়ির অনুষ্ঠানে আমাদের নিমন্ত্রণ থাকত। বাসব, জয়ন্ত, ডলি, রাইমা, আমি সবাই যেতাম বিকেলবেলায়। বাড়ির উঠোনে ব্যাডমিন্টন, গোল্লাছুট কিংবা চোর-পুলিশ খেলতাম।

সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে দেখতাম পাঁচিলের ধারে কত হলুদ কলকে ফুল ফুটেছে। আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যেত জেট প্লেন। বিস্ময়ে দেখতাম সরু ধোঁয়ার রেখা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। ডলিও বুকে হাত রেখে আমার পাশে শুয়ে বলত দেখেছিস, কী সুন্দর চাঁপাফুল ফুটেছে? দাঁড়া কুড়িয়ে আনি।

ফ্রকের কোঁচড়ে করে আট-দশটা কাঠচাঁপা এনে হাঁটু মুড়ে পাশে বসে আমার নাকের সামনে ঘোরাত। রাইমা, সঞ্জনা, বাসব সবাই ছুটে আসত। ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমি অবাক হয়ে দেখতাম কেমন নিঃশব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে জেট প্লেনের ধোঁয়াটা।

আবার খেলা শুরু করতাম। সুমিতা ঘর থেকে একটা ক্যাম্বিস বল আনত। বিস্কুটের মতো সাতটা টালির টুকরো ওপর ওপর সাজিয়ে পিট্টু খেলতাম।

আমাদের তখন ক্লাস থ্রি। বিকেল ফুরিয়ে আসার আগেই বাড়ি ফিরে আসতে হয়। সুমিতাদের বাড়ির সামনে একটা লম্বা ঝিল। ঝিলের শেষে কেউ হেঁটে গেলে মনে হতো লিলিপুট। ঝিলের পাড়ে ধোপাদের জলের মধ্যে খুঁটি পুঁতে কাঠ লাগিয়ে কাপড় ধোলাইয়ে পাঠাতন করা। বাড়ি ফেরার সময় আমরা সবাই এক একটা পাঠাতনে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতাম।

নারকেল গাছ তাল গাছের মাথার উপর কমলা রঙা কত্ত বড়ো সূর্যটা, ছোটো হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। পুকুরে কমলা আভা। জলফড়িং ছোঁ মেরে যায়। কমলা রং গোল হয়ে ছড়াতে ছড়াতে আমাদের সামনে চলে আসে। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠি।

রাইমা বলে এবার চল। মা বকবে।

জয়ন্ত বলে একটু দাঁড়া না। সূর্যটা একেবারে ডুবে যাক।

ডলি বলল তোরা থাক। আমরা চললাম।

আমরা সবাই পথে পড়ে থাকা একটা মাঝারি সাইজের ইটকে ফুটবলের মতো মারতে মারতে বাড়ি ফিরি।

একদিন ইটটা রাইমার গোড়ালিতে গিয়ে লাগল। রাইমা কেঁদে উঠে বলল, কাল থেকে তোদের সঙ্গে আর খেলব না।

সত্যিই রাইমা দুদিন এল না। স্কুলেও যায়নি। পরের দিন খেলতে গিয়ে দেখি রাইমা আসেনি। আমাদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই গেলাম ওদের বাড়ি।

রাইমার জ্বর। কাঁথা চাপা দিয়ে শুয়েছিল। খুব খুশি হল ওকে দেখতে গেছি বলে। বলল তোরাই শুধু আমাকে দেখতে এলি। মামা, জেঠিমারা কেউ আসেনি।

সঞ্জনা, অমিতা, সুমিতা, ডলি, অঞ্জলি করে চাঁপা আর কলকে ফুল নিয়ে গেছিল ওর জন্য। সব বাটির জলে ভাসিয়ে টেবিলে রাখল।

বাসব ওর পায়ে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল তোর সেদিন খুব লেগেছিল? ব্যথা?

বিনুনি দুলিয়ে রাইমা বলল, একটুও না। আমি তোদের সঙ্গে মজা করেছিলাম।

হাসতে হাসতে মজায় মজায় ঘরের মধ্যে বিকেল ফুরিয়ে এল। জানলা দিয়ে কমলা রঙের আকাশ দেখা যাচ্ছে। আমরা বেরিয়ে এলাম জয়নগরের মোয়া খেতে খেতে।

হাঁটতে লাগলাম পুটুসফুল, আকন্দফুল, শ্যাওড়ার ঝোপের পাশ দিয়ে গাছের ডালে ডালে পাখির কলরব। সূর্যের সামনে দিয়ে উড়ে যায় কাক।

হঠাৎই অমিতা বলল সন্ধে হয়ে গেছে। এবার ভাঙা মন্দিরের বনে শিয়াল ডেকে উঠবে। ভয়ে আমরা দৌড়োতে শুরু করলাম।

এসবই অমিতাদের, সমরকাকুদের… সবই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। এই মন্দির

যে-কত বছরের আমরা জানি না। এখানে খেলি, ঘুরে বেড়াই শুনে ঠাম্মা বলেছিল ওখানে মামদো ভত থাকে। মন্দিরের পাশের পুকুরে চান করতে নেমে কত মানুষ ডুবে গেছে তার হিসেব নেই।

ভাঙা পরিত্যক্ত সুড়কি ঝরা মন্দির বনের মাঝে। মন্দিরের চূড়ার গায়ে বড়ো হয়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থ গাছ। সমরকাকু বলেছিলেন, ভেতরে তক্ষক আছে। ডাকে মাঝে মাঝে। মন্দিরের চারপাশে জমিতে মাঝেমাঝে গর্ত মতো হয়ে আছে। ওখানে নাকি ত্রিশূল পোঁতা থাকত।

এই পথে সুমিতারা আসতে চায় না। সত্তর দশকের উত্তরের নকশাল আন্দোলনের হাওয়া আছড়ে পড়েছিল এই অঞ্চলেও। অমিতা এক বৃষ্টির বিকেলে বলেছিল, পুলিশ গভীর রাত্রে নকশালিস্টদের ভ্যানে করে এনে পেছন থেকে গুলি করে মেরেই জঙ্গলে ফেলে দিত। ওর মেজকাকাকে তাই করেছিল। পরের দিন কাকার দেহটা পাওয়া যায়।

সুমিতাদের সদর দরজার সামনে এসে আমাদের দৌড় থামল।

সমরকাকুর গলির একটা সরকারি নাম আছে। বিপ্লবী উপেন ব্যানার্জি লেন।

এই নাম কেউ জানে না। এখানে পড়ে আছে আমার শৈশবকাল, কৈশোরবেলা। প্রথম চুম্বনের আবেশ। প্রথম যৌবনের সাম্রাজ্য।

সকলেই বলে এ অঞ্চলটা পালটে গেছে। পিচের রাস্তা হয়েছে। ফুটবল খেলার মাঠে ফ্ল্যাট উঠছে। মন্দিরটা মাটিতে মিশে যাচ্ছে যেন।

ভয় করে শুনতে আমার। ছেলেবেলাকে ভুলতে ইচ্ছা করে না। বন্ধুরা সবাই হারিয়ে গেছি। ছেলেবেলার স্বপ্নের গল্পগুলো ভুলে গেছি। ভুলে যাচ্ছি সত্তরের দশকে সেজমামার উধাও হয়ে যাওয়া কিংবা খুন হওয়া।

মা-মাসিরা আজও বলে দেখিস, সেজদা একদিন ফিরে আসবে।

দিদাও সে কথা বলতে বলতে একদিন ঘুমের মধ্যে মারা গেছে।

সমরকাকুর মাঠ আমায় ডাকে। ঘুমের মধ্যে ডাকে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে পলিত কেশ সমরকাকু আমায় ডাকে আয়… আয়…

আমি বলি যাব, নিশ্চয়ই যাব…। ক্লাস ফাইভে উঠতেই সব কিছু কেমন হয়ে গেল। মেয়েরা চলে গেল ঊষাঙ্গিনী অথবা শিক্ষামন্দিরের মতো স্কুলে। ছেলেরা গেলাম কানাইলাল, অরবিন্দ কিংবা রক্ষিতে। আমার সঙ্গে জয়ন্ত আর বাসব এল কানাইলালে।

( ২ )

জীবনের শোক-তাপ বোঝার বয়স তখন আমাদের কারওরই হয়নি। আমারই হল। জানুয়ারির মাঝামাঝি রাত সাড়ে দশটা। মা আমাকে খাইয়ে মশারিতে ঢুকিয়ে লেপচাপা দিয়ে বলল, ঘুমোও। বাবা ফিরলে শোওয়ার সময় একবার হিসি করে নেবে। তখনই সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল। এই শব্দ বাবার নয়। বাবা আস্তে আস্তে দুবার নাড়ে। মায়ের পেছন পেছন আমিও গেলাম। স্ট্রিট ল্যাম্পের স্বল্প আলোয় কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। সোমনাথকাকুর গলাটা শুধু চিনতে পারলাম। তারপর ভড়জেঠু, প্রদু্যত্কাকু, অসীমজেঠু সবাইকে চিনতে পারলাম। সোমনাথকাকু বললেন, বউদি, আপনারা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন। ঠান্ডায়, উত্কন্ঠায় জড়ানো গলায় মা বলল, কেন?

সবাই চুপ।

মা যেন এবার সাহস পেয়েছে। চাদরটা মাথায় তুলে বলল কেন বলুন? কী হয়েছে? কোথায় যাব?

কেউ কোনও কথা বলছে না। হয়তো কীভাবে বলবে ভাবছে। কিছুক্ষণ পর ভড়জেঠু বললেন, একটু হাসপাতালে যেতে হবে। আমরা রিকশা নিয়ে এসেছি। মা চাদরটা মুখে চেপে দরজাটা ধরে বলল হে ঠাকুর! এ আমার কী হল?

আমার তখন নতুন ক্লাসের সব বই কেনা হয়নি। মাত্র পাঁচটা হয়েছে। বাবা ব্রাউন পেপারে খুব সুন্দর করে মলাট দিয়ে বলল শনিবার মাইনে পাব; বাকি বই কিনে দেব।

কারখানায় কাজ। তাই বাবাদের সপ্তাহে সপ্তাহে মাইনে হয়। আমি নতুন বইয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বললাম বাবা, সামনের মাসের এক তারিখ থেকে ড্রেস পরে যেতে হবে। না হলে ক্লাসে ঢুকতে দেবে না।

বাবা বলল ঠিক আছে। পরের সপ্তায় ড্রেস হয়ে যাবে। আমরা যখন সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন বাবার পাশে অরুণজেঠু আর কার্তিকজেঠু দাঁড়িয়ে বাবার শরীরটা সাদা চাদরে মোড়া। আমাদের সঙ্গে পাড়ার জ্যোত্স্না কাকিমা এসেছিলেন। মহিলাসমিতি করেন। দারুণ সাহসী। আমার মনে হল কাকিমা বাবার মাথায় হাত দিলেই বাবা বেঁচে যাবে। আফটারনুন ডিউটি করে বাবা ফিরছিল। সঙ্গে ওঁরাও। বাবা লরি চাপা পড়েছিল।

এদিকে বিকেলে খেলতে যাচ্ছি না বলে বন্ধুরা সবাই চারদিন পর এল। ছোটোকাপড় পরা অবস্থায় আমায় দেখে ওরা চমকে উঠল।

মৃত্যু কী! অকাল মৃত্যু কেমন! শৈশবে পিতৃহীন হওয়া কী! এসব বোধই আমার তৈরি হয়নি। বললাম, জানিস আমার বাবা মারা গেছে।

অমিতা, ডলি আমার দুহাত ধরে কেঁদে উঠল। মৃত্যুকান্না কী তা ওদের কান্নায় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ওই শীতের ভোরে গঙ্গার হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে বাবার শেষকৃত্য করেছি। তখনও বুঝিনি পিতৃহীনতা কী।

আমার দুচোখ বেয়ে জল এল। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম আমার পাঁচটা মাত্র বই কেনা হয়েছে। বাকিগুলো বাবা রবিবার কিনে দেবে বলেছিল। আর ড্রেসটা সামনের হপ্তায়।

সঞ্জনা আমাকে মেঝেতে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বেশ গিন্নির মতো বলল কাঁদিস না পিকুন, কাঁদিস না। বুঝলাম আমরা বড়ো হচ্ছি।

ওরা চলে গেল। ঠাম্মা আমাকে খই-মুড়কি খেতে দিল। মা শুয়েছিল। মা খুব ভেঙে পড়েছে। মায়ের ঘরে অনেক লোকজন। ছোটোমামা-মাইমা, মাসি, পাড়ার লোক।

ঠাম্মা খুব শক্ত। বাবাকে যখন বাড়িতে আনা হয়েছিল তখনই বাবার বুকে পড়ে কেঁদেছিল। আর কোনওদিন একটুও চোখের জল দেখা যায়নি। ষাট-বাষট্টি বছর বয়স। সব দায়িত্ব যেন মাথায় তুলে নিয়েছে। একটু পরেই ডাক্তারজেঠু আসলেন মাকে দেখতে। ঠাম্মা আর একটা চেয়ার দিল মায়ের ঘরে।

বারান্দায় আমার পড়ার কাঠের চেয়ারে বসে খই-মুড়কি খাচ্ছিলাম। মায়ের ঘরে যেতে যেতে আমার কুশনটা হাতে করে নিয়ে এসে ঠাম্মা বলল, এটা কোমরে ঝুলিয়ে রাখ। এখানে ওখানে পড়ে থাকছে। আমার কোমরে গুঁজে দিয়ে বলল একটা সন্দেশ দিচ্ছি, খা। আবার সন্দেশ আনতে ছুটল।

দাদুকে আমি দেখিনি। আমার জন্মের বছর চারেক আগে মারা গেছেন। বারান্দার লম্বা দেয়ালে দাদুর সাদাকালো একটা পেল্লাই সাইজের ছবি ঝোলে। দাদু উকিল ছিলেন। দারুণ পসার ছিল। সেই টাকাতেই আমাদের বাড়ি, এতখানি জমি বাড়ির সামনে। দাদুর নাকি খুব ফুলগাছের শখ ছিল। আমি বাবাকে দেখেছি শীতকালে হরেকরকম ফুলের গাছ লাগাতে। অন্য সময়ে ফুল ফুটত বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ নানান ফুল।

সন্দেশ খেতে মোটেই ভালো লাগে না। একটুখানি খেয়ে বাকিটা জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে ভাবছিলাম আমার বাকি বই ড্রেসের কী হবে। স্কুলে কি আর যাওয়া হবে?

সব হল আমার। ঠাম্মা টাকা দিয়েছিল। ছোটোমামার সঙ্গে গিয়ে বই, ড্রেস কেনা হল। কিন্তু সমস্যা এল অন্য জায়গায়।

স্কুলে যেতেই দুতিনদিন পর থেকে ছেলেরা আমার ন্যাড়া মাথায় তবলা বাজাতে শুরু করল। স্যার পেছন ফিরে বোর্ডে যখন কিছু লেখেন, তখন কেউ না কেউ আমার মাথায় তবলা বাজিয়ে দেয়। স্যারকে বলতেই স্যার ওদের বকেন। অবশ্য তার কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে গেল। মশারির মধ্যে ঢুকতে বেরোতে বারবার মাথায় মশারি আটকে যায়। চান করার সময় মা ভালো করে মাথায় নারকেল তেল মাখিয়ে দিয়ে বলল দেখবি, এবার ভালো ঘন চুল গজাবে।

আবার আমি খেলতে যাই। ঠাম্মা বারবার বলে দিয়েছে সন্ধের আগেই যেন ফিরি। এক বছর অপদেবতারা আমাকে ভয় দেখাবে। তাই ফিরি। তবুও মাঝে মাঝে আমার শরীর খারাপ হয়। ঠাম্মা নিয়াজি পিরমন্দিরে গিয়ে আমার নামে জলপড়া নিয়ে আসে। খাইয়ে দেয়। বাড়ির চারপাশে সেই জল ছেটায়। আবার আমি ভালো হয়ে উঠি। স্কুলে যাই। খেলতে যাই।

এক রবিবার সকাল দশটার সময় বাসবের বাড়ি গেলাম। ও নেই। সরস্বতীদি হাতে ঘড়ি পরতে পরতে নীচে নেমে এসে বলল, ও মামার বাড়ি গেছে।

ফিরে আসছিলাম, সরস্বতীদি ডাকল শোন, যাবি আমার সঙ্গে এক জায়গায়?

বাসবরা পাঁচ ভাই-বোন। ও-ই ছোটো। ওর বড়ো সরস্বতীদি। অন্য দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। বড়দা দুর্গাপুরে থাকে। সরস্বতীদি কলেজে পড়ে। খুব সুন্দর দেখতে। লম্বা, ফরসা কী সুন্দর চেহারা। ঠিক সরস্বতী ঠাকুরের মতো। তবে কাঁধ পর্যন্ত চুল।

জিজ্ঞেস করি, কোথায়?

সরস্বতীদি সিঁড়ির নীচে নেমে এসে আমার ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল  ঠাকুমার কাছে যাব। যাবি?

বাসবের ঠাকুমা আসলে ওর বাবার মামা। হিজড়ে। সবাই ভাই ঠাকুমা বলে। বাসবের বাবার স্টেনলেস স্টিল বাসনের দোকান। এভাবেই চলে। এই বাড়িটাও নিতাই ঠাকুমার। সবাই বলে নিতাই হিজড়ে। হিজড়েদের নেত্রী উনি।

বললাম যাব।

সরস্বতীদি হেসে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরল। মাথাটা বুকের ঠিক কাছে যাচ্ছিল না, তবুও আমার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল ভেরি গুড।

আমার সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। জীবনের পরিবর্তন আস্তে আস্তে বুঝতে শিখছি।

মা, আসছি। আমার হাত ধরে সরস্বতীদি বেরিয়ে পড়ল।

কী রকম ওর হাত! গা থেকে কী সুন্দর গন্ধ! আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি।

একটু হাঁটতেই রিকশা পেয়ে গেলাম।

( ৩ )

রিকশা আপনমনেই যাচ্ছিল। সরস্বতীদি আমার হাতটা তুলে নিয়ে চটকাতে চটকাতে বলল কী নরম তোর হাতটা। স্কিনটাও সুন্দর। তেলতেলে।

শিহরণটা কেটে গেছে আমার। এখন এক অন্য অনুভতি। ঠিক যেন ভেসে যাওয়া। নিতাই ঠাকুমার বাড়ির সামনে রিকশা থামল। ভাড়া মিটিয়ে সরস্বতীদি ডাকল। লাফিয়ে নামলাম। আমাকে কোমরের সঙ্গে প্রায় জড়িয়ে সরস্বতীদি ভেতরে ঢুকল।

কলতলায় চিত্কার চ্যাঁচামেচি চলছিল। কাপড় কাচা, গায়ে সাবান মাখা জল ভরা সবই চলছিল। আর অদ্ভুত লাগছে এতগুলো মহিলার পুরুষোচিত কন্ঠস্বর। সব থেমে গেছে মুহূর্তে। কতগুলো সম্মিলিত শব্দ ভেসে এল ওম্মা! দিদি যে গো!

একজন মহিলা অদ্ভুত হাতের শব্দ করে তাদের অদ্ভুত নিজস্ব কথা বলার ভঙ্গিতে ওপর দিকে তাকিয়ে বলল অ অনিমা! দিদি এয়েছে লো! নিয়ে যা লো।

চুড়িদার পরা আমার থেকে সামান্য একটু বড়ো মেয়েটি দোতলার রেলিঙে ঝুঁকে দেখে তরতর করে নীচে নেমে এল। এমন অস্বাভাবিক পরিবেশ কখনও দেখিনি। বাড়িটার সামনে দিয়ে বহুবার গেছি। কিন্তু কখনওই ভাবিনি। তিনতলা চারপাশ ঘেরা বাড়িটার উঠোনে রোদ্দুর নেই। শ্যাওলা ধরা উঠোনে শুধুই আলোর আভা। এত রকম অদ্ভুত জগতের মানুষকেও কখনও এক সঙ্গে দেখিনি। কারও বুকের আঁচল খসে গেছে। কারও কারও শরীরে শাড়ি নেই। শুধু ব্লাউজ আর সায়া। কর্কশ গলায় কথাবার্তা।

আমার ভয় করছে। সরস্বতীদির কোমর জড়িয়ে ধরলাম দু-হাতে। ও আমার কাঁধে হাত রাখল। পেঁচানো ভাঙা-চোরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। মেয়েটি আগে আগে উঠছে আর পেছন ফিরে দেখছে। সমস্ত রেলিঙটায় শাড়ি শুকোচ্ছে।

তিনতলার ঘরটা খুব সুন্দর। একটা কাঠের ছোটো আলমারি। মাথায় ছোট্ট টিভি। পাশে ফুলদানি। ফুলগুলো চিনি না। জানলায় দরজায় সস্তার রঙিন পর্দা। একটা বড়ো স্টিল আলমারি। চাবিটা লকারে ঝুলছে। চার ইঞ্চি পায়া খাটে নিতাই ঠাকুমা শুয়ে আমাদের দেখে উঠে বসলেন। পা গুটিয়ে চাদরটা হাত দিয়ে সমান করে বললেন বোস। এটা কে?

সরস্বতীদি বলল, পিকুন। ভাইয়ে বন্ধু।

উনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমায় কোলে তুলে বাঁ হাতে পিকের পিচদানি তুলে পিক তুলে পিক ফেলে বললেন, ভারি মিষ্টি দেখতে তো? তারপরই বুকে জড়িয়ে ধরে এগালে ওগালে চুমু খেতে লাগলেন। আর আমি জর্দার মিষ্টি গন্ধে ভেসে গিয়ে ঠাকুমার দু গালে চুমু খেলাম।

ঠাকুমা হ্যা হ্যা করে হাসছেন। তখনই দেখলাম ঠাকুমার দাঁতে লাল নীল সাদা সবুজ রঙের স্টোন বসানো। ঠাকুমার বুকের ওপর বসে অবাক চোখে দেখছিলাম। ঠাকুমা দুপাটি দাঁত বার করে আমাকে দেখালেন।

কী? কেমন লাগছে?

ঠাকুমার বিকট সুরওলা কন্ঠে ভয় পেয়ে বললাম, ভালো। তাড়াতাড়ি নেমে সরস্বতীদির পাশে গিয়ে বসে পড়লাম।

ঠাকুমা ডাকলেন হিমানি! হিমানি! গোটা ঘর কেঁপে উঠল। আমিও। ঠাকুমা সরস্বতীদির সঙ্গে কথা বলছেন। আমি দেখছিলাম জানলার পাল্লায় দুটো ব্লাউজ শুকোচ্ছে। আলমারির পাশে পাঁচ-ছটা ঢোল রাখা।

হিমানি এলে ঠাকুমা বললেন টাকার ব্যাগটা দে তো! ব্যাপারটা জানি। বাসব বলেছিল ঠাকুমা তাদের অর্থ সাহায্য করে।

টাকার ব্যাগ দিয়ে হিমানি আমাকে নিয়ে পড়ল। মাঝবয়সি মহিলা। সামান্য গোঁফের রেখা। সেই অদ্ভুত কন্ঠস্বর। অদ্ভুত কথা বলার ভঙ্গি। নীচে বোধহয় ঝগড়া লেগেছে। চ্যাঁচামেচি আর হাত তালির শব্দ।

হিমানি মাসির কী লম্বা চেহারা। কত উঁচু উঁচু বুক। অবলীলায় আমার মতো

এগারো-বারো বছরের ছেলেকে কোলে তুলে কত আদর করছে। আমি ছটফট করতে করতে নেমে পড়ি।

ঠাকুমা বেশ কিছু টাকা সরস্বতীদিকে দিয়ে হিমানি মাসিকে বলল ওদের দুটো মিষ্টি দে।

হিমানি টাকার ব্যাগটা আলমারিতে তুলে রাখছিল, তখনই ওরা এল। পাঁচ-সাতটা বেতের ধামা নামিয়ে রাখল। ওরা গেছিল তোলা তুলতে বউবাজার হাটে।

ধামাভর্তি সবজি-ফল-আলু-চাল। টাটকা সবজি।

ঠাকুমা বলল ব্যাগে কিছু ভরে দে।

সরস্বতীদি বলল আমি অত নিয়ে যেতে পারব না।

ঠাকুমা ধমকে বললেন আমার রিকশায় তুলে দিচ্ছি। পৌঁছে দেবে।

লাড্ডু খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। রিকশাওয়ালা আমাদের পায়ে সামনে ব্যাগটা কায়দা করে বসিয়ে দিল।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হয়তো বাড়ি ফিরলে মা ঠাকুমা খুব বকবে। বলবে হিজড়ে বাড়ি যাওয়া! আর কক্ষনও যাবে না। জামা প্যান্ট ছেড়ে বাইরে কলতলায় চান করো।

বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম ওদের জীবনযাপন। বাচ্চা হলে হিন্দুধর্মের নিয়ম অনুযায়ী ওদের শিশু দেখতে আসা মহাপুণ্য। ওদের আশীর্বাদ, দর করা চলার পথে আমাদের জীবন। কী নিষ্ঠুর এই সমাজ! জানি না এ থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব।

( ৪ )

বাবার মৃত্যুর ছমাসের মধ্যেই আমাদের জীবন অনেক স্বাভাবিক হয়ে উঠল। বাবা নেই কিংবা বাবা ছিল এ ব্যাপারটাই আর অনুভব করতে পারি না। বারান্দার এক কোণে ছোটো টেবিলে বাবার ফটো বসানো। ছোট্ট একটা ফুলদানিতে রোজ সকালে চান করে উঠে মা গন্ধরাজ বা রঙ্গন ফুল এনে তাতে দিয়ে ধূপ জ্বেলে প্রণাম করে।

আমিও রোজ স্কুলে খাওয়ার সময় পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে জুতো-মোজা পরে বাবাকে প্রণাম করি।

সন্ধ্যায় এখন বাড়িতে টিভি চলে। মা ঠাম্মা দেখে। হাসে। ভালোমন্দ বিচার করে। আমার খুব ভালো লাগে। প্রথম প্রথম মনে হতো বন্দি হয়ে আছি আকাশের নীচে। চাঁদের আলোয়। সূর‌্যের উত্তাপে।

ফ্যাক্টরি থেকে বাবার পাওনা টাকা সব পাওয়া গেছে। দাদুরও বেশ কিছু টাকা ছিল ফিক্সড করা। সোমনাথকাকু, সব টাকা মাকে পোস্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে ফিক্সড করে দিয়েছে। মা কিংবা ঠাম্মা গিয়ে মাসে মাসে টাকা তুলে আনে।

আমার মাস্টারমশাই নেই। মা রোজ সন্ধ্যায় পড়ায়। এখন আর মায়ের কোলে বসে পড়ি না। সামনে বসি। মায়ের গায়ে গন্ধটা দূর থেকেও পাই।

মা বলে অনেক লেখাপড়া শিখতে হবে। বড়ো হতে হবে। মা চোখের জল মোছে আঁচলে।

ক্রমশ…

মুনিয়া

ঘটনার সূত্রপাত মাস দশেক আগে। সেদিন বৈশাখ মাসের সতেরো তারিখ। দিনটা এখনও মনে আছে পালকের। বোধহয় সারাজীবন-ই মনে থেকে যাবে। মারাত্মক গরম পড়েছিল সেদিন। এর আগে এপ্রিল মাসে এত গরম পালক দেখেনি কখনও। সেদিন-ই সে মোক্ষম জবাব দিয়েছিল কেয়াকে।

প্রায় বছর দুয়ে হল এই ফ্ল্যাটে এসেছে পালক। কেয়া অবশ্য তার-ও আগে থেকেই এখানে থাকে। এই ফ্ল্যাটটার পজিশন সবচাইতে ভালো বলে দামটাও তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি-ই ছিল। দামে-দরে ঠিকঠাক পোষাচ্ছিল না বলে প্রোমোটার ফ্ল্যাটটা নিজের হাতেই রেখেছিল। নীচের তলায় ডানপাশে ফ্ল্যাট। পালকের ফ্ল্যাটটা পছন্দ হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে তার ফ্ল্যাটের সামনে পুর্বমুখী এক চিলতে ফাঁকা জায়গা। এই অঞ্চলে এরকম ফ্ল্যাট আর একটাও তার চোখে পড়েনি। তাই এক দেখাতেই পালকের পছন্দ হয়ে যায় ফ্ল্যাটটা।

পালকের হাজব্যান্ড সায়ন্তন ভোলাভালা গোবেচারা টাইপের মানুষ। বউ-এর পছন্দের ওপর ভরসা রেখে চলা পুরুষদের মধ্যে একজন। তাই ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে কোনও দ্বিমত বা দ্বিরুক্তি করার মতো কেউ না থাকায়, পালক ফ্ল্যাটটা খুব সহজেই কিনে নিতে পেরেছিল। যদিও ওদের একমাত্র সন্তান জুলির স্কুলটা এই ফ্ল্যাট থেকে একটু বেশি দূর হয়ে গেল। তা হোক সামনের এত সুন্দর জায়গাটাতে বেশ কয়েকটা টব বসানো যাবে।

ফুলে ফলে ভরে যাবে তার ঘরের সামনের জমি। একি কম আনন্দের কথা! আর তাছাড়া পালক তো হাউস ওয়াইফ। জুলিকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া সে-ই তো করে। বাড়ি থেকে একটু আগে বেরোতে হবে এই যা। দামটা একটু বেশি দিতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু পছন্দসই জিনিসের জন্য দাম নিয়ে ভাবলে চলে না। তাই মানে মানে নিয়ে ফেলেছিল ফ্ল্যাটটা।

পালকের পাশের ফ্ল্যাটে প্রায় পালকের-ই বয়সের আর একটি বউ থাকে। সে-ই হল কেয়া। প্রথম থেকেই পালক কেয়াদের এড়িয়ে চলে। যদিও কেয়া ভীষণই মিশুকে এবং হেল্পফুল। এই তো ফ্ল্যাটে ঢোকার পরপর-ই পালকদের পুরোনো ওয়াটার পিউরিফায়ারটা কাজ করছিল না ঠিকঠাক। সেই সময় কেয়াই ওদের ঘর থেকে ফিলটার্ড জল বোতলে করে দিয়ে সমস্যা মিটিয়েছিল। তারপর যখন ফ্ল্যাটে কাজ চলছিল তখন মইটা দাও তো, এটা দাও তো সেটা দাও তো এসব তো লেগেই ছিল। কেয়া কিন্তু সবকিছুই হাসিমুখে করেছে। কখনও মনে হয়নি যে, সে বিরক্ত।

তবুও পালক ওদের এড়িয়ে চলত। কারণ, নিঃসন্তান কেয়ার ঘরে ওর পোষ্য মুনিয়া থাকত। মুনিয়া ফটফটে সাদা রঙের একটা বজ্জাত বেড়াল। কেয়াদের ঘরের দরজা খোলা পেলেই সে বেরিয়ে আসে। আর ঢুকবি তো ঢোক ঢুকে পড়ে পালকদের ঘরে। পালকের জাস্ট গা ঘিনঘিন করে বেড়াল দেখে। কুকুর ওর যদি-বা একটু সহ্য হয়, বিড়াল জাতটাকে সে মোটেই সহ্য করতে পারে না।

ফ্ল্যাট কেনার আগে পালক দুবার এসেছিল ফ্ল্যাটটা দেখতে। কিন্তু সেই সময় কেয়ার শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় ওরা সপরিবারে মেদিনীপুর ছিল। ফ্ল্যাট কেনার আগের :  পর্যন্ত পালক জানতেই পারেনি যে, তার পাশের ফ্ল্যাটেই অমন একটা ইরিটেটিং অ্যানিম্যাল থাকবে আর যখন তখন তার ঘরে ঢুকে দুধ, মাছে মুখ লাগাবে।

এর আগে কেয়াকে বেশ কয়েকবার বলেওছে পালক, তোমার মুনিয়াকে গলায় চেন দিয়ে বেঁধে রাখো কেয়া। এভাবে আর পারা যাচ্ছে না জাস্ট।

কিন্তু কেয়া একই কথা বলেছে প্রত্যেকবারেই, পালক, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড প্লিজ। ওরা জাতে বিড়াল হলেও আসলে মানুষের-ই মতো। তোমার গলায় যদি সারাক্ষণ দড়ি বেঁধে রাখা হয়, ভালো লাগবে তোমার?

কী কথার কী উত্তর! একটা বিড়ালের সঙ্গে মানুষের তুলনা! জাস্ট ডিসগাস্টিং। সেই বাদানুবাদের ঠিক দশ দিনের মাথায় দুই কেজি মাছ সবে ধুয়ে রেখেছে পালক। সায়ন্তন রোজ বাজারে যেতে পারে না বলে যেদিন-ই মাছ আনে বেশি করেই আনে। যেন দু-তিনদিন ফ্রিজে রেখে চালিয়ে নেওয়া যায়।

পালক ফ্রিজের পাশে মাছের গামলা রেখে কিচেনে ঢুকেছে, তিনটে বাটিতে তিন দিনের জন্য মাছ আলাদা আলাদা করে ফ্রিজে ঢোকাবে বলে। সে সময় কেন জানি না জুলি কি একটা কারণে দরজাটা খুলে রেখেছিল। ঠিক সেই সময় কেয়াদের বিড়াল মুনিয়া গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পালকের রান্নাঘরে ঢুকেই বসে পড়ল মাছ খেতে। যেন মাছগুলো ওর জন্যেই গামলায় যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে পালক। ব্যস। পালক দেখেই জোরে চিত্কার করে উঠল। পুরো দু-কেজি মাছ ফেলে দিতে হয় সেই দিন।

জুলির পছন্দের পাবদা আর ভেটকি মাছ ফেলে দিতে পালকের বুক ফেটে যাচ্ছিল। বারো-তেরোশো টাকার মাছ জুলিকে না খাইয়ে নিজেরা না খেয়ে এভাবে ফেলে দিতে মন চায় কারও! সায়ন্তন তবু মিনমিন করে বলেছিল বটে, যেদিক থেকে মুনিয়া খেয়েছে সেদিক থেকে ফেলে দিয়ে বাদবাকিটা নেওয়া যায় না পালক! কিন্তু না। বিড়ালের মুখের জিনিস খেয়ে অন্য কোনও বড়ো অসুখ বাধাবে! পালক কি পাগল হয়েছে নাকি!

তারপর থেকেই ভেতরে ভেতরে ফুটছে পালক। মুনিয়ার একটা চরম এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সেটা ঠিক কী এবং কীভাবে করবে তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। তারপরেই তনয়াকে ফোন করে বেশ কিছুক্ষণ জরুরি আলোচনা সেরে নেয় সে।

তনয়া হচ্ছে পালকের সেই ছোটোবেলার স্কুল ফ্রেন্ড। মনের গঠনগত দিক থেকে দুজনেই প্রায় একই রকম। দুজনেই ভীষণ ভাবে ঘেন্না করে এই বিড়াল জাতটাকে। দুজনেই ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে। দুজনের-ই প্রিয় রং ম্যাজেন্টা। দুজনেই বাগান করতে ভালোবাসে। এরকম আরও কত কী! তনয়ার মাথা থেকেই আইডিয়াটা বের হয়। ব্যস। তারপর আর কি! দেখেশুনে একটা দিন ঠিক করল পালক।

পরের সপ্তাহে মঙ্গলবার সায়ন্তন অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরে জুলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে জিনিসটা কিনে নিয়ে ফিরল পালক। তারপর একটা বাটিতে মাছ আর একটা বাটিতে দুধ রেখে তার মধ্যে বিষটা বেশ যত্ন করে মাখিয়ে দিল সে। শত হলেও শেষ খাওয়া খাবে মুনিয়া। একটু ভালো করে দেওয়াই ভালো। এরপর সে গ্রিলটা টেনে দিয়ে দরজাটা খুলে রেখে ফ্রিজের পাশে বাটি দুটো সাজিয়ে রেখে আরাম করে স্নান করতে লাগল।

ওয়াশরুমের দরজা ফাঁক করে একবার দেখে নিল পালক। হ্যাঁ। প্ল্যান মতোই সবকিছু এগোচ্ছে। মুনিয়া আরাম করে দুধের বাটিতে চুমুক দিচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ পর পালক বেরিয়ে দেখল দুটো বাটিই সাফ করে মুনিয়া পালিয়ে গেছে। যাক বাবা! এতদিন পর একটা কাজের কাজ করেছে পালক। এরকম একটা কিছুর ভীষণ-ই দরকার ছিল। সবকিছুর-ই একটা সীমা থাকা উচিত। একেই তো বিড়ালের পশমকে দারুণ ভয় পায় পালক, তার ওপর আবার যখন তখন ঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দিয়ে দেওয়া। উফ! অসহ্য!

দুপুর পর্যন্ত মুনিয়ার আর কোনও সাড়াশব্দ পায়নি পালক। একবার উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেরকম কিছুই বুঝতে পারেনি সে। জুলিকে আনতে যেতে হবে। হাতে এই মুহূর্তে প্রচুর কাজ পালকের। রান্না করতে করতে একরকম ভুলেই গেছিল মুনিয়ার কথা, ঠিক সেই সময় কলিং বেলটা সশব্দে বেজে উঠল। কে এল! কেয়া নাকি! ও কিছু সন্দেহ করছে না তো!

দু-বার ঢোঁক গিলে পালক দরজা খুলল। সাথে সাথেই কেয়া চিত্কার করে বলল, কী করে এরকম একটা নোংরা কাজ করতে পারলে পালক! আমার মুনিয়া প্রেগন্যান্ট ছিল। এই অবস্থায় নিজে একজন মা হয়ে আরেকটা মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে একটুও হাত কাঁপল না তোমার! ছিঃ।

—বিষ! এসব তুমি কী বলছ কেয়া! না বোঝার ভান করল পালক।

—ন্যাকামো না করে তোমার বাগানে গিয়ে দেখে আসো মুনিয়ার কী অবস্থা!

বাগানের নাম শুনেই এক লাফে সিঁড়ির প্যাসেজ পার হয়ে মেন গেটের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল পালক। বেরিয়ে ডান হাতে তার বাগান। বাগানের বেশিরভাগ-ই সব ছোটো ছোটো টব। তাতে কোনটা তুলসী, কোনটাতে ধনেপাতা, আবার কোনওটাতে গোলাপ। একটাই শুধু বড়ো গামলার মতো টব। গামলায় একটা বনসাই আম গাছ। গাছটা বেশ সুন্দর ডালপালা ছড়িয়েছে। এই গরমে মাঝে মাঝেই মুনিয়া আম গাছটার তলায় এসে বসে থাকে। এখনও যেমন শুয়ে আছে। তবে এই শোয়ার সঙ্গে আগের শোয়ার বেশ পার্থক্য রয়েছে, সেটা ভালো মতোই বুঝতে পারল পালক। মুখে সেসব কিছুই প্রকাশ না করে পালক বলল, ও মা! মুনিয়া এভাবে শুয়ে আছে কেন!

—এই প্রশ্নটাই আমি তোমাকে করতে চাই পালক। মুনিয়া একটা ছোট্ট প্রাণী তার ওপর সে মা হতে চলেছিল। তাকে এভাবে খুন করলে কেন পালক?

তার মধ্যেই পালক দেখে নিয়েছে মুনিয়ার মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরিয়ে জিভ বের করে সে ঠিক আমগাছের গোড়ায় পড়ে রয়েছে।

—উফ! দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এখানে এসেই মরতে হল! মরেও শান্তি দেবে না দেখছি মুনিয়া!

মুনিয়াকে বুকের মধ্যে নিয়ে কেয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই গর্ভবতী মাকে মারার শাস্তি ভগবান তোমায় দেবে না ভেবেছ! এর শাস্তি তুমি পাবেই পালক। আমার মুনিয়া এত বড়ো অন্যায় কিছুতেই সহ্য করবে না। তুমি মিলিয়ে নিও।

পালক এরকম অভিশাপ শুনে একটু থমকে গেছিল প্রথমে। কেয়ার কান্না দেখেও বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে পালকের। কেয়া মুনিয়াকেই যে তার নিজের সন্তান ভাবত তা সে মরমে মরমে বুঝতে পারছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পালক দেখল আম গাছটাও গর্ভবতী। ডালে ডালে মুকুল এসেছে। কদিন বাদেই ফল ধরবে। কিন্তু না। ফল ধরার আগেই বিনা নোটিশে গাছটা মরে গেল। কিছুদিন ধরেই গাছের গোড়ায় জল দিলেও জল শুষে নিচ্ছিল না আমগাছটা। তার দিন কয়েক পরে মুকুলগুলোও হলুদ হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।

পালকের মনে কু ডাকতে লাগল। তাহলে মুনিয়ার আত্মা-ই কি গাছটাকে মেরে ফেলল! ভগবান কি এভাবেই শাস্তি দিল পালককে! এরপর আম গাছের জায়গায় খুব ভালো জাতের একটা বনসাই বাতাবি লেবুর গাছ লাগাল পালক। রোজ পালকের হাতের পরিচর‌্যা পেয়ে গাছটা বাড়তে লাগল দ্রুত। কিছুদিন পরে ফুল ধরল তাতে। ততদিনে পালকও বুঝতে পেরে গেছে ওসব আত্মা-টাত্মা পুরো ফালতু ব্যাপার।

তনয়াও এই ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছে পালককে। নিজের হাতে লাগানো গাছের বাতাবি লেবু জুলি খাবে। এটা ভেবেই খুব ভালো লাগছে পালকের। কিন্তু সেসব কিছুই ঘটল না। বরং ঘটল ঠিক তার উলটোটা। ফুল আসার কদিন পর থেকেই গাছটা শুকোতে আরম্ভ করল। এবার সত্যি সত্যি ভেতরে ভেতরে ভীষণ রকম ভয় পেতে শুরু করেছে পালক।

আম গাছটা না হয় এমনিই মরে গেছিল। কিন্তু বাতাবি লেবুগাছ! সেটা কোন কারণে মারা গেল! গাছগুলোর যদি মরার-ই ইচ্ছে হয় তাহলে আগে বা পরে নয় কেন! ঠিক মুকুল এলেই গাছগুলো মরে যায় কেন! এবারে আর কোনও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিকেও মানতে নারাজ পালক। তনয়ার নানারকম যুক্তি শুনতে ইচ্ছে করে না তার। তার মনের মধ্যে ভয়, দুশ্চিন্তা ক্রমশই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আজ অনেক দিন যাবত ঘুমাতে পারছে না পালক। কখনও যদি বা একটু ঘুমিয়ে পড়ে তাহলেই স্বপ্নের মধ্যে মুনিয়াকে দেখতে পায় সে।

মুনিয়া যেন মিহি সুরে বলছে, আমার বাচ্চাদের মেরেছিস কেন পালক! আমাকেই বা মারলি কেন পালক!

যখন তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে পালক। দুই চোখের তলায় জমাটবাঁধা কালি। পেলব মসৃণ ত্বক জৌলুস হারিয়ে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শরীর ভেঙে আধখানা হয়ে গেছে। সায়ন্তন কোনও কিছুই বুঝতে না পেরে পাড়ার নার্সারি থেকে আবার একটা বনসাই আম গাছ এনে ফাঁকা টবে লাগিয়ে দিয়েছে।

পালক আর কাউকে সহ্য করতে পারছে না। সায়ন্তনকে না। জুলিকে না। কাউকে না। বহু রাত সে ঘুমোতে পারছে না ঠিকমতো। ঘুম এলেও একটু পরেই ভেঙে যায়। বারেবারে মুনিয়ার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কেয়ার দেওয়া অভিশাপ সবসময়-ই যেন শুনতে পায় সে। তবে কি পালক পাগল হয়ে যাচ্ছে!

সকালে উঠতেই সায়ন্তন পালকের হাতটা ধরে বলল, পালক, আমগাছে মুকুল এসেছে। এবার আর কিছুই হবে না। এবারে তোমার গাছে আম ধরবে দেখো!

মুকুল ধরেছে! আবার মুকুল ধরেছে! উফ! আবারও আসবে মুনিয়া। এই গাছটাকেও বাঁচতে দেবে না ও। কিছুতেই বাঁচতে দেবে না মুনিয়া।

পাশের কোনও একটা ফ্ল্যাট থেকে রাত দুটোর ঘন্টা বাজল। ঘুম আসছে না পালকের। এভাবে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বরং ওয়াশরুমে গিয়ে একটু মুখে জল দিয়ে আসি। ভাবতে ভাবতেই খুব আস্তে করে শোবার ঘরের দরজা খুলল পালক। নাহ! জুলিদের ঘুম ভাঙেনি। ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়ে বারান্দার দিকে চোখ পড়ে গেল হঠাত্। আমগাছটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমগাছের পাশে ওটা কে দাঁড়িয়েছিল মনে হল! বসে পড়ল নাকি! আর দেখা যাচ্ছে না তো! পা টিপে টিপে বারান্দার কাছে এসে দেখল, কেকা একটা মগে একটা নুনের প্যাকেট থেকে নুন ঢেলে জলে গুলছে আর আম গাছের গোড়ায় ঢেলে দিচ্ছে।

ওহ মাই গড! গাছে মুকুল এলেই গাছগুলো তাহলে এভাবেই মরে যায়! হায় রে কেয়া! পালক প্রেগন্যান্ট মুনিয়াকে মেরেছে বলে তুমি আমার ফলবতী গাছগুলোকে এভাবে মেরে ফেলছ! মুনিয়ার মতো যে গাছগুলিও নিষ্পাপ গো কেয়া! আমি তো মহাপাপ করেছিলাম কেয়া। সেটা আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। কত বড়ো ভুল আর অন্যায় যে সেদিন করেছিলাম এক গর্ভবতী মাকে খুন করে, সেটা ভেবে জ্বলে পুড়ে মরছি আমি। সেই একই ভুল তুমিও করলে কেয়া! ভুল দিয়ে ভুলকে কি উপড়ে ফেলা যায় কেয়া!

আজ বহু দিন পর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে পালকের। আজ থেকে আবার ঘুমোবে সে।

রবে নীরবে

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, রোজের মতোই সবকিছু যেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোমার ভিতরে ঝড়ের দাপট সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটটা থেকে বেরোনোর জন্য ও ছটফট করছিল। কোথাও থেকে সুজয়কে একটা ফোন করার উপায় পর্যন্ত নেই। এভাবে কী করে দিনগুলো কাটাবে কিছুতেই রোমা ভেবে পাচ্ছিল না।

এদিকে স্বামী অয়ন সারাদিন বাড়িতে আছে। চারপাশের পরিস্থিতির কারণে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করাচ্ছে ওদের কোম্পানি। অয়ন ছাড়াও রাতুলও সবসময় মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ওরই বা কী দোষ, বয়স মাত্র দুবছর। রাতুলের আনন্দের কোনও সীমাপরিসীমা নেই কারণ মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে।

ওই দুধের শিশু কী করে জানবে মায়ের মনে ঝড় উঠেছে। এটা তো ওর জানার কথাও না। অয়নও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কাজে রোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলেছে তবুও রোমার মুখে সর্বক্ষণ বিরক্তি এবং রাগ কিছুতেই কমবার নাম নিচ্ছে না।

অধৈর্য হয়ে একদিন অয়ন বলেই ফেলল, কী হয়েছে রোমা তোমার? বাড়ির যে-কাজটা করতে অসুবিধা মনে হবে আমাকে বলে দিও, আমি করে দেব। মুখটা সবসময় হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় যেন হাসতেই ভুলে গেছ।

রোমা রাগে ফেটে পড়ে, চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে বদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে যাচ্ছে।

ডার্লিং, তুমি তো আগেও বাড়িতেই থাকতে। যেটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার রুটিনের। আগে অফিস যাচ্ছিলাম এখন বাড়ি থেকে কাজ করছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি একেবারেই বিরক্ত করি না। না আমার কোনও অভিযোগ রয়েছে! তোমার আর রাতুলের মুখ দেখেই আমি আনন্দ পাই।

রোমা ভেবে পায় না অয়নকে কী উত্তর দেবে। সুজয়কে ও ভালোবাসে, অয়নকে নয়। এর আগে রোজ পার্কে সুজয়ের সঙ্গে দেখা হতো যখন রাতুলকে নিয়ে পার্কে যেত রোমা। সুজয় শরীরচর্চা করার জন্য রোজ পার্কে দৌড়োত।

সুজয়ের সুগঠিত শরীরের আকর্ষণ চুম্বকের মতো রোমার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সুজয়ের প্রতি অনুরাগ লুকোবার চেষ্টাও করেনি রোমা। সুজয় রোমার চোখে স্পষ্টই পড়ে নিয়েছিল ওর মনোভাব। রোমার সামনে দিয়ে যখনই যেত, সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

চোখে চোখে কথা দিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন হলেও ধীরে ধীরে সেটা পাখনা মেলতে শুরু করেছিল। সুজয় অবিবাহিত, মা-বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে একই সোসাইটিতে থাকে। অয়নের অনুপস্থিতিতে রোমা বেশ কয়েকবার সুজয়কে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দেখা হলেই বেশিরভাগ কথা হতো ওদের অথবা ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। রোজ দেখা করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে পার্কে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সারাটা দিন উন্মুখ হয়ে থাকত রোমা।

এখন লকডাউন-এর জন্য সবকিছুই বন্ধ, পার্কও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার করার জন্যও বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না কারণ সবই বন্ধ। জিনিস কেনাকাটা সবই তো অনলাইনেই। সুজয়ও বাইরে কোথাও বেরোয় না। কখনও-সখনও একটা দুটো মেসেজ দেওয়া নেওয়া চলত প্রেমিকযুগলের মধ্যে, তাও রোমা ভয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিত যদি অয়ন দেখে ফেলে।

রোমাকে আনন্দে রাখতে অয়নের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। রোমার রাগ, বিরক্তি দিনদিন বেড়েই চলেছিল। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ইচ্ছে হলে রোমা স্বামীকে সঙ্গ দিত নয়তো একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে নিশ্চুপ পড়ে থাকত।

অয়নের সরল সাদামাটা স্বভাব রোমার অজানা ছিল না। ও জানত স্ত্রী, সন্তানকে আনন্দে থাকতে দেখলেই অয়নের আনন্দ। ওর কোনওরকম দোষ রোমা কোনওদিন খুঁজে পায়নি তবুও স্বামীর প্রতি কোনও টান অনুভব করত না রোমা।

মা-বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল রোমা অয়নকে বিয়ে করতে কিন্তু স্বভাবে অয়নের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল রোমা। বিবাহিতা হয়ে পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখা নিয়ে কোনও পাপবোধ ওর মধ্যে ছিল না। বরং অয়নের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে আঙুলে নাচানো অভ্যাস হয়ে উঠেছিল রোমার।

কিছুদিন লক্ষ্য করার পর অয়ন একদিন রোমাকে জিজ্ঞেস করেই বসল, আচ্ছা রোমা আমাকে বিয়ে করে কি তুমি খুশি হওনি? লক্ষ্য করছি যবে থেকে আমি বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি তুমি কেন জানি না সবসময় রেগে রেগে থাকো। তোমার মনের ভিতর কী চলছে আমাকে খুলে বলবে?

বিয়ে তো হয়ে গেছে সুতরাং আনন্দে থাকি বা দুঃখে, তাতে কী যায় আসে! রোমা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল।

অয়ন রোমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল, আমাকে বলো, কেন আজকাল তোমার মুড এত খারাপ থাকে?

ঘরে বসে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে বেরোতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় যেতে চাও বলো? আমি ঘুরিয়ে আনছি কিন্তু সবই তো বন্ধ।

তোমার সঙ্গে নয়, আমি একাই যেতে চাই। কঠিন স্বরে রোমা অয়নের দিকে কথাগুলো ছুড়ে দিল।

রোমার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হিংস্র বাঘিনীর মতো রোমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলক খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল অয়নের বুক চিরে। অফিসের জরুরি মিটিং ছিল ফলে উঠে এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল। কিন্তু মনটার ভিতর একটা ব্যথার উপলব্ধি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ও জীবনে কী পাচ্ছে? রোমা যে ওকে পছন্দ করে না, সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ওর কাছে।

রোমার সঙ্গে ঠিকুজি মিলিয়ে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী বলেছিল রাজযোটক। এই বিয়ে হলে নাকি অয়নের সুখের শেষ থাকবে না। কিন্তু কী পেল অয়ন? এখন এমন অবস্থা, নিজের দুঃখ শেয়ার করারও কোনও রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে।

একদিন অয়ন স্নানে গেলে রোমা নিজেকে আটকাতে পারল না, সুজয়কে ফোন করল। সুজয় কোনও কাজে ব্যস্ত থাকাতে সেই মুহূর্তে ফোন ধরতে পারল না। পরে রোমার ফোন দেখে যখন কল ব্যাক করল তখন সুজয়ের ফোন দেখেও রোমা ফোন তুলতে পারল না, ঘরের মধ্যে অয়ন বসেছিল বলে।

সুজয়ের ফোন ধরতে না পারাতে সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। অয়নকে জলখাবার দিতে গিয়ে এত জোরে খাবারের প্লেট-টা রোমা টেবিলে নামিয়ে রাখল যে অয়নও নিজের রাগ সামলাতে না পেরে রাগে ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে কেউ খেতে দেয়?

রোমা মনে মনে ফুঁশছিলই। ও গলা না নামিয়ে উত্তর দিল, খেতে হলে খাও, না খেলেও আমার কিছু…

রোমার চিৎকারে রাতুল ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে মায়ের ওই মূর্তি দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অয়ন ওকে বুকে চেপে ধরে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে অয়নের মন চাইছিল না। রোমা এভাবে কথা বলতে পারে সেটা মেনে নিতে পারছিল না অয়ন। কথা বলার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল অয়নের বরং ওর ভিতরটা আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। মন বিদ্রোহ করতে চাইছিল।

রোমার ব্যবহারে কেন এই পরিবর্তন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। রোমার ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মানুষ নয় অয়ন। সকলেরই নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, সেটাতে হস্তক্ষেপ করা অয়নের পছন্দ নয়। রোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ও। ভুলটা কোথায় হচ্ছে যার জন্য সংসারের শান্তি চলে যেতে বসেছে, সেটা ভাবতে ভাবতে অয়নের মন অশান্ত হয়ে উঠল।

 

একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে রোমা ছেলেকে নিয়ে একটু শুতে এলে, অয়ন বেরিয়ে ল্যাপটপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে বসল। সুযোগ বুঝে রোমা সুজয়কে মেসেজ করল এবং তৎক্ষণাৎ উত্তরও চলে এল। এভাবেই মেসেজ আদানপ্রদান করতে করতেই কখন এক ঘন্টার বেশি পেরিয়ে গেছে রোমা বুঝতেই পারেনি। তার প্রতি সুজয়ের টান দেখে মনে মনে আনন্দই হচ্ছিল রোমার।

হঠাৎই মনে হল অয়ন বাড়িতে থাকায় সুজয়ের সঙ্গে বাইরে দেখা করার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল রোমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। আর কতদিন লোকটা বাড়িতে বসে থাকবে কে জানে, ভেবে মনটা খিঁচিয়ে উঠল রোমার। ফোন রেখে দিয়ে রোমা উঠে রান্নাঘরে চলে এল। উঁকি দিয়ে দেখল অয়ন একমনে অফিসের কাজ করছে।

নিজের ভেতরের রাগটা প্রকাশ করতে জোরে জোরে বাসনের আওয়াজ করতে লাগল কাজের অছিলায়। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ইশারায় রোমাকে আওয়াজ করতে বারণ করল, জানাল অফিসের একটা জরুরি মিটিং চলছে। রোমা অয়নের কথার কর্ণপাত না করে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল।

মিটিং শেষ হতেই অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। এটা কী ধরনের অসভ্যতা রোমা! টিভি দেখাটা কি এতই জরুরি ছিল? বারণ করা সত্ত্বেও তুমি…

অয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রোমাও চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে কখন দেখব? সারাদিন তো তুমি বাড়িতে বসে আছ। কোথাও বেরোও না যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নেব। আমার এ বাড়িতে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতেও পারি না, বলে রাগের মাথায় টিভির রিমোট সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিল রোমা।

ছেলের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অয়ন যথাসম্ভব গলাটা নীচে নামিয়ে রোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক আছে তুমি টিভি দ্যাখো, আমি শোবার ঘরে চলে যাচ্ছি।

রোমা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, টিভি দেখার মুড তো তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। আমিই ভিতরে যাচ্ছি, এখন একটু শোব আমি।

রোমার এই অসঙ্গত ব্যবহারের কোনও কারণ অয়ন খুঁজে পেল না। রোমা কেন এতটা বদলে গেল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে। এভাবে কী করে সংসার চলবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা করতে পাচ্ছিল না অয়ন। তারপর মনে হল হয়তো বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে বলেই রোমার এই পরিবর্তন। এমনটা হয়তো সকলেরই হচ্ছে।

অয়ন নিজে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে বলেই রোমাও পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা কোথায়? তার উপর ওইটুকু ছেলে রাতুলেরও সব দায়িত্বও তো রোমাকেই সামলাতে হয়, অয়ন নিজে আর কতটুকু পারে স্ত্রীকে সাহায্য করতে? ও নিশ্চয়ই সারাদিন কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার উপর কাজের মেয়েটাও তো করোনার কারণে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তাও আশেপাশের ফ্ল্যাটে রোমার যাতায়াত ছিল। পার্কের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারত আর এখন তো বাড়িতে বসা। রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক।

অয়নের মনে হল, রোমা ওর উপর রাগ দেখাবে না তো আর কার উপরই বা দেখাবে? নিজের লোক বলতে তো অয়নই। এখন তো কারও সঙ্গে কোনও কথা হওয়া মানেই করোনা নিয়ে আলোচনা। মানুষ আনন্দ করবে কী নিয়ে? কোথাও তো ভিতরে পুষে রাখা রাগটা প্রকাশ করতেই হবে রোমাকে।

রোমার প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে অনুকম্পা বোধ করল অয়ন। শোবার ঘরে এসে রোমার পাশে বসল অয়ন। ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। রাতুল ঘুমোচ্ছিল আর রোমা সবেমাত্র সুজয়ের সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেছিল। অয়ন আসাতে রোম্যান্স-এ বিঘ্ন ঘটায় চিড়বিড়িয়ে উঠল রোমা। গলায় বিদ্বেষ চেপে বলল, আচ্ছা, তুমি কি ঠিকই করে নিয়েছ শান্তিতে আমাকে থাকতে দেবে না?

মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল অয়নের মুখচোখ। কতকিছু ভেবে রোমার পাশে গিয়ে বসেছিল। চুপচাপ উঠে বসার ঘরে সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল অয়ন। দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর।

অয়নদের সোসাইটির প্রত্যেক বিল্ডিং-এর পার্কিং এরিয়াতে কিছুটা করে খোলা জায়গা ছিল। রাত্রে কখনও-সখনও এক দুজন ওয়াক করতে করতে এসে পড়ত। নয়তো পার্কিং-এর জায়গাগুলো রাত্রে নির্জনই থাকত। সুজয় রোমাকে জানাল রাত নটায় ডিনার সেরে দুজনেই হাঁটতে বেরোবে। দূর থেকে হলেও দুজনের দেখা তো হবেই। আর ওখানে লোকজন না থাকলে কথা বলতেও পারবে দুজনে।

রোমা এটাই তো চাইছিল। ও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। অয়নের সঙ্গেও সেদিন একেবারেই ঝগড়া করল না। অয়নও চুপচাপই রইল সারাদিন। সবসময় রোমার মুড অনুযায়ী চলাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোমার সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলা বন্ধ করে দিল। রাতুলের সঙ্গে খেলত আর কখনও কখনও বাড়ির কাজ যতটা পারত চুপচাপ করে দিত।

ডিনার সেরে রোমা একলাই বেরিয়ে গেল হাঁটতে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেত না। রোজ খাওয়ার পর রোমার বাইরে হাঁটতে যাওয়া চাই-ই চাই। অয়নও এটা ভেবে চুপ করে থাকত যে এইটুকুতে রোমা যদি শান্তি পায়, আনন্দে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়াতেই রোমার যত অসন্তোষ।

এদিকে সুজয়ের মা-বাবা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুজয় রোমাকে জানাল, কয়েকদিন দেখা করতে পারবে না। করোনা কমে আসাতে সোসাইটির অনেক লোকই নীচে ওয়াক করতে শুরু করেছিল। সুজয়ের ভয় ছিল, বাইরে বেরোলে ওর মাধ্যমে যদি করোনার ভাইরাস মা-বাবাকে অ্যাটাক করে। সুতরাং বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো বলে সুজয় মনস্থির করে নিয়েছিল।

রোমা আবার একটা ধাক্কা খেল। ওর মুড আবার খারাপ হয়ে উঠল। সুজয়ের প্রতি যেন ওর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করাতেই ওর যত উৎসাহ। সেই উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। মনে মনে অয়নকেই এর জন্য দায়ী করে বসল ও। অয়ন বাড়িতে থেকেই ওর সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হল। অয়নের জন্যই বাড়িতে সুজয়ের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারে না। সব রাগ আবার গিয়ে পড়ল অয়নের উপর।

রোজই ঝগড়া হতে শুরু হল। অয়নও অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত আর চুপ করে থাকা যায়! আবার লড়াই ঝগড়া ওর স্বভাবেও নেই। শান্ত স্বভাবের যে-কোনও মানুষই এইরকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই সমস্যার সমাধান বলে ধরে নেন। অয়নও ওই একই রাস্তা নিল। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল। নরমে-গরমে অয়ন আর রোমার সংসার টলমল ভাবে কোনওমতে চলছিল।

হঠাৎই আবার একদিন সুজয়ের মেসেজ এল, রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওদেরই সোসাইটির কাছাকাছি সুজয়দের আর একটা ফ্ল্যাট ছিল যেটা ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটে ছেড়ে দেওয়াতে সুজয় জানিয়েছে ওই ফ্ল্যাটে ও রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

রোমাও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করে জানিয়ে দিল, যাওয়াটা মুশকিল তবে ও সবরকম চেষ্টা করবে যাওয়ার। নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল রোমা, কী বলে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনও উত্তেজনা ছাড়াই।

বাড়িটা দিন দিন নরক হয়ে উঠতে লাগল রোমার কাছে। আর এসবের মূলে যে অয়ন, এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল ওর মনের ভিতর। অয়নের উপস্থিতি চক্ষুশূল হয়ে উঠল রোমার কাছে।

সেদিনটা অয়নের কাজের চাপ একটু কম থাকাতে লাঞ্চ টেবিলে রোমাকে সাহায্য করতে যেতেই রোমা স্পষ্ট জানাল, থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি করে নেব। অয়ন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ টেবিলে থালা, গেলাসগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। আজকাল বাড়িতে কথা বলা অয়ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কষ্ট এতটাই রোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, অয়নের শুকনো ক্লিষ্ট মুখটা ওর নজরেই এল না। ভাতের গরম হাঁড়িটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে অয়ন টেবিলে রাখবে বলে আনতে যেতেই রাগের মাথায় রোমা অয়নকে একটা ঝটকা মারল। মুহূর্তে হাঁড়িটা অয়নের হাত ফসকে ওর পায়ের উপর পড়ে গেল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল অয়ন।

রোমা অয়নের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাটি থেকে হাঁড়িটা উঠিয়ে খাবার টেবিলে এনে রেখে দিল। যতটা ভাত মাটিতে পড়েছিল সব পড়ে রইল। হাঁড়িতে থাকা বাকি ভাতটা প্লেটে নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে বসে গেল রোমা এবং নিজেও খেতে শুরু করে দিল।

অয়ন নিজেই ফ্রিজ খুলে বরফ বার করে পায়ে লাগাতে শুরু করল সোফায় বসে। আড় চোখে দেখল রোমা নিশ্চিন্তে নিজে খেতে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় অসহ্য জ্বালা অয়নের চোখে জল এনে দিল।

কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? কাঁদতে জানে, যখন নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ পাওয়ার লোভে রোমার মতো স্ত্রীয়েরা স্বামী, সংসার, সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করে তখন অয়নের মতো পুরুষ মানুষের চোখেও জল আসে।

পুরুষ মানুষের হৃদয়ে নৈঃশব্দ্যের সাগরে তুফান চললেও তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এই তুফান মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে। অয়নের মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও স্পষ্ট রূপ নিতে পারল না। অসহায়ের মতন শুধু তাকিয়ে রইল রোমার খাওয়ার দিকে। কীসের জন্য রোমা ওর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অয়ন!

 

গুড সামারিটান

প্রকাশ ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে চলে যাবার পর প্রায় দুমিনিট মোহাচ্ছন্নের মতো দরজা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল বাসবী।

দুপুর দেড়টা নাগাদ খিচুড়ি খেতে বসেছিল বাসবী আর ঠিক সে সময়ই প্রকাশ এসে হাজির হল। পাঁচদিন আগে লক্ষীনগরের মোড়ের কাছে রাস্তা পার হবার সময় অটোর ধাক্কায় ছিটকে রাস্তায় পড়ে গিয়ে বাসবী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। চারপাশে জমে যাওয়া ভিড়ের মধ্য থেকে যখন কেউ এগিয়ে আসছিল না ওকে সাহায্য করতে তখন প্রকাশই বাসবীকে রাস্তা থেকে তুলে ওলা ডেকে, নিয়ে গিয়েছিল আকাশ নার্সিংহোমে।

ডান পায়ে পাতায় হেয়ার-লাইন ফ্র‌্যাকচার জুড়তে প্লাস্টার আর ফেটে যাওয়া মাথায় পাঁচটা স্টিচিং লাগিয়ে প্রকাশ ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল সন্ধের দিকে। যাবার সময় ও বলেছিল দেখা করতে আসবে কোনও একদিন। কিন্তু এভাবে দুপুরের দিকে আগে না জানিয়ে ও এসে হঠাৎ হাজির হবে ভাবতে পারেনি বাসবী।

—চমকে গেছেন আমাকে দেখে, তাই না? প্রকাশ বলেছিল হেসে। অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম।

বাসবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, না না, বিরক্ত হব কেন? আসুন ভেতরে।

—আপনি ওয়াকার ইউজ করছেন না কেন? ভাঙা পা তাড়াতাড়ি সারাতে হলে আপনাকে ওয়াকারের সাহায্য নিতে হবে।

—আমার মেয়ে রিয়াও আমাকে ওয়াকার নিতে বলেছে, বাসবী দরজা বন্ধ করতে করতে বলেছিল।

—আপাতত আমার হাতে ভর দিয়ে ভেতরে চলুন আপনি, প্রকাশ বলল হাত বাড়িয়ে দিয়ে দীর্ঘকায়, সুদর্শন যুবকটি বয়সে অন্তত দশ বছরের ছোটো হবে ওর থেকে কাজেই বাসবী বিনা দ্বিধায়, অসংকোচে প্রকাশের হাতে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে এসে বসল সোফায়।

—সেদিন আপনি খুব বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছেন আমাকে মিস্টার প্রকাশ।

—যখন বয়সে আপনার থেকে ছোটোই, তখন আমাকে নাম ধরে তুমি বলে সম্বোধন করলে খুশি হব।

বাসবী হেসে বলল, আচ্ছা তাই করব আমি। সেদিন তুমি এসে আমাকে রাস্তা থেকে না তুললে পেছন থেকে কোনও গাড়ি বা ভ্যান এসে যদি…

—আরে না না, অতটা ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি। লোকজন তো জমেই গিয়েছিল আপনার চারপাশে, কেউ না কেউ ঠিক এগিয়ে আসত আপনাকে তুলে নিতে।

বাসবী ভ্রূ কুঁচকে বলল, বুঝতে পাচ্ছি তুমি দিল্লির ছেলে নও। এখানকার লোকজন কারও আপদ-বিপদে সহজে এগোতে চায় না। পকেটমার, ছিনতাইবাজ কাজ করে চলে যায় কিন্তু চ্যাঁচামেচি করলেও সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসে না। তা কোথাকার ছেলে তুমি বলো তো?

—আমার বাড়ি বেনারস। পড়াশোনা করেছি এলাহাবাদ আর বেঙ্গালুরুতে। চাকরি নিয়ে গুরুগ্রামে এসেছি ছমাস হল।

—খুব ভালো। বসো প্রকাশ, তোমার জন্য চা করে আনছি আমি।

—মাফ করবেন, এই ভরদুপুরে চা খাব না। আপনার দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছে?

বাসবী ভাবল হ্যাঁ বলবে, কিন্তু তারপর ওর মনে হল যে-লোকটা ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে তাকে মিথ্যে বলবে না। আমার ঝি উমা খিচুড়ি রেঁধে রেখে গেছে আমার জন্য। তোমার যদি আপত্তি না থাকে একটু খিচুড়ি খেয়ে নাও আমার সঙ্গে।

প্রকাশ প্রথমে না না করলেও শেষ পর্যন্ত বাসবীর অনুরোধে খিচুড়ি খেতে বসে গেল ওর সঙ্গে।

—আগে থেকে জানিয়ে এলে তোমাকে এর থেকে ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারতাম, বাসবী বলল খেতে খেতে। রাজমা-চাওল কিংবা পুরি-সবজি। তা এদিকে কোথায় এসেছিলে তুমি?

প্রকাশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কেন আপনাকে দেখতে আসতে পারি না আমি? আজ তো শনিবার, আমার অফিস ছুটি।

—কী কাজ করো তুমি, প্রকাশ?

—আমি ইঞ্জিনিয়র, একটা আইটি কোম্পানিতে কাজ করি।

—খুব ভালো। আমার মেয়ে রিয়ার সঙ্গে তোমার কখনও আলাপ করিয়ে দেব। ও দুসপ্তাহ আগে পুণেতে গেছে কম্পিউটার সাযে্সে বিটেক কোর্স করতে। আমার মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভালো। বারো ক্লাসের পরীক্ষায় সাতানব্বুই পারসেন্ট পেয়েছে সাযে্সে। জযে্ট এন্ট্রান্সেও ভালো রেজাল্ট করেছে। বাসবী সস্নেহে তাকাল দেয়ালে টাঙানো, ফ্রেমে বাঁধানো, মা-মেয়ে যুগল ছবির দিকে। গালে গাল লাগিয়ে ওরা যেভাবে হাসছে তাতে ওদের মা মেয়ে নয়, দুই বোন বা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

—আপনার সঙ্গে আপনার মেয়ে বয়সের তফাত খুব কম মনে হচ্ছে এই ছবিতে, প্রকাশ বলল ছবির দিকে চোখ রেখেই।

—ঠিকই বলেছ তুমি, ও আমার থেকে ঠিক সতেরো বছরের ছোটো। আমরা এখন বন্ধুর মতোই হয়ে গেছি।

খাওয়া হয়ে গেলে বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ওরা এসে বসল সোফায়। একটু পরে প্রকাশ বলল, এখন আপনি বিশ্রাম করুন, আমি উঠি। সামনের বার এসে আপনাকে যেন ওয়াকার নিয়ে হাঁটছেন দেখতে পাই।

—নিশ্চয়ই দেখবে, কিন্তু তোমার সামনের বার কতদিন পরে আসবে সেটা তো বললে না?

প্রকাশ হেসে বলল, শনি-রোববার ছাড়া তো আমার আসা হবে না।

—এবার দয়া করে একটা ফোন করে এসো, যাতে তোমাকে আবার খিচুড়ি খেতে না হয়। আমার ফোন নাম্বারটা সেভ করে নাও তোমার মোবাইলে।

একটু পরে প্রকাশের হাতে ভর দিয়ে বাসবী দরজায় পৌঁছেছিল ওকে বিদায় জানাতে। কিন্তু দরজার ছিটকিনি না খুলে বাসবীর মুখটা দুহাতের মধ্যে নিয়ে ওকে স্তম্ভিত করে দিয়ে প্রকাশ চুমু খেল! বাসবী প্রথম ভেবেছিল প্রকাশ ওর সঙ্গে বেয়াড়া ঠাট্টা করছে, কিন্তু প্রকাশের উত্তপ্ত ঠোঁট ওর ঠোঁটের উপর চেপে রইল পুরো এক মিনিট কিংবা তারও বেশি সময়। তারপর মুখ তুলে বাসবীর দুই গালে চুমু খেয়ে নরম গলায় ও বলেছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, বাসবী।

দরজা খুলে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ও নীচে চলে গেল আর হতভম্ব বাসবী পাথরের মূর্তির মতো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

দুই

দুর্ঘটনার পর কীভাবে প্রকাশ ওকে রাস্তা থেকে তুলে নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিত্সা করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ রিয়াকে পরের দিনই জানিয়েছিল বাসবী। সেদিন সন্ধ্যার দিকে মায়ের শরীর কেমন আছে ফোনে জানতে চাইলে বাসবী মেয়েকে জানাল, প্রকাশ আজ ওকে দেখতে এসেছিল। খুব ভালো ছেলেটা, বলল বাসবী হালকা ভাবেই।

—হি ইজ আ গুড সামারিটান, মম। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি খুব আনন্দে রয়ে আজ, রিয়া বলল। প্রকাশ কি খুব হ্যান্ডসাম মম?

—তা বলতে পারিস। বেনারসের ছেলে, একটু বাউন্ডুলে টাইপের নইলে এভাবে না জানিয়ে ভরদুপুরে এসে হাজির হয়? আমি ভাবলাম খেয়েটেয়ে এসেছে, তাই চা অফার করলাম। চা না খেয়ে ছেলেটা শেষে আমার সঙ্গে বসে খিচুড়ি খেল।

—ভালোই তো, হ্যান্ডসাম গুড সামারিটানের সঙ্গে বসে খিচুড়ি খাওয়ার ভাগ্য কজনার হয় বলো?

—ধ্যাৎ, কী যে বলিস তুই। পাগলাটে টাইপের ছেলে ও, কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। প্রকাশ যে ওকে চুমু খেয়েছে সে খবরটা মেয়েকে জানাবার সাহস হল না বাসবীর। প্রকাশ যদি সত্যিই খেয়ালের বশে ওকে চুমু খেয়ে থাকে আর দুএকবার ওর খবরাখবর নিয়ে এখানে আসা বন্ধ করে দেয়? রিয়া জানতে পারলে মাকে ত্রিশোর্ধ মহিলাদের নতুন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, সে ব্যাপারে জ্ঞান দিতে শুরু করবে।

—পা কেমন আছে তোমার? রিয়া জিজ্ঞেস করল।

—ব্যথাটা চলে গেছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মতো ক্যালসিয়াম খেয়ে যাচ্ছি। ওয়াকার নিয়ে চলাফেরা করছি না বলে প্রকাশ খুব বকাবকি করে গেল।

—ঠিকই করেছে, আমি তো প্রথম দিনই বলেছিলাম তোমাকে। তা আমার কথা শুনলে তো! ওয়াকার না ইউজ করলে পায়ে পাতার উপর জোর পড়বে, হাড় জোড়া লাগতে সময় লাগবে।

—ঠিক আছে, ওয়াকার কিনে নেব আমি। কাল পাশের বাড়ির সুনীতাকে নিয়ে নার্সিংহোমে যাব কপালের স্টিচ কাটতে। এবার তোর খবর বল। কলেজ, হস্টেল সব ঠিক আছে তো?

রিয়া জানাল, ওর কলেজের ফ্যাকাল্টি খুব ভালো, প্রশ্ন করলে বিরক্ত হয় না। হস্টেলে ওর রুমমেট অঙ্কিতা খুব শান্ত, পড়ুয়া মেয়ে একটু ধার্মিক টাইপের, সকালে উঠে হনুমান চল্লিশা পড়ে, বৃহস্পতিবার সাঁইবাবার মন্দিরে যায়। ওর বাড়ি লখ্নউ-এ। হস্টেলের খাবারদাবার এ ক্লাস না হলেও মোটামুটি ভালো, টলারেব্ল বলা চলে। গতকাল ফ্রেশারদের জন্য যে-পার্টি দিয়েছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ, তাতে রিয়া রং দে বাসন্তী গেয়ে খুব তালি পেয়েছে। পুণেতে গিয়ে রিয়া ওর কলেজ লাইফ ভালোভাবে উপভোগ করছে শুনে বাসবী নিশ্চিন্ত হল।

মেয়ে সঙ্গে কথা শেষ করে বাসবী এসে ওর শোবার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ছত্রিশ বছর বয়সে বাসবী এখনও সুন্দরী, এমনকী রিয়ার ভাষায় ওকে সেক্সিও বলা চলে। গায়ে রং একটু চাপা আর মাঝারি উচ্চতার হলেও ওর বড়ো বড়ো প্রতিমার মতো টানা চোখ, ডিম্বাকৃতি মুখের গড়ন, পুরু ঠোঁট (রিয়ার ভাষায় বি স্টাংগ লিপ্স) আর লম্বা, ঘন, কালো চুল এখনও আকৃষ্ট করতে পারে প্রকাশের মতো অনেক কম বয়সি ছেলেকে। রসগোল্লা খেয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনে দিল্লির বাঙালি কলোনি চিত্তরঞ্জন পার্কে বড়ো হওয়া বাসবী এখন দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব দিল্লির পাণ্ডব নগরের বাসিন্দা।

মুখের উপর এসে পড়া চুল সরিয়ে দিয়ে আয়নায় হাসল বাসবী। কী দেখল প্রকাশ ওর মধ্যে যে দ্বিতীয়বার দেখা হতেই ওর এই অসুস্থ অবস্থায় চুমু খেয়ে বসল ওকে? পুরুষ মানুষকে সব সময় চেনা যায় না, বোঝা যায় না। লম্বা একটা শ্বাস নিল বাসবী। প্রকাশ এক আচেনা, আগন্তুক, আমাকে সাবধানে থাকতে হবে, বাসবী নিজেকে বোঝাল। কে জানে বেনারসের এই সুদর্শন ছেলেটি ওর সঙ্গে ভাব করে হয়তো শুধু উপভোগ করতে চায় তার শরীর, ওর সেবার বিনিময়ে যদি সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায় তবে ওকে স্পষ্ট ভাবে না করে দিতে হবে।

মনস্থির করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসবী চলে গেল রান্নাঘরে এক কাপ চা করতে। না, কাল সুনীতার সঙ্গে বেরিয়ে নার্সিংহোম থেকে ফেরার পথে একটা ওয়াকার কিনতে হবে। না হলে হুট করে প্রকাশ যদি আবার এসে পড়ে কোনওদিন তাহলে, গালমন্দ শুনতে হবে তাকে।

তিন

পরের শনিবার সন্ধের দিকে প্রকাশ আবার এসে হাজির হল ফোন না করেই। বাসবী ওয়াকার ব্যবহার করছে দেখে ও খুশি হল, আরও খুশি হল ওর মাথার স্টিচ খুলে ফেলা হয়েছে দেখে।

—আজ তোমার কপাল ভালো প্রকাশ, বাসবী বলল সোফায় বসে। আমার ঝি ঊমা বিকেলে এসে সুজির হালুয়া করে দিয়ে গেছে, চায়ের সঙ্গে ওটাই দেব তোমাকে।

—কিন্তু ভাঙা পায়ে ভর দিয়ে তোমাকে আমার জন্য চা করতে হবে না, প্রকাশ বলল। প্রকাশ যে ওকে তুমি সম্বোধন করেছে তাতে আর আশ্চর্য হল না বাসবী।

—চা করতে কোনও অসুবিধা হবে না আমার, বলল বাসবী। ওয়াকার নিয়ে এখন আমি দিব্বি চলাফেরা করতে পারি।

—চলো রান্নাঘরে গিয়ে তোমায় সাহায্য করি আমি।

প্রস্তাবটা সরাসরি নাকচ করে দিতে চাইল না বাসবী। তাই বলল, সবতো হাতের কাছেই আছে, কী দরকার তোমার?

কিন্তু প্রকাশ ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গেছে, কাজেই ও যখন কেটলিতে জল ভরে, উপরের তাক থেকে চায়ের কাপ, ছাঁকনি ইত্যাদি এগিয়ে দিল, বাসবী কোনও বাধা দিল না। চায়ের জল যখন ফুটতে আরম্ভ করেছে ঠিক তখনই প্রকাশ ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খেল আর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল সেই যাদু মাখানো, হৃদয় দ্রবিভত করা তিনটে শব্দ— আমি তোমাকে ভালোবাসি।

প্রকাশ যখন ওর সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকল বাসবী তো তখনই জানত, প্রকাশ ওকে চুমু খাবে! তবু ওর হাত কাঁপল, নিশ্বাস ঘন হয়ে এল। আমাকে চা-টা করতে দাও প্রকাশ, ও কাঁপা গলায় বলল।

উত্তরে নব ঘুরিয়ে গ্যাসের উনুন বন্ধ করে দিয়ে প্রকাশ বলল, চা পরে খাওয়া যাবে।

ওরা দুজন যখন গভীর আবেগে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিল ঠিক তখনই বেল বাজল দরজায়। পাশের বাড়ির সুনীতা এসেছে, আঁচল দিয়ে ঠোঁট মুছে ফিসফিস করে বলল বাসবী। তুমি আমার মেয়ে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকো যতক্ষণ না ও চলে যায়।

কিন্তু সে রাতে সুনীতা গল্পগাছা সেরে যখন উঠল তখন রাত সোয়া আটটা। ততক্ষণে রিয়ার বিছানায় শুয়ে প্রকাশ ম্যাগাজিনের পুরোনো একটা সংখ্যা নাড়াচাড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসবী এসে যখন ওকে জাগিয়ে তুলে সুনীতার দেওয়া পুরির সঙ্গে হালুয়া খেতে দিল তখন নতুন করে প্রেমপর্ব শুরু করার উত্সাহ হারিয়ে ফেলেছে ওরা দুজনেই।

সে রাতে বিছানায় শুয়ে বাসবীর মনে হল, প্রকাশকে ওর পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল নতুন করে প্রেমে পড়ার বয়স ও পেরিয়ে এসেছে। শরীরের একটা নিজস্ব দাবি আছে যেটা অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই বাসবীর কিন্তু সেটা মেটাতে গিয়ে নতুন ভাবে কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে চায় না ও। নতুন সম্পর্ক মানেই নতুন আবেগ আর আবেগ মানুষকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার কোনও ঠিকানা নেই। নাহলে মাত্র ষোলো বছর বয়সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবার আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ওর বাবার অফিসের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক, পাঞ্জাবি ছেলে রোহিত খন্নার সঙ্গে কালকাজি মন্দিরে গিয়ে মালা বদল করতে পারত না বাসবী।

বিয়েটা ওদের টিকেছিল ঠিক দেড় বছর কারণ ওই সময়ে মধ্যেই মেধাবী এবং পরিশ্রমী ছেলে রোহিত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভালো সরকারি চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। পরিবারের গুঁতোয় আর পাঁচ কোটি টাকা পণের লোভে রোহিত লুধিয়ানার এক ধনী পরিবারের মেয়ে নেহাকে বিয়ে করে ফেলল। আর আঠারো বছর বয়সে ছমাসের মেয়ে কোলে নিয়ে পাণ্ডব নগরের দুকামরার ভাড়া বাড়িতে এসে উঠতে হয়েছিল বাসবীকে।

বাসবীর বাবা রণেন বোস কোর্টে কেস ঠুকে দিলে রোহন শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব নগরের এই পাঁচশ পঞ্চাশ স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট, দুকামরার ফ্ল্যাট আর মেয়ে ভরণপোষণ এবং শিক্ষার জন্য কুড়ি লাখ টাকা বাসবীর অ্যাকাউন্টে জমা করে ডিভোর্সের পেপারে সই করায় ওকে দিয়ে।

মেয়ে দশ বছরে পড়লে বাসবী ওকে সব কথা জানিয়ে দিয়েছিল কেন না একটু বড়ো হবার পর থেকেই রিয়া ওকে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল। সব শুনে ওই বয়সেই বুদ্ধিমতী রিয়া মাকে বলেছিল, তোমার বয়স কম, দেখতেও তুমি খারাপ নও। তুমি আবার বিয়ে করো, মম।

বাসবী হেসে বলেছিল, না রে, আমি বিয়ে টিয়ে করব না। আমি তোকে নিয়ে খুব ভালো আছি।

কয়েক বছর পর আরেকটু বড়ো হলে বাসবী মেয়েকে বলেছিল, সাবধান রিয়া, আমার মতো অল্প বয়সে প্রেমে পড়ে জীবনটা নষ্ট করবি না তুই। নিজের পায়ে ভালো ভাবে দাঁড়িয়ে তবেই বিয়ে কথা ভাববি।

তা রিয়া তো মার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। উনিশ বছরের মেয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও ছেলেকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। কিন্তু মা হয়ে বাসবী কি সেই ভুলটাই করতে বসল দ্বিতীয় বার?

পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ রিয়া ফোন করলে বাসবী বলল, তোকে একটা কথা বলার ছিল রিয়া।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মোবাইলের স্পিকার অন করে রিয়া বলল, ভালো না খারাপ কথা সেটা আগে বলে দাও মম।

—সেটা নির্ভর করছে তুই কীভাবে নিবি আমার কথাটা তার উপর। আমার মনে হচ্ছে আমি প্রেমে পড়ে গেছি।

রিয়া চট করে ওর প্রতিক্রিয়া জানাল না। সম্ভবত খবরটা ভালো ভাবে হজম করতে একটু সময় নিল ও, তারপর বলল, তুমি ঠাট্টা করছ না তো মম? তা কার প্রেমে পড়লে তুমি? প্রকাশ?

—হ্যাঁ। বয়সে আমার থেকে বছর দশেকের ছোটো হবে ও।

—সেটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু ও যে তোমাকে সত্যি ভালোবাসে সেটা তোমার জানা দরকার।

—বার বার বাড়ি আসছে আর…

—তোমাকে চুমু খেয়েছে, তাই না?

—কী করব বল? রান্নাঘরে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরে…

—ঘুরে দাঁড়িয়ে কষে একটা থাপ্পড় মারলে না কেন?

—কী করে থাপ্পড় মারব ওকে? ও যে আমার জীবন বাঁচিয়েছে, আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নার্সিংহোমে চিকিত্সা করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে।

—সত্যিকার গুড সামারিটানরা কিন্তু সাহায্যপ্রার্থীকে প্রেম নিবেদন করে না, মম। ওর যে আর কোনও প্রেমিকা নেই বা ও যে বিবাহিত নয় সেটা জানার প্রযোজন বোধ করলে না তুমি? কী আশ্চর্য! ও যে তোমার সঙ্গে দুদিন ফুর্তি করে কেটে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী?

—ওকে এসব কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। এখন কী করব তুই বল আমাকে।

—ও তোমাকে বিছানায় নিয়ে যায়নি তো?

—না, আর চাইলেও আমি রাজি হব না।

—গুড। সিচুযেন এখনও তোমার কন্ট্রোলেই আছে। ও আবার এসে চুমু খেতে চাইলে বা প্রেম নিবেদন করলে ওকে স্পষ্ট বলে দিও তুমি ওর আন্টির বয়সি, কাজেই তোমাকে ও যেন আন্টি বলেই ডাকে আর আন্টির সন্মান দেয়। ওকে সোজাসুজি বলবে ও যেন ওর নিজের বয়সি কোনও মেয়ে খুঁজে নেয় প্রেম ভালোবাসার জন্য।

—ঠিক আছে, তুই যেরকম বললি সে রকমটাই করব আমি।

—গুড গার্ল। যা বললাম তাই করবে। কলেজের সময় হয়ে গেছে, আমাকে এখন ছুটতে হবে। বাই মম।

চার

সাতদিন পর রোববার সকালে প্রকাশ এসে বলল, আমাকে কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে, বাসবী।

রিয়ার উপদেশ মনে ছিল বাসবীর, তবু কেন ওর বুকের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেল ও বুঝতে পারল না।

—কোথায় যাচ্ছ তুমি?

—সিয়াটেল, ইউএসএ। ছমাসের ট্রেনিং হবে ওখানে।

—খুব ভালো। মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করল বাসবী। নতুন দেশ দেখবে, চাকরিতে আরও উন্নতি হবে।

—কিন্তু তোমাকে তো ওখানে দেখতে পাব না।

—আমি তো তোমার আন্টির বয়সি প্রকাশ। আমার বয়স কত জান তুমি? চল্লিশে পা রেখেছি আমি। নিজের বয়সটা চার বছর বাড়িয়ে প্রকাশকে ওর থেকে দূরে সরে যাবার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিল বাসবী। তারপর বলল, আমাকে তুমি আন্টি বলে ডাকলেই খুশি হব আমি।

—নেভার! আমি তোমাকে ভালোবাসি, বাসবী।

—কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না, বলতে গিয়ে বলতে পারল না বাসবী। নিজের বয়সি কোনও মেয়েকে তুমি খুঁজে নাও প্রকাশ, বাসবী বলল রিয়ার উপদেশ মনে রেখে।

আর ঠিক তখনই প্রকাশ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল প্রবল আবেগে, বাসবীর শ্বাস রোধ করে। দুমিনিট পর ওর ঠোঁট থেকে মুখ তুলে নিয়ে প্রকাশ বলল, আমার ভালোবাসার কী প্রমাণ চাও তুমি আমার কাছ থেকে, বলো?

—ছ’মাস পর আমেরিকা থেকে ফিরে এলে এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলব আমি, বাসবী বলল ওর চোখে চোখ রেখে। বাসবী জানে ছ মাসের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে দুজনের জীবনে। বিদেশে গিয়ে প্রকাশ কোনও অল্প বয়সি, সুন্দরী মেয়ে সংস্পর্শে এসে ওকে ভুলে যেতে পারে।

—ঠিক আছে, তাই হবে। কিন্তু ছমাস পর ফিরে এলে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না তুমি। তুমি হয়তো জানো না তোমাকে রাস্তা থেকে কোলে তুলে নেবার সময়-ই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি আমি। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছ।

বাসবী মুখ ফিরিয়ে নিল কেন না ওর চোখে জল এসে গিয়েছিল। ভাগ্যের এ কী বিড়াম্বনা? প্রকাশ যদি দশ বছর আগে আসত ওর জীবনে তাহলে ওকে বিয়ে করতে কোনওই অসুবিধা ছিল না বাসবীর। এমনকী রিয়াও কোনও বাধা দিত না ওদের বিয়েতে।

বাসবীর অনুরোধ সত্ত্বেও প্রকাশ চা খেতে রাজি হল না সেদিন। ও বলল বাইরে যাবার জন্য ওকে কিছু কেনাকাটি করতে হবে আর দেখা করতে হবে কয়েকজন কলিগের সঙ্গে। যাবার আগে শুধু এটুকুই জানিয়ে গেল প্রকাশ যে আমেরিকায় গিয়ে বাসবীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখবে ও।

সন্ধ্যার দিকে রিয়া ফোন করলে বাসবী জানাল প্রকাশ অধ্যায়ে যবনিকা টেনে দিয়েছে ও কোনওরকম ঝগড়াঝাঁটি না করেই। প্রকাশ যে ট্রেনিং নিতে আমেরিকার সিয়াটেলে চলে যাচ্ছে তাও জানাল রিয়াকে।

—ভেরি গুড মম। ইউ হ্যাভ ডান দ্য রাইট থিং। ছমাসের মধ্যে ও ওর পার্টনার ঠিক পেয়ে যাবে, হয়তো সুযোগ পেলে আমেরিকায় ও সেটল করে যাবে। ওখানের কোনও মেয়েকে বিয়ে করলে গ্রিন কার্ড পেতেও সুবিধা হবে ওর।

—ওখানে গিয়ে ও আমাকে ফোন করবে বলে বলেছে। ভাবছি ওর ফোন এলে আমি তুলব না, কী বলিস তুই?

—নো মম, ডোন্ট বি সিলি। আফটার অল হি ইজ আ গুড সামারিটান। ফোন করলে কথা বলবে জাস্ট অ্যাজ আ ওয়ে উইশিং আন্টি।

—কিন্তু আন্টি বললে ও যে খুব রেগে যায়।

—ওকে, ওকে, দেন ট্রিট হিম অ্যাজ আ ফ্রেন্ড, অ্যাজ আ গুড সামারিটান। গুড সামারিটানদের ডিসকারেজ করতে নেই কারণ ওদের সংখ্যা কমে আসছে পৃথিবীতে।

রিয়ার সঙ্গে কথা বলে মন হালকা হয়ে গেল বাসবীর। ঈশ্বরের ইচ্ছায়-ই প্রকাশ দূরে সরে যাচ্ছে যাতে ওর সঙ্গে সম্পর্কটা দানা বাঁধতে না পারে, ভাবল বাসবী স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে

পাঁচ

প্রথম সপ্তাহটা ভয়ে ভয়ে কাটল বাসবীর প্রকাশের ফোন আসবে ভেবে। রিয়া যতই বলুক একটা জোয়ান, শক্ত-সমর্থ ছেলে যে ওকে কোলে তুলেছে, ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে বেশ কয়েকবার, তাকে প্রেমিকের সিংহাসন থেকে নামিয়ে বন্ধুত্বের নড়বড়ে চেয়ারে বসানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনমাস পরেও প্রকাশের ফোন না আসায় বাসবীর সেই সমস্যাটা মিটে গেল।

রিয়া শুনে বলল, মম, আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম ও ওর পার্টনার জোগাড় করে নেবে। সিয়াটেল তো আইটি হাব, বেশ কয়েক হাজার ইন্ডিয়ান থাকে ওখানে। আচ্ছা শোনো, ক্রিসমাস ভ্যাকেশনে আসছি আমি পাঁচদিনের জন্য। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।

—আমারও তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কথা বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল বাসবীর। প্রায় ছমাস মেয়েকে দেখেনি ও।

ক্রিসমাসের ছুটিতে রিয়া এলে পাঁচটা দিন মা আর মেয়ে খুব আনন্দে কাটাল। ওরা দুজন তো বন্ধুর মতোই ছিল আগে থেকে। এখন ছমাস দূরে থাকার পর সেই বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়েছে। একসঙ্গে মলে যাওয়া, সিনেমা দেখা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া… দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কীভাবে উড়ে চলে গেল টেরও পেল না ওরা।

বাসবী বাঙালি রান্নাবান্না শেখবার তেমন সুযোগ পায়নি, তবু বাংলা চ্যানেলে রান্নার রেসিপি দেখে নিয়ে রিয়ার পুণে ফিরে যাবার আগের দিন শুক্তোনি আর মোচার ঘন্ট করে খাওয়াল মেয়েকে।

রিয়া চলে যাবার দুসপ্তাহ পর বাসবী যখন ধীরে ধীরে ওর একক জীবনে আবার অভ্যস্ত হয়ে উঠছে তখনই ফোন এল প্রকাশের। সকাল দশটার দিকে এল ফোনটা, আমেরিকায় তখন প্রায় রাত বারোটা। ফোন ধরে হ্যালো বললে ওপাশ থেকে প্রকাশ জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন আপনি আন্টি?

প্রকাশের মুখে এই প্রথম আন্টি ডাক শুনে বাসবী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। ঢোক গিলে কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছো প্রকাশ?

—আমিও খুব ভালো আছি আন্টি। অনেকদিন আপনাকে ফোন করব ভেবেছি, কিন্তু ঠিক সাহস করে উঠতে পারিনি। তা আপনার পা ঠিক আছে এখন?

—হ্যাঁ, চলতে ফিরতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

—খুব ভালো। আপনার মেয়ে রিয়া কেমন আছে?

রিয়ার নাম শুনে খুশি হয়ে বাসবী বলল, ক্রিসমাসের ছুটিতে ও এখানে এসেছিল। দুজনে মিলে খুব ঘোরাঘুরি করেছি, সিনেমা দেখেছি, রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। ও তো এখন আমার বন্ধুই!

—তা তো বুঝতেই পারছি। আমার দুঃখটা কী জানেন আন্টি, বয়সে অনেক ছোটো মেয়েকে বন্ধু করতে আপনার কোনও বাধা নেই কিন্তু কম বয়সি কাউকে নিজের প্রেমিক হিসেবে মেনে নিতে আপনার ঘোর আপত্তি আছে। এই ডাব্ল স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে জীবন কাটাতে আপনার যে-কোনও অসুবিধা হচ্ছে না সেটাই খুব আশ্চর্য লাগছে আমার!

বাসবী বুঝল প্রকাশ ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বসেছে। অপ্রস্তুত হয়ে ও বলল, এসব কথা এখন থাক না প্রকাশ। তোমার ওখানে কেমন সময় কাটছে বলো।

—দিনটা কীভাবে কেটে যায় টের পাই না কারণ ট্রেনিং-এ বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। রাত কাটানোই একটু কষ্টকর।

—ওখানে কোনও বন্ধুবান্ধব নেই তোমার?

—আছে বইকি তবে বন্ধু তো বন্ধুর-ই কাজ করতে পারে। কিন্তু তার বাইরেও তো একটা জীবন আছে।

প্রকাশের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বাসবী বলল, তা বান্ধবী জুটিয়ে নাও না কেন? রিয়া বলল তোমার ওখানে হাজার হাজার ভারতীয় আছে।

—তা আছে কিন্তু আমার তো বান্ধবীর প্রযোজন নেই, আমার আপনার মতো একজন সুন্দরী আন্টির প্রযোজন। নিজের অজান্তেই বাসবী খিল খিল করে হেসে উঠল।

—তুমি তো গুড সামারিটান, পরোপকারী। বাইরে বেরোলে রাস্তাঘাটের দিকে নজর রেখো। কখনও কোন সুন্দরী ভারতীয় বা আমেরিকান আন্টি দুর্ঘটনাগ্রস্ত দেখলে এগিয়ে যাবে।

—কিন্তু এখানে তো অটো নেই আন্টি আর যে স্পিডে গাড়ি চলে এখানে, তাতে অ্যাক্সিডেন্ট হলে গুড সামারিটানরা অ্যামবুলেন্স ডেকে আন্টিকে সোজা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। যাক জেনে খুশি হলাম আন্টি আপনি বহাল তবিয়তেই আছেন আর আপনার মেয়েকাম-বন্ধু…

বাসবী আর সহ্য করতে পারল না। বার বার আন্টি ডাকটা একটা বিশ্রী ঠাট্টার মতো কানে বিঁধছিল ওর। প্লিজ প্রকাশ আমাকে আর আন্টি ডাকতে হবে না তোমাকে।

—তাহলে কী ডাকব আপনাকে, ম্যাডাম?

—আগে যা ডাকতে তাই ডেকো।

—বাসবী ডার্লিং!

—প্রথমটাই যথেষ্ট নয় কি?

—অলরাইট। থ্যাংক ইউ সো-ও-ও মাচ, বেবি।

বাসবী আরেকবার খিল খিল করে হাসল। সত্যিই তো, সতেরো বছরের ছোটো মেয়ে যদি বন্ধু হতে পারে, তবে দশ বছরের ছোটো প্রকাশ প্রেমিক হতে বাধা কোথায়?

রিয়ার সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক করবে বাসবী আর ও জানে এবার ওর স্মার্ট, বিদুষী মেয়ে ওর কাছে হেরে যাবে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব