সুখে থাকতে গেলে একজন মানুষের কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন হয়? মানুষের উপর বিশ্বাসের? সম্পর্কের উপর আস্থার? সহানুভূতির? নাকি, অনেক অর্থ উপার্জনের ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে সুখ, যেরকম বলে থাকেন অনেকে। জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে বাঁচার রসদ, গলা ফাটিয়ে নিজের অধিকার ঘোষণা করার অধিকার– সুখে থাকার জন্য এইরকম কত বিষয়েরই না দরকার পড়ে!
কিন্তু সবসময় কি এই সবকিছু খুব সহজে মেলে? সহজে পাওয়ার রাস্তায় কত না বাধা। মানুষের রিপু বড়ো পরশ্রীকাতর। সে বড়ো হিংসুক। বড়ো লালসা তার! চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, প্রতারণা, দাঙ্গা, বিশ্বাসঘাতকতা, ছল– ইত্যাকার হাজাররকম প্রকাশ সেই লালসার। এই কি তবে মানুষের নসিব? মানুষ একটু সুখে থাকবে, তাতে আর একজন মানুষের খুব কি কিছু আসে-যায়, যদি না সেই সুখ অন্য কারও বঞ্চনার মাধ্যমে এসে না থাকে? যুক্তি বলে, যায় না। বুদ্ধি বলে, অবশ্যই যায়।
তাড়াহুড়ো করে স্টেশনের দিকে যেতে গিয়ে এই সব কথাই মনে মনে ভাবছিল সুজাতা। রোজ সকালে ঠিক এভাবেই অত্যন্ত ব্যস্ত পা ফেলে তাকে স্টেশনে আসতে হয়। অফিসযাত্রীদের ভিড়টা এসময়েই সবচেয়ে বেশি থাকে। পা মাড়িয়ে, কনুই দিয়ে সহযাত্রীকে ঠেলে ফেলে দিয়ে মানুষের চলমান শরীরগুলো উন্মত্তের মতো প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কারওর অন্য কোনও দিকে হুঁশ নেই। মানুষ কি ধীরে ধীরে উন্মাদ বা পাশবিক হয়ে যাচ্ছে? কে জানে!
পিছন থেকে এসে একটা লোক সুজাতার পা মাড়িয়ে চলে যেতেই সে চাপা গুঙিয়ে উঠল। লোকটি বোধহয় একটু ভদ্রগোছের। সুজাতার গোঙানি শুনে অন্তত পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে গেল, ‘দুঃখিত’! হায়, দুঃখ প্রকাশে যদি শরীরের ব্যথা কিছুমাত্রাতেও কমত! যদিও ব্যথার দিকে পিছু ফিরে তাকানোর সময় সুজাতারও নেই। ভোরে বাড়িতে একটা ব্যাচ পড়তে আসে। তাদের পড়িয়ে উঠতে বেলা চড়ে যায়। অন্যান্য দিন যদিও সে কিছুটা সমবেদনামূলক ছাড় পায়, কিন্তু সেটি হওয়ার জো নেই আজ। স্কুলপরিদর্শনে সরকারের অফিসারেরা আসছেন। ছাত্রছাত্রীদের কালকেই সে পইপই করে বলে দিয়েছিল যাতে আজ কেউ কামাই না করে। সরকারি বাবুরা যদি দেখেন স্কুলে পড়াশুনা ভালো হচ্ছে, ছেলেমেয়েদর মধ্যে পড়ার এবং বাবা-মায়েদের মধ্যে তাদের স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছা রয়েছে, তাহলে স্কুলের জন্য বাড়তি কিছু অনুদান চাইবার মুখটা থাকে।
কিন্তু এত সহজে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কিছুতেই। শেষমুহূর্তে ছেলেমেয়েগুলো যেন না ডোবায়।
মালতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভূগোলের দিদিমণি সুজাতা। মালতীপুর জায়গাটা খুব বড়ো হয়তো নয়, তবে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এ অঞ্চলে ধান খুব ভালো হয়। ট্রেন থেকে নেমে ভ্যান রিকশায় চেপে সুজাতা যখন স্কুলের দিকে যায়, রাস্তার দুধারে হলুদ হয়ে যাওয়া ধানগাছগুলি হাওয়ায় মাথা দোলাতে থাকে। মাটিতে বীজ পোঁতা থেকে, কচি সবুজ ধানগাছগুলির বেড়ে ওঠা, তারপরে সেগুলির সোনালি হতে থাকার প্রতিটি দৃশ্য এখন তার চেনা। কিন্তু ওই পর্যন্তই! এত বর্ধিষ্ণু গ্রামেও বিকাশের লক্ষণগুলি তেমন স্পষ্ট নয়। টিউবওয়েলে ঠিকমতো জল ওঠে না, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা নামমাত্র। কে বলবে, এখানেও বছর-বছর ভোটের হাওয়া বয়। নেতাদের গরম বক্তৃতায় তেতে ওঠে সমাজজীবন। ভোট হয়ে যায়। উন্নয়নও ঝিমিয়ে পড়ে। জীবন চলতে থাকে সেই একইরকম শম্বুকগতিতে। তাই এখানে চাকরি করতে আসার ইচ্ছে থাকে না সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও। সুজাতাই কি পোস্টিংটা পেয়ে খুব খুশি হতে পেরেছিল?
তার অবশ্য অন্য সমস্যাও কিছু ছিল। তবে সবকিছুর উপরে, এখানে বদলি হয়ে আসতেও তার মন চায়নি। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, কোনওরকম সামাজিক সুযোগসুবিধাহীন জায়গায় পঙ্গু হয়ে থাকার চেয়ে কষ্টকর আর কী হতে পারে?
তার উপর রাতুল এখনও যথেষ্ট ছোটো। শ্বশুর-শাশুড়িও বৃদ্ধ হয়েছেন। তবু যদি মনোময় কলকাতায় চাকরি করত, একটা কথা ছিল। তাকেও তো বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বদলি করে দিয়েছে।
সুজাতা তাই বাস্তবিক খুবই আতান্তরে পড়ছিল। অনুরোধে যদি কিছু হয়, সেই ভেবে সত্যপ্রিয় মজুমদারের কাছে পৗঁছেও গিয়েছিল একদিন। টাকমাথা, মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। সারাদিন পান চিবোচ্ছেন। দেখলেই মনে হয় ধুরন্ধর, ভোগী মানুষ। সব শুনে বাঁকা হেসে বললেন, ‘মিসেস মিত্র, আপনি কি মনে করেন অসুবিধা আপনার একার? কিন্তু তাই বলে, লোকে শহর ছেড়ে নড়বে না, এরকম হলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাদীক্ষার হালটা কী দাঁড়াবে ভাবতে পারছেন?’
সুজাতা এরপরও তার নাচার অবস্থাটা আর একটু বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে গেছিল। সত্যপ্রিয়বাবু থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কত্তা তো ভালো পোস্টেই আছেন, তাই তো? তা আপনার আর টাকাপয়সার কী দরকার? অসুবিধা হলে ছেড়ে দিন না। আমরাও তো সেটাই চাই। আপনার পুরোনো লোকেরা সব বাস্তুঘুঘু হয়ে গেছেন। চাকরির বাজারের যা অবস্থা তাতে নতুন টিচার অনেক কম মাইনেয় পাওয়া যাবে।’
জিভটা মুহূর্তে তেতো হয়ে গিয়েছিল লোকটার চাঁচাছোলা বক্তব্য শুনে। কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে সত্যপ্রিয়র চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এল সুজাতা। সত্যিই তো, প্যানেলে এখনও শতসহস্র যুবক-যুবতি অপেক্ষা করছে চাকরি পাওয়ার জন্য। একটা জায়গা খালি হওয়ার খবর পেলেই তদ্বিরের ধুম পড়ে যায় বলে শোনা যায়। যার যেখানে যত প্রভাবশালী খুঁটি আছে, তাদের ব্যবহার করার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। কপালের শিকে তো এক-আধজনেরই ছেঁড়ে। আর সত্যপ্রিয় মজুমদারের মতো লোকেরা দিব্যি মাতব্বরি করার সুযোগ পেয়ে যান।
তাকে ম্লানমুখে চেম্বারের বাইরে বের হতে দেখে রামকুমার দাঁড়িয়ে পড়ে। বগলে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে সে কোথাও যাচ্ছিল। সুজাতাকে দেখে গলায় খানিকটা শ্লেষ এনে কথা শুরু করে।
‘কী? হল না বুঝি?’– মুখে একফালি হাসি ঝুলিয়ে রাখল রামকুমার, যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে।
ম্লান হাসল সুজাতা, যার মানে, না।
রামকুমার বলল, ‘আপনাদের কিছু হবেও না। কেন হবে? এত বছর ধরে চাকরি করছেন, এখনও সরকারি কর্তারা কীসে তুষ্ট সেটা ধরতে পারলেন না?’
রামকুমার খুব অর্থবহ দৃষ্টিতে সুজাতার দিকে চেয়ে রইল। তার মনে পড়ে গেল সহকর্মী তপতীর কথা। সাধারণ গ্রামীণ পরিবারের মেয়ে তপতী। কিন্তু মেয়েটির বাস্তববোধ দেখার মতো। সুজাতাদের বয়সি হলেও তপতী তাদের থেকে বেশ খানিকটা পরিণত। বছরকয়েক শহরের জল পেটে পড়তেই, তপতী গ্রাম ছেড়ে এসে এখানেই একটা ছোটোখাটো ফ্ল্যাট কিনে জমিয়ে বসল। বিয়ে-থা করেনি। গ্রাম থেকে বাবা-মাকে নিয়ে এল।
সেই তপতীর আবার গ্রামে পোস্টিং হতে সে বেঁকে বসল। সুজাতাদের কাছে বলল, ‘এই অর্ডার আমি পালটে তবে ছাড়ব।’ বাস্তবে ঘটলও তাই। তপতীর বদলে অন্য কোন শিক্ষকের ঘাড়ে বদলির কোপটা পড়ল, তা অবশ্য সুজাতা জনে না। তপতী হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জানতে হবে, কোন পুরুষের কী চাহিদা! লোকটা বোকা ছিল বুঝলি! খুব বেশি আপস করতে হল না। বাঁ হাতের মুঠোয় আদর করে কিছু ছাপানো কাগজ গুঁজে দিতেই গলে গেল!’
আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তপতী বলল, ‘তুই চাইলে লোকটার সঙ্গে আমি একবার কথা বলে দেখতে পারি। খুব বেশি কম্প্রোমাইজ না করে যদি হয়ে যায় ক্ষতি কী? আর একটু-আধটু কম্প্রোমাইজ করলেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় বল তো? পৃথিবীর প্রত্যেককে আপস করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে. কেউ কম করছে, কেউ বেশি। এত সতীপনা করলে নিজেকেই ভুগতে হবে আজীবন!’
তপতীর চাপা গলায় বলা কথাগুলো কানে যেন গরম সিসের মতেই ঢুকল সুজাতার। সে মরে গেলেও পারবে না তপতীর মতো করে ভাবতে। কঠিন গলায় বলল, ‘না, তার দরকার হবে না!’ তক্ষুনি তার চোখের সামনে মনোময়ের সহজ ঋজু চাহনিটা ভেসে উঠেছিল।
আজকাল পনেরো দিনে একবার বাড়িতে আসার সুযোগ পায় মনোময়। আর তাই নিয়ে তার খেদের অন্ত নেই। যে দু-একদিন বাড়িতে থাকে মনোময়, সুজাতার ইচ্ছে করে না তাকে ছেড়ে দূরে যেতে। এটা শুধু প্রেমের জন্য নয়। নির্ভরতার জন্য, বলা যেতে পারে। মনোময় একটা ভাড়াবাড়িতে থাকে। সকাল-সন্ধে কাজের মাসি এসে তার জন্য রান্না করে চাপাঢাকা দিয়ে রেখে চলে যায়। অধিকাংশ দিন সেই ঠান্ডা খাবারই গিলতে হয় তাকে। সুজাতার বুকটা ভেঙে যায় এসব কথা শুনে। মনোময় বোঝে। তাই আজকাল ক্লিষ্ট হাসি ঠোঁটে টেনে এনে বলে, সে ভালো আছে।
সুজাতা এখন দিব্যি বোঝে, সেই ভালো থাকার মানে কী! সকালের ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে ঘণ্টাদেড়েক যাত্রার পর, কম করে দু-কিলোমিটার হাঁটা। তবে পৌঁছোনো যায় স্কুলে। সেদিন অংকের বিনোদবাবু বলছিলেন, ‘আপনি একটা সাইকেল কিনে নিন মিসেস মিত্র। এখানে একটু খোঁজখবর নিলে পুরোনোও পেয়ে যেতে পারেন। স্টেশন থেকে স্কুলে আসবেন, আবার ফেরার সময় স্টেশনে রেখে বাড়ি চলে যাবেন।’
সুজাতাও দেখেছে, গ্রামের রাস্তায় মেয়েরা এখানে সাইকেলে যাতায়াত করে। কিন্তু সুজাতার বড়ো সংকোচ হয়।
ইংরেজির বিনতা মিস বলেছিলেন, ‘একটা কথা তোকে বলে রাখি সুজাতা। আমাদের গ্রামটা আর আগের মতো নেই বুঝলি? পাশের গ্রামে পলিটিক্যাল মারামারি নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই খুনজখম হয় বলে শুনি। তার ছোঁয়াচ এ গ্রামেও লাগছে। কাজেই সাবধানে রাস্তা চলবি । তুই নতুন লোক। কখনও রাত করে ফিরবি না।’
বিনোদবাবু বললেন, ‘শুধু পলিটিক্যাল বলছেন কেন? আমাদের স্কুলের কতগুলো মেয়ে গত দু-তিন বছরে উধাও হয়ে গেছে কেউ খোঁজ রেখেছে? সব নারীপাচারের ব্যাপার, বুঝলেন মিসেস মিত্র! কেউ দেখার নেই!’
বিনোদবাবু খেদের সঙ্গে জিভে শব্দ করলেন। ভয়ে শিউরে উঠছিল সুজাতা। সব শুনে মনোময়ও কম উদ্বিগ্ন হল না। বলল, ‘তোমার ছুটিছাটা জমা নেই? কোনওমতে ওসব নিয়ে এ বছরটা কাটিয়ে দাও সুজাতা। সামনের বছর দেখি, কাউকে ধরেকরে কিছু করা যায় কিনা!’
বিছানায় শুয়ে থাকা মনোময়ের শরীরের উপর নিজেকে হিঁচড়ে তুলে এনে সুজাতা বলল, ‘আর ততদিনে আমার যদি একটা কিছু হয়ে যায়? তুমি এত দূরে থাকো, তুমি তো খবরও পাবে না! আমার খুব ভয় করে।’
মনোময় বলল, ‘ভয়ের কী? তুমি একা অত দূরে চাকরি করতে যাও? আরও অনেকে ওই স্টেশনে বা কাছাকাছি স্টেশনে নামে। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেবে। তোমরা দল বেঁধে যাওয়া-আসা কোরো। দেখবে কোনও বিপদ থাকবে না।’
মুখে এ কথা বলে সুজাতার মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করলেও মনোময়ের গলায় যেন জোর নেই। সুজাতাও হয়তো সেটা বুঝতে পারল। কিন্তু কিছুই করার নেই, মনে করে চুপ করে রইল দুজনেই।
দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেতকে সাক্ষী রেখে ট্রেনটা ছুটছে। সুজাতাদের স্কুলের হেডমাস্টার অভ্রনীল দত্ত, বিপ্লবী মানুষ। একসময় নাকি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতেন। কিন্তু রাজনীতির ক্লেদটা নিজের চোখের সামনে দেখার পরেই এক মুহূর্ত আর থাকেননি তার মধ্যে। ইদানীং বেশ হালছাড়া হতাশ গলাতেই কথাবার্তা বলে থাকেন। একদিন স্টাফরুমে সুজাতাকে ঝুঁকির কথা বলতে শুনে, নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘খুব বেশি ভেবো না এসব নিয়ে সুজাতা। পৃথিবীটা এরকম-ই। এভাবেই চলবে। তুমি আর আমি কিছু ভাবলেই যে সেটা হয়ে যাবে, এমন নয়। আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি, আমার কিংবা তোমার মতে কিছুই হওয়ার নয়।’
তারপর থেকে প্রবীণ এই শিক্ষকের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বই হয়ে গেল সুজাতার।
মানুষের সত্ত্বা সবসময়ই দ্বৈত। যে-অভ্রনীল অন্য সময় সুজাতাকে স্ত্বান্না দেন, সেই তিনিই কোনও কোনওদিন চরম বিরক্তিতে বলে ওঠেন, ‘ভেবে দ্যাখো একবার, সরকারি যোজনাগুলিকে গ্রামীণ জনতার কাছে পৗঁছে দেবে কে? না আমরা। পোলিয়ো ড্রপস খাওয়ানোর প্রচার কে করবে? আমরাই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের বোঝাবে, গ্রামীণ মানুষের মনে গণতান্ত্রিক চেতনার জাগরণ ঘটাবে, সাক্ষরতা অভিযান চালাবে, বিনে পয়সার বই বন্টন করবে, বাচ্চারা স্কুলে না এলে বাড়ি থেকে টেনে আনবে, সরকারি কর্তারা এলে জলপানির ব্যবস্থা করবে কে? কেন, আমরা!’
হেডমাস্টারমশাইয়ের কথাটা যে কত দূর সত্যি, তা আজ হাড়ে-হাড়ে টের পেল সুজাতা। দশটা বাজতে না বাজতে স্কুলের সামনে এসে হাজির হয়েছে ধুলোমাখা দুটো গাড়ি। ঝটপট দরজা খুলে চার-পাঁচজন মানুষ নেমে এলেন। ততক্ষণে তাদের দেখতে গ্রামের কৗতূহলী মানুষজন ভিড় করেছে। আজ স্কুলে অ্যাটেনডেন্স একশো শতাংশ। এর পুরো কৃতিত্বটাই অবশ্য স্কুলের অশিক্ষক কর্মীদের। অভ্রনীলের একটা বড়ো চিন্তা তাতে দূর হয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সুজাতারাও।
সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতার নাম জয়ন্ত গুহ। ক্লাসগুলো খুব কম সময়ে পরিদর্শন করে ফিরে এলেন স্টাফরুমে। সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসলেন সরকারি প্রতিনিধিরা। তাদের ফেরার তাড়া আছে। ফলে একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে তারা রাজি নন।
জয়ন্ত গুহ গম্ভীর চোখে হেডমাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের কথাও শুনি–!’
খুকখুক করে একটু কেশে নিলেন অভ্রনীল। তারপর বললেন, ‘আমাদের স্কুলবাড়িটার অবস্থাটা তো নিজের চোখেই দেখলেন স্যার। আমাদের এ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে অনেকবার বলেছি। কাজ হয়নি। আরও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন ধরুন, স্কুলে যে-টিউবওয়েলটা আছে, তাতে জল ওঠে না ঠিকমতো। বাচ্চারা জল খেতে পারছে না। স্কুলের মূল দরজাটা চুরি হয়ে গেছে। সকালবেলা এসে আমরা দেখতে পাই অবলা জীবের বিষ্ঠায় ভরে আছে ক্লাসঘর। পরিষ্কার না করলে ভদ্রভাবে বসা পর্যন্ত যাবে না। কে পরিষ্কার করবে? এখানে তো কোনও সাফাইকর্মীও নেই!’
অভ্রনীল হাঁফিয়ে উঠলেন সমস্যার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে। জয়ন্ত গুহরা নিশ্চয়ই সব জায়গাতে গিয়েই এমন ফিরিস্তি শুনতে অভ্যস্ত। তাই, তার মুখেচোখে কোনও ভাবান্তর ধরা পড়ল না। কেবল বললেন, ‘সমস্যা কোথায় নেই অভ্রনীলবাবু? এই তো, আমরা শহর থেকে আসছিলাম। আসার পথে গাড়ির টায়ার গেল ফেটে। এটা সমস্যা নয়?’
জয়ন্ত গুহের রসিকতায় তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা হেসে উঠলেন।
জয়ন্ত তাদের থামিয়ে বললেন, ‘যাক সে কথা। ঘটনা হচ্ছে, অভ্রনীলবাবু, আমি আপনাদের কোনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে আসিনি। স্কুলের ডেভেলপমেন্টের জন্য পঞ্চায়েতের কাছে সরকারি টাকাপয়সা আছে। এত দূর থেকে আমরা তো আর সবটা দেখে উঠতে পারি না! আপনাকেই প্রধানের সঙ্গে বসে সমস্যাগুলো মিটিয়ে নিতে হবে। তবে একটা কথা, মিড-ডে মিলের ব্যাপারে সরকার কিন্তু এখন খুবই কড়া। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাজেই ওই প্রকল্পটা যাতে ঠিকভাবে চলে সেটা দেখবেন।
‘মিড-ডে-মিল?’ অভ্রনীল আঁতকে ওঠেন, ‘সত্যি বলতে কী জয়ন্তবাবু, সপ্তাহে তিনদিনের বেশি স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য রান্না হয় না। বাসনপত্র নেই। জ্বালানি কেনার টাকা পাওয়া যায় না। আপনারা কেবল আমাদেরই দোষ দেখেন!’
অভ্রনীল রেগে উঠতে গিয়েও উলটোদিকে বসে থাকা সুজাতার ভয়ার্ত মুখচোখ দেখে চুপ করে যান। সরকারি লোকেদের কাছে কোন বিষয়গুলি তুলে ধরা হবে, এ নিয়ে শিক্ষকদের মিটিংয়ে মিড-ডে মিলের বিষয়ে প্রবলভাবে সরব হয়েছিলেন অভ্রনীল। তার বক্তব্য ছিল, একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাক এইবার। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বাচ্চারা মিড-ডে মিলের মতো সরকারি প্রকল্প থেক বঞ্চিত হবে, আর সব দোষটা এসে পড়বে শিক্ষকদের উপর– এটা চলতে পারে না।
তখনই অজানা আতঙ্কে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গিয়েছিল সুজাতার। মরিয়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, ‘এমন চরম মনোভাব নেওয়া ঠিক হবে না স্যার। আপনি মোটরসাইকেলে গ্রামের মধ্য দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করেন। কেউ যদি আপনাকে একা পেয়ে অপহরণ করে, তাহলে? আপনি আছেন বলেই আমরা জোর পাই।’
‘তা বলে কি চুপ করে থাকব দিনের পর দিন?’ অভ্রনীল রেগে গিয়েছিলেন সেদিনও। তারপর নিজেকে সামলে, শান্ত গলায় বললেন, ‘মনে রেখো, এটা আমার গ্রাম। আমার মাতৃভূমি। আমার কিছু অধিকার আছে। পাঁচটা মানুষ আমায় সম্মান করে। সবকিছু এত সহজ হবে না।’
ভূগোলের দিদিমণি চিত্রা সমর্থন করেছিল সুজাতাকে। বলল, ‘আমার মনে হয় সুজাতা ঠিক কথাই বলেছে স্যার। আপনি না হয় এখানকার ভূমিপুত্র। আমরা তো তা নই। সকালবেলা সংসার গুছিয়ে রেখে শহর থেকে এখানে আসি চাকরি করতে। কাজেই, আমার মনে হয় কৗশল নিয়ে চলাই সমীচীন হবে।’
অভ্রনীল খানিকটা থমকে গেলেন শিক্ষিকাদের প্রত্যুত্তরে। শেষে নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘কৗশল কাকে বলে, আপনারাই বলে দিন আমায়। প্রধানের কাছে মিড-ডে মিলের টাকাপয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী আসে। সেগুলো ঠিকমতো দেওয়া হয় না। আংশিক দেওয়া হয়। হেডমাস্টারের আলাদা ঘর আছে। কিন্তু প্রথমত সেটি জরাজীর্ণ, বসার অযোগ্য, উপরন্তু পঞ্চায়েত মেম্বারের বাড়ির পশুখাদ্য সব ওখানেই থাকে, আপনারা জানেন। স্কুলবাড়িটা ভেঙে পড়ছে, কারওর নজর আছে সেদিকে? সরকারি লোকজন তো দেখেশুনে আমাদেরই দোষ দেবেন। বলবেন, আপনারাই ঠিকভাবে যত্ন নেননি। শাস্তিও দিতে পারেন তারা। তখন কোন কৌশলটা কাজে লাগবে বলুন তো!’
সুজাতা আর কোনও কথা বলেনি। চিত্রাও চুপ করেই ছিল। কারণ ওরা সকলেই জানত, অভ্রনীল যতই গলা ফাটান, সে কেবল অরণ্যেরোদন ছাড়া অন্য কিছু হবে না। এই গ্রামে প্রধানের প্রতিপত্তি সীমাহীন। সামনে অবশ্যই একটা ভদ্রতার আড়াল আছে। কিন্তু বাস্তবে যে তার ভয়ংকর লোকলস্করের সঙ্গে ওঠাবসা, এ কথাও গ্রামে সকলে জানে। তাই কেউ মুখ খোলে না। কে জানে, কোন কথায় আবার কোন সংঘাতের আগুন জ্বলে ওঠে!
অভ্রনীলের অভিযোগ লোকটি নতমস্তকে শুনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যাবে– এটাই তো ঘটেছে বারবার।
সরকারি প্রতিনিধিরা আসার আগেরদিন অভ্রনীল নিজেই স্কুল বসার আগে একজন মজুরকে ডেকে এনে গোটা স্কুল সাফ করালেন নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে। সুজাতা অবশ্য বলছিল, সে-ও অর্ধেক খরচ দেবে। স্কুল সাফ করা কি একা হেডমাস্টারের দায়িত্ব?
অভ্রনীল রাজি হননি। গলা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘গতকাল রাতে নিজেকে অনেক বোঝালাম সুজাতা। কিন্তু মন সায় দিল না আপসে। বাস্তব পরিস্থিতি যা, তাকেই সামনে না এনে উপায় নেই সুজাতা। কাউকে আড়াল করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।’
সুজাতা চুপ করে রইল। এক অদ্ভুত মানসিক দোলাচল তাকে ক্রমাগত পীড়িত করছে।
অভ্রনীল ফের বললেন, ‘ভয় পাচ্ছ?’
সুজাতা ক্লিষ্ট হেসে জবাব দিল, ‘একটু।’
অভ্রনীল বললেন, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না, দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই, মরব না’– শুনেছ তো এই রবীন্দ্রসংগীতটা? তাহলে? সমস্যার প্রতিকার তো একদিন কাউকে না কাউকে করতেই হবে। তাহলে আমরাই বা নই কেন? এখনই বা নয় কেন?’
জয়ন্ত গুহ পোড়খাওয়া আমলা। ফুঁসে উঠলেন, ‘দোষের ভাগি তো আপনাকেও হতে হবে অভ্রনীলবাবু। এই স্কুল দেখাশোনার দায়িত্ব সরকার আপনার উপর সঁপেছে। ইস, কী অবস্থা করেছেন স্কুলটার! চোখে দেখা যায় না!’
অভ্রনীল ম্লান হেসে বললেন, ‘কেন কিছু হয়নি, সবই আপনাকে বলেছি স্যার। তারপরও…!’
জয়ন্ত গুহর পাশে বসে থাকা অন্য অফিসারটি এবার মুখ খুললেন, ‘ঞ্জসব বাহানা না হয় না-ই শোনালেন! আমরা সবকিছুই জানি। গ্রামের বেশিরভাগ বাইরে থেকে আসা শিক্ষক স্কুলেই আসেন না। কেবল মাইনে নেন। আমরা এও জানি, সেই মাইনে থেকে সামান্য টাকা গ্রামেরই কোনও বেকার যুবককে দিয়ে, তাকে দিয়ে শিক্ষকতার কাজটা করিয়ে নেন।’
জয়ন্ত গুহ হাসেন, ‘যা হোক, এটুকু দায়িত্ববোধ তো তাদের আছে, কী বলো সরকার! এটুকু অন্তত বোঝে যে, স্কুলটা খুলতে হবে।’
সরকার বলে যেতে থাকেন, ‘আমরা জানি, এ স্কুলেও সেই ঘটনা ঘটে। প্রধানসাহেব আমাদের সবই জানিয়েছেন। লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ হবে না অভ্রনীলবাবু।’
অভ্রনীল স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শুনে। বলতে গেলেন, তার স্কুলে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। তিনি গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। এইসময় বিনোদবাবু এসে তার কানে কিছু যেন বললেন। মিটিং ছেড়ে বাইরে এলেন অভ্রনীল। গ্রামের প্রধান অরূপ মাইতি এসেছেন। মুখে বিগলিত হাসি। দেখেই মনটা বিষিয়ে উঠল অভ্রনীলের। ভ্রূদুটো কুঁচকে গেল।
প্রধান বললেন, ‘মাস্টারমশাই, একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’
অভ্রনীল প্রমাদ গুনলেন।
প্রধান বললেন, ‘শহর থেকে বাবুদের যে-দলটা এসেছে, তারা আজ এখানেই থাকবেন। কাল এখান থেকেই অন্য জায়গায় স্কুল পরিদর্শনে যাবেন। ওদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয়।’
অভ্রনীল বললেন, ‘পঞ্চায়েত করুক। আমায় বলছেন কেন?’
প্রধান বললেন, ‘সে তো করবই। কিন্তু, আপনার স্কুলের দুই দিদিমণিরও বাড়ি যাওয়া চলবে না। বাবুদের একটু যত্নআত্যি…!’
প্রধানের কথা শেষ করতে দিলেন না অভ্রনীল। বলে উঠলেন, ‘ওরা অনেক দূর থেকে আসেন। সংসার, ছোটো বাচ্চা আছে। ওদেরকে তো ছাড়তেই হবে ভাই!’
‘ছাড়তেই হবে, মানে?’ প্রধানের গলা চড়ে যায়, ‘ঞ্জই স্কুলে চাকরি করতে হলে ওদের যে এটুকু করতেই হবে মাস্টারমশাই!’
অভ্রনীলের যে কী হয়ে গেল, হঠাৎই হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে সজোরে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন প্রধানের গালে। অরূপ মাইতির টকটকে গায়ের রং ক্রমশ রক্তাভা ধারণ করল। তাকে কিছু বলতেও হল না। তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অভ্রনীলের উপর।
তার পরের দৃশ্যটা দেখার জন্য অবশ্য প্রস্তত ছিল না সুজাতা। সমস্ত ক্লাসঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছেলেমেয়েদের দল। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুষ্কৃতীদের উপর। আর অভ্রনীল দূর থেকে চ্যাচাঁচ্ছেন, ‘ওরে ছেড়ে দে। মারের পালটা মার নয়।…’ কিন্তু তার দুচোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রু।