মুখোশ (দ্বিতীয় পর্ব)

কয়েক ঘন্টা পর সমর এসে ওকে বাড়ি নিয়ে গেল। বাড়ি পৌঁছোবার পর সন্ধেবেলায় সমর সঞ্চিতাকে শুধু এটুকুই বলল যে, ও এখন বাচ্চার দায়িত্ব নিতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। ওর এখন অনেক কাজ বাকি রয়েছে। ও যদি সঞ্চিতাকে গর্ভপাত করাবার কথা বলত, তাহলে হয়তো ও রাজি হতো না। তাই বাধ্য হয়ে সমরকে এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।

সবকিছু শোনার পর নিজের মনে গুমরে মরা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা ওর কাছে খোলা নেই— সেটা খুব ভালো করেই বুঝে নিয়েছিল সঞ্চিতা। সমরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। এতদিন সমরের প্রতি যে-সম্মান, ভালোবাসা সঞ্চিতার হৃদয়কে ঘিরে রেখেছিল— সেখানে জায়গা হল ঘৃণা, তিরস্কারের। কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ে থেকে সমরের বিরুদ্ধতা করা উচিত মনে করল না সঞ্চিতা। কারণ এখানে ও কাউকেই চেনে না, যে ওর পক্ষ নেবে। এখানে না কোনও বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা চেনা-পরিচিত— কার সঙ্গে ও মনের দুঃখ শেয়ার করবে?

একদিন দুপুরে বনানী পিসির ফোন এল সঞ্চিতার কাছে। পিসির কাছ থেকেই সঞ্চিতা জানতে পারল— গত পনেরো দিনে সমর বনানী পিসিকে তিনবার ফোন করেছে। প্রতিবারই নাকি পঁচিশ লক্ষ টাকা বনানীকে পাঠাতে বলেছে সমর ওর আমেরিকার অ্যাকাউন্টে। ও পিসিকে বলেছে, ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে এবং এই টাকা দিয়ে নিজের ব্যাবসা শুরু করবে। তাই টাকাটা ওর খুব প্রয়োজন।

সমরের হাবভাবে বনানীর সন্দেহ হওয়াতে সঞ্চিতাকে ফোন করে তিনি নিশ্চিত হতে চাইছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সঞ্চিতা কিছু জানতই না বরং মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সঞ্চিতার গর্ভপাত ঘটানোর কথা সঞ্চিতা পিসিকে জানালে— বনানী সমরের ব্যবহারে মানসিক ভাবে খুবই মুষড়ে পড়লেন।

সঞ্চিতা সমরকে ভয় পেতে আরম্ভ করল। সমর সম্পর্কে সমস্ত সত্যটা ধীরে ধীরে সঞ্চিতার সামনে আসতে আরম্ভ করল। বিদেশে সমরের শত্রুতা করার সাহস ছিল না সঞ্চিতার— আর দেশে মা-বাবাকে জানিয়ে তাদের চিন্তিত করে তুলতে কিছুতেই মন চাইছিল না তার।

বাড়িতেও আর সময় কাটছিল না সঞ্চিতার। ভাগ্যের কাছে পরাজিত সঞ্চিতা একদিন বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিল। পত্রিকাটি আমেরিকার হলেও আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্যই মূলতঃ পত্রিকাটি বার হতো। একটা খবরের দিকে দৃষ্টি পড়তে সঞ্চিতার চোখ সেখানে আটকে গেল।

প্রণতি নামের একজন ক্রাইম রিপোর্টার কীভাবে নিজের সাহস এবং বুদ্ধির জোরে একটি বড়ো সেক্স র‌্যাকেটের পর্দা ফাঁস করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের বেশ কিছু প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, প্রমাণ-সহ আইনের চোখে তাদের সে দোষী সাব্যস্ত করে ছেড়েছে— তার সম্পূর্ণ বিস্তারিত খবর ‘দ্য ট্রুথ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।

খবরটা তিন-চারবার পড়ল সঞ্চিতা। আশার একটা আলো দেখতে পেল সে। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটির দফতরে ফোন করে প্রণতির ঠিকানা এবং ফোন নম্বর সংগ্রহ করল সে। প্রণতিকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল সঞ্চিতা। কথায় কথায় জানতে পারল প্রণতি ওর স্কুলেরই মেয়ে ওর থেকে দুবছরের সিনিয়র ছিল। তার বাবা চাকরি নিয়ে আমেরিকা চলে আসাতে ওদের পরিবার আমেরিকায় পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে।

প্রণতি নিজের বাড়িতেই আসতে বলল সঞ্চিতাকে। আমেরিকাতেও সঞ্চিতার নিজের বলতে কেউ আছে, এটা ভেবেই সঞ্চিতার মন অনেকটা হালকা বোধ হল। প্রণতির সঙ্গে দেখা করে ওর সঙ্গে যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল। এমনকী পিসির কাছে পঁচিশ লক্ষ টাকা সমর চেয়েছে, এটা জানাতেও ভুলল না।

প্রণতিও মন দিয়ে সব শুনল। প্রায় দুঘন্টা ধরে ওদের কথাবার্তা চলল। প্রণতি কথা দিল, ও সমর সম্পর্কে সবকিছু অনুসন্ধান করে সঞ্চিতার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। নিশ্চিন্ত মনে সঞ্চিতা বাড়ি ফিরে এল।

সেদিন সারারাত সমর বাড়ি ফিরল না। ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে, সঞ্চিতার কখন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল ও নিজেই বুঝতে পারেনি। বহুবার ফোন করার পরেও কোনও রিপ্লাই না আসাতে, সঞ্চিতাও খোঁজ করা বৃথা চেষ্টা, ভেবে হাল ছেড়ে দিল। পরের দিন দুপুরে সমর বাড়ি ফিরল। ও কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল না। এক সপ্তাহর বেশি সময় পেরিয়ে গেল। রাতে বাড়ি না ফেরাটা প্রায়শই হতে লাগল সমরের। ফেরার কোনও ঠিক থাকত না। একবার টানা দুই রাত বাড়ি ফিরল না। জিজ্ঞেস করাও ছেড়ে দিল সঞ্চিতা।

পরের সপ্তাহের শেষের দিকে প্রণতির ফোন এল দেখা করার জন্য। তার আগের রাতেও সমর বাড়ি ফিরল না। সকালে উঠে চা খেয়ে সঞ্চিতা তৈরি হয়ে নিল। ওর অনুপস্থিতিতে সমর বাড়ি ফিরতে পারে, এই ভেবে একটা কাগজে মার্কেট যাচ্ছে লিখে খাবার টেবিলে চাপা দিয়ে রাখল।

প্রণতির বাড়ি পৌঁছোতেই প্রণতি ওকে বসার ঘরে আসার জন্য বলল। সঞ্চিতা সোফায় এসে বসলে প্রণতি বলতে শুরু করল, সঞ্চিতা তুমি আমাকে সমরের অফিস এবং ওর সম্পর্কে যা যা প্রয়োজনীয় তথ্য জানিয়েছিলে, সেই মতন আমি খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। ও একটা খুনের কেসে জড়িয়ে গেছে। গতকাল পুলিশ ওর ডেরায় পৌঁছে ওকে অ্যারেস্ট করেছে। এই কয়েকদিন ও পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, তাই রাতে বাড়ি ফিরত না। ও এখন পুলিশের লক-আপে রয়েছে।

দ্বিতীয়ত ও চাকরি ছাড়েনি বরং কোম্পানি ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। ও অফিসে ভারতীয় মুদ্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা তছরুপ করেছে। বনানী পিসিকেও মিথ্যা বলেছিল। উনি সমরের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতেই ওই টাকা তুলে ও কোম্পানিকে দিয়ে আইনি সাজা পাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে।

 

মুখোশ (প্রথম পর্ব)

বিয়ের পর ভারতীয় মেয়েদের দুরাবস্থার খবর আমাদের আশেপাশে, খবরের কাগজে প্রায়শই চোখে পড়ে, বিশেষ করে পাত্র যদি বিদেশে বসবাসকারী হয়। এর কারণ হচ্ছে মেয়ের পরিবারের লোকজন পাত্রের ঠিকমতো খোঁজখবর না নিয়েই মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান।

নির্মলা পুণাতে থাকে। ওর মা আর ওখানকার মহিলা সমিতির মেম্বার বনানী খুব ভালো বন্ধু, সেই সূত্রে নির্মলার সঙ্গেও বনানী আন্টির ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন কথায় কথায় নির্মলা নিজের মেয়ে সঞ্চিতার বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু করেছে জানাতে, বনানী আন্টি নিজের ভাইপো সমরের কথা বললেন। পাত্র বর্তমানে আমেরিকায় থাকে এবং ওখানে খুব ভালো চাকরি করে। বনানীর কথায় নির্মলা জানতে পারল— সমরের জন্যও পাত্রী সন্ধান করা হচ্ছে।

বাড়িতে স্বামী এবং মেয়েকে সমরের কথা জানাতে, নির্মলার স্বামী একটু ইতস্তত করলেও, সঞ্চিতা কিন্তু বিদেশে থাকা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। ওদিকে বনানীও সমরকে ফোনে সঞ্চিতার ছবি-সহ ওর সম্পর্কে, সবকিছু জানাতে সমরও কথা দিল পাত্রীর সঙ্গে কথা বলে পিসিকে জানিয়ে দেবে। বনানী পাত্র-পাত্রী উভয়কে ভিডিও চ্যাটে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। বেশ কিছুদনি ওরা ফোনে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে সবকিছু ঠিক মনে হতে, নিজের নিজের পরিবারকে জানিয়ে দিল উভয়ে বিয়েতে রাজি আছে।

বিয়ের দিন স্থির হতে সমর এক মাসের ছুটি নিয়ে পুণা এসে পৌঁছোল। সবকিছু আগে থেকে ঠিক করাই ছিল। সমর ও সঞ্চিতার বিয়ে হয়ে গেল। সমরের কোনওরকম খোঁজখবর না নিয়ে সঞ্চিতার মা-বাবা বনানীর উপর ভরসা করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন।

ভরসা করার অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল, শৈশবে এক দুর্ঘটনায় মা-বাবাকে হারিয়ে সমর তার বনানী পিসির কাছেই মানুষ হয়েছিল। অবশ্য টাকা-পয়সার জন্য বনানীকে চিন্তা করতে হয়নি। মা-বাবার অকালে মৃত্যু হওয়াতে ওই শিশু বয়সেই সমর বিপুল সম্পত্তির একমাত্র মালিক হয়ে উঠেছিল। বিধবা নিঃসন্তান বনানী, সমরকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করাতে সমরের বাবার তৈরি ট্রাস্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাতা হিসেবে বনানীকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

অর্থের লোভে বনানী সমরকে দত্তক নিলেও ওকে মানুষ করতে কোনও কার্পণ্য করেননি। ভালো স্কুল থেকে পড়াশোনা করিয়ে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন সমরকে। একুশ বছর বয়সে সম্পত্তির অধিকার সমরের হাতে চলে আসায়, ধীরে ধীরে সমরের স্বভাব পালটাতে থাকে। সে ঠিক করে আমেরিকায় গিয়ে পাকাপাকি বসবাস করবে।

সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবে চাকরি নিয়ে সমর আমেরিকায় পাড়ি জমায় এবং ওখানেই থেকে যাওয়া মনস্থির করে। এত বছর বাদে বিয়ের জন্য দেশে ফিরেও বিয়ে মিটতে না মিটতেই সঞ্চিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় ফিরে আসে ও।

কী করে দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়, নতুন বিয়ের আনন্দে সঞ্চিতা বুঝতেই পারে না। রোজই মনে হতো সমরকে বিয়ে করে সারা বিশ্বের সুখ ওর মনের কোণায় জমা হয়েছে। একদিন হঠাৎ-ই সঞ্চিতা বুঝতে পারে যে, সে মা হতে চলেছে। এর পরেই ঠিক করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে তবে সমরকে জানাবে। ডাক্তার সব রিপোর্ট পজিটিভ জানালে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে সঞ্চিতা। অধীর আগ্রহে সমরের ফেরার অপেক্ষা করতে থাকে সবকিছু সমরকে বলার জন্য।

সন্ধেবেলায় সমর বাড়ি ফিরলে সবথেকে আগে সঞ্চিতা এই আনন্দ সংবাদ সমরকে জানায়। কিন্তু ওর মুখে আনন্দের বদলে অন্যকিছু চোখে পড়াতে সঞ্চিতা ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল। সমরের মুখের এই ভাবান্তর আগে কখনও সঞ্চিতা দেখেনি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সমর নিজেকে সামলে নিল। সঞ্চিতাকে দুই হাতে নিজের কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, আমি তো বিশ্বাস করতেই পারছি না যে আমি বাবা হতে চলেছি। খবরটা শুনে কিছু মুহূর্ত আমার ব্রেন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। তুমি এখন থেকে খুব সাবধানে থাকবে। আমার পরিচিত একজন ভালো গাইনিকোলজিস্ট আছেন, কাল আমি তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব সম্পূর্ণ চেক-আপের জন্য।

পরের দিন সঞ্চিতার যখন চোখ খুলল, দেখল অপরিচিত একটা বিছানায় ও শুয়ে আছে। কোমরের নীচের থেকে একটু ভারী ভারী মনে হচ্ছিল, পেটেও একটা সামান্য ব্যথা ছিল। চারপাশে চোখ বোলাতে মনে হল কোনও হাসপাতালের ঘরে ও শুয়ে আছে। উঠে বসার চেষ্টা করেও শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারল না। সেই মুহূর্তে একজন নার্স দৌড়ে এসে বলল, আপনি আরও খানিক্ষণ বিশ্রাম করুন। তিন ঘন্টা পর আপনি উঠতে পারেন।

হাসপাতালের বিছানায় ও কীভাবে এল জানতে, কাউকে না পেয়ে নার্সকেই জিজ্ঞেস করাতে নার্স একটু অবাক হল। নার্স সঞ্চিতার দিকে একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, আপনি জানেন না আপনার কী হয়েছে? আপনার অ্যাবর্শন হয়েছে।

শুনেই সঞ্চিতার মাথা ঘুরে গেল। ওর মনে পড়ল সমরের সঙ্গে ও হাসপাতালে গাইনিকোলজিস্ট-এর কাছে এসেছিল চেক-আপ করাতে। ওখানে ওকে জল খেতে দেওয়া হয়েছিল তারপরেই ওর খুব ঘুম পাচ্ছিল। ব্যস আর কিছু ওর মনে নেই। এখন পুরো ঘটনাটাই সঞ্চিতার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

 

পিরামিড (শেষপর্ব)

মাস তিন আরও পেরিয়ে গেল। রূপার মায়ের গর্ভের সেই অপত্যস্নেহের প্রাণ এই তিনমাসে আরও তিনমাস বড়ো হয়ে গেছে। রূপার মাকে এখন দেখলে বোঝা যায়। সেদিনের ঘটনার পর রূপার ব্যবহার জটিল থেকে যৌগিক হয়ে উঠল।

রূপার বাবা-মা ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওয়াশের ব্যাপারে আলোচনা করেছিল। রূপার কথাও বলেছিল। কিন্তু ডাক্তারবাবু সবকিছু পরীক্ষা করে বললেন, আপনাদের এইরকম পরিকল্পনা থাকলে আরও আগে ভাবতে হতো। এখন ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে। এমনকী ম্যাডামের কিছু ভালো-মন্দ হয়ে যেতে পারে। তার থেকে মেয়ের সঙ্গে আবার কথা বলুন, বোঝান।

বাড়ি ফিরে রূপাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বরং দিন দিন রূপা তার নিজস্ব পৃথিবীর মধ্যে নিজেকে আরও বেশি করে পেঁচিয়ে রাখতে আরম্ভ করে। প্রযোজন ছাড়া বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। লাঞ্চ তো একা খেতই, ডিনার নিয়ে নিজের ঘরে চলে যেতে আরম্ভ করল। বাবা-মায়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দিত না। স্কুল বা টিউশন থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে আরম্ভ করল। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বেশির ভাগ সময়ে এড়িয়ে চলে যেত, অথবা চিল্লিয়ে বলত, তোমাদের কী?

একটা ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরির কথাও কানে এল। কিন্তু রূপাকে কিছু বলতে সাহস হয় না। একদিন রাত্রি নটার সময় বাবা বাড়ির সামনে একটা ছেলের বাইক থেকে রূপাকে নামতে দেখে। বাড়ি ফিরলে ছেলেটার ব্যাপারে প্রশ্ন করতে খুব বাজে ভাবে উত্তর দেয়, ইজ ইট ইযোর বিজনেস?

মা শুয়ে শুয়ে চেল্লাতে আরম্ভ করে, এর মানে! আমরা জিজ্ঞেস করব না তো কে করবে?

বাবা শান্ত করে বলে, ডাক্তার তোমায় উত্তেজিত হতে বারণ করেছে, শান্ত থাকো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি। তারপর খুব শান্ত ভাবেই ছেলেটার কথা আবার জিজ্ঞেস করতে রূপা জবাব দেয়, ও চাঙ্কি, আমার টাইম পার্টনার, এনি প্রবলেম?

তবে ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শূন্যের দিকে গেলে বাবার কাছে এসে গম্ভীর গলায় বলে, বাবা আমাকে কিছু ফান্ড ট্রান্সফার করে দেবে তো।

বাড়িতে টুকটাক কাজ করবার জন্যে আলপনা মাসি ছাড়াও রান্নার জন্যে আরকজন এসেছে। খিদে পেলে তাদের কাউকে বলে টিফিন থেকে আরম্ভ করে বাকি সব নিয়ে নেয়।

মা কিন্তু এখন এক্কেবারে শয্যাশাযী। ডাক্তার বলেছেন, বেশি বয়সের তো, বেশ কমপ্লিকেটেড প্রেগন্যান্সি। রেস্ট না নিলে রিস্ক হতে পারে।

রূপা কিন্তু কোনওদিন মায়ের ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছো? সাধের দিন পিসি আর দূর সম্পর্কের মাসি মামিরা এলেও রূপা স্কুল চলে যায়। এমনকী আগের রাতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফোনে বলে, তাহলে কাল টিউশন থেকে ফেরার সময় পার্টি হবে।

আরও মাস দেড় পরে একরাতে দরজাতে বাবার জোরে জোরে ধাক্কা মারবার আওয়াজে রূপার ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বাবার গলার আওয়াজ পায়, মাম্পি তোর মায়ের শরীর খারাপ, তুই দরজা খোল।

একবার দুবার তিনবার। রূপা কিন্তু দরজা খোলে না। শুধু ভিতর থেকেই জোরে বলে ওঠে, শরীর খারাপ তো আমি কী করব? তোমাদের ব্যাপার, তোমরা বোঝো।

মিনিট পনেরো পরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। ঘরের ভিতরে আরও কয়েকজন মানুষের উপস্থিতিও বোঝা যায়। আস্তে, একটু নামাও। এইসব কয়েকটা কথাও কানে আসে। আরও কিছু সময় পরে আবার বাবার গলা পায়।

—মাম্পি, তোর মাকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছি। আলপনা থাকল, পারলে সকালে আসবি।

রূপা কিন্তু তার পরের দিন হাসপাতালে যায়নি। সকালে উঠেই টিউশন চলে গেল। বাড়ি ফিরে তাকে আরও গুম হয়ে থাকতে হল। ঘরভর্তি লোকজন। ঢুকতেই প্রশ্ন, তোর মা কেমন আছে জানিস? সে কী রে?

তারপরেও হাজারটা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা। রূপা কোনওরকমে সবাইকে এড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। কিছুসময় পরে দরজাতে টোকা দেওয়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুললে, পিসি ঘরের ভিতরে এসেই বলে উঠল, পড়তে গেছিলি?

—হ্যাঁ।

—তোদের রান্নার মেয়েটা বলল সাড়ে আটটার মধ্যে চলে আসবে। তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।

—কেন?

—তোর মাকে দেখতে যাবি না?

—তোমরা যাচ্ছ তো।

—তোর মায়ের এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

—ও।

—ও মানে! ডাক্তার বলেছে ক্রিটিক্যাল স্টেজ।

কিছু সময় চুপ থেকে রূপার কাঁধে হাত রেখে বলল, কাল ওটিতে ঢোকানোর সময়ে ওই ব্যথার মধ্যেও তোর নাম ধরে ডাকছিল। দাদাকে বলে, তুমি বাড়ি যাও, মাম্পি একা আছে। কথাগুলো বলে বেরিয়ে যাবার সময় দরজাতে হাত রেখে বলে উঠল, তোর বোনটাও বাঁচেনি।

নিজের ঘরে এই প্রথম রূপা নিজে খুব একা হয়ে উঠল। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের হাওয়া ঢুকলেও তার গরম লাগছিল। ব্যাগটা কিছুসময় আগেই বিছানাতে রেখেছিল। এবার নিজের শরীরটাকেও বিছানাতে জড় পদার্থের মতো ফেলে রাখল। মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়…

মোবাইলে হিন্দি গান বেজে উঠল। একবার, দুইবার তিনবারের বার মোবাইলে চোখ রাখল। স্ক্রিনে চাঙ্কির ছবি দেখা যাচ্ছে।

—বল।

—বাড়িতে কেউ নেই তো, স্কুলে আসবি?

—কেন?

—আমারও বাড়ি ফাঁকা।

—একটু ব্যস্ত, পরে কল করব।

ফোনটা কেটে বিছানাতে মুখ নীচু করে কিছুসময় শুয়ে থাকল রূপা। পিসির কথাগুলো কানে বাজছে। কিছুসময় পরেই বিছানাতে উঠে বসল। বাইরে একটা আওয়াজ আসছে। সবাই বেরোচ্ছে। রূপা ফোনটা সাইলেন্ট করে জোরে বলে উঠল, পিসি… তোমরা কখন যাবে? আমি রেডি।

 

 

পিরামিড (প্রথম পর্ব)

অঘটন বিভিন্ন রকমের হয়। সবই যে শরীর ধ্বংস করে বা হাত পা মাথা কাটে এমন নয়, মাঝে মাঝে এই অঘটন একটা অদ্ভুত আনন্দও দেয়। আনন্দের ধারণাটাও আপেক্ষিক, তাই একই ঘটনা এক পরিবারের একজনকে আনন্দিত করলেও অন্য আরেকজনকে দুঃখিত করে। সমস্যা হল এই দুঃখ আবার প্রকাশ করা যায় না, ঠিক যেমন রূপার হল।

ক্লাস টুয়েলভে পড়বার সময় একদিন রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে বাবার গুজুরফুসুর কানে এল। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোনওদিন এইভাবে বাবা-মা আড়ালে ফিসফাস করেছে বলে কোনও কিছু চোখে পড়েনি। আর পড়বেই বা কী করে— তিনজনের সংসারে ঝামেলা বলতে শুধুমাত্র স্কুল আর অফিসের ভাত দেওয়া নিয়ে। তাও তো অর্ধেক দিন বাবাকে আগের দিনের রান্নাই গরম করে দেয়। বাবা অম্লান মুখে খেয়ে নেয়। মায়ের টুকটাক ঠুসঠাস যা হয়, তা রূপার সঙ্গে।

সরাসরি মা বা বাবাকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না, তোমরা কী সব চুপিচুপি আলোচনা করছিলে? বাবা চুপ থাকলেও মা হয়তো রেগে যাবে। তাই জানার ইচ্ছে থাকলেও চুপ করেই থাকতে হল। কয়েকদিন পরেই অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।

স্কুল থেকে ফেরবার সময় কমার্স সেকশনের অমৃতা বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল, কী রে খবরটা দিসনি তো?

কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল রূপা। চয়ন মানে চাঙ্কির সঙ্গে ঘোরাঘুরি নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করে। রূপা উত্তরও দেয় আবার দেয়ও না। তবে অমৃতাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে, কোন খবরটা রে?

—সে কী রে, তোর নাকি ভাই বা বোন হবে? বেশ ভালো, তবে এজ গ্যাপটা একটু বেশি হয়ে যাবে।

রূপা এবার বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, কী বাজে বকছিস?

—বাজে নয় কাজের কথাই বলছি, তুই খবর না দিলেই বা কী! আমি ঠিক খবর পেয়ে গেছি। কবে ট্রিট দিবি বল?

আকাশ থেকে পড়ল রূপা, চারপাশটা দেখে গম্ভীর ভাবেই বলে উঠল, তোকে কে বলল?

—মা-বাবা আলোচনা করছিল, আমি শুনেছি। তোর মা আমার মাকে বলেছে।

সব শুনেও রূপা কিছু সময় কোনও কথা বলতে পারল না। রাস্তার একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তাহলে গুজুরফুসুর মানে এইসব। কয়েক সপ্তাহ আগে বাবা অফিস কামাই করে মা-কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিল, তার মানে ভিতরে ভিতরে এতদূর সবকিছু হয়ে গেল, আর কিছুই জানা গেল না। নিজের ওপরেই রাগ হল রূপার। অমৃতাকে বলল, আমার একটু তাড়া আছে। তারপরেই তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।

বাড়ি পৌঁছে নিজের ঘরে ঢুকতেই চোখ ফেটে জল এল। কারওর সঙ্গে কোনও কথা না বলে দরজা বন্ধ করে সন্ধে পর্যন্ত বসে রইল। মাঝে মা কয়েকবার এসে, কী হয়েছে? কেন এমন করছিস? এসব জিজ্ঞেস করল। স্কুলে বা টিউশনে কোনও কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল। রূপম নামের সেই ছেলেটা আর বিরক্ত করছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করল।

সব প্রশ্নেরই এক উত্তর, না, কিছু হয়নি। কেউ কিছু করেনি। তুমি যাও। সন্ধের পর বাবা এসেও জিজ্ঞেস করল কিন্তু এবারেও উত্তর পেল না।

সমস্যা আরও বাড়ল। খেতে বসবার সময়। রূপা প্রথমে তো আসতেই রাজি হচ্ছিল না। পরে বাবার কথা শুনে খাবার টেবিলে এলেও খাবার নিয়ে বসে রইল। বাবা-মা দুজনে গিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, রূপার দুচোখ দিয়ে জল নেমে এল।

কিছুসময় পর রূপা কাঁদতে কঁদতেই বলে উঠল, আমার নাকি ভাই-বোন কিছু একটা হবে?

—কে বলল তোকে? কথাটা মা কিছুক্ষণ চুপ থাকবার পর বলল।

—কে বলল জানতে হবে না। সত্যি না মিথ্যা সেটা বলো।

বাবা এবার লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল, হ্যাঁ, চারমাস চলছে।

—আর ইউ ম্যাড, অর স্যাভেজ ইললিটারেট?

মা কোনও উত্তর না দিয়ে গালে এক চড় কষিয়ে দিল। আচমকা আসা এই আঘাতে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও কিছুসময় পরেই গালে হাত বোলাতে বোলাতে রূপা বলে উঠল, আমাকে চড় মারলে কিন্তু পাড়ার সবাই, ফ্ল্যাটের সবাই? ছিঃ ছিঃ করছে তোমাদের। কজনকে চড় মেরে মুখ বন্ধ করবে।

সেই রাতে আর কারওরই খাওয়া হল না। পরেরদিন সকালে উঠেই বাবা রূপাকে চায়ের টেবিলে ডেকে বলল, দেখ তুই বড়ো হয়ে গেছিস। আজকের যুগের মেয়ে তুই, আসলে ঘটনাটা খুবই সাডেন। এমনকী তোর মা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি।

—বোকা বোকা কথা বোলো না বাবা। তুমি বুঝতে পারোনি দ্যাটস ওকে, বাট মা!

—তোর মায়ের একটা প্রবলেম আছে সেটা তো জানিস। তোর সঙ্গে ডাক্তারও দেখাতে গেছিল।

—আমি বুঝতে পেরেছি কি পারিনি, সেটা তোকে বলব না। তোর আমি ইয়ার দোস্ত না। আমরা মা-কাকিমাদের কখনও এইসব কথা বলবার সাহস পেতাম না। কথাগুলো একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল মা।

—তোমাদের কথা আলাদা মা।

—আলাদা মানে কি? মা-বাবার সঙ্গে এইসব কথা বলা?

—তোমরা কি এইসব কথা বলবার জন্য আমাকে ডাকলে, তাহলে আমি আসছি, কাজ আছে।

—কাজ মানে তো ফোনে ফটর ফটর করা।

—আমার এটাই বয়স। যে-বয়সে যেটা মানায়, সেটাই করতে হয়।

বাবা কিছুসময় চুপ থেকে মা-মেয়ের কথা শুনছিল। রূপার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠল, ঠিক আছে, এবার বল তোর মতামত কী?

—হোয়াই শুড আই বাবা? ইউ হ্যাভ নট আস্কড মি বিফোর ডুইং দ্যাট।

—তা না, আমরা তো, মানে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।

—দুর্ঘটনা! হাউ ফানি বাবা, দুর্ঘটনা মেড মাই মাদার প্রেগন্যান্ট।

—শোন ব্যাপারটা ঠিক ওইরকম নয়। আসলে আর বছর তিন পরে তোকে বিয়ে দিতে হবে, তার পরে তো আমরা একা।

—ইজ ইট এনি এক্সকিউজ? আমার বিয়ের পরে তোমার জামাই আসবে। কোথাও তো লেখা নেই বিয়ের পর মেয়েরা বাবা-মা-কে দেখবে না। তাছাড়া আমি বিয়ে করব কিনা সেটাও ঠিক নেই। তোমরা এত কিছু ভেবে এই বয়সে এরকম করে ফেললে?

—শোনো, মেয়ের কথা শোনো, তোমার প্রশ্রয়ে আজ এইরকম অবস্থা। আমার না হয় ভাই বোন নেই কিন্তু তোমার তো আছে। বুগি তোমার থেকে কত ছোটো?

—মা, ননসেন্সের মতো কথা বলো না। বুগি বাবার থেকে এগারো বছরের ছোটো, না জ্যাঠা বাবার থেকে বারো বছরের বড়ো, এটা নিয়ে কোনও কমপ্যারিজন হয় কি?

—ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে বলে কথা, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলবার বহর শোনো।

—মা, আমার শিক্ষা আমাকে তোমাদের সামনে এইভাবে কথা বলতে শিখিয়েছে। আর পৃথিবীর কোথাও লেখা নেই সন্তান হলে বাবা-মায়ের ভুল বলা যাবে না।

শেষের কথাগুলো বলেই ব্রেকফাস্টের টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রূপা। বাবা একভাবে দরজার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে আবার একটা জোরালো শ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়ে গেল বলো তো?

—তুমি বলো। তখন বারবার বারণ করেছিলাম, এখন সামলাও।

 

মাঙ্কি ক্যাপ (২য় পর্ব)

(৩)

সাতসকালেই ঝিলমিলের এসএমএস— আই নিড এ মাঙ্কি ক্যাপ ইমিডিয়েটলি। ইমন মেসেজ পড়ে বিস্মিত হয়। ঝিলমিলের হনুমান টুপির আবার কি দরকার? ক’দিন আগেও দেখা হয়েছে। সকালবেলায় আরকেটি-র বাড়িতে লাইফ সায়েন্স পড়তে গিয়ে। কিছু তো বলেনি। মাফলার দিয়ে মাথা গলা ঢেকে ছিল। তেমন অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। অবশ্য ওপর থেকে বোঝা যায় না ভিতরে কী হয়েছে? কী ধরনের অসুবিধা? তবে এবারের হাড় হিম করা কনকনে শীত সত্যিই অসহনীয়। ঝিলমিলের কি তাহলে এক্সট্রা লার্জ প্রোটেকশনের দরকার এখন?

ইমনও এসএমএস পাঠাল— এক্সকিউজ মি। আই হ্যাভ ওনলি ওয়ান।

ঝিলমিলের চট্‌জলদি মেসেজ— ইফ ইউ লাভ মি, শেয়ার ইট। এতো ভারি বিপদ! নো ডাউট ঝিলমিলকে ইমন ভালোবাসে। কিন্তু তাদের বংশপরম্পরাগত মাঙ্কি ক্যাপ ভালোবাসার নামে উৎসর্গ করলে বাড়িতে তাণ্ডব থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। টুপিদাদু জানতে পারলে ইমনকে আর আস্ত রাখবে না। তার বাবাও কি তাকে মার্সি করবে? যে টুপি পরিয়ে ইমনের বাবা তার মা-কে হাসিল করেছে ইমনও কি পারবে এই সুযোগে ঝিলমিলকে টুপি পরাতে?

ঝিলমিলের তবু বেপরোয়া আবদার— টুপি আমায় দিতেই হবে।

—টুপি ছাড়া আমি তোমায় সব দিতে পারি। প্লিজ মাইরি টুপি চেয়ো না।

—আমার টুপিই চাই।

—কী করে সম্ভব? টুপি আমাদের বাড়িতে একটাই। দাদু থেকে বাবা, বাবা থেকে আমি গসাগু-র মতো ব্যবহার করছি।

—গসাগু মানে?

—গরিষ্ঠ সাধারণ গুননীয়ক অর্থাৎ বড়ো থেকে ছোটো। এক্কেবারে কেসি নাগের ফর্মুলা।

—ওসব গ.সা.গু. ল.সা.গু. ছেড়ে ঝেড়ে কাশো তো চাঁদু। টুপি দেবে কি না?

—একি মামার বাড়ির আবদার নাকি?

—সামান্য টুপি দিতে পারো না, তুমি বাসবে ভালো?

—কি বলছ ঝিলমিল? ভালোবাসার জন্য আমার প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু টুপি দিতে পারব না। তুমি অন্য কিছু চাও, আমার আই ফোন, ল্যাপটপ, মানিব্যাগ…..

—আমার টুপিই চাই।

—বাজার থেকে কিনে নিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

—তুমি হয়তো জানো না এবারের কনকনে শীতে আলু পেঁয়াজের মতো বাজার থেকে মাঙ্কি ক্যাপও ভ্যানিশ। হাতে-গোনা দু-একটা যাও পাওয়া যাচ্ছে, তার দামও আকাশছোঁয়া। পঞ্চাশের হনু ব্ল্যাকে পাঁচশো হাঁকছে।

—কি বলছ?

—যা বলছি মার্কেট স্টাডি করেই বলছি। ভাবলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো। টুপি ছাড়া আমি বাঁচব না। আমার মান- সম্মান লাজ-লজ্জা সব ওই হনুমান টুপির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ইমন বোকার মতো জানতে চায়— এসব তুমি কী বলছ? আমি তোমার মাথামুণ্ডু কিছুই ছাই বুঝতে পারছি না।

—তোমায় অতশত বুঝতে হবে না। যা বলছি সেটা করতে পারবে কিনা বলো?

—আমি চেষ্টা করব ঝিলমিল। কিন্তু যদি না পারি? ঝিলমিলের সটান জবাব— আমাদের ভালোবাসার —দি এন্ড।

(8)

ইমনের দাদু স্বদেশ হালদার বিদ্যুৎ চমকানোর মতো বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলেন— চোর শেষপর্যন্ত আর কিছু না নিয়ে মাঙ্কি ক্যাপ নিয়ে চম্পট দিল?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— আপদ গেছে। এখন ক’দিন শান্তিমতো ঘুমোতে পারব। বাব্বা কয়েক রাত্তির যা ধকল গেল।

—মহিম তুই একথা বলতে পারলি?

—আগের গান্ধিটা ট্রাই করছ না কেন?

—হনুমানটা বেশ সেট হয়ে গিয়েছিল। দারুণ গরম হতো। শরীরে মনে বেশ চাঙ্গা বোধ করতাম। গান্ধি বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। আধুনিক ছেলেছোকরার দল যেন মানতেই চায় না। আমাকে টুপি দাদু বলে খেপাত— তোর মনে নেই?

—না পাওয়া গেলে কী করবে? ক’দিন পুরোনোটা দিয়ে চালাও। তারপর সময়মতো পেলে কিনে দেব। অন্তত মাথাটা তো বাঁচবে। সঙ্গে মাফলার, শাল জড়িয়ে নিলে দিব্যি ক’দিন কেটে যাবে। বরং বলি কি তুমি ক’দিন রেস্ট নাও। মর্নিং ওয়াকে না গেলেই নয়?

—আমায় জ্ঞান দিস না মহিম। আমি বিপ্লবী, চুটিয়ে স্বদেশি করেছি। আমাদের অভিধানে রেস্ট বলে কোনও শব্দ লেখা নেই। কিন্তু আমি ভাবছি এত সাধের মাঙ্কি ক্যাপটা মিসিং হল কী করে? চোর, সোনাদানা-টিভি-ফ্রিজ-ল্যাপটপ চুরি না করে শেষপর্যন্ত হনুমান টুপি? ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—এই প্রচণ্ড শীতে মনে হয় চোরের কাছে ওটাই মস্ত জরুরি, মহা মূল্যবান। আরে বাবা চোরও তো মানুষ নাকি? চোরেরও ঠান্ডা লাগে।

—ডোন্ট টক ননসেন্স, মহিম। এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপারকে লঘু করে দেখা উচিত না।

—তুমিও পারো বাবা। সামান্য একটা টুপি নিয়ে কি কাণ্ডটাই না তুমি করছ।

—এটা সামান্য নয়। আমার কাছে বেশ রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। প্রেস্টিজ ইস্যুও বলতে পারিস।

ক’দিন বাদে দাদুই আবিষ্কার করলেন ইমনদের পারিবারিক ঐতিহ্যশালী মিসিং লিংক মাঙ্কি ক্যাপটি। দাদু ইমনকে জরুরি তলব করলেন, পার্ক থেকে মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে আসার পর। দাদু কি শেষ পর্যন্ত ইমনকে সন্দেহ করছেন? ইমন কি ধরা পড়ে গেল? ইমনের বুকের ভিতর হাজারটা অশ্বখুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঝিলমিলকে ইমনই যে টুপিটা দিয়েছিল, দাদু জানল কী করে?

তার দাদু গলার মাফলার আলগা করে চাদরটা গা থেকে খুলে মায়ের দেওয়া এক কাপ গরম চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বললেন— জানিস দাদুভাই হনুমানটাকে খুঁজে পেয়েছি।

ইমন অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল— কোথায়?

—পার্কে রংগন গাছের ঝোপের আড়ালে। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। হালকা হলুদ রঙের, মাথায় কালো উলের বল।

ইমন আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বলে– ধ্যাৎ দাদু কী যে বলো না। তোমার চোখে নির্ঘাত ছানি পড়েছে। এরকম কালার কম্বিনেশন অনেক টুপির হতে পারে।

—আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। আমার বিপ্লবীর চোখ। দূর থেকে দেখেই কত ইংরেজের দুরভিসন্ধি ফাঁস করে দিয়েছি। ঝোপের আড়ালে টুপিতে মুখ ঢেকে মেয়েটা এমনভাবে বসেছিল যাতে কেউ চিনতে না পারে আর তার গা ঘেঁষে ছেলেটি অশোভন অবস্থায়…। পার্কটা ক্রমশ দূষিত হয়ে যাচ্ছে রে দাদুভাই। আর বোধহয় মর্নিং ওয়াকে যাওয়া যাবে না।

ইমন দারুণ বিস্ময়ে হতবাক। তার চোখের সামনে সবকিছু এখন জলের মতো পরিষ্কার। আসলে ঝিলমিল তাকে ঠকিয়েছে। তাকেই মস্ত টুপি পরিয়েছে।

 

মাঙ্কি ক্যাপ (১ম পর্ব)

শীত এলেই সবার নজরে পড়ে মাঙ্কি ক্যাপটির উপর। প্রথমে ইমনের দাদু এক্স বিপ্লবী স্বদেশ হালদারের। একসময় চুটিয়ে স্বদেশি করেছেন। সার্থক তাঁর নাম আর কাম। মাথায় গান্ধি ক্যাপ। মনে হতো তিনিই মহাত্মা। স্বাধীনতার পরও টুপি মাথায়। গান্ধি যেন তাঁর তেলা নি-কেশ মাথায় চেপে বসেছে। পাড়ার উঠতি ছেলেছোকরার কাছে তিনি টুপিদাদু। কিন্তু দাদুরও বয়স বাড়ছে। সঙ্গে জাঁকিয়ে পড়ছে শীত। গান্ধি টাক মাথা সামলালেও কান আর নাকের ফুটোয় গোঁজ মারা তার কম্মো নয়। ফলত হিমেল হাওয়ার দাপটে ইমনের টুপি দাদু একেবারে কুপোকাত। গলায় ঘর্ঘর, নাকে সরসর আর কানের ভিতর কড়কড় অনবরত বেজেই চলেছে। তবু দাদু টুপি খুলবেন না। ডাক্তার সনাতন হাজরা ইমনের মাকে উপদেশ দিলেন— এমনটা কখনওই বরদাস্ত করা যাবে না। আরে বাবা বয়স তো হচ্ছে নাকি? কত চলছে?

ইমনের মা আঙুলের কড় গুনে বলেন— আশি ছুঁই ছুঁই।

ডাক্তার হাজরা চমকে উঠে বলেন— এই ভয়ংকর শীতে এখনও হাফ নেকেড ফকির হয়ে থাকতে চান। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—বাবা তো সচিনের মতো সেঞ্চুরির পাহাড় গড়বেন বলে শপথ করেছেন।

—বলবেন, ওসব গান্ধিগিরি চলবে না। বুড়ো বয়সে যত্তসব ভিমরতি। নিউমোনিয়ায় একেবারে টেসে যাবে।

—তাহলে উপায় ডাক্তারবাবু?

—হনুমান ডট কমের যুগ। ছবিতে দেখেছেন বিশুর ছেলেটা মাথায় কী পরে আছে? ইমনের মা মাথা নাড়ে।

ডাক্তার হাজরা বিজ্ঞের মতো বলেন— আইসল্যান্ডে ওসব গান্ধি-টান্ধি এক্কেবারে অচল। হনুমানই পারে ওরকম রাবণের মতো ভয়ংকর প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে।

—তার মানে, আপনি বলছেন মাঙ্কি ক্যাপ।

—গান্ধির বদলে হনুমান। ঠিক ধরেছেন।

—কিন্তু হনুমান টুপি যদি মাথায় না পরতে চান? আমার শ্বশুরমশাইয়ের যা জেদ।

ডাক্তার হাজরা খানিকক্ষণ গুম হয়ে কিসব চিন্তা করলেন। তারপর স্মিতহাস্যে বললেন— কুছ পরোয়া নেই। যে রোগের যেমন ওষুধ।

ইমনের মা বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন— সেটা আবার কী?

—কথা না শুনলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।

—আপনি কী করবেন?

—ঘুমের ওষুধ গিলিয়ে গান্ধি খুলিয়ে হনুমান পরিয়ে দেব।

—কতক্ষণ লাগবে?

—মাত্র সাড়ে সতেরো মিনিট।

—বলেন কী টুপি পরানো এত সোজা? এত তাড়াতাড়ি?

—আমার নাম…।

ইমনের মা সামান্য রসিকতা করে বলে— মুন্না ভাই এমবিবিএস। তাই না?

—ধ্যাৎ, কী যে বলেন। আমার নাম সনাতন হাজরা। রোগীদের টুপি পরানোই আমার কাজ। বিফলে মূল্য ফেরত।

ইমনের মা বিড়বিড় করে বলে— মুন্নার বদলে সনাতন। গান্ধির বদলে হনুমান। দুয়ে দুয়ে চার।   ভালোই মিলেছে।

ডাক্তার হাজরার চেম্বার পর্যটন করে ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপের স্বাদ টের পেয়েছেন এখন হাড়ে হাড়ে। তাঁর মুখে দিনরাত হনুমান চালিশা। হনুমান ভক্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। টুপির এত গুণ, আগে জানা ছিল না। শীত এলেই তিনি বাহুবলী হয়ে যান। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহে যখন সবাই লেপের ভিতর জবুথবু, ঘুম আর ভাঙতেই চায় না, তখন ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপে মুখ ঢেকে স্বপ্নবীথি পার্কের ভিতর তিন রাউন্ড মর্নিং-ওয়াক সেরে অবলীলায় বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর সোজা ইমনের বাবার ঘরে ঢুকে এক ঝটকায় লেপ সরিয়ে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলেন— যা আর দেরি করিস না। পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। ইমনের বাবার মুখে বিরক্তির সুর— আঃ আমাকে আবার টুপি পরাতে এলে কেন? দাদু নাছোড়বান্দা। টুপি পরানোয় তিনি জেনারেশন ধরে অভ্যস্ত করাবেনই। সবশেষে যে ইমনের পালা, তা আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। সে জানে লেপের তলায় ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থাকলেও রেহাই নেই। দাদু ইমনের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন – শোন মহিম, মাঙ্কি ক্যাপ পরে শীতের সকালে মর্নিং ওয়াকের মজাই আলাদা। ইমনের বাবা যেন তার দাদুর কথা শুনতেই পায় না। লেপের ভিতর শামুক হয়ে থাকতে চায়। দাদু তবু ছাড়ে না ইমনের বাবাকে। বলেন— কিরে উঠবি নাকি বউমাকে বলব গায়ে জল ঢেলে দিতে। ইমনের বাবা মুখ বিকৃত করে বলে— আঃ কি জ্বালাতন! শান্তিমতো ঘুমোতেও দেবে না নাকি?

—ব্যাটা কুম্ভকৰ্ণ। এত ঘুম আসে কী করে? রাতে ঘুমোসনি? হঠাৎ দাদু বাজখাই গলায় ইমনের মাকে চিৎকার করে ডেকে বলেন— বউমা, মহিম কি রাতে ঘুমায় না? তোমরা করো কী? মা আমতা আমতা করে বলে— আপনার গুণধর ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করুন। আমি পই পই করে বলি, যা ঠান্ডা পড়েছে তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর…। দাদু মাকে সমর্থন করে বলেন— ইউ আর রাইট বউমা। বাট মহিম…।

—সাত তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর ঢুকলে ওর নাকি জ্বর আসে।

—হোয়াট ডু ইউ মিন বাই জ্বর?

—মানে গরম হয়ে গেলে আর ঘুম আসে না। —কই আমি তো এসবের বিন্দুবিসর্গ জানি না।

—আপনি গুরুজন। আপনাকে কি সব খুলে বলা যায়?

—তুমি কাছে থাকো না?

—আমি থাকলে জ্বর আরও বাড়ে।

—সে কি কথা! কেমন ব্যাধি?

—আপনার ছেলেই ভালো বলতে পারবে।

—ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

—আপনার ছেলে না যেতে চাইলে আমি কি আর করতে পারি?

—আঃ বউমা হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমার হাতেই ওর কলকব্জা।

—শীত এলেই ও এরকম বিগড়ে যায়। মেশিন ঠিক থাকে না।

—না না এতো ভালো কথা নয়। এর একটা আশু বিহিত প্রয়োজন।

—দেখুন চেষ্টা করে। আপনার মধ্যস্থতায় যদি কাজ হয়। আমি তো অলরেডি ফেড-আপ।

এইবার দাদু ইমনের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন— কী’রে বউমা যা বলছে সত্যি?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— হুম।

—রাতে ঘুমোস না?

—হুম।

—বউমার কথা শুনিস না?

—হুম।

—কী তখন থেকে হুম হুম করছিস?

—আঃ বিরক্ত কোরো না তো। লেট মি হ্যাভ এ সাউন্ড স্লিপ।

—রাতে না ঘুমিয়ে সকালে কেন ঘুমোচ্ছিস মহিম?

—ক’দিন ধরে অফিসের কিছু জরুরি ফাইল রাতে দেখতে হচ্ছে। তাই শুতে দেরি হচ্ছে। আর কোনও গল্প নেই।

ইমনের মার দিকে তাকিয়ে দাদু বলেন— ও তাই বল। আমরা তো অন্য কিছু সন্দেহ করছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন -ওরে বাবা সাতটা বেজে গেল। নে আর দেরি না করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপটা চাপিয়ে পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। দেখবি মন-মেজাজ একেবারে ঝরঝরে হয়ে যাবে।

ইমনের বাবার সেই এক বিরক্তিকর জবাব— আজ টুপি না পরলেই নয়?

— টুপি না পরলে ইউ মাস্ট ক্যাচ কাফ্ অ্যান্ড কোল্ড। আজকের টেম্পারেচার কত জানিস? অলমোস্ট এইট ডিগ্রি। ‘জয় হনুমান’ বলে বেরিয়ে পড়।

—আজ আমি টুপি পরব না।

—ছেলেমানুষি করিস না মহিম। টুপি তোকে পরতেই হবে।

—কিছুতেই না।

—অবাধ্য হোস না। তুই ভালো করেই জানিস। আমি এক সময় স্বদেশি করেছি। কতজন গোরাকে চ্যাংদোলা করে ছুড়ে মাটিতে আছড়ে ফেলেছি। গান্ধি ছেড়ে এখন আমি হনু হয়েছি। আমার এখন মহাবলী শক্তি।

হঠাৎ ‘জয় বজরংবলী’ বলে একলাফে ইমনের টুপিদাদু তার বাবাকে চ্যাংদোলা করে তুলে বাইরে এনে ফেলে। তারপর মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ পরিয়ে বলেন— মহিম তুই এখনও আমার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু রে।

(২)

সেদিনটাও ছিল এমনই এক ভয়ংকর শীতের সকাল। হনুমান টুপি মাথায় ইমনের বাবা বেরিয়েছে মর্নিং ওয়াকে। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে তখন পড়ত বাবা। সঙ্গে চাকরির পরীক্ষা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বডি ফিট। বাইসেপস, ট্রাইসেপস, সিক্স প্যাকস সবই তার স্বাস্থ্যবান শরীরে সুসজ্জিত ও সুশোভিত। কিন্তু শীতকাল এলেই কেমন জবুথবু হয়ে যায় ইমনের বাবা। সামান্য ঠান্ডা যেন সহ্য হয় না। হাঁচি একবার শুরু হলে তিন কুড়িতে গিয়ে থামত। নাকের ট্যাপ কলে প্যাঁচ বিকল। অনবরত জল পড়েই চলেছে। ইমনের ঠাম্মা বুকে গরম তেল মালিশ করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলত— যা মর্নিং ওয়াকটা সেরে আয়। তোর বাবা আগেই বেরিয়েছে। আমি গরম জল চাপাচ্ছি। চা খেয়ে বাজারে যাবি। ইমনের বাবা ঠাম্মার কথা শিরোধার্য করে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।

আড়াই রাউন্ড মারার পর হঠাৎ ইমনের বাবার বোধোদয় হয় কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। একেই ভয়ংকর ঠান্ডা। তার উপর পার্ক প্রায় জনমানবশূন্য। যে দু-চারজন সিনিয়র সিটিজেন হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করছিল তারাও একবার কোনওক্রমে রাউন্ড মেরেই সটকেছে। কেবল ইমনের নির্ভীক স্বাস্থ্যবান বাবা একা শীতের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

পিছনে না তাকিয়েই জোরে পা চালায় তার বাবা। ভাবে, নির্ঘাৎ কোনও চোর-ডাকাত। তার পকেটে বাজারের টাকা। আঙুলে জন্মদিনের সোনার আংটি। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। সব কেড়ে নিলে, খুলে নিলে তার যাবতীয় বীরত্ব ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। ওর হাতে নিশ্চয়ই অস্ত্র আছে।

এরকম ভাবে বেশ কিছুক্ষণ পিছু-নেওয়া আগন্তুকের সঙ্গে ছোটাছুটি লুকোচুরি খেলার পর অকস্মাৎ এক মেয়েলি কন্ঠস্বরে ইমনের বাবার সম্বিৎ ফেরে। তার বাবা শুনতে পায়— প্লিজ হেল্প মি…. আর পারছি না… ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি… আমাকে বাঁচান।

মেয়েলি কেসে তার বাবা কোনওদিনই পাশ করতে পারেনি। বরাবরই শূন্য পেয়েছে মেয়ে পটানোর পরীক্ষায়। অথচ কলেজ ইউনিভার্সিটিতে তার বন্ধুরা ক্যান্টিনে বাথরুমে-সিঁড়িতে- ব্যালকনিতে— যত্রতত্র নির্ভয়ে টুকলি করে পাশ করে যাচ্ছে। ইমনের বাবার কানে ফের সেই করুণ আর্ত কন্ঠস্বর — আমাকে বাঁচান… আমি জমে যাচ্ছি… মরে যাচ্ছি। ইমনের বাবা মনে মনে ভাবে— কেসটা জন্ডিস নয় তো? বাঁচাতে গিয়ে যদি ফেঁসে যায়? মেয়েরা সব পারে। ইমনের বাবা তবু সাহস সঞ্চয় করে ‘জয় বজরং বলী’ বলে একলাফে মেয়েটির সম্মুখীন হয়— আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কী চান বলুন তো? মেয়েটি তার কথার জবাব না দিয়ে ইমনের বাবার মুখের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। বাবা থতমত খেয়ে যায়। মনে মনে বলে— কী মেয়েরে বাবা, কথা নেই বার্তা নেই। প্রথম সাক্ষাতেই মুখ দেখাচ্ছে। এরপর না জানি কী করতে বলবে। এদিকে মেয়েটি প্রচন্ড ঠান্ডায় প্রায় বাকরুদ্ধ। আঙুল দেখিয়ে কোনওক্রমে বলে — টুপি। ইমনের বাবা চমকে উঠে বলে— টুপি কেন?

—বাইটিং কোল্ড। বুঝিনি বাইরে এতটা ঠান্ডা। টুপি না জড়ালে কানের যন্ত্রণায়…।

—কিন্তু আমার টুপি আপনাকে জড়ালে আমার হাঁচি, কাশি, নাকের জল…।

—আপনি কি চান না একটা অসহায় মেয়েকে এই নিষ্ঠুর আবহাওয়া থেকে বাঁচাতে, উদ্ধার করতে। আপনি সু-পুরুষ স্বাস্থ্যবান। আপনি নিশ্চয়ই চান না চোখের সামনে অসহায় মেয়েটি শীতের প্রচন্ড কামড়ে ফালাফালা হোক। ইমনের বাবার মনে হল, কে যেন তার জামা-প্যান্ট-মাফলার-সোয়েটার-হনুমান টুপি সব খুলে নিয়ে প্রায় অর্ধনগ্ন দেহে এক বালতি জল ঢেলে দিল।

মাথার মাঙ্কি ক্যাপটা একটানে খুলে ইমনের বাবা মেয়েটির মাথায় পরিয়ে দিল। উষ্ণতা পেয়ে মেয়েটি ক্রমশ স্বাভাবিক হতে থাকল। তার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি। কিন্তু টুপি খসিয়ে হাড়-কামড়ানো কনকনে শীতে ইমনের বাবা টানা এক মাস বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছিল। মেয়েটি এর মধ্যে বার কয়েক এসে তার বাবাকে উষ্ণ করে দিয়ে গেছে। এরপর তার বাবার চাকরি, তার বাবার বিয়ে সবই সম্ভব হয়েছে মেয়েটির চিরস্থায়ী সঙ্গলাভ এবং ভালোবাসার হাতের-গরম স্পর্শে। মাঙ্কি ক্যাপের আড়ালে সুজাতা সরকার নামের সেই মেয়েটি এইভাবেই ইমনের বাবার অর্ধাঙ্গিনি এবং ইমনের গর্ভধারিণীরূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।

রঘু

মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি। একদম দুয়ে নিয়ে ছাড়ে। রোজ রোজ অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয় খুব। তাই ‘স্লিপ ডেট’ কাটাতে রবিবারই ভরসা। সেখানেও জ্বালা। ন’টা বাজলেই গামলা মুখে বউয়ের গর্জন। চলো বাজার, বাজার চলো! এপাশ ওপাশ করে যে আরও আধঘন্টা ল্যাদ খাবো তার উপায় নেই। আজ যেমন গরম চায়ের কাপে আমার আঙ্গুল দিল ডুবিয়ে। ড্যাশের নাম খগেন। একলাফে বাথরুম গজগজ করতে করতে।

রবিবার বাজার সেরে আমাদের বন্ধুদের একটা আড্ডা হয় কাকার চায়ের দোকানে। জনা পনেরো থাকি। বাজার ফেলেই দে দৌড়। প্রথমে মাছ মাংস কিনে তারপর সবজি বাজার সারি। ক’দিন ধরেই চিংড়ি চিংড়ি করছে ছেলেটা। একটু বড়ো সাইজের কয়েকটা নিলাম। বাটা মাছ বাবার জন্য। কাতলা কিছুটা নিলাম বাড়ির বাকিদের জন্য। চিকেন নিয়ে সবজি বাজারে ঢুকতেই দেখি পল্টুর ফলের দোকানের সামনে খুব ভিড়। পল্টু জুতো খুলে কাউকে মারছে আর “চোর চোর” বলে চিৎকার করছে। উৎসাহী কয়েকজন বেশ সোচ্চার। তাদের হুলোর মতো মুখগুলো, যেন এখনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাকিয়ে দেখলাম সব মুখগুলোয় অপরের রাগ অন্যকে ঝাড়ার চেষ্টা।

একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম পল্টু জুতো নিয়ে একটা সাত-আট বছরের বাচ্চাকে মারছে। ছেলেটার জামা ছিঁড়ে গেছে। সারা মুখ লাল মারের চোটে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। খুব মায়া হলো। এইটুকু বাচ্চাকে কেউ ওভাবে মারে! ছুটে গিয়ে পল্টুর হাতটা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম, “মেরে ফেলবি নাকি বাচ্চাটাকে”। আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে লাগল। নাটকের যবনিকা এতো তাড়াতাড়ি হবে ওরা ভাবতে পারেনি। এর মধ্যে তাপসদা হাজির।

তাপসদা অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার। বিশাল চেহারা ও মোটা পাকানো গোঁফ ভয় ধরায়। তাপসদা পিছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। পল্টুর হাতে একটা আপেল। মারার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “ছেলেটা আপেল চুরি করে ছুটে পালাচ্ছিল”। এর মধ্যে বাচ্চা ছেলেটা উঠে বসেছে। সারা শরীরে লাল লাল মারের দাগ।

হঠাৎ তাপসদা গম্ভীর গলায় বাচ্চাটাকে জিঞ্জাসা করল, “কি করেছিলিস সত্যি করে বল।”

তাপসদার চেহারা দেখেই ছেলেটা ভয় পেয়েছে খুব বোঝা গেল। একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘একটা আপেল কিনতে চেয়েছিলাম। পাঁচ টাকা আমার কাছে ছিল। দোকানদার বলল, দশটাকা দাম। আমি একটা ছোট আপেল দেখিয়ে বলি, এটা পাঁচ টাকায় দাও না। ও তখন আমাকে গালাগাল করে। বলে অতো কম দামে আপেল হয় না। তারপরও একটা নোংরা কথা বলে।’

‘আমি বলি ‘ওরকম খারাপ কথা কেন বলছো?’ বলতেই ও চিৎকার করতে থাকে আর বলে চোর চোর। আমি ভয় পেয়ে ছুটতেই ও ধরে মারতে শুরু করে। আরও কয়েকজন মারতে থাকে। আমি আপেল চুরি করিনি। আপেলে হাতই দিইনি।’ রিক্সা চালায় হারু সব দেখেছে। সে বলল, ‘বাচ্চাটা ঠিকই বলছে।’ পল্টু এমনি এমনি মারছে বাচ্চাটাকে। ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল যেন।

তাপসদা পল্টুকে শূন্যে তুলে ধরে ছুড়ে ফেলল দূরে রাস্তার ওপর। তারপর আগুন চোখে মিলিটারি মার শুরু করল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলে দেখছে। যারা এতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে পল্টুর সঙ্গ দিচ্ছিল তারা পগারপার। তাপসদাকে থামানো যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর নিজের পায়ের জুতো খুলে বাচ্চাটার হাতে দিয়ে বলল, ‘তুই মার এবার ওর মুখে তোকে যেমন মারছিল।’

সকলকে অবাক করে বাচ্চাটা বলে উঠল, ‘মা বলে, বড়োদের অসম্মান করতে নেই। গায়ে হাত দিতে নেই’। স্তম্ভিত সকলে। বাচ্চার কথাটা সকলের হৃদয় ছুঁয়ে গেল যেন। পল্টুকে ছেড়ে হাসিমুখে তাপসদা বাচ্চাটাকে কাকার চায়ের দোকানে নিয়ে গেল।

বাচ্চাটার নাম রঘু। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, সকাল থেকে সে কিছু খায়নি। ওর মা এক বাড়িতে কাজ করে। তারা সকালে চা আর বাসি রুটি দেয়। ওর মা ওই রুটি নিয়ে এলে ওরা সকলে খাবে। বাড়িতে ওরা তিনজন। মা, বোন আর ও। বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। চা আর বিস্কুট হাতে চুপ করে বসে রইল রঘু। খেতে বলতেই কেঁদে ফেলল। বলল, ওর বোনের ক’দিন ধরে জ্বর। ও না খেয়ে আছে। এক বাবুর গাড়ি ধুয়ে পাঁচ টাকা পেয়েছিল কাল। ওই টাকা নিয়ে বোনের জন্য আপেল কিনতে এসেছিল। ক’দিন ধরেই রঘুর কাছে আপেল খাবার বায়না করছিল বোন। বোন না খেয়ে আছে, তাই ও চা বিস্কুট খেতে পারবে না!

তাপসদা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রঘুর দিকে। বোনের জন্য ওর ভালোবাসায় মুগ্ধ সকলে। তাপসদা হঠাৎ চিৎকার করে পল্টুকে ডাক দিল। মাথা নিচু করে পল্টু হাজির। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে তাপসদার দিকে। তাপসদা হাসতে হাসতে পল্টুকে কাছে ডাকল। বলল, এক কেজি আপেল আর এক ছড়া কলা নিয়ে আয়। দৌড়ে গেল পল্টু দোকানে। আপেল আর কলা আনতেই একটা পাঁচশো টাকার নোট রঘুকে দিয়ে বলল, টাকাটা দে কাকুর হাতে। তুই তোর বোনের জন্য আপেল আর কলা কিনলি।

রঘু কিছুতেই নেবে না। ওর মা বলেছে, ‘এভাবে কেউ দয়া করলে নিবি না’। হো হো করে হেসে উঠল তাপসদা।

পল্টুকে বলল, ‘দেখলি এই ছেলেটাকে তুই চোর বলে মারলি। তোর ছেলেকে কখনও তুই এই শিক্ষা দিয়েছিস? এ ছেলে অনেক দূর যাবে, দেখে নিস।’ তাপসদা জোর করতেই রঘু বলে উঠল, তাহলে আমি বড়ো হয়ে চাকরি করলে তখন ফেরত নিতে হবে কিন্তু। উপস্থিত সকলে রঘুর কথায় হেসে উঠল। কয়েকটা কেক আর বিস্কুটের প্যাকেট আমি দিয়ে দিলাম ফলের ব্যাগে।

আনন্দে রঘু দে দৌড়। আমিও রঘুর মতো দৌড় লাগালাম সবজি বাজারের দিকে। দেরিতে বাজার নিয়ে ঢুকলেই বৌয়ের গামলা মুখের অগ্নিবান কল্পনা করতে করতে।

 

আজি ঝড়ের রাতে…

আঠারো বছর বয়সের সময় যখন আমি কলকাতায় পালিয়ে যাই, তখন নন্দিনীর বয়স ছিল পনেরো। আজ তিন বছর পর আমি বাড়ি ফিরলাম। এখন আমার বয়স একুশ আর নন্দিনীর আঠারো। মা বললেন, দুজনের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে এবার চারহাত এক করতে হবে।

ওই যে কথায় আছে না, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। কেউ জানে না কার ভাগ্য কার সঙ্গে লেখা হয়ে আছে। কিন্তু শুরুটা তো এমন ভাবে হয়নি, হয়েছিল এক প্রাণবন্ত ছন্দে। নন্দিনী যে কখনও অন্য কারও হয়ে যাবে সে কথা তো কোনওদিন ভেবেই দেখিনি।

নন্দিনীর সঙ্গে ছোটোবেলায় স্কুলে গেছি। পুতুল খেলেছি। পুতুলের বাবা মা সাজার সময় আমি বাবা হয়েছি ও মা হয়েছে। কখনও আবার বর-বউ খেলেছি। ওদের বাড়িতে গেলে নন্দিনীর মা আমাকে খুব আদর যত্ন করতেন। স্কুল ছুটি থাকলে দুপুরবেলা প্রায়ই ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন এবং দস্তুর মতো দুজনকে পাশে বসিয়ে হাত দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন। আবার আমাদের দুজনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে আপনা-আপনি বলাবলি করতেন, আহা, বেশ মানিয়েছে দুটিকে।

তখন ক্লাস টু-তে পড়ি। অনেক ছোটো ছিলাম তাই হয়তো কথাটার মানে বুঝতে পারতাম না। শুধু এটুকু বুঝতাম আমাদের দুজনকে ওনারা খুব পছন্দ করতেন। নন্দিনীর প্রতি আমার একটু বেশিই দাবি ছিল অন্যান্য বন্ধুবান্ধব বা ওর আত্মীয়স্বজনের থেকে এবং সেই ধারণা ক্রমশই বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিল আমার মনের মধ্যে। সেই অধিকারে আমি কখনও তাকে শাসন করতাম এবং সেও আমার সব শাসন মাথা পেতে নিত সহিষ্ণু ভাবে।

মাঝে মাঝে তাকে উপদ্রব করতাম, শাস্তি দিতাম কিন্তু কোনওদিন টুঁ-শব্দটি করেনি। নির্দ্বিধায় সব মাথা পেতে নিত। খুব সুন্দরী বলব না তবে বেশ ভালোই দেখতে ছিল। পাড়ার বখাটে ছেলেদের কাছে সে সৌন্দর্যের কোনও দাবি ছিল না। তবে আমি জানতাম আমার আদেশ পালন করার জন্যেই তার জন্ম এবং হয়তো সেই কারণে আমি অনেকটাই তাকে অবহেলা করতাম।

বাবাকে হারিয়েছি বছর দুই আগে। শুনেছি বাবা বলতেন, বাড়ুজ্জ্যে মশাই ওর হাত দেখে বলেছেন আমার রাজা একদিন সত্যি-সত্যিই দেশের রাজা হবে। বাবার ইচ্ছা আমি পড়াশোনা করে অনেক বড়ো হই। তাঁর মতো কলমপেশার চাকরি যেন না করি। ছোটোবেলায় আমি কিন্তু মনে মনে তা, কোনওদিন চাইতাম না। আমি চাইতাম সারাদিন ধরে শুধু খেলাধুলা করব। তাই জীবনে আমি হয়তো কোনও খেলাই বাদ দিইনি।

মার্বেলগুলি, ডাংগুলি, সিগারেট-এর প্যাকেট কেটে তাস, পিট্টু ছাড়াও মেয়েদের সঙ্গে গোল্লাছুট, আরও কত বলব। ফুটবল, ক্রিকেট তো একটা ইতিহাস। দুপুর রোদে ঘর থেকে পালিয়ে যেতাম ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্যে। মা আবার আমাকে খোঁজ করে ঘরে এনে বেঁধে রাখতেন। কখনও মার সবে একটু তন্দ্রা এসেছে, সেই ফাঁকে বাঁধন খুলে, দরজার খিল খুলে আবার পালিয়ে গিয়েছি। পরে দাদাদের হাতে মার খেয়েছি কিন্তু খেলা থেকে কখনও পিছপা হইনি।

প্রতিদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে এসে কোনওমতে নাকেমুখে গুঁজে সোজা অরবিন্দ স্কুলের মাঠে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এদিকে মা ছাতা নিয়ে যখন আমাকে মাঠে খুঁজতে গেছে তখন আমি স্ট্রাইকার রোলে সররা খাচ্ছি।

যাইহোক ধীরে ধীরে খেলাধুলার জগৎ থেকে ইতি টানলাম। শৈশব থেকে কৈশোরে পা বাড়াতেই দেখলাম আমার বন্ধু রঞ্জন ডাক্তার হওয়ার বাসনায় তেড়েফুঁড়ে লেগেছে। হঠাৎ একদিন এও শুনলাম যে, সে কলকাতায় পালিয়ে গেছে। উঠেছে কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে থেকে সে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সফল করবে।

আমার জীবনেও সেরকম অনেক উচ্চাশা ছিল। ওর মতো ডাক্তার না হতে পারি (যদিও মনে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বাসনা ছিল) নিদেনপক্ষে একটা সরকারি চাকুরে অর্থাৎ সরকারি অফিসের বড়োবাবু হওয়ার জন্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম।

ছোটোবেলার কথা আবছা মনে পড়ে। বাবাকে দেখতাম হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ পদ্ধতি কত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। তাছাড়া বাবার আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই উঁচু পোস্টের ইঞ্জিনিয়ার। বাড়িতে তাঁরা এলে বাবা তাঁদের অনেক সম্মান করতেন। সেদিন যেন বাড়িতে উৎসব আনন্দের ঢেউ উঠত। কত পদ যে-মাকে রান্না করতে হতো তার হিসাব নেই।

আমিও শিশুকাল থেকে সেই ইঞ্জিনিয়ার আত্মীয়দের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে সম্ভ্রমের আসন দিয়েছিলাম। যেন আমার ভারতবর্ষের পূজ্য দেবতা। তেত্রিশ কোটি দেবতার ছোটো ছোটো সংস্করণ। যেন বাবা বিশ্বকর্মার সন্তান, নাতি, পুতি এঁরা। বাবা বিশ্বকর্মা কী কী খেতে ভালোবাসতেন জানি না, তবে এদের খাতির আরও বেশি ছিল।

আমিও রঞ্জনের মতো একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম কলকাতায়। যাই হোক বালিগঞ্জে একটা চেনা লোক পেয়ে গেলাম। তার বাড়িতেই উঠলাম। ভদ্রলোকের নাম বীরেন দাস। তাঁর আবার তিন মেয়ে, বড়োজন ভালো গান গাইতে পারে অনেক মেডেলও পেয়েছে। সে আমার চেয়ে বছর দু-তিনেক বড়ো। আবার প্রেমও করে। ছেলে সাধারণ কারখানায় কাজ করে।

বীরেনবাবুর আপত্তি ওই ছেলের সঙ্গে বড়ো মেয়ের বিয়ে দিতে। সেই দুঃখে বড়ো মেয়ে কন্টিনিউয়াস সাতদিন অনশনে। বীরেনবাবু অনেক কষ্টে বিয়েতে রাজি হলেন এবং তারপর বড়ো মেয়ে অনশন ভঙ্গ হল। মেজটার বিয়ে হবে হবে করছে। ছেলে আর্মিতে চাকরি করে। ছোটোটা স্কুলে পড়ে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল ছোটোটাকে পড়ানোর।

মাথায় গোবর আছে বললেও বেশি বলা হবে। আমি পড়াব কী, সে উলটে আমায় পড়িয়ে দেয়। জানি না ওনারা কী ভেবেছিলেন বা আমার ছাত্রীর মনে কী মনোভাব ছিল। তবে ওদের পাড়ায় কানাঘুষো চলত আমি ওই বাড়ির ছোটো জামাই। যাই হোক মা কেঁদেকেটে যখন খবর পেলেন যে, আমি কোথায় আছি তখন দাদাদের হাত দিয়ে পড়াশোনার জন্য কিছু কিছু দক্ষিণা পাঠাতে লাগলেন।

পড়াশোনাও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। আর টিউশানির পয়সা আমি নিতাম না, ওটা বীরেনবাবুর কাছে জমা থাকত। ওনার রেফারেন্সে গ্রাজুয়েশনের পরে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গেলাম। কারণ উনি বলেছিলেন সাধারণ গ্রাজুয়েট হয়ে কিচ্ছু হবে না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই শুধু বাড়বে। খরচা ম্যানেজ করেছিলাম ওই জমা টিউশানির পয়সা আর ওনার সামান্য কিছু সাহায্য দিয়ে। বীরেনবাবুকে কোনওদিন ভুলব না!

মাঝে মাঝে কলকাতার মিছিল-মিটিং-এ যোগ দিতাম। সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভযংকর ছিল। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা অবিলম্বে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এবং সে সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সেই দুঃসাধ্য কাজটা কীভাবে করব, লোকে উপদেশ দিত কিন্তু দৃষ্টান্ত কেউ দেখাত না।

সেই শহরে তখন নীলুদা, রূপকদার পাল্লায় পড়ে দেশের কাজে লেগে পড়লাম। বদমাস ছিলাম ঠিকই, তবে সেই কাজে উৎসাহের কোনও ঘাটতি ছিল না। আমরা পাড়াগাঁয়ের ছেলে হতে পারি, কলকাতার ওই ইঁচড়ে-পাকা ছেলেদের মতো সব জিনিস নিয়ে পরিহাস করতে শিখিনি। সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল।

আমাদের সভায় নেতা-নেত্রীরা বক্তৃতা দিতেন, আর আমরা চাঁদার বই হাতে নিয়ে না-খেয়ে দুপুর-রৌদ্রে টো-টো করে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াতাম। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে লিফলেট-পত্রিকা বিলি করতাম। সভার জন্য চেয়ার-বেঞ্চি সাজাতাম। আমাদের নেতার নামে কেউ একটা খারাপ মন্তব্য করলে মারামারি পর্যন্ত করতে এগিয়ে যেতাম। শহরের ছেলেরা এসব দেখে আমাদের নিয়ে মজা করত।

আসলে পার্টির লোকেরা যে আমার ব্রেন ওয়াশ করে রেখেছে। দেশের এখন দুরবস্থা, তাই দেশের জন্য লড়তে হবে। মনে মনে আমি প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম, আজীবন বিয়ে না করে দেশের জন্য লড়ে যাব। মাকেও তাই বললাম, পড়াশোনা শেষ না করে আমি বিয়ে করব না।

এসব ভাবনা যখন চলছিল, তার ঠিক ছমাস পরেই খবর পেলাম, এলআইসি-তে কর্মরত অবিনাশবাবুর সাথে নন্দিনীর বিয়ে হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ডামাডোলে অসহায় ভারতের চাঁদা-আদায়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম, নন্দিনীর বিয়ের খবর তখন অত্যন্ত তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। পরে শুনেছিলাম দুজনের বয়সের অনেকটাই পার্থক্য, বছর পনেরো তো হবেই।

বন্ধুরা বলেছিল বিয়ের দিন নন্দিনী নাকি খুব কান্নাকাটি করেছিল। বারবার বলছিল রাজা আমাকে ভীষণ ঠকাল। সেই ছোটোবেলা থেকে ওকে আমি ভালোবাসি। সে কথা শুনে আমার চোখের কোণাটা একটু ভিজেছিল ঠিকই আর ঠিক সেই সময়ে রবিঠাকুরের কবিতাটা কোথা থেকে যেন উড়ে এসে আমার দিকে বুকের মধ্যে তার তির নিক্ষেপ করে বলতে চাইল, যে আছে অপেক্ষা করে তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।

ম্যানেজমেন্ট পড়া সবে শুরু করেছি এমন সময় দাদা বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। সংসারে আমি আর মা। কলেজ থেকে ফিরে রাত্রে দুটো টিউশানি ধরলাম। এর ফাঁকে চাকরির সন্ধানও চলতে লাগল। ম্যানেজমেন্ট পড়ার পাঠ অনেক লড়াই ও কষ্টে শেষ হল। রেজাল্ট ভালোই করলাম। অনেক ইন্টারভিউ দেওয়ার পর একটা বিদেশি কোম্পানিতে ট্রেনিং অফিসার-এর কাজ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম মাঠে-ঘাটে পার্টির জন্য লেকচার দেওয়াটা এখন বেশ কাজে লাগবে। কাজও যেমন শেখাতে পারব, উপদেশ আর উৎসাহ দিয়ে এক একটা ছাত্রকে আগামী ভারতবর্ষের সৈনিক করে গড়ে তুলতে পারব।

ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। দেখলাম আগামী ভারতবর্ষের চেয়ে প্রোজেক্ট-এর কাজের ধারণা ও প্রোগ্রেস নিয়ে তাদের তাড়া বেশি। প্রোজেক্ট-এর সিলেবাসের বাইরে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে ম্যানেজারবাবু রাগ করেন। ধীরে ধীরে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হতে লাগল।

আমাদের বেশির ভাগ লোকেদেরই বোকা বুদ্ধি বেশি, আর কাজের বুদ্ধি কম। তাছাড়া বেশির ভাগই প্রতিভাহীন। ঘরে বসে নানান কল্পনা করতেই ব্যস্ত। কার্যক্ষেত্রে নেমে ঘাড়ে লাঙল নিয়ে পশ্চাত্দেশে ল্যাজমলা খেয়ে নতশিরে সহিষ্ণু ভাবে প্রত্যেকদিন মাটি-ভাঙার কাজ করে, সন্ধ্যাবেলায় একপেট জাবনা খেতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকে। লম্ফেঝম্ফে আর উৎসাহ থাকে না।

যাই হোক প্রোজেক্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ট্রান্সফার হয়ে গেলাম ভুবনেশ্বর। যে-গ্রামের মধ্যে আমাদের প্রোজেক্ট শুরু হবে তার প্রায় কাছাকাছিই সমুদ্র। ওখানেই একটা গ্রামে মেস ভাড়া করে থাকলাম। চারিদিকে সুপুরি, নারকেল এবং মাদারের গাছ। মেস-বাড়িটার প্রায় গায়ে দুটো প্রকাণ্ড বৃদ্ধ নিমগাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হয়ে ছায়া দান করছে।

অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি। আসলে আমি নিজেই সেই কথাটাকে বেশি প্রাধান্য দিতে রাজি ছিলাম না। সেই যে অবিনাশবাবু, এলআইসি-তে চাকরি করেন, যার সঙ্গে আমার ছোটোবেলার বান্ধবী নন্দিনীর বিয়ে হয়েছিল তিনিও এই সুদূরে ভুবনেশ্বরে আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকেন।

অবিনাশবাবুর সঙ্গে দেখা হল, আলাপ হল। আসলে আমরা দুই বাঙালি কলকাতা থেকে এসেছি। আশেপাশের বাড়িতে উড়িষ্যাবাসীরাই বেশি থাকেন। ভাষার অজ্ঞানতায় তাই কথা বলতে একটু অসুবিধা হয়। নন্দিনীর সাথে ছোটোবেলায় আমার যে জানাশোনা ছিল সেটা অবিনাশবাবু জানতেন কি না জানি না, তবে আমিও নতুন পরিচয়ে সে সম্বন্ধে কোনও কথা বলা উচিত হবে বলে মনে করলাম না। এবং নন্দিনী যে কোনওদিন আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল, সে কথাগুলোও আমি ভাবতে চাইছিলাম না। যাই হোক উনি সস্ত্রীক এখানে আছেন আমাকে বললেন, নিমন্ত্রণও জানালেন ওনার বাড়িতে যাওয়ার জন্য।

এক রবিবার প্রোজেক্টে না গিয়ে অবিনাশবাবুর বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। অনেকরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হল। আলোচনার ইতি টানা হল বর্তমান ভারতবর্ষের দুরবস্থা প্রসঙ্গে। তিনি যে সেজন্য বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মান সেটা কিন্তু নয়। কিন্তু বিষয়টা এমন যে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এ সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক অনর্গল শখের দুঃখ করা যেতেই পারে।

আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে শুনতে পাই পাশের ঘরে অত্যন্ত হালকা বাসন পড়ার আওয়াজ, দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ, আর হাওয়াই চটির খসখস। বুঝতে দেরি হল না, জানলার ফাঁক দিয়ে কোনও কৌতূহলী চোখ আমার দিকে ইশারা করছে।

সেই মুহুর্তে চোখে চোখ পড়তেই আমার মনে পড়ে গেল সেই সরলতা, সেই নিবেদিত প্রাণ এবং শৈশবের প্রেমের ঢলঢল দুটো বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থিরস্নিগ্ধ দৃষ্টি। হঠাৎ আমার হৃদপিণ্ডটাকে কে যেন তার ডান হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল আর অব্যক্ত বেদনায় বুকের ভিতরটা টন টন করে উঠল।

সেই বুকের ব্যথা সঙ্গে নিয়ে অবশেষে মেসে ফিরলাম। রাত্রে যখন লিখতে বসি কিংবা কোনও ম্যাগাজিন পড়তে বসি সেই চিন চিন ব্যথাটা শরীরটাকে কেমন যেন অবসন্ন করে রাখে। মনের মধ্যে একটা ভারী বোঝার সঙ্গে শিরা-উপশিরার রক্তগুলো দ্রুতলয়ে ছুটতে থাকে। গভীর রাতে একটু স্থির হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম এমনটা কেন হল? বিবেক যেন জিজ্ঞেস করল, তোমার নন্দিনী কোথায় গেল?

বিবেকের প্রশ্নে আমার মনের ভেতর থেকে উত্তর এল, কই তাকে তো আমি ভালোবাসিনি। কবেই তো তাকে মন থেকে মুছে দিয়েছি। সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে কেন? বিবেক আবার প্রত্যুত্তরে বলল, নন্দিনীকে তুমি ইচ্ছা করলেই পেতে পারতে। আজ শত চেষ্টা করলেও, মাথা খুঁড়ে মরলেও তাকে আর দেখতে পাবে না।

সেই ছোটোবেলার নন্দিনী যতই তোমার চারপাশে ঘুরে বেড়াক, আজ হয়তো তুমি দূর থেকে তার পায়ের নুপূরের ধ্বনি শুনতে পাবে, দূর থেকে তার শরীর থেকে মিষ্টি সুগন্ধ অনুভব করতে পারবে কিন্তু মাঝখানে চিনের প্রাচীরের মতো একটা দেয়াল থাকবে বরাবর।

মনের অব্যক্ত বেদনাকে চেপে রেখে বিবেককে উত্তর দিলাম, তা থাক না, নন্দিনী আমার কে? প্রত্যুত্তরে বিবেক বলল, নন্দিনী আজ হয়তো তোমার কেউ নয়, কিন্তু এই নন্দিনী তোমার মনের অনেক কিছু হতে পারত।

কথাটা হয়তো সে সত্যি বলেছে। নন্দিনী আমার জীবনে, মননে অনেক কিছুই হতে পারত। আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ, আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী, আমার সমস্ত জীবনের সুখদুঃখের অংশীদার ছিল সে। আজ অনেক দূরে, কত আপন ছিল, আজ পর হয়ে গেছে, আজ তাকে দেখার অবকাশ নেই। একটু দেখার চেষ্টা করলে লোকে পরকীয়ার বদনাম দেবে। সেটা হয়তো নন্দিনীর শান্তির জীবনে অশান্তি ডেকে আনবে। আর আমিও সেটা চাই না। তার সঙ্গে কথা বলা তো দূর অস্ত, তাকে নিয়ে চিন্তা করাও পাপ। আর ওই ভদ্রলোক, কোথা থেকে যে উড়ে এসে জুড়ে বসল, শুধু কটা মন্ত্র উচ্চারণ করে নন্দিনীকে আমার কাছ থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে পালিয়ে গেল।

তবু স্বামীর সুখের সংসারে যে-নন্দিনী বিরাজ করছিল সে যে ওই মানুষটার চেয়ে বেশি করে আমার, এ কথা আমি কিছুতেই মন থেকে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। জানি এরকম চিন্তা করা নিতান্ত অন্যায় এবং সেটা আমি স্বীকার করি। তবে নিজের মনের কাছে সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তারপর থেকে আর কোনও কাজে মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না। লাঞ্চের পরে যখন সুপারভাইজাররা ট্রেনিং-এর ক্লাসে বসে সোরগোল করতে থাকত, বাইরে প্রখর রোদ ঝাঁ ঝাঁ করত, গরম বাতাস নিমগাছের ফুলের গন্ধ বহন করে আনত, তখন ইচ্ছা করত… জানি না কী ইচ্ছা করত! এই পর্যন্ত বলতে পারি, ভারতবর্ষের শিল্পের এই সমস্ত ভাবী অফিসারদের প্রযুক্তিগত উপদেশ দিয়ে এই ইট-কাঠ-বালির জীবনযাপন করতে ইচ্ছা করত না।

অফিসের ছুটি হয়ে গেলে আমার ছোট্ট ওই মেসবাড়িতে একলা থাকতে মন টিকত না, অথচ কোনও অফিসের স্টাফ দেখা করতে এলেও অসহ্য লাগত। রাত্রে যখন পাশের একটা পুকুর ধার দিয়ে হাঁটতাম, তখন সুপারি-নারকেলের হেলেদুলে ওঠা অর্থহীন মর্মরধ্বনি শুনতে শুনতে ভাবতাম, মানুষ জাতটা মাকড়সার জালের মতো ভুলগুলিকে বুনতে থাকে। আবার ঘুরে ঘুরে ফিরে এসে কবে যে তাকে শোধরাবে সে নিজেই জানে না। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতে মনে পড়ে না, তার পরে প্রয়োজনে মনের বাসনা চরিতার্থ করতে টেনশন নিয়ে মরে।

অবচেতন মনে বিবেকের খোঁচা মারা ভাষণ শুনতে পাই, তুমি নন্দিনীর স্বামী হয়ে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেশ সুখে থাকতে পারতে, আর তুমি কিনা প্রথমে হতে গেলে দেশপ্রেমী এবং শেষে ইট-বালি-চুন-সুরকি কোম্পানির ট্রেনিং অফিসার। আর, অবিনাশবাবু একজন অফিসার, আর তার কি বিশেষ করে নন্দিনীর স্বামী হবার কোনও জরুরি আবশ্যকতা ছিল? বিয়ের আগে পর্যন্ত তার কাছে নন্দিনীও যেমন, রানী লক্ষ্মীবাঈও তেমন। সে কিনা কিছু না ভেবে না চিন্তা করে বিয়ে করে বসলেন আর সরকারি কর্মচারী হয়ে হাজার হাজার টাকা কামিয়ে যাচ্ছেন। যেদিন তরকারিতে বেশি নুন পড়ে যায় সেদিন তিনি নন্দিনীকে গালিগালাজ করেন, আর যেদিন মন প্রসন্ন থাকে সেদিন নন্দিনীর জন্য উপহার কিনে আনেন। গোলগাল শরীর, সু্ট-টাই পরেন, মনের মধ্যে কোনও টেনশন নেই। যাকে পুকুরের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের তারা গুনতে গুনতে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবসর সময় কাটাতে হয় না।

যাই হোক, ভদ্রলোক অফিসের কাজে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় গেছেন। অবশ্য যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছেন। আমি হাঁটছি আর ভাবছি, এই মেসবাড়িতে আজ আমি যেরকম একা আছি নন্দিনীও সেরকম বোধহয় তার ঘরে একাই আছে।

মনে পড়ে, সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার। সকাল থেকেই আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। সকাল আটটা থেকেই টুপটুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিভির খবরে বলছে ভযংকর এক ঘুর্ণিঝড় ফণী, উড়িষ্যার উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে। আকাশের ভাবগতিক দেখে আশেপাশের সব স্কুল ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে। প্রোজেক্টের কাজও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। খণ্ড খণ্ড কালো কালো মেঘগুলো যেন আকাশের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝড় আরম্ভ হল। যত রাত বাড়ছে বৃষ্টি আর ঝড়ের বেগ ভযংকর ভাবে বাড়তে লাগল। প্রথমে পূর্ব দিক থেকে বাতাস বইছিল, ক্রমে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বইতে লাগল।

ওই দুর্যোগের রাতে ঘুমোবার চেষ্টা করা বৃথা। মনে পড়ল, এই দুর্যোগে নন্দিনীও ঘরে একলা আছে। আমাদের মেসবাড়ি তাদের একতলা ঘরের থেকে অনেক মজবুত। কতবার মনে করলাম, তাকে মেসবাড়িতে বসিয়ে রেখে আমি না হয় পুকুর পাড়ে গ্রামের কোনও চালাঘরের নীচে দাঁড়িয়ে বিধ্বংসী ঝড়ের রূপ উপভোগ করব। কিন্তু কিছুতেই মন স্থির করে উঠতে পারলাম না। অনেকটা মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আটকে গেলাম।

রাত যখন একটা-দেড়টা হবে হঠাৎ আরও প্রবল বেগে ঝড়ের সোঁ সোঁ ডাক শোনা গেল। সমুদ্র যেন উথাল পাতাল হয়ে ছুটে আসছে। ঘর থেকে ছাতা হাতে বাইরে বেরোলাম। দেখি একটা রক্তকরবী গাছ ঝড়ের দাপটে একদম শিকড় থেকে উপড়ে পড়েছে। আমার খুব পছন্দের ফুল। মনে পড়ে কতদিন নন্দিনী তার ওড়নায় বেঁধে আমার জন্য নিয়ে এসেছে। সে কথা মনে পড়তেই কটা ফুল কুড়িয়ে নিলাম। নন্দিনীর বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। পথে যে-পুকুরের পাড়, সে পর্যন্ত যেতে না যেতেই দেখি হাঁটুজল হয়ে গেছে। পুকুরের পাড়ের উপর যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন দ্বিতীয় আর একটা জলের স্রোত এসে আছড়ে পড়ল।

পুকুর পাড়ের একটা অংশ প্রায় দশ-এগারো হাত উঁচু। পাড়ের উপর আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম, বিপরীত দিক থেকে আরেকজন লোকও উঠে দাঁড়াল। লোকটা যে কে সেটা আমার সমস্ত অন্তরাত্মা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমার সমস্ত শরীর অনুভব করতে পারল। এবং সেও যে আমাকে চিনতে পারল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম রাজা, তুমিও এখানে?

সমস্ত জলমগ্ন হয়ে গেছে কেবল হাত-পাঁচ-ছয় দূরত্বে দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী এসে দাঁড়ালাম। তখন প্রলয় চলছে, আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ যেন নিভে গেছে। তখন একটা কথা বললেও বলতে পারতাম। হাতে ধরা সিক্ত রক্তকরবী ওর পায়ের কাছে পড়ে গেল কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেউ কাউকেও একটা কুশল প্রশ্নও করল না। শুধু দুজনে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে রবিঠাকুরের গান গেয়ে উঠলাম, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার।

আজ সমস্ত বিশ্বসংসার ছেড়ে নন্দিনী আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ এই বিপদের দিনে আমি ছাড়া নন্দিনীর পাশে কেউ নেই। সেই কবে শৈশবে, কোন এক জন্মান্তর, কোন এক পুরোনো রহস্য অন্ধকার থেকে ভেসে, এই সূর্য‌্য আর চন্দ্রের আলোকে আলোকিত হয়ে এই পৃথিবীর কোলে আমারই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল; আর, আজ বহুদিন পরে সেই আলোকিত পৃথিবী ছেড়ে এই ভযংকর জনশূন্য প্রলয় অন্ধকারের মধ্যে নন্দিনী একাকিনী আমারই পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। জন্মের পরে সেই ফুলের কলিকে যেমন বিধাতা আমার হাতে সমর্পণ করেছিল, আজও প্রকৃতির তাণ্ডবে জীবনমৃত্যুর মাঝখানে সেই বিকশিত পুষ্পকে আমারই কাছে এনে দাঁড় করিয়েছে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে আর একটা ঢেউ আসলেই পৃথিবীর এই সীমানা থেকে বিচ্ছেদের শেষ বৃন্তটুকু ছিঁড়ে, আবার আমরা দুজনে এক হয়ে যেতে পারি।

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সে ঢেউ যেন আর না আসে। স্বামী সংসার নিয়ে নন্দিনী যেন বাকি জীবন সুখে থাকে। ওই রাতে ফণীর তাণ্ডবে হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তবু এই মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে নন্দিনীকে ফিরে পেয়ে এক অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পেয়েছি।

রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। ঝড় থামল, জলও নেমে গেল। নন্দিনী কোনও কথা না বলে বাড়ির পথে পা বাড়াল। তার পায়ের সামনে পড়ে থাকা রক্তকরবী ফুলগুলো কি বলল জানি না, তবে আমিও কোনও কথা না বলে মেসবাড়ির দিকে রওনা হলাম। কোনওদিন কবিতা লিখিনি, কিন্তু আজ বিবেকের দংশন খেয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে কয়েকটা লাইন লিখে ফেললাম,

আজ এই প্রলয়ে দিনে,

মেঘে মেঘে গুরু গর্জনে

ধেয়ে আসে ঘুর্ণিঝড় ফণী,

তুমি এসে দাঁড়ালে নন্দিনী।

নূপুর ছিল না ওই পায়,

এভাবে কেউ অভিসারে যায়?

পায়ে পায়ে বাজে না কিঙ্কিণী,

কেন এসে দাঁড়ালে নন্দিনী?

এলে যদি কেন গেলে একা?

আর কি হবে না তবে দেখা?

শৈশবের কৈশোরের রানি

সব ভুলে গেলে নন্দিনী?

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মেসে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আমি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমীও হতে পারলাম না, ইঞ্জিনিয়ারও হতে পারলাম না, আমি সামান্য এক ইট-বালি-চুন-সুরকি কোম্পানির ট্রেনিং অফিসার। সাধারণ মেস বাড়িতে থাকি। শুধু ক্ষণিকের অবকাশে এক প্রলয়রাত্রির উদয় হয়েছিল আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে। সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে, একমাত্র সেই প্রলয়রাত্রিতে আমার তুচ্ছ জীবনে নন্দিনীকে ফিরে পাওয়াই আমার জীবনের চরম সার্থকতা।

 

জীবন-নদী

অদিতি এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। অদিতি এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে তাও অকল্পনীয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে এত রূপ রস, সব আমার জন্য!

‘আমি তোমার সাথে দেখা করব।’ অচেনা স্বর, কিন্তু আওয়াজে বোঝা যায় কিশোরী কণ্ঠ। দ্বিধাহীন ভাবে ‘তুমি’ সম্বোধনে সে কথা বলল।

‘কে কথা বলছ?’

‘নয়না।’

ভেবে পেলাম না এমন নামে আমি কাউকে চিনি কি না। গম্ভীর হয়ে তাই জবাব দিলাম, ‘আমার কোনও আগ্রহ নেই তোমার সাথে দেখা করায়।’ ওধার থেকে ধীরে জবাব এল, ‘আপনি আমায় মানে নয়নাকে চেনেন না কিন্তু আমার মাকে চেনেন।’ মেয়েটা হঠাৎ ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে উঠে এল। বোধহয় আমার বলাটা একটু বেশিই রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল।

সকালবেলা একটা উটকো ফোন। চা খাওয়া হয়নি এখনও। বাসি মুখেই এমন ঝামেলা। দিনটা কেমন যাবে কে জানে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না,’ বলেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোনও দিশা খুঁজে পেলাম না। কার মেয়ে! আমার কাছে কী চায়? ‘মেয়ে’ শব্দটাই আমার কাছে অতীত মাত্র। সেই স্মৃতি– যা আমায় রুক্ষ, একা করে দিয়েছে। জীবনবোধে বিতৃষ্ণা এলেও জীবনকে ছাড়তে পারিনি। মেয়েটা কে? অদিতির চলে যাওয়া, আমার মাথার উপর ছাদ উড়ে যাওয়ার সমান। আমি ফিরে গেলাম চল্লিশ বছর আগের স্মৃতির পাতায়।

মফসসলের ছেলে আমি। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় বাবা পাঠিয়ে দিল কলকাতায়, কাকার বাড়ি। ভর্তি হলাম আশুতোষ কলেজে। কাকার বাড়ি থেকে কলেজ হাঁটা পথ। একদিন এমনই একা একা হেঁটে ফিরছি রবীন্দ্রসরোবর লেকের ভিতর দিয়ে হঠাৎ কেউ ডাকল ‘হাই অলোক।’ তাকিয়ে দেখি আমাদেরই সাইকোলজি ক্লাসের একটি মেয়ে। অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি। বেশ ভালো লাগল কিন্তু ও আমার নাম জানল কী করে? ওই বয়েসে বেশ গর্ব-ও হল ক্লাসমেট আমার নাম জানে বলে। আমি হেসে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমার নাম অলক, অলোক নয়।’ ও পরিচয় দিল, ‘আমি অদিতি। তুমি কোথায় থাকো? আমি কি তোমার সাথে একটু হাঁটতে পারি? আমার বাড়ি কাঁকুলিয়া রোড। বাড়িতে…।’ বেশ অনেকক্ষণ একা একাই বকবক করে গেল। হঠাৎ কী মনে হতে নিজেই চুপ করে হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কই কথার জবাব দিলে না তো?’ আমি ওর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম– ‘সময় দিলে কোথায় কথা বলার?’ এইভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব। অদিতি কবে যে আমার কাছে ‘দিতি’ হয়ে গেল তা নিজেই জানি না। এই আমার দিতি। অদিতি।

সামাজিকতার ধার আমি কোনওদিন ধারিনি। নিজের ইচ্ছেতেই চলেছি।

আমি এই বয়েসে নিজের কাজকর্ম নিয়ে বেশ আনন্দে আছি। জীবনে তেমন উচ্চাশা নেই, কেউকেটা হতেও চাইনি। তাই কলেজ জীবনে যখন, কলেজের মধ্যে সবথেকে সুন্দরী, মেধাবী মেয়েটি আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ছিল, আমার সহপাঠীরা বেশ ঈর্ষান্বিতই হয়েছিল। আমার কিন্তু কোনও হেলদোল নেই, আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। অদিতিও বেশ স্বাভাবিক। আমাদের মেলামেশা দিনের আলোর মতো সহজই ছিল কিন্তু অদিতি ধীরে ধীরে সেই সীমা ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে এল। আমি বারণ করেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম ‘দিতি তোমার সমাজ আর আমার সমাজে অনেক তফাত। প্লিজ, তুমি এমন কোরো না, পরে কষ্ট পাবে।’ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। অদিতি আমার কোনও কথাই শুনল না। ও দুর্দম, আমিও ভেসে গেলাম ওর সাথে। জানতাম অদিতির জীবনে আমি প্রথম পুরুষ নয়, তবু নিজের মধ্যে একটু দোটানা থাকলেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। আমরা স্বপ্নে ভেসে গেলাম– ছোট্ট সংসার, টলোমলো পা।

সত্যি আমরা ভেসে গেলাম। যেদিন দিতি জানাল তার শরীরের নতুন অনুভবের, সেদিন আমি আনন্দের পরিবর্তে বেশ ভীত হয়ে উঠলাম। মুখে হাসলেও দিতি ঠিক বুঝতে পারল, আমি ভয় পেয়েছি। দুজনের বাড়িতে কে কী বলবে? কীভাবে সামলাব? আমার শুকনো মুখ দেখে অদিতি কি বুঝল, কে জানে! বারবার একই কথা জোরের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করতে থাকল, ‘আমাদের ভালোবাসার ফসল, নতুন মানুষ আসবেই। আমাদের উত্তাপ ওর মধ্যেই। আমি পারবই।’ আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। খটকা লাগল ওর কথায় ‘আমি পারবই,’ তবে কী ‘আমরা’ নয়? হঠাৎ অনুভব করলাম আমি ঘেমে উঠেছি। এমনই হয়েছিল যেদিন প্রথম অদিতিকে আমি চুমু খেয়েছিলাম, ফাঁকা কলেজ করিডোর-এ। ভুল বললাম, আমি নয়, ও এগিয়ে এসে সপাটে জাপটে ধরে…। আমি ছটফট করে ওকে ঠেলে দিতেই ওর বাঁধভাঙা হাসি। ভয়, ভালোলাগা মিলেমিশে… এমনটাই হয়। হয়তো বা সকলের জীবন-সন্ধিক্ষণে। সেই শুরু। এতদিন পরে অদিতির সন্তানসম্ভাবনার কথা শুনে আবার তেমন ভয় আমায় চেপে ধরল।

সময় এগিয়ে চলে। অদিতির আড়ষ্টতাহীন চলাফেরা আমায় আবার স্বাভাবিক করে তুলল। আমি প্রায় ভুলেই গেলাম ওর শরীরের নতুন অঙ্কুরোগদ্মের কথা। আমি মেতে উঠলাম ওকে নিয়ে। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, হইচই করা, ঘুরে বেড়ানো সব আগের মতোই। ধীরে ধীরে আমি ধাতস্থ হয়ে গেলাম। দুজনের আনন্দের জীবনে শুধু নিস্তরঙ্গ জোয়ারের খেলা। অদিতি কিছু বুঝতে দেয়নি।

জোয়ারের পর ভাটা অনিবার্য। তা এল, কিন্তু এমনভাবে যা আমার কল্পনার অতীত। দিতি একদিন এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘আজ আমার লাঞ্চ আছে, স্পেশাল ব্যাপার।’ আমি শান্ত চোখ তুলে তাকালাম। কোনও প্রশ্ন নেই মুখে। শুধুই তাকিয়ে থাকলাম। ও আশা করেছিল আমি কিছু জিজ্ঞাসা করব। দিতিই নীরবতা ভাঙল, ‘আমার পুরোনো প্রেমিক। লন্ডন থেকে এসেই যোগাযোগ করেছে। সোহম সেন।’ আমি জানতাম, অদিতি বলেছিল, দুম করে সোহমের লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ চান্স পেয়ে যাওয়ার কথা। অদিতির খুব মন খারাপ হয়েছিল। তবে ওর মতন হুল্লোড়বাজ মেয়ের সব কিছু ভুলে যেতে সময় লাগেনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় অদিতি খুবই ক্যাজুয়াল। জামাকাপড় বদলানোর মতো বয়ফ্রেন্ড বদল করে। ভাবতেও ভালো লাগে না এভাবে। আসলে ও তো ধনী পরিবারের দুলালি। আমারও কখনও কখনও সংশয় হয়। সত্যি ভালোবাসে তো মেয়েটা আমায়! আচ্ছা ও কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট! তাই ওর সাথে দেখা করা। আমার মনের মধ্যে যাই-ই হোক, আমি ‘না’ বলতে পারিনি ওর মুখ দেখে।

সেদিন দিতি কলেজে এলেও ক্লাস করল না, তারপর দিনও এল না। পরপর চারদিন এল না। ওর ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ সদুত্তর দিতে পারল না। যেখানে যেখানে খোঁজ নেওয়া যায় নিলাম, কিন্তু কোথাও দিতির খোঁজ পেলাম না। হতাশা কেমন যেন আমায় গ্রাস করে নিল। আমি কলেজে আসতাম, শুধু আমার শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে। মনটা সারাক্ষণ অদিতি-অদিতি করে ওকেই খুঁজে চলত।

গাছতলায় মাথা হেঁট করে বসে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছি, মাটি খুঁটছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম সামনে একটা ছায়া। মুখ তুলে দেখি অদিতি। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে, ঝলমল করছে ও। আমি বুঝলাম না, কারণটা কী? আমি রাগে-দুঃখে ওকে দেখে চিৎকার করে উঠলাম ‘কী ব্যাপার তোমার? তুমি বোঝো না, তোমার সাথে একদিন দেখা না হলে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাই। কোথায় ছিলে? এত দায়িত্বজ্ঞানের অভাব কেন?’ অন্য সময় আমি চিৎকার করলেই দিতিও সমানতালে ঝগড়া করত। সব সময় আমিই পরাজিত হতাম এবং হেসে সারেন্ডার করতাম। আজ এ কোন দিতি, আমার সামনে? আমি চিৎকার করছি, ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকল। আমি হতভম্ব। দিতি চুপ করেই থাকল, তারপর যেন বহু কষ্টে নীরবতা ভেঙে অস্ফূটে বলল, ‘সরি অলক, এই ক’দিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে আমার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। আমার মতামত নিয়ে, সোহমের সাথে।’ অর্থাৎ অদিতির প্রাক্তন প্রেমিক, লন্ডন ফেরত, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় পূর্ণ সেই সোহম সেনই দিতির মনোনীত পাত্র। দিতির কথা শুনে আমি প্রায় হিংস্র বাঘের মতন হয়ে উঠেছিলাম। আমি হিস হিস করে বলে উঠলাম, ‘অসম্ভব, আমার দিতি অন্যের হতে পারে না। আমি তোমার বাড়িতে যাব, মা-বাবার সাথে কথা বলব, তুমি এভাবে আমায় ছেড়ে…।’

‘চুপ অলক’, আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দিতির শানিত স্বর আমায় থামিয়ে দিল। ‘কত উপার্জন তোমার? তোমার স্ট্যাটাস কী? কী খাওয়াবে? সবার আগে বলো, আজ বিয়ে করলে কোথায় রাখবে আমায়?’ আমি ঝড়ে ধাক্বা খাওয়া পাখির মতন যেন কিছুটা টাল খেয়ে গেলাম ওর কথায়, একটু সামলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। সত্যিই তো, অদিতির কথাগুলো বাস্তব-যুক্তিপূর্ণ। আমার কী আছে?

অদিতি সত্যিই চলে গেল আমায় ছেড়ে। আমার অনেক কিছু বলার ছিল, করার ছিল। কিন্তু আমি পারলাম না। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম শামুকের মতন। দিতির শেষ কথাগুলো ‘তোমার স্ট্যাটাস কী? কোথায় রাখবে?…’ আমায় যেন এক নতুন আমি-তে রূপান্তরিত করল। আমি নিজেকে নিয়ে একটা ব্যূহ রচনা করে ফেললাম। নিজেরই অজান্তে। দিতি-সোহম, চলে গেল গোয়ায়। ও বিয়েতে নিমন্ত্রণও করে গিয়েছিল। কলেজ সহপাঠীরা জোরজবরদস্তি করে আমায় নিয়ে গিয়েছিল। ওরা সব কিছু জানত, তবুও। পরে শুনেছি অদিতি ওদের বারবার বলেছিল আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের বাড়ি গিয়েও আমি অদিতির সামনে দাঁড়াতে চাইনি। ঢুকেই কোল্ড-ড্রিংকস নিয়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম। অদিতি খুঁজে পেতে ঠিক আমার সামনে হাজির। অদিতি– না স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরি! আমার চোখের পলক পড়ে না। আমি মূর্তির মতো নিথর। নিজের না পাওয়া আকাঙ্খাগুলো, ক্ষোভ-যন্ত্রণা আবার যেন সামনে এসে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। অদিতি আমার। কেন অন্যের বিছানায় ও শোবে! কেন? কেন? একটা কথাও অদিতিকে বলতে পারলাম না। অথবা ওই অবস্থাতেও সে আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘অলক আমি তোমারই থাকব।’

মেয়েদের প্রতি আমার এক অদ্ভুত বিতৃষ্ণা সেই থেকে। আমি নিজের লেখাপড়ার মধ্যেই পুরোপুরি ডুবে গেলাম। নিজের শরীর, খাওয়াদাওয়া, কোনও দিকে দৃষ্টি নেই। বাবা-মা এসেছিলেন, আমায় বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আমি নারাজ। এভাবে মাস গড়াল, ফুরোল বছর।

স্মৃতির জালে যেন খাবি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় কলিংবেল শুনে আমার চমক ভাঙল। আমি স্খলিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার বেল, ভাবার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে? মাথা কাজ করল না। প্রায় অবশ হাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। এ কে! প্রায় কুড়ি বছর আগের দিতি এতটুকুও বদলায়নি! এ কী করে সম্ভব! আমি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়েই রইলাম। দিতি না, দিতির প্রতিচ্ছবি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমারই ঘরে বিনা অনুমতিতে গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। বিছানায় ছড়ানো আমার পুজো সংখ্যার উপন্যাসের খসড়া। দিতি নয়, নয়না মেয়েটি আমার কোনও পরোয়া না করেই ঘরের মধ্যে এটা ওটা ঘুরে দেখতে শুরু করল। বইয়ের তাক, টেবিলে ছড়ানো বই, ঢাকনা না লাগানো পেন, পেনসিল, ফাইল-ক্লিপ সব এলোমেলো। ও শুধু দেখেই গেল। যেমন দিতিকে আমি কখনও বারণ করতে পারতাম না, নয়নাকেও আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার চোখজোড়া ওকে অনুসরণ করে গেল। একসময় ও থামল, আবার চেয়ারে এসে বসল, ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি।’ প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন এসেছ?’ নয়না তক্ষুণি কোনও প্রত্যুত্তর করল না। কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘আমি জানি, আপনি আর মা মেড ফর ইচ আদার ছিলেন। সমাজ, পরিবার আপনাদের এক হতে দেয়নি। আমার মা পারেনি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে। তাই আপনাদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন নিয়ে সে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যে-বীজ বপন হয়েছিল তার শরীরে, তাকে সে বিনষ্ট হতে দেয়নি। ডালপালা মেলে তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করেছে। সোহম সেন সামাজিক দায়িত্ববোধে অবশ্যই আমার বাবা। কিন্তু আমার মা, মানে আপনার অদিতি, দিতি আমায় সব বলেছে অকপটে। আমার স্কুল-গণ্ডি পার হয়ে যাবার পরেই। আমি দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম, কবে আপনার সাথে দেখা হবে।’

আমি স্থবির, নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। একি শুনছি। দিতি এখানেও তুমি আমায় হারিয়ে দিলে! তোমার প্রতি আমার যে ধারণা তা চুরচুর করে ভেঙে তুমি সোহমের সঙ্গে চলে গিয়েছিলে। সেটা যে তোমার অভিনয় ছিল তা বিন্দুমাত্র আমাকে বুঝতে দাওনি। আমার ভালোবাসাকে তুমি অপমানিত হতে দাওনি, দিতি। মেয়েদের প্রতি আমার যত বিষ সব আমি উগরে দিয়েছি, ঘৃণা, জ্বালা সব মিলিয়ে মেয়েরা যে বিশ্বাসঘাতকতার নজির তৈরি করেছিল আমার জীবনে, তা একমুহূর্তের জন্য ভুলিনি। আজ নয়না আমায় সম্পূর্ণরূপে এলোমেলো করে দিল। দিতি আমায় তুমি ক্ষমা করো। নিজেকে অবহেলা অযত্নে শেষ করে দিয়েছি। তুমি চলে যাওয়ার পর নেশা ধরলাম। কিছুদিন বাদে বুঝলাম আমি নেশা না করতে চাইলেও মদ আমার পিছু ছাড়ে না। আমার শরীর পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এই মধ্যচল্লিশে আমায় দেখতে লাগে ষাট বছরের বুড়োর মতো। আজ আমার সামনে আমার আত্মজ– নয়না। আমি কি স্বপ্ন দেখছি!

মা জানত, বাড়িতে জানাজানি হলে দাদু আপনাকে খুন করিয়ে দিতেও দ্বিধা করবেন না। আপনিও জানেন আমার মামার বাড়ির অর্থনৈতিক ক্ষমতা-প্রতিপত্তির কথা। তাই মা নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল। মায়ের জেদ ছিল আমায় পৃথিবীতে আনার। সোহম সেনের প্রতি তার কর্তব্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। শুধু এতগুলো বছর মা অপেক্ষায় ছিল, আপনাকে দেখানোর জন্য মা ও আপনার ভালোবাসায় ফাঁকি ছিল না।’

এ কোনও স্বপ্ন নয়, বড়ো নির্দয় কঠিন বাস্তব, নয়না, নয়নমণি।

 

শহরবাসের কথকতা পর্ব-০১

( ১ )

আজও পাদ্রিপাড়ার গলি দিয়ে যাওয়া হল না।

ব্যাংক থেকে বেরিয়ে টোটোকে বললাম, লালবাগান। ভেতরে ঢুকতে হবে না, মুখেই নেমে যাব।

টোটো টুনু ঘোষ সরণি দিয়ে চলতে শুরু করল।

আসলে যাওয়া হল না নয়, আমিই তাকে বললাম না। ওই পথে যাওয়া হয়নি কত দিন! প্রায় ষোলো কি আঠেরো বছর। সেই যে ছিয়ানব্বইয়ে মাধ্যমিক দিলাম তারপরই যেন লায়েক হয়ে গেলাম। তখনই সাইকেল কেনা হল, অ্যাটলাস। আমার মানে সব বন্ধুদের পথ গেল বদলে। আমরা আর খানাখন্দ গর্তে ভরা এঁকাবেঁকা সরু পথে হাঁটতেই ভুলে গেলাম।

মাধ্যমিক পাশের পর আমাদের শার্টের রং গেল পালটে। প্যান্টের ডিজাইনও। সাইকেল চালাতে চালাতে উড়ি রং-বেরঙের প্রজাপতির সামনে পাশে কিংবা পেছনে। তারপর সেই রঙিন বিকেল মিলিয়ে যাওয়ার সময়ই রঙিন প্রজাপতি এক একটা গলির মুখে এসে মিলিয়ে যায়।

আমরা আবার আপন পথেই ফিরে আসি বাড়িতে।

সেই সমরকাকুর সাম্রাজ্য। বিশাল মাঠ। বাগান। মন্দির। তিনটে বিরাট বিরাট পুকুর। লোকে টিকিট কেটে মাছ ধরত বাগানের পুকুরে। জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। অজস্র ঘর। অনেক ঘরে আমরা ঢুকিইনি।

সমরকাকুর দুই মেয়ে সুমিতা আর অমিতা আমাদের সঙ্গেই প্রাইমারিতে পড়ত। ওদের বাড়ির অনুষ্ঠানে আমাদের নিমন্ত্রণ থাকত। বাসব, জয়ন্ত, ডলি, রাইমা, আমি সবাই যেতাম বিকেলবেলায়। বাড়ির উঠোনে ব্যাডমিন্টন, গোল্লাছুট কিংবা চোর-পুলিশ খেলতাম।

সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে দেখতাম পাঁচিলের ধারে কত হলুদ কলকে ফুল ফুটেছে। আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যেত জেট প্লেন। বিস্ময়ে দেখতাম সরু ধোঁয়ার রেখা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। ডলিও বুকে হাত রেখে আমার পাশে শুয়ে বলত দেখেছিস, কী সুন্দর চাঁপাফুল ফুটেছে? দাঁড়া কুড়িয়ে আনি।

ফ্রকের কোঁচড়ে করে আট-দশটা কাঠচাঁপা এনে হাঁটু মুড়ে পাশে বসে আমার নাকের সামনে ঘোরাত। রাইমা, সঞ্জনা, বাসব সবাই ছুটে আসত। ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমি অবাক হয়ে দেখতাম কেমন নিঃশব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে জেট প্লেনের ধোঁয়াটা।

আবার খেলা শুরু করতাম। সুমিতা ঘর থেকে একটা ক্যাম্বিস বল আনত। বিস্কুটের মতো সাতটা টালির টুকরো ওপর ওপর সাজিয়ে পিট্টু খেলতাম।

আমাদের তখন ক্লাস থ্রি। বিকেল ফুরিয়ে আসার আগেই বাড়ি ফিরে আসতে হয়। সুমিতাদের বাড়ির সামনে একটা লম্বা ঝিল। ঝিলের শেষে কেউ হেঁটে গেলে মনে হতো লিলিপুট। ঝিলের পাড়ে ধোপাদের জলের মধ্যে খুঁটি পুঁতে কাঠ লাগিয়ে কাপড় ধোলাইয়ে পাঠাতন করা। বাড়ি ফেরার সময় আমরা সবাই এক একটা পাঠাতনে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতাম।

নারকেল গাছ তাল গাছের মাথার উপর কমলা রঙা কত্ত বড়ো সূর্যটা, ছোটো হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। পুকুরে কমলা আভা। জলফড়িং ছোঁ মেরে যায়। কমলা রং গোল হয়ে ছড়াতে ছড়াতে আমাদের সামনে চলে আসে। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠি।

রাইমা বলে এবার চল। মা বকবে।

জয়ন্ত বলে একটু দাঁড়া না। সূর্যটা একেবারে ডুবে যাক।

ডলি বলল তোরা থাক। আমরা চললাম।

আমরা সবাই পথে পড়ে থাকা একটা মাঝারি সাইজের ইটকে ফুটবলের মতো মারতে মারতে বাড়ি ফিরি।

একদিন ইটটা রাইমার গোড়ালিতে গিয়ে লাগল। রাইমা কেঁদে উঠে বলল, কাল থেকে তোদের সঙ্গে আর খেলব না।

সত্যিই রাইমা দুদিন এল না। স্কুলেও যায়নি। পরের দিন খেলতে গিয়ে দেখি রাইমা আসেনি। আমাদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই গেলাম ওদের বাড়ি।

রাইমার জ্বর। কাঁথা চাপা দিয়ে শুয়েছিল। খুব খুশি হল ওকে দেখতে গেছি বলে। বলল তোরাই শুধু আমাকে দেখতে এলি। মামা, জেঠিমারা কেউ আসেনি।

সঞ্জনা, অমিতা, সুমিতা, ডলি, অঞ্জলি করে চাঁপা আর কলকে ফুল নিয়ে গেছিল ওর জন্য। সব বাটির জলে ভাসিয়ে টেবিলে রাখল।

বাসব ওর পায়ে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল তোর সেদিন খুব লেগেছিল? ব্যথা?

বিনুনি দুলিয়ে রাইমা বলল, একটুও না। আমি তোদের সঙ্গে মজা করেছিলাম।

হাসতে হাসতে মজায় মজায় ঘরের মধ্যে বিকেল ফুরিয়ে এল। জানলা দিয়ে কমলা রঙের আকাশ দেখা যাচ্ছে। আমরা বেরিয়ে এলাম জয়নগরের মোয়া খেতে খেতে।

হাঁটতে লাগলাম পুটুসফুল, আকন্দফুল, শ্যাওড়ার ঝোপের পাশ দিয়ে গাছের ডালে ডালে পাখির কলরব। সূর্যের সামনে দিয়ে উড়ে যায় কাক।

হঠাৎই অমিতা বলল সন্ধে হয়ে গেছে। এবার ভাঙা মন্দিরের বনে শিয়াল ডেকে উঠবে। ভয়ে আমরা দৌড়োতে শুরু করলাম।

এসবই অমিতাদের, সমরকাকুদের… সবই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। এই মন্দির

যে-কত বছরের আমরা জানি না। এখানে খেলি, ঘুরে বেড়াই শুনে ঠাম্মা বলেছিল ওখানে মামদো ভত থাকে। মন্দিরের পাশের পুকুরে চান করতে নেমে কত মানুষ ডুবে গেছে তার হিসেব নেই।

ভাঙা পরিত্যক্ত সুড়কি ঝরা মন্দির বনের মাঝে। মন্দিরের চূড়ার গায়ে বড়ো হয়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থ গাছ। সমরকাকু বলেছিলেন, ভেতরে তক্ষক আছে। ডাকে মাঝে মাঝে। মন্দিরের চারপাশে জমিতে মাঝেমাঝে গর্ত মতো হয়ে আছে। ওখানে নাকি ত্রিশূল পোঁতা থাকত।

এই পথে সুমিতারা আসতে চায় না। সত্তর দশকের উত্তরের নকশাল আন্দোলনের হাওয়া আছড়ে পড়েছিল এই অঞ্চলেও। অমিতা এক বৃষ্টির বিকেলে বলেছিল, পুলিশ গভীর রাত্রে নকশালিস্টদের ভ্যানে করে এনে পেছন থেকে গুলি করে মেরেই জঙ্গলে ফেলে দিত। ওর মেজকাকাকে তাই করেছিল। পরের দিন কাকার দেহটা পাওয়া যায়।

সুমিতাদের সদর দরজার সামনে এসে আমাদের দৌড় থামল।

সমরকাকুর গলির একটা সরকারি নাম আছে। বিপ্লবী উপেন ব্যানার্জি লেন।

এই নাম কেউ জানে না। এখানে পড়ে আছে আমার শৈশবকাল, কৈশোরবেলা। প্রথম চুম্বনের আবেশ। প্রথম যৌবনের সাম্রাজ্য।

সকলেই বলে এ অঞ্চলটা পালটে গেছে। পিচের রাস্তা হয়েছে। ফুটবল খেলার মাঠে ফ্ল্যাট উঠছে। মন্দিরটা মাটিতে মিশে যাচ্ছে যেন।

ভয় করে শুনতে আমার। ছেলেবেলাকে ভুলতে ইচ্ছা করে না। বন্ধুরা সবাই হারিয়ে গেছি। ছেলেবেলার স্বপ্নের গল্পগুলো ভুলে গেছি। ভুলে যাচ্ছি সত্তরের দশকে সেজমামার উধাও হয়ে যাওয়া কিংবা খুন হওয়া।

মা-মাসিরা আজও বলে দেখিস, সেজদা একদিন ফিরে আসবে।

দিদাও সে কথা বলতে বলতে একদিন ঘুমের মধ্যে মারা গেছে।

সমরকাকুর মাঠ আমায় ডাকে। ঘুমের মধ্যে ডাকে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে পলিত কেশ সমরকাকু আমায় ডাকে আয়… আয়…

আমি বলি যাব, নিশ্চয়ই যাব…। ক্লাস ফাইভে উঠতেই সব কিছু কেমন হয়ে গেল। মেয়েরা চলে গেল ঊষাঙ্গিনী অথবা শিক্ষামন্দিরের মতো স্কুলে। ছেলেরা গেলাম কানাইলাল, অরবিন্দ কিংবা রক্ষিতে। আমার সঙ্গে জয়ন্ত আর বাসব এল কানাইলালে।

( ২ )

জীবনের শোক-তাপ বোঝার বয়স তখন আমাদের কারওরই হয়নি। আমারই হল। জানুয়ারির মাঝামাঝি রাত সাড়ে দশটা। মা আমাকে খাইয়ে মশারিতে ঢুকিয়ে লেপচাপা দিয়ে বলল, ঘুমোও। বাবা ফিরলে শোওয়ার সময় একবার হিসি করে নেবে। তখনই সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল। এই শব্দ বাবার নয়। বাবা আস্তে আস্তে দুবার নাড়ে। মায়ের পেছন পেছন আমিও গেলাম। স্ট্রিট ল্যাম্পের স্বল্প আলোয় কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। সোমনাথকাকুর গলাটা শুধু চিনতে পারলাম। তারপর ভড়জেঠু, প্রদু্যত্কাকু, অসীমজেঠু সবাইকে চিনতে পারলাম। সোমনাথকাকু বললেন, বউদি, আপনারা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন। ঠান্ডায়, উত্কন্ঠায় জড়ানো গলায় মা বলল, কেন?

সবাই চুপ।

মা যেন এবার সাহস পেয়েছে। চাদরটা মাথায় তুলে বলল কেন বলুন? কী হয়েছে? কোথায় যাব?

কেউ কোনও কথা বলছে না। হয়তো কীভাবে বলবে ভাবছে। কিছুক্ষণ পর ভড়জেঠু বললেন, একটু হাসপাতালে যেতে হবে। আমরা রিকশা নিয়ে এসেছি। মা চাদরটা মুখে চেপে দরজাটা ধরে বলল হে ঠাকুর! এ আমার কী হল?

আমার তখন নতুন ক্লাসের সব বই কেনা হয়নি। মাত্র পাঁচটা হয়েছে। বাবা ব্রাউন পেপারে খুব সুন্দর করে মলাট দিয়ে বলল শনিবার মাইনে পাব; বাকি বই কিনে দেব।

কারখানায় কাজ। তাই বাবাদের সপ্তাহে সপ্তাহে মাইনে হয়। আমি নতুন বইয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বললাম বাবা, সামনের মাসের এক তারিখ থেকে ড্রেস পরে যেতে হবে। না হলে ক্লাসে ঢুকতে দেবে না।

বাবা বলল ঠিক আছে। পরের সপ্তায় ড্রেস হয়ে যাবে। আমরা যখন সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন বাবার পাশে অরুণজেঠু আর কার্তিকজেঠু দাঁড়িয়ে বাবার শরীরটা সাদা চাদরে মোড়া। আমাদের সঙ্গে পাড়ার জ্যোত্স্না কাকিমা এসেছিলেন। মহিলাসমিতি করেন। দারুণ সাহসী। আমার মনে হল কাকিমা বাবার মাথায় হাত দিলেই বাবা বেঁচে যাবে। আফটারনুন ডিউটি করে বাবা ফিরছিল। সঙ্গে ওঁরাও। বাবা লরি চাপা পড়েছিল।

এদিকে বিকেলে খেলতে যাচ্ছি না বলে বন্ধুরা সবাই চারদিন পর এল। ছোটোকাপড় পরা অবস্থায় আমায় দেখে ওরা চমকে উঠল।

মৃত্যু কী! অকাল মৃত্যু কেমন! শৈশবে পিতৃহীন হওয়া কী! এসব বোধই আমার তৈরি হয়নি। বললাম, জানিস আমার বাবা মারা গেছে।

অমিতা, ডলি আমার দুহাত ধরে কেঁদে উঠল। মৃত্যুকান্না কী তা ওদের কান্নায় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ওই শীতের ভোরে গঙ্গার হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে বাবার শেষকৃত্য করেছি। তখনও বুঝিনি পিতৃহীনতা কী।

আমার দুচোখ বেয়ে জল এল। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম আমার পাঁচটা মাত্র বই কেনা হয়েছে। বাকিগুলো বাবা রবিবার কিনে দেবে বলেছিল। আর ড্রেসটা সামনের হপ্তায়।

সঞ্জনা আমাকে মেঝেতে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বেশ গিন্নির মতো বলল কাঁদিস না পিকুন, কাঁদিস না। বুঝলাম আমরা বড়ো হচ্ছি।

ওরা চলে গেল। ঠাম্মা আমাকে খই-মুড়কি খেতে দিল। মা শুয়েছিল। মা খুব ভেঙে পড়েছে। মায়ের ঘরে অনেক লোকজন। ছোটোমামা-মাইমা, মাসি, পাড়ার লোক।

ঠাম্মা খুব শক্ত। বাবাকে যখন বাড়িতে আনা হয়েছিল তখনই বাবার বুকে পড়ে কেঁদেছিল। আর কোনওদিন একটুও চোখের জল দেখা যায়নি। ষাট-বাষট্টি বছর বয়স। সব দায়িত্ব যেন মাথায় তুলে নিয়েছে। একটু পরেই ডাক্তারজেঠু আসলেন মাকে দেখতে। ঠাম্মা আর একটা চেয়ার দিল মায়ের ঘরে।

বারান্দায় আমার পড়ার কাঠের চেয়ারে বসে খই-মুড়কি খাচ্ছিলাম। মায়ের ঘরে যেতে যেতে আমার কুশনটা হাতে করে নিয়ে এসে ঠাম্মা বলল, এটা কোমরে ঝুলিয়ে রাখ। এখানে ওখানে পড়ে থাকছে। আমার কোমরে গুঁজে দিয়ে বলল একটা সন্দেশ দিচ্ছি, খা। আবার সন্দেশ আনতে ছুটল।

দাদুকে আমি দেখিনি। আমার জন্মের বছর চারেক আগে মারা গেছেন। বারান্দার লম্বা দেয়ালে দাদুর সাদাকালো একটা পেল্লাই সাইজের ছবি ঝোলে। দাদু উকিল ছিলেন। দারুণ পসার ছিল। সেই টাকাতেই আমাদের বাড়ি, এতখানি জমি বাড়ির সামনে। দাদুর নাকি খুব ফুলগাছের শখ ছিল। আমি বাবাকে দেখেছি শীতকালে হরেকরকম ফুলের গাছ লাগাতে। অন্য সময়ে ফুল ফুটত বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ নানান ফুল।

সন্দেশ খেতে মোটেই ভালো লাগে না। একটুখানি খেয়ে বাকিটা জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে ভাবছিলাম আমার বাকি বই ড্রেসের কী হবে। স্কুলে কি আর যাওয়া হবে?

সব হল আমার। ঠাম্মা টাকা দিয়েছিল। ছোটোমামার সঙ্গে গিয়ে বই, ড্রেস কেনা হল। কিন্তু সমস্যা এল অন্য জায়গায়।

স্কুলে যেতেই দুতিনদিন পর থেকে ছেলেরা আমার ন্যাড়া মাথায় তবলা বাজাতে শুরু করল। স্যার পেছন ফিরে বোর্ডে যখন কিছু লেখেন, তখন কেউ না কেউ আমার মাথায় তবলা বাজিয়ে দেয়। স্যারকে বলতেই স্যার ওদের বকেন। অবশ্য তার কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে গেল। মশারির মধ্যে ঢুকতে বেরোতে বারবার মাথায় মশারি আটকে যায়। চান করার সময় মা ভালো করে মাথায় নারকেল তেল মাখিয়ে দিয়ে বলল দেখবি, এবার ভালো ঘন চুল গজাবে।

আবার আমি খেলতে যাই। ঠাম্মা বারবার বলে দিয়েছে সন্ধের আগেই যেন ফিরি। এক বছর অপদেবতারা আমাকে ভয় দেখাবে। তাই ফিরি। তবুও মাঝে মাঝে আমার শরীর খারাপ হয়। ঠাম্মা নিয়াজি পিরমন্দিরে গিয়ে আমার নামে জলপড়া নিয়ে আসে। খাইয়ে দেয়। বাড়ির চারপাশে সেই জল ছেটায়। আবার আমি ভালো হয়ে উঠি। স্কুলে যাই। খেলতে যাই।

এক রবিবার সকাল দশটার সময় বাসবের বাড়ি গেলাম। ও নেই। সরস্বতীদি হাতে ঘড়ি পরতে পরতে নীচে নেমে এসে বলল, ও মামার বাড়ি গেছে।

ফিরে আসছিলাম, সরস্বতীদি ডাকল শোন, যাবি আমার সঙ্গে এক জায়গায়?

বাসবরা পাঁচ ভাই-বোন। ও-ই ছোটো। ওর বড়ো সরস্বতীদি। অন্য দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। বড়দা দুর্গাপুরে থাকে। সরস্বতীদি কলেজে পড়ে। খুব সুন্দর দেখতে। লম্বা, ফরসা কী সুন্দর চেহারা। ঠিক সরস্বতী ঠাকুরের মতো। তবে কাঁধ পর্যন্ত চুল।

জিজ্ঞেস করি, কোথায়?

সরস্বতীদি সিঁড়ির নীচে নেমে এসে আমার ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল  ঠাকুমার কাছে যাব। যাবি?

বাসবের ঠাকুমা আসলে ওর বাবার মামা। হিজড়ে। সবাই ভাই ঠাকুমা বলে। বাসবের বাবার স্টেনলেস স্টিল বাসনের দোকান। এভাবেই চলে। এই বাড়িটাও নিতাই ঠাকুমার। সবাই বলে নিতাই হিজড়ে। হিজড়েদের নেত্রী উনি।

বললাম যাব।

সরস্বতীদি হেসে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরল। মাথাটা বুকের ঠিক কাছে যাচ্ছিল না, তবুও আমার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল ভেরি গুড।

আমার সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। জীবনের পরিবর্তন আস্তে আস্তে বুঝতে শিখছি।

মা, আসছি। আমার হাত ধরে সরস্বতীদি বেরিয়ে পড়ল।

কী রকম ওর হাত! গা থেকে কী সুন্দর গন্ধ! আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি।

একটু হাঁটতেই রিকশা পেয়ে গেলাম।

( ৩ )

রিকশা আপনমনেই যাচ্ছিল। সরস্বতীদি আমার হাতটা তুলে নিয়ে চটকাতে চটকাতে বলল কী নরম তোর হাতটা। স্কিনটাও সুন্দর। তেলতেলে।

শিহরণটা কেটে গেছে আমার। এখন এক অন্য অনুভতি। ঠিক যেন ভেসে যাওয়া। নিতাই ঠাকুমার বাড়ির সামনে রিকশা থামল। ভাড়া মিটিয়ে সরস্বতীদি ডাকল। লাফিয়ে নামলাম। আমাকে কোমরের সঙ্গে প্রায় জড়িয়ে সরস্বতীদি ভেতরে ঢুকল।

কলতলায় চিত্কার চ্যাঁচামেচি চলছিল। কাপড় কাচা, গায়ে সাবান মাখা জল ভরা সবই চলছিল। আর অদ্ভুত লাগছে এতগুলো মহিলার পুরুষোচিত কন্ঠস্বর। সব থেমে গেছে মুহূর্তে। কতগুলো সম্মিলিত শব্দ ভেসে এল ওম্মা! দিদি যে গো!

একজন মহিলা অদ্ভুত হাতের শব্দ করে তাদের অদ্ভুত নিজস্ব কথা বলার ভঙ্গিতে ওপর দিকে তাকিয়ে বলল অ অনিমা! দিদি এয়েছে লো! নিয়ে যা লো।

চুড়িদার পরা আমার থেকে সামান্য একটু বড়ো মেয়েটি দোতলার রেলিঙে ঝুঁকে দেখে তরতর করে নীচে নেমে এল। এমন অস্বাভাবিক পরিবেশ কখনও দেখিনি। বাড়িটার সামনে দিয়ে বহুবার গেছি। কিন্তু কখনওই ভাবিনি। তিনতলা চারপাশ ঘেরা বাড়িটার উঠোনে রোদ্দুর নেই। শ্যাওলা ধরা উঠোনে শুধুই আলোর আভা। এত রকম অদ্ভুত জগতের মানুষকেও কখনও এক সঙ্গে দেখিনি। কারও বুকের আঁচল খসে গেছে। কারও কারও শরীরে শাড়ি নেই। শুধু ব্লাউজ আর সায়া। কর্কশ গলায় কথাবার্তা।

আমার ভয় করছে। সরস্বতীদির কোমর জড়িয়ে ধরলাম দু-হাতে। ও আমার কাঁধে হাত রাখল। পেঁচানো ভাঙা-চোরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। মেয়েটি আগে আগে উঠছে আর পেছন ফিরে দেখছে। সমস্ত রেলিঙটায় শাড়ি শুকোচ্ছে।

তিনতলার ঘরটা খুব সুন্দর। একটা কাঠের ছোটো আলমারি। মাথায় ছোট্ট টিভি। পাশে ফুলদানি। ফুলগুলো চিনি না। জানলায় দরজায় সস্তার রঙিন পর্দা। একটা বড়ো স্টিল আলমারি। চাবিটা লকারে ঝুলছে। চার ইঞ্চি পায়া খাটে নিতাই ঠাকুমা শুয়ে আমাদের দেখে উঠে বসলেন। পা গুটিয়ে চাদরটা হাত দিয়ে সমান করে বললেন বোস। এটা কে?

সরস্বতীদি বলল, পিকুন। ভাইয়ে বন্ধু।

উনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমায় কোলে তুলে বাঁ হাতে পিকের পিচদানি তুলে পিক তুলে পিক ফেলে বললেন, ভারি মিষ্টি দেখতে তো? তারপরই বুকে জড়িয়ে ধরে এগালে ওগালে চুমু খেতে লাগলেন। আর আমি জর্দার মিষ্টি গন্ধে ভেসে গিয়ে ঠাকুমার দু গালে চুমু খেলাম।

ঠাকুমা হ্যা হ্যা করে হাসছেন। তখনই দেখলাম ঠাকুমার দাঁতে লাল নীল সাদা সবুজ রঙের স্টোন বসানো। ঠাকুমার বুকের ওপর বসে অবাক চোখে দেখছিলাম। ঠাকুমা দুপাটি দাঁত বার করে আমাকে দেখালেন।

কী? কেমন লাগছে?

ঠাকুমার বিকট সুরওলা কন্ঠে ভয় পেয়ে বললাম, ভালো। তাড়াতাড়ি নেমে সরস্বতীদির পাশে গিয়ে বসে পড়লাম।

ঠাকুমা ডাকলেন হিমানি! হিমানি! গোটা ঘর কেঁপে উঠল। আমিও। ঠাকুমা সরস্বতীদির সঙ্গে কথা বলছেন। আমি দেখছিলাম জানলার পাল্লায় দুটো ব্লাউজ শুকোচ্ছে। আলমারির পাশে পাঁচ-ছটা ঢোল রাখা।

হিমানি এলে ঠাকুমা বললেন টাকার ব্যাগটা দে তো! ব্যাপারটা জানি। বাসব বলেছিল ঠাকুমা তাদের অর্থ সাহায্য করে।

টাকার ব্যাগ দিয়ে হিমানি আমাকে নিয়ে পড়ল। মাঝবয়সি মহিলা। সামান্য গোঁফের রেখা। সেই অদ্ভুত কন্ঠস্বর। অদ্ভুত কথা বলার ভঙ্গি। নীচে বোধহয় ঝগড়া লেগেছে। চ্যাঁচামেচি আর হাত তালির শব্দ।

হিমানি মাসির কী লম্বা চেহারা। কত উঁচু উঁচু বুক। অবলীলায় আমার মতো

এগারো-বারো বছরের ছেলেকে কোলে তুলে কত আদর করছে। আমি ছটফট করতে করতে নেমে পড়ি।

ঠাকুমা বেশ কিছু টাকা সরস্বতীদিকে দিয়ে হিমানি মাসিকে বলল ওদের দুটো মিষ্টি দে।

হিমানি টাকার ব্যাগটা আলমারিতে তুলে রাখছিল, তখনই ওরা এল। পাঁচ-সাতটা বেতের ধামা নামিয়ে রাখল। ওরা গেছিল তোলা তুলতে বউবাজার হাটে।

ধামাভর্তি সবজি-ফল-আলু-চাল। টাটকা সবজি।

ঠাকুমা বলল ব্যাগে কিছু ভরে দে।

সরস্বতীদি বলল আমি অত নিয়ে যেতে পারব না।

ঠাকুমা ধমকে বললেন আমার রিকশায় তুলে দিচ্ছি। পৌঁছে দেবে।

লাড্ডু খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। রিকশাওয়ালা আমাদের পায়ে সামনে ব্যাগটা কায়দা করে বসিয়ে দিল।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হয়তো বাড়ি ফিরলে মা ঠাকুমা খুব বকবে। বলবে হিজড়ে বাড়ি যাওয়া! আর কক্ষনও যাবে না। জামা প্যান্ট ছেড়ে বাইরে কলতলায় চান করো।

বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম ওদের জীবনযাপন। বাচ্চা হলে হিন্দুধর্মের নিয়ম অনুযায়ী ওদের শিশু দেখতে আসা মহাপুণ্য। ওদের আশীর্বাদ, দর করা চলার পথে আমাদের জীবন। কী নিষ্ঠুর এই সমাজ! জানি না এ থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব।

( ৪ )

বাবার মৃত্যুর ছমাসের মধ্যেই আমাদের জীবন অনেক স্বাভাবিক হয়ে উঠল। বাবা নেই কিংবা বাবা ছিল এ ব্যাপারটাই আর অনুভব করতে পারি না। বারান্দার এক কোণে ছোটো টেবিলে বাবার ফটো বসানো। ছোট্ট একটা ফুলদানিতে রোজ সকালে চান করে উঠে মা গন্ধরাজ বা রঙ্গন ফুল এনে তাতে দিয়ে ধূপ জ্বেলে প্রণাম করে।

আমিও রোজ স্কুলে খাওয়ার সময় পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে জুতো-মোজা পরে বাবাকে প্রণাম করি।

সন্ধ্যায় এখন বাড়িতে টিভি চলে। মা ঠাম্মা দেখে। হাসে। ভালোমন্দ বিচার করে। আমার খুব ভালো লাগে। প্রথম প্রথম মনে হতো বন্দি হয়ে আছি আকাশের নীচে। চাঁদের আলোয়। সূর‌্যের উত্তাপে।

ফ্যাক্টরি থেকে বাবার পাওনা টাকা সব পাওয়া গেছে। দাদুরও বেশ কিছু টাকা ছিল ফিক্সড করা। সোমনাথকাকু, সব টাকা মাকে পোস্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে ফিক্সড করে দিয়েছে। মা কিংবা ঠাম্মা গিয়ে মাসে মাসে টাকা তুলে আনে।

আমার মাস্টারমশাই নেই। মা রোজ সন্ধ্যায় পড়ায়। এখন আর মায়ের কোলে বসে পড়ি না। সামনে বসি। মায়ের গায়ে গন্ধটা দূর থেকেও পাই।

মা বলে অনেক লেখাপড়া শিখতে হবে। বড়ো হতে হবে। মা চোখের জল মোছে আঁচলে।

ক্রমশ…

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব