সুচন্দ্রা এই পাড়ায় নতুন নয়। সেই নয় বছর বয়সে মা-বাবার হাত ধরে এই পাড়াটায় প্রথম পা রেখেছিল সে। প্রথম প্রথম বন্ধু বলতে কেউ ছিল না। খুব খারাপ লাগত সুচন্দ্রার। স্কুল থেকে ফিরে খেলার সঙ্গী বলতে কেউ ছিল না।
ধীরে ধীরে একই পাড়ার ঘোষ পরিবারের সঙ্গে সুচন্দ্রার মা-বাবার আলাপ-পরিচয় গড়ে ওঠে। সেই সূত্রে সুচন্দ্রাও ওদের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করে। ওর প্রধান আকর্ষণ ছিল ঘোষদের ছোট্ট ছেলেটা। কীরকম ফুটফুটে পুতুলের মতো। ওর থেকে বয়সে চার বছরের ছোটো। সবে সবে সুচন্দ্রার স্কুলেই ভর্তি হয়েছিল। নাম অনির্বাণ। বড়োদের সবার দেখাদেখি সুচন্দ্রাও ওকে ‘অনি’ বলেই ডাকত।
মা শিখিয়ে দিয়েছিল সুচন্দ্রাকে যে, অনি-ই সুচন্দ্রার ছোটো ভাই, তাই অত কম বয়সেই সুচন্দ্রা অনি-র অনেকটা দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
স্কুলে অনি যতক্ষণ থাকত সুচন্দ্রা ওকে চোখে চোখে রাখত। একটা ক্লাস শেষ করেই দৌড়ে এসে ভাইকে দেখে যেত। ভাইয়ের ছুটি আগেই হয়ে যেত। স্কুল থেকে ফিরেই সুচন্দ্রা চলে যেত ঘোষদের বাড়ি। সারাটা বিকেল ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে সময় কেটে যেত সুচন্দ্রার। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লে সুচন্দ্রা বাড়ি ফিরে আসত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দু’জনে একসাথে বড়ো হতে থাকে। কিন্তু একে অপরের প্রতি স্নেহ ওদের এতটুকুও কম হয় না। অনির্বাণ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেঙ্গালুরু চলে যায়। আর সুচন্দ্রা কলকাতাতেই থেকে যায়। ও কলকাতার মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে নিজেরই এক সহপাঠীকে বিয়ে করে নেয়। সরকারি হাসপাতালে চাকরিও হয়ে যায় ওর।
এরই মধ্যে অনির্বাণের বাবা অন্য শহরে বদলি হয়ে যান। পরিবার নিয়ে ওরা নাগপুর চলে যায়। দূরত্ব তৈরি হলেও অনির্বাণ ছুটিছাটায় সুচন্দ্রার সঙ্গে এসে দেখা করে যেত। ফোনে যোগাযোগ সুচন্দ্রা কোনওদিনই বন্ধ করেনি।
সউদি আরবে চাকরি পাওয়ার খবর অনির্বাণ ফোনেই জানিয়েছিল। অনির্বাণের সঙ্গে ফোন ছাড়াও, মেলেও সুচন্দ্রা খবরা-খবর রাখত। এরই মধ্যে তিন বছরের জন্য সুচন্দ্রা স্বামীর সঙ্গে আয়ারল্যান্ড চলে যায় পড়াশোনা করতে। ওখানে থাকতেই খবর পায় যে অনির্বাণ দেশে ফিরে এসে একটি বিদেশি সংস্থায় চাকরি নিয়েছে। কলকাতাতেই ওর পোস্টিং।
কলকাতায় ফিরতেই সুচন্দ্রা, অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই সন্ধেতেই অনির্বাণ এসে হাজির হয় সুচন্দ্রার বাড়িতে।
‘আয় ভাই, ভিতরে আয়। বাব্বা কতদিন পর তোর সঙ্গে দেখা,’ সহাস্যে সুচন্দ্রা বলে।
‘এত দেরি করে ফিরলে তোমরা, আমার আর সময় কাটছিল না। বাবারা তো নাগপুরেই সেটেল করলেন। আমি এখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রয়েছি। সারাটা দিন অফিসে কাজেই কেটে যায় কিন্তু সন্ধে থেকে কিছুই আর করার থাকে না…’ বলতে বলতে অনির্বাণ বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে দেয়।
অনির্বাণের সাড়া পেয়ে ততক্ষণে সুচন্দ্রার স্বামী অর্ক-ও বাইরের ঘরে বেরিয়ে এসেছে। বাড়িতেই চেম্বার অর্ক-র কিন্তু অনির্বাণ আসবে জেনে রুগি দেখা বন্ধ রেখেছে আজ ও।
‘কী ব্যাপার শালাবাবু? একাকিত্বে বড়োই কাহিল হয়ে পড়েছ, বোধ হচ্ছে। তা জানো তো, এর একমাত্র চিকিৎসা হয় কিন্তু ছাদনাতলায়,’ হাসতে হাসতে অর্ক বলে।
‘অর্ক ঠিকই বলেছে অনি, তুই এখনও কেন বিয়ে করিসনি?’ সুচন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।
‘প্রথম সউদি আরব আর এখন কলকাতা, একা একা থাকা। বিয়েটা হবে কী করে? তারপর মা আর বাবার শরীরের অবস্থা তো জানোই তুমি। ওঁদের পক্ষে মেয়ে খোঁজা অসম্ভব আর মেয়ে দেখতে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক, এখন তোমরা এসে গেছ, সুতরাং মনে হচ্ছে দিদি এবার আমার বিয়েটা হয়েই যাবে।’
‘অনি, হয়েই যাবে মনে হচ্ছে… এই কথাটার মানে কী? আর একলা থাকলে কি বাইরে বিয়ে করে এসে এখানে একটা রিসেপশন দেওয়া যেত না?’ কপট রাগের সঙ্গে সুচন্দ্রা অনি-কে বাগে আনার চেষ্টা করে।
‘দিদি, নাগপুরে কোনও বাবা-মা তাঁদের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে না কারণ বয়সটা আমার কম হল না। আর আমার পছন্দ মায়ের পছন্দ নয়। এই করে বিয়েটাই আর করা হচ্ছে না। দিদি, তুমি এক কাজ করো, হয় মা-বাবাকে বোঝাও যে আমি নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করব আর নয়তো তুমি নিজেই এই পাত্রী ঠিক করার দায়িত্বটা নাও।’
‘কিন্তু কাকু-কাকিমা, তোর পছন্দের মেয়েকে কেন মেনে নিচ্ছেন না? অন্য কাস্ট ও, নাকি ডিভোর্সি?’ সুচন্দ্রা জানতে চায়।
‘ওই সব কিছুই না দিদি। মেয়েটি অবিবাহিত এবং আমাদেরই কাস্টের। কিন্তু ওর একটাই শর্ত যে ভবিষ্যতে আমাদের যেন কোনও সন্তান না হয়। আর এটাতেই মায়ের আপত্তি।’
‘কিন্তু মেয়েটি কেন সন্তান চায় না আর এখনও কেন মেয়েটি বিয়ে করেনি? এটা একটু অদ্ভুতই মনে হচ্ছে,’ সুচন্দ্রার গলায় স্পষ্ট শঙ্কা ফুটে ওঠে।
‘দিদি, রুমন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার সঙ্গে একসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। ওখানে পড়তে পড়তেই ওর বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই ওর মা-ও, ওই একই রোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা করিয়েও ওদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এখন ও চাকরি করে। আমাকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু ওর একটাই শর্ত– মা হতে চায় না,’ অনির্বাণের কণ্ঠে হতাশা ফুটে ওঠে।
‘কিন্তু কেন ওর এরকম জেদ?’
‘এটা আমি জিজ্ঞেস করিনি বা করবও না। ও আমাকে কারণটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর অতীত জানার আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমি ওকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই।’
‘কিন্তু এরকম একটা ডিসিশন নেওয়ার কোনও তো কারণ হবে,’ সুচন্দ্রা বলতে বাধ্য হয়।
‘রুমন আমাকে বলেছিল যে মা-বাবার চিকিৎসায় প্রচুর টাকার দরকার ছিল যার জন্য ওকে রাতদিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু এমন কাজ ও কোনওদিন করেনি যাতে ওকে পরে লজ্জায় পড়তে হয়। আর ওর মা না হওয়ার ডিসিশনও সম্পূর্ণ ওর নিজের ইচ্ছেয়, এর পিছনেও কোনও অনৈতিক কারণ নেই। দিদি, আমার মনে হয় কাউকে ভালোবাসলে তাকে তার প্রয়োজনীয় প্রাইভেসিটুকু দেওয়া উচিত। আমার সন্তান হোক আর নাই হোক, তাতে মা-বাবার সমস্যা কোথায়? বাড়িতে বংশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো ভাই রয়েছে।’ একটু চুপ করে থেকে অনির্বাণ বলে, ‘তাছাড়া বাচ্চা দত্তক নেওয়ার অথবা সারোগেসির বিকল্প তো রয়েইছে।’
‘এই ব্যাপারটা নিয়ে রুমনের সঙ্গে কথা বলেছ?’ অর্ক এতক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ, অর্কদা। ও-ই আমাকে বলেছিল যে আমার বাড়ির লোক যদি আমার মা হওয়া নিয়ে খুব বেশি চাপ দেয়, তাহলে সারোগেসির মাধ্যমে আমি যেন ওদের ইচ্ছে পূরণ করি। ওর কোনও আপত্তি নেই। এত কিছুর পরেও মা-বাবা রাজি হয়নি। এখন তোমরা যদি কোনও ভাবে সাহায্য করো।’ অনির্বাণের কথা শুনে অর্ক চিন্তিত হয়ে পড়ে। সুচন্দ্রার দিকে তাকায় অনির্বাণ, ‘দিদি জানোই তো ভালোবাসা অন্ধ। আর রুমনের প্রতি ভালোবাসাই আমার প্রথম এবং শেষ বলতে পারো।’
‘আর রুমনের ক্ষেত্রেও কি তুই-ই ওর প্রথম এবং শেষ প্রেম?’ সুচন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।
অনির্বাণ সম্মতিসূচক ঘাড় হেলায়। সুচন্দ্রার প্রশ্নের উত্তরে ও বলে, ‘হ্যাঁ দিদি। প্রথম থেকেই আমরা দু’জনে একে অপরকে পছন্দ করতাম। ভেবেছিলাম পড়া শেষ করে সকলকে আমাদের সম্পর্কটার বিষয়ে জানাব। কিন্তু তার আগেই রুমনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর রুমনও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইল না। কিন্তু একই শহরে থেকে সেটা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। সেইসময় আমিও সউদি আরবে চাকরিটা পেয়ে চলে যাই।’
‘তাই জন্যেই কি তুই হঠাৎ বাইরে চলে গিয়েছিলি?’ সুচন্দ্রা, অনিকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেয়।
‘হ্যাঁ দিদি, তুমি ঠিকই ধরেছ। রুমনের জীবন থেকে আমি সরেই যেতে চেয়েছিলাম।’
‘কিন্তু তাহলে ফিরে এলি কেন?’
‘আমাদের দু’জনের কমন ফ্রেন্ড শান্তা। ওর সঙ্গে বরাবরই আমার যোগাযোগ ছিল। ওই আমাকে রুমনের বাবা-মায়ের মৃত্যুসংবাদ দেয়। এই খবর পাওয়ার পরেই আমি এখানে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করি। চাকরি পেয়েই কলকাতায় ফিরে আসি। রুমন আর আমি এখন একই অফিসে চাকরি করি।’ অকপটে সবকিছু সুচন্দ্রার কাছে খুলে বলে অনির্বাণ।
‘নাঃ, শালাবাবু! তোমার কেসটা দেখতেই হচ্ছে। সুচন্দ্রা, তোমাকে অনির সাহায্য করতেই হবে। হাসপাতালে কাজের মাঝে মাঝে কীভাবে অনিকে সাহায্য করবে ভাবো,’ অর্ক এবার মুখ খোলে।
‘অনি, আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে, আজ আর কিছু করা যাবে না। কাল দেখি কোথা থেকে শুরু করা যায়,’ সুচন্দ্রা বলে।
‘তাহলে দিদি, আজ আসি। কাল তোমাকে একবার রুমনের বাড়ি নিয়ে যাব কিন্তু তার আগে পারলে মায়ের সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলে নিও। দ্যাখো, মা তোমাকে কী বলেন!’ অনির্বাণ বাড়ি চলে যায়।
পরের দিন সকালে সুচন্দ্রা নাগপুরে অনির্বাণের বাড়িতে ফোন করে অনির্বাণের মা-র সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও কাকিমাকে জানায়।
‘আমার আশ্চর্য লাগছে সুচন্দ্রা, তুই ডাক্তার হয়েও এই সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইছিস? তোর মনে হচ্ছে না যে, ওই মেয়েটি কোনওরকম মানসিক অথবা শারীরিক অসুস্থতার শিকার নয়তো অনির সামনে এই ধরনের শর্ত রাখে?’ অনির্বাণের মা সুচন্দ্রার কাছে প্রশ্নটা রাখেন।
‘হ্যাঁ, হতেই পারে কাকিমা… আজ আমি মেয়েটির বাড়ি যাব ওর সাথে কথা বলতে। দেখি কিছু বুঝতে পারি কিনা। কথাবার্তা যাই হোক তোমাকে এসে ফোন করব’, এই বলে সুচন্দ্রা ফোনটা কেটে দেয়।
অর্ক, সুচন্দ্রার কথাগুলো বসে শুনছিল। ও বলে ওঠে, ‘সুচন্দ্রা, এই দিকটা তো আমার মাথাতেই আসেনি। কাকিমা এর মধ্যে অনেক কিছুই ভেবে ফেলেছেন।’
‘যদি এরকম কিছু হয় তাহলে আমরা ওর চিকিৎসা করাতেই পারি। সব রোগেরই চিকিৎসা আছে। কিন্তু এখনই অনিকে ওদের কথা কিছু বোলো না তাহলে ওর মন আরও ভেঙে যাবে,’ সুচন্দ্রা ভেবে বলে।
‘ওনাদের আপত্তি হওয়াটাও স্বাভাবিক সুচন্দ্রা। কোনও রোগগ্রস্ত মেয়ের সঙ্গে কি কোনও মা-বাবা নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইবেন? অনি আর রুমনকে না জানিয়েই বুদ্ধি খাটিয়ে আসল কাহিনিটা জানতে হবে তোমাকে।’ অর্কর কথাগুলো সুচন্দ্রা মেনে নেয়।
অর্ক আরও বলে, ‘তুমি এক কাজ করো। রুমনের বাড়ি যাওয়ার থেকে অন্য কোথাও ওর সঙ্গে দেখা করো। তুমি বরং আজ না গিয়ে কাল লাঞ্চ ব্রেকে অনির অফিসে চলে যাও। রুমনও তো একই অফিসে চাকরি করে। গিয়ে বোলো, হঠাৎ কাজের জন্য তোমাকে ওদিকে আসতে হয়েছে, একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চাও। ও নিজেই হয়তো তোমাকে রুমনকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু যদি না-ও ডাকে তুমিই ওকে ডেকে নিতে পারো।’
সুচন্দ্রা কাজের দোহাই দিয়ে সেদিন রুমনের বাড়ি যাওয়া ক্যানসেল করে দিল। পরের দিন না জানিয়েই অনির অফিসে পৌঁছে গেল। দরজায় ঢুকে লিফটের সামনে দাঁড়াতেই, লিফটের দরজা খুলে দেখল অনি বেরিয়ে আসছে সঙ্গে লম্বা, শ্যামলা একটি মেয়ে, বেশ সুন্দরী।
সুচন্দ্রাকে দেখেই অনির্বাণ বলে ওঠে, ‘আরে দিদি। তুমি এখানে? সব ঠিক তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ… সব ঠিক আছে। ঘাবড়াস না। এদিকে একটু কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা করে যাই। কেন, কোথাও বেরোচ্ছিস নাকি?’ সুচন্দ্রা বলে।
‘রুমনকে লাঞ্চে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বিকেলের প্রোগ্রাম ফিক্স করার ছিল… তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে,’ অনির্বাণের অনুরোধে সুচন্দ্রা ওদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যায়।
‘ঠিক আছে, চল। ভালো কোথাও একটু বসি যেখানে শান্তিতে কথা বলা যাবে।’
‘তাহলে একটু এগিয়ে ‘আঙ্গিঠি’ রেস্তোরাঁর ফ্যামিলিরুমে গিয়ে বসা যেতে পারে। ওটা বেশ ভালো আর দুপুরে ওখানে ভিড়টা কম,’ রুমন বলে ওঠে।
পাঁচ মিনিটেই ওরা রেস্তোরাঁয় এসে পৌঁছে যায়।
‘খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছ রুমন। নয়তো পার্কিং পেতে আর ব্যস্ত রাস্তায় যাতায়াত করতেই অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যেত,’ সুচন্দ্রা বলে।
অনির্বাণ বলে, ‘রুমনের আইডিয়া কিন্তু সবসময়ই খুব কাজে লাগে দিদি। এটা ওর একটা বড়ো গুণ।’
‘তাহলে তো ওকে খুব শিগগিরই, পরিবারের একজন সদস্য করে নিতে হবে।’
অনির্বাণ হেসে রুমনের দিকে তাকায়। সুচন্দ্রার মনে হয়, রুমনের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকলেও চোখ দুটো বিষাদ মাখানো। এই বিষাদটাকে লুকোবার জন্যেই যেন রুমন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
রেস্তোরাঁয় বসে রুমন সুচন্দ্রার কাছে ওর বিদেশে থাকাকালীন দিনগুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। এই নিয়েই খানিকটা সময় কেটে যায় ওদের। খাবার খেতে খেতে সুচন্দ্রা বলে, ‘আমার বিদেশের এক্সপিরিয়েন্স সবই তো শুনলে, এখন তোমার কথা বলো রুমন।’
‘আমার সম্পর্কে বলার মতো সবকিছুই হয়তো শুনে থাকবেন অনির্বাণের কাছে। বলার মতো কিছুই নেই। অনির্বাণের সঙ্গে কলেজে পড়তাম, এখন এক অফিসে চাকরি করি আর আমি থাকি যাদবপুরে।’
‘যাদবপুরে রুমনের বাবা খুব শখ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। হাজার অসুবিধে হওয়া সত্ত্বেও ও ওই বাড়ি বিক্রি করেনি,’ অনি এরই সঙ্গে জুড়ে দেয়, ‘ওখানে ও একাই থাকে।’
‘ভয় লাগে না?’
‘না, দিদি। ভয় পাওয়া অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি,’ রুমন হাসে।
‘বাঃ, খুব ভালো। কিন্তু অনিকে ছোটোবেলায় ভীতু বলে ডাকতাম, সেটা জানো কি?’
রুমনা হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘কই না-তো দিদি। ও তো কখনও বলেনি যে ছোটোবেলায় ওকে ভীতু বলে ডাকা হতো। কীসে ভয় পেত দিদি?’
‘বলার দরকার নেই। যখন ওর সাথে থাকবে তখন নিজে থেকেই সব জানতে পারবে,’ হেসে উত্তর দেয় সুচন্দ্রা।
‘ওর সাথে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অনির মা-কে কষ্ট দিয়ে আমি অনিকে বিয়ে করতে পারব না।’ রুমনের চোখে বিষাদের ছায়া উঁকি মারলেও কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা সুচন্দ্রাকে অবাক করল।
সুচন্দ্রা হাতঘড়ির দিকে তাকায়, ‘এই কথা আলোচনা করার সময় বা জায়গা এটা নয়। আমাকে একবার হাসপাতালে ঢুঁ মারতে হবে। হাতে সময় রয়েছে। তোমার সময় হলে বোলো, আরাম করে বসে এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। হয়তো সমাধানের একটা রাস্তাও পাওয়া যেতে পারে।’
‘আজ সন্ধেবেলা তুমি আর অর্কদা যাবে রুমনের বাড়ি?’ অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে।
‘এখন কাজ শেষ করে বাড়ি যাব। একবার বাড়ি গেলে দ্বিতীয়বার আর বেরোবার ইচ্ছে হবে বলে মনে হয় না। আর আজ তো তোদের সঙ্গে দেখা হয়েই গেল।’
‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু অর্কদার সঙ্গেও তো ওর আলাপ করাতে হবে।’ অনির্বাণ বলে, ‘তুমি বাড়ি গিয়ে আরাম করো, আমি রুমনকে নিয়ে বরং তোমাদের বাড়ি চলে আসব।’
‘সেটা তো খুব ভালো হয়। চলে আয় রুমনকে নিয়ে। রাত্রে আমার বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফিরিস।’
সন্ধে হতেই অনির্বাণ, রুমনকে সঙ্গে করে সুচন্দ্রাদের বাড়ি পৌঁছে গেল। একসাথে বসে হাসি, আড্ডায় চারজনেই জমে উঠল। গল্পের মাঝে একপ্রস্থ চা আর স্ন্যাক্স সার্ভ করল সুচন্দ্রা। গল্প চলতে চলতেই অর্ক বলল, ‘সুচন্দ্রা আর একবার চা হলে আড্ডাটা কিন্তু আরও জমে যেত।’
‘চা খাওয়ার তোমার একটা এক্সকিউজ চাই।’
‘প্লিজ, লক্ষ্মীটি…।’
অর্কর মুখের ভঙ্গি দেখে সকলে হেসে ফেলল। অগত্যা সুচন্দ্রাকে উঠতেই হল। রান্নাঘরের দিকে ও পা বাড়াল। চায়ের জলটা গরম করতে করতেই অনির্বাণ এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল, ‘দিদি তুমি কি মাকে ফোন করেছিলে?’
‘হ্যাঁ, ফোন করেছিলাম। কাকিমারা কেমন আছেন সেটা নিয়েই কিছুক্ষণ কথা হল।’
‘ব্যস, আর কিছু বললে না? আমাদের কথা কিছু বলোনি? তোমাকে বলেছিলাম না, মায়ের সঙ্গে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলতে,’ অনির্বাণের স্বরে সামান্য হতাশা প্রকাশ পেল।
‘সুযোগ হয়নি। আর সব কথা আলোচনা করার একটা সঠিক সময় থাকে। রুমন কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না, বিয়ে করলে তো তোকেই করবে। যখন এতদিন অপেক্ষা করলি তখন না হয় আরও কটা দিন কর।’
‘এছাড়া আর করারই বা কী আছে?’ অনির দীর্ঘশ্বাস সুচন্দ্রার কানে এসে বাজল।
রুমনের সঙ্গে সুচন্দ্রার বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে আরও গভীর হয়ে উঠল। সবদিক দিয়ে সুচন্দ্রা রুমনের বিশ্বাস অর্জন করে নিল। একদিন সুচন্দ্রার সঙ্গে কথা না হলে রুমনের মনে হতো তার জীবন থেকে একটা কিছু বাদ পড়ে গেছে। কিছু একটা অমূল্য জিনিস যেন ও হারিয়ে ফেলেছে।
সুচন্দ্রাও রুমনের প্রতি একটা স্নেহের আকর্ষণ অনুভব করত। মেয়েটার মধ্যে সত্যিই একটা চুম্বকীয় আকর্ষণ ছিল। রুমনের কাছেই সুচন্দ্রা জানতে পারল, অনি অফিসের কাজে কয়েকদিনের জন্য মুম্বই যাচ্ছে। মুম্বই চলে গেলে অনির অনুপস্থিতিতে সুচন্দ্রা একদিন ফোন করে রুমনের বাড়ি এসে উপস্থিত হল। রুমনের বাড়িটা সত্যিই দেখার মতো। বোঝাই যাচ্ছিল যিনি বানিয়েছেন তার পছন্দটা বেশ উঁচুমানের।
‘খুব ভালো করেছ বাড়িটা বিক্রি না করে রুমন। বিয়ের পরেও নিশ্চয়ই তুমি এখানেই থাকতে চাও? অনির্বাণ রাজি তোমার প্রস্তাবে?’ সুচন্দ্রা আস্তে করে রুমনকে জিজ্ঞেস করল।
‘অনি তো কোনও শর্ত ছাড়াই আমার সব প্রস্তাব মানতে রাজি। কিন্তু আমি ওর মা-বাবার আশীর্বাদ না নিয়ে অনিকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না। মা-বাবার স্নেহ থেকে তাদের সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেওয়া কখনও উচিত নয়। স্বার্থপর ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না। আমার জন্য অনি সবার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করুক, এ আমি কিছুতেই চাই না।’
‘এটা তো খুবই ভালো কথা রুমন। কাকু, কাকিমা মানে অনির বাবা-মা খুবই ভালোমানুষ। ওদের যদি ঠিকমতো বোঝানো যায় মানে তুমি বিয়ের যে শর্ত রেখেছ, তার কারণ বলা যায়, তাহলে ওনারাও বিনা দ্বিধায় হাসতে হাসতে এই বিয়েতে মত দেবেন। কিন্তু অনি ওদের কোনও কারণও বলেনি।’
‘ও নিজে জানলে তবে তো ও, অন্য কাউকে বলবে। আমি ওকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু ও কিছুতেই শুনতে চায় না। অনির কথা হল ভবিষ্যতকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করো, অতীতকে মনে রেখে কী লাভ।
আমিও অতীতকে মনে করতে চাই না দিদি। কিন্তু অতীত অথবা জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু ঘটনা এমনও হয় যেটাকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সারা জীবন সেটাকে নিয়েই বাঁচতে হয় দিদি,’ রুমনের চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে।
‘তুমি চাইলে তোমার জীবনের এই অধ্যায়টা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারো,’ সুচন্দ্রা দুই হাত দিয়ে নত হয়ে আসা রুমনার মুখটা পরম স্নেহে তুলে ধরে।
‘কয়েকদিন ধরে আমি এটাই ভাবছিলাম দিদি।’ গভীর নিঃশ্বাস নেয় রুমন। একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় নেয়। বলতে শুরু করে, ‘কলেজের পরেই চাকরি পেয়ে যাই। ততদিনে বাবা আর মা দু’জনেরই ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চাকরি থেকে দেরি করে ফেরা আর বারবার ছুটি নেওয়ার জন্য চাকরিটাও ঠিকমতো করতে পারছিলাম না। আর মা-বাবার দেখাশোনাও ঠিকমতো হচ্ছিল না। অতএব চাকরিটা আমি ছেড়ে দিই। মুম্বই চলে যাই মা-বাবাকে নিয়ে। আত্মীয়ের একটা ফ্ল্যাট খালি ছিল, ওখানে গিয়েই উঠি। বাবার টাকা ছিল। কিন্তু বিপুল পরিমাণ চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য আমিও কাজ করতে শুরু করি। ভ্যাকিউম ক্লিনার বেচা থেকে শুরু করে, কী না করেছি। হাসপাতালে ক্যান্টিনে কাজ করেছি, বেবি সিটিং করেছি। মা-বাবার আপত্তি সত্ত্বেও বেশি পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে দু’বার স্যারোগেট মাদার হতেও লজ্জা পাইনি।
সেইসময় মেশিনের মতো বাচ্চার জন্ম দিয়েছি আর টাকার বিনিময়ে যারা টাকা দিয়েছে তাদের হাতে তুলে দিয়েছি বাচ্চাকে। কিন্তু এখন মনে হয় বিয়ের পর যখন নিজের সন্তান হবে তখন তাকে মানুষ করতে গিয়ে আগের দু’টো বাচ্চার কথাও মনে পড়তে পারে। তাদের তো আমি অচেনা লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে এসেছি। ওদের কথা মনে পড়লে আমি যদি বিচলিত হয়ে উঠি, তাহলে সেটা অনি বা অনির সন্তানের প্রতি অন্যায় করা হবে। সুতরাং বিয়ের পর নিজের সন্তান যাতে না হয় তারই জন্য অনির কাছে ওই প্রস্তাব রেখেছিলাম। দিদি তুমি, অনি এবং ওর মা-বাবাকে পুরো সত্যিটা খুলে বলো। ওনারা যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা আমি মাথা পেতে নেব।’
‘ঠিক আছে রুমন, সুযোগ বুঝে আমি ওনাদের সঙ্গে কথা বলব,’ সুচন্দ্রা রুমনকে আশ্বাস দেয়।
সুচন্দ্রা বেরিয়ে আসে রুমনের বাড়ি থেকে। রুমনের স্বীকারোক্তি সুচন্দ্রার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। রুমনের ভাবনাটা সত্যি। অনির সঙ্গে হয়তো ওর কোনও সমস্যা হবে না কারণ অনির রুমনের প্রতি ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ। রুমনের সবকিছুই ও মেনে নেবে কিন্তু অনির মা-বাবা? তারা কী করে এমন মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করবেন যে কিনা দু’বার স্যারোগেট মাদার হয়েছে? কাজটা সহজ নয়।
সুচন্দ্রা ভাবতে থাকে। কাকু, কাকিমাকে রুমনের বয়সের দোহাই দেওয়াটা কি খুব অন্যায় হবে? রুমনের যা বয়স তাতে সন্তানের জন্ম দেওয়াটা বিপজ্জনক, এমনটা বোঝানো অসুবিধার নয়। কথাটা খুব একটা মিথ্যাও না। সুচন্দ্রার মনে হয় অনি আর রুমনের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে এতটুকু ছলনার আশ্রয় তো নেওয়াই যেতে পারে।