ডা. চ্যাটার্জি বললেন, এটা নিশ্চয়ই আপনার সবসময় হয় না?

টেবিলের উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকলেও, অর্পণের চোখ মোটেও ডা. চ্যাটার্জির উপর ছিল না। বরং তার দৃষ্টি ছিল ঘরের দেয়াল ঘড়ি, মানুষের ব্রেনের বিভিন্ন অংশের ছবি, একটা ক্যালেন্ডার বা ওর রিভলভিং-এর একটু উপরে একটা এসির উপর। জায়গাটা চেম্বার আর কর্পোরেট অফিসের এক মিশ্রণ মনে হচ্ছিল।

মুখ ফিরিয়ে এবার বলল, একেবারেই না। হয়তো মনের কোথাও থাকে অনুভূতিটা। কিন্তু তীব্র ভাবে জেগে ওঠে, যখন ও আমার কাছাকাছি থাকে। যেমন ধরুন, খাবার টেবিলে। আমার কাছাকাছি বসে খাচ্ছে বা আমার বাইকে। বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

আর কোথাও? টেবিলের উপর দুটো কনুই তুলে, হাতের উপর কায়দা করে নিজের চিবুক রাখলেন ডা. চ্যাটার্জি। ফরসা মুখ আর হালফ্যাশনের চশমায় মুখে আগ্রহের রেখা।

না, সবচেয়ে বেশি হয়, গলা এক স্কেল নামিয়ে বলল অর্পণ, যখন আমরা বিছানা শেয়ার করি।

তখন কোনও সমস্যা? মানে, প্রসেসটা চলার সময় আপনার কোনও অনুভূতি?

ঘরে কেউ নেই। তাও বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ডা. চ্যাটার্জির চোখে চোখ রাখতে পারল না। ভাসা সুরে বলল, প্রবলেম মানে, ব্যাপারটার মধ্যে যেন একশো শতাংশ থাকতে পারি না। একটা নতুন বৈবাহিক সম্পর্কে ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। আর সে জন্যেই তো আপনার কাছে…

আসলে, কাউন্সেলিং-এর পরিভাষায় এটাও এক ধরনের ডবল পার্সোনালিটি। এই স্টেজটাকে আমরা অ্যাবনর্মাল সাইকোলজির মধ্যে রাখলেও, আমরা বুঝি নর্মাল আর অ্যাবনর্মাল-এর মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা প্রায় অসম্ভব, ডা. চ্যাটার্জির কাউন্সেলিং সত্তা জেগে উঠেছে।

অর্পণের মনে হচ্ছিল, উনি একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করছেন এগোনোর। মন বলছিল, আরও প্রশ্ন ভেসে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। উত্তর তো দিতেই হবে। না হলে সমাধান মিলবে কেমন করে।

আসলে, সত্যিটা এটাই। আবার বলতে শুরু করেছেন উনি, আমরা যতই বলি, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার তা কিন্তু নয়। কিছু স্মৃতি অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি থাকলেও, ভীষণ সতেজ থাকে। মানে, আমরা ভিতর থেকে, অবচেতন মনে তার থেকে ডিট্যাচড্ হতে চাই না।

চেম্বারের ভেতরের নিস্তব্ধ হিম পরশে আর ডা. চ্যাটার্জির নরম সাহচর্যে ইতিমধ্যেই অশান্ত ভাবটা কমতে শুরু করেছিল। স্বস্তি নেমে আসছিল। অর্ণব অফিস কলিগ হলেও ইনটিমেট ফ্রেন্ড। ডা. সৌম্যশেখর চ্যাটার্জির নাম সাজেস্ট করে বলেছিল, ওনাকে সব বলতে পারবি। ওনার সমাধান একেবারেই অফবিট। পেশাদারিত্বর সঙ্গে গোপনীয়তাও দারুণ বজায় রাখেন। জাস্ট চেক করে দেখতে এসেছিল। নির্ভরতাটা তৈরি হচ্ছে। শ্রদ্ধা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সমাধান আছে নিশ্চই?

অবশ্যই আছে। আই গ্যারান্টি। বন্ধুর মতো, নিজের মতো করে আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে এই টেকনিকটাকে আমরা বলি, ফ্রি অ্যাসোসিয়েন অবাধ অনুষঙ্গ। এতে আপনি অনেকটা হালকা বোধ করবেন। আর সমাধানটা অনেক মাইনর ব্যাপার। জাস্ট একটা উপসংহার টানার মতো।

থমকাল অর্পণ। এখনও পর্যন্ত ডা. চ্যাটার্জির সঙ্গে এই অ্যাপযে্টমেন্টের বেশ কয়েটা ধাপে প্রথমে থেমে, তারপর এগোতে হয়েছে। সুতো ছাড়ছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে। সমস্যা নিয়ে একজন কাউন্সেলর-এর পরামর্শ নিতে আসা। লাজুক ভাব আর হাসির মোটামুটি ব্যালেন্স যেমন অফিসে করে, সেরকম ভাবে বলল, আসলে, এ রকম অ্যাফেয়ার তো আজকের যুগে সবারই একটা-দুটো থাকে। পাসিং অ্যাফেয়ারের মতো। তা পেরিয়ে সবাই চলেও যায়। বিবাহিত জীবন শুরুও হয়ে যায় জমাটি ভাবে। আমাদের বন্ধুদের বেশির ভাগেরই কাহিনি অনেকটা এ রকমই।

একদম ঠিক বলেছেন। তবে ঘটনার রেখাপাত সবার মনে একরকম ভাবে হয় না। ইনডিভিজুয়াল মানুষের মনের আলাদা আলাদা স্তর।

অর্পণকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র আর শিক্ষিত মনে হয় বলেই কি শুরু থেকেই ডা. চ্যাটার্জি এতটা টেকনিক্যাল স্বর বজায় রাখছেন? হতেও পারে। বেশ কিছুটা বাতাস বুকে ভরে নিয়ে অর্পণ বলল, যে-সমাধান আপনি দেবেন, তাতে কি মনের ভারি ভাবটা সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে কি আর রেজাল্ট পাবেন, মি. মিত্র? কিন্তু রেজাল্ট আসে। আর সে চেঞ্জ আপনি বুঝতে পারবেন আপনা থেকেই।

ফিল-গুড ভাবটা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। বুঝতেও পারছে অর্পণ। প্রথমে ভেবেছিল, কোনও জ্যোতিষের কাছে যাবে। টিভি খুললেই তিন মিনিটে কালসর্পদোষ, ব্যাংদোষ, টিকটিকিদোষ কাটানো হয়। স্ক্রিনের নীচের ফোন নাম্বারে ফোন করলেই এদের চেম্বারে। সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র-সূর্য এদের হাতের মুঠোয়। জ্যোতিষির ডিগ্রিতে সব এক একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী আর ত্রিকালজ্ঞ। অর্ণবকে বলতেই চোখ কপালে তুলে বলেছিল, কাউকে বলিস না, অ্যাড এজেন্সিতে এই পদে চাকরি করিস। বিজ্ঞাপন এখন তোকেই টুপি পরাচ্ছে! ভাবতে পারি না।

তখন আর কথা এগোয়নি। এখন মনে হচ্ছে অর্ণবের কথা শুনে একদম ঠিক করেছে। চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বলল, ওকে। কিন্তু সলিউশনটা কী?

কিছু না। ছোট্ট একটা কনফেশন।

কনফেশন! কার কাছে? ভ্রূ কুঁচকে গেছে অর্পণের।

হেসে ফেলেছেন ডা. চ্যাটার্জি। নট সো ফাস্ট। কারও-র কাছে না। নিজের কাছে। কেউ থাকবেও না।

মানে?

খুব সহজ মি. মিত্র। নিজের ভেতরে যদি কোনও পাপবোধ থেকেও থাকে, তা খুঁড়ে, তুলে ফেলে দিন স্ট্রেট…

সেটাই তো বলছি। মানে…

দেখুন, আপনি নিশ্চয় চার্চে কনফেশন বক্স দেখেছেন।

হুঁ….

উলটো প্রান্তে একজন পাদরি বসে থাকেন। কিন্তু তাঁর কাজ হল শুধু শুনে যাওয়া। অনেকেই বলে, তা করে তারা রিলিফ পেয়েছে।

তাহলে কি চার্চে, বিভ্রান্ত লাগছে অর্পণের।

না, না। আসলে নিজের ভেতরের কথাগুলো আপনি কোনও দিন কাউকে পুরোটা বলেননি। সেটাই নিজে এবার একটা কাগজে পুরো লিখে ফেলুন।

এক মিনিট। আপনাকে তো…

সরি, মি. মিত্র, আমাকেও আপনি পুরোটা বলেননি। ইনফ্যাক্ট বলতে পারছেন না। তাই বলছি, লিখে ফেলুন পুরোটা।

হ্যাঁ, তারপর?

সিম্পল। কোনও ভরা পূর্ণিমার রাতে, যখন কেউ দেখছে না সেটাকেই কুচিয়ে টুকরো করে চোখের সামনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিন। এ টুকুই। দেখবেন, অনেকটা রিলিভড হয়ে যাবেন।

সত্যি কি এটা হতে পারে? এর কোনও সাযে্নটিফিক জাস্টিফিকেশনই তো নেই।

সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের সব সলিউশন, বিজ্ঞান মেনে হয় না মি. মিত্র। একবার ট্রাই করুন শুধু। ডা. চ্যাটার্জি হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়েছেন। টলে যাওয়া বিশ্বাসটা আবার দৃঢ় হচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল অর্পণ, কিন্তু মুন লাইটই কেন?

মুন ইজ আ লাভ সিম্বল। চাঁদের আলোর একটা ম্যাজিকাল পাওয়ার আছে।

ওকে, কবে করতে বলছেন এটা? কাল বাদ পরশুই কিন্তু পূর্ণিমা আছে। মোবাইল খুলে বং ক্যালেন্ডার-এ ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছে অর্পণ।

দুচোখ বুজে কী যেন ভাবলেন ডা. চ্যাটার্জি। তারপর বললেন, পরে করতে গেলে আবার বেশ কিছুদিনের অপেক্ষা। কামিং ডেটটাই কাজে লাগান।

একটা কথা, একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল অর্পণ, বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা বেশ সিক্রেট। এটা নিশ্চয়ই ডিসক্লোজ হবে না কোনও ভাবেই?

শুনুন মি. মিত্র, কোনও কাউন্সেলরই এক জন পেশেন্ট-এর কেস হিস্ট্রি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

থ্যাংক ইউ। পেছনের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করে আনে অর্পণ।

 

তোফা দুপুরের ঘুমের পরও আলিস্যি ভাবটা ছেড়ে যাচ্ছিল না। রোববার মানেই শেষ তিন মাসে পাতলা খাসির মাংসের ঝোল আর ভাত। শেষ পাতে একটু টক দই। ঘুম ঘুম ভাবটা খাবার টেবিলেই ফিল করে অর্পণ। নতুন ফ্ল্যাট-এর ইএমআই-এর সময় যত এগিয়ে গেছে, তত বেশি করে এই অলস ভাবটা ঘিরে ধরেছে। উত্তরপাড়ায় জিটি রোড গঙ্গার কোল ঘেঁসে এই ফ্ল্যাট। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেছিল। সে সময় ওর বয়স আঠাশ। কোম্পানি চেঞ্জ করে বহুজাতিকে যোগদান করে, ডিজাইনার হিসেবে তখনই ঈর্ষণীয় পে-স্কেলে চলে গিয়েছিল। আর এখন তো উন্নতির চরমসীমায়।

অ্যাড-এর ফিল্ডে অর্পণ মিত্রকে সমস্ত ক্লাযে্নট এক ডাকে চেনে। গ্র‌্যাজুয়েশনের পর পোস্ট গ্র‌্যাজুয়েশন না করে স্পেশালাইজড কোর্স করতে গোঘাট থেকে সোজা কলকাতায়। একেবারে রেসিডেন্সিয়াল। দুবছর পর ক্যাম্পাস থেকেই একটা মোটামুটি কোম্পানিতে। দেশের বাড়িতে আর ফিরলই না। বছর তিনেক গড়িয়াতে দুজনের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকা। গোঘাটে দাদার সংসারে বাবা-মা থাকলেও, বেশ কয়েবার কাটিয়ে গেছে এখানে।

ঘরে ঢুকে বক্স খাটের পাশের ড্রয়ারের উপরে বিকেলের চা রাখল ঐশিকি। এই তিনমাসে দুপুরে অন্তত ছুটির দিনে তাকে ঘুমোতে দেখেনি অর্পণ। প্রচণ্ড হেলথ কনশাস বলেই কি ঘুমোয় না! তিন মাসের নব বিবাহিত জীবনে, এখনও জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি। চায়ের গন্ধের সঙ্গে ঐশিকির লম্বা চুলের শ্যাম্পুর গন্ধটাও মিশে যাচ্ছে। একটা ইচ্ছে চাগাড় দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখলেও এখনই কাছে টানাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

সদ্য ঘুমিয়ে উঠেছে। বাসি গন্ধ, মাথা চাড়া দিল যেন। উঠে বসে চা বিছানায় নিল। খোলা ব্যালকনিতে চলে গেছে ঐশিকি। এ সময়টায় ওর বাড়ি থেকে মা বা বাবা কেউ একজন ফোন করে। চোখ সরিয়ে রাখল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। পুরুষ্ট গোঁফে আর একটু বেড়ে ওঠা ভুঁড়িতে, সুখের ঝলক নাকি স্বামী হয়ে ওঠার আদল প্রকাশ পাচ্ছে!

চা খেয়ে আলিস্যি ভাবটা যাচ্ছে না। আজ রাতে কী করবে ভাবতেই বুকে শান্তির হাওয়া। একটা বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া।

চা শেষ করে চিত হয়ে শুল অর্পণ। স্যান্ডো গেঞ্জিটা উঠে গেছিল। নামিয়ে নিল পাজামার উপর ঠিক ঠাক। সুখের উড়ানকে সারা জীবন ধরে রাখতে চেয়েছে। এমনকী সুদেষ্ণার সঙ্গে কাটানো সময়ে তো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

স্কুল বা কলেজে কারও-র সঙ্গে ক্রাশ হয়নি। প্রফেশনাল ইনস্টিটিউটে যখন এসে বলেছিল, রীতিমতো মুখ টিপে হাসাহাসি হয়েছিল। হোস্টেলে অলক বলেছিল, তোরা মফস্সল বা একটু ভিতর দিকের ছেলেরা কেমন যেন একটু বাড়তি চাপা প্রকৃতির হোস। গ্রাম শব্দটা যেন ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া।

ভ্রূ কুঁচকে অর্পণ বলেছিল, আর তোরা সিটির লোকেরা সত্যি কথা বলে যে ডিক্সনারিতে কিছু হয়, তা বোধহয় বিশ্বাসই করিস না।

অলক চোখ গোল্লা করে বলেছিল, তুই কিন্তু অন্যরকম। আগ লাগা দেগা তু।

তো আগুনই লেগেছিল। সে আগুন যে কী কী পোড়ায়, বুঝতে সময় লাগেনি। ইনফরমাল কমিউনিকেশনের চতুর্থ ক্লাসেই চোখ গেছিল অর্পণের। হ্যাঁ, তবে উপরের ঠোঁটের এক সেমি উপরের তিলটায়। পাশের ডেস্কে বার বার ঘাড় ঘোরাচ্ছিল বলে অলক এক সময়ে ফিসফিসিয়ে বলেও ছিল, পুরো ম্যাডোনা তো রে। ঠোঁটে হাসি চলে এসেছিল।

ক্লাস শেষ করেই সিনেমাটোগ্রাফিক বিস্ফোরণ। তবে ম্যাডোনা না, সুচিত্রা সেন টাইপ। এগিয়ে এসে একেবারে মিসাইল, সোজাসুজি কারও-র সম্পর্কে কিছু বলতে না পারাটা হিপোক্রেসি। বুঝতে পারছিস?

ঠোঁটে হাসিটা রেখে বলে উঠেছিল অর্পণ, ফ্যাকাল্টির সামনে তোর তিল নিয়ে আলোচনা করলে ভালো লাগত?

বাঃ! স্মার্টনেসের তো অভাব নেই।

অভাব কেন হবে। আশির দশকের কেবলু বাংলা সিনেমার নায়ক আর কোথায় পাবি এখন!

সুদেষ্ণা পাত্তা না দিয়ে চলে গেলেও, অলক পিঠ চাপড়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেছিল, তেরা হোগা গুরু।

সত্যিই হয়েছিল এবং এগিয়ে গিয়েছিল একটু দ্রুত গতিতে। প্রথম প্রেম আর তার ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া, ভিক্টোরিয়ার মাঠ থেকে লেকের ধার সুদেষ্ণার সঙ্গে সে সম্পর্ক এগিয়েছিল চোখের পলকে। সিনেমার হলে একই ফাউন্টেনে চুমুক, লাইব্রেরিতে স্টাডিনোট লোড করা বা গড়িয়াহাটের ফুট ধরে হাঁটা হু হু করে কেটে গেছিল দিনগুলো। একই গতিতে শেষ হয়েছিল কোর্সের বছর দুটোও।

অর্পণের মনে হয়েছিল ছেদ পড়তে এবার বাধ্য, কারণ সুদেষ্ণা বর্ধমানে নিজের বাড়িতে ফেরার কথা বলছিল। ঠিক সেই সময় অর্পণের হঠাৎ চাকরি। আর সুদেষ্ণার আবার একটা স্পেশাল কোর্সে ভর্তি হওয়া।

 

চব্বিশে চাকরি কি অর্পণকে বেপরোয়া করে দিয়েছিল? ছুটির দিনে নতুন কেনা বাইকে বোম্বে হাই রোড ধরে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া বা বাইকে রাতের কলকাতা আবিষ্কার ওর আর সুদেষ্ণার। এ ছাড়াও বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে ভাড়ার ফ্ল্যাটে সুদেষ্ণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া।

অফিসিয়ালি দাঁড়ি টানলাম, এই জাতীয় কথা কোনও দিন ওরা পরস্পরকে বলে, সম্পর্ক থেকে বেরোয়নি। কেউ কোনও দিন কাউকে পরে ফোন করে বা দেখা করে কৈফিয়তও চায়নি। সেটা সম্পর্কের চোরাটানের মৃত্যু হতে পারে বা, দুজনের ইগো ফ্যাক্টর হতে পারে। এমনকী নিজের তরফে ঠিক কী, সেটাও নিশ্চিত করে অর্পণ বলতে পারে না। মনের গভীরে স্মৃতি থেকে যাওয়াতেই কি কোথাও পাপবোধ! প্রথম কয়েক মাস ব্যস্ত রুটিনের ফাঁকেও মনে হতো, একবার যোগাযোগ করলে কেমন হয়। তারপর একদিন সেখানেও ধাক্কা।

ছোটোখাটো মনোমালিন্য ওদের মধ্যে হলেও তা দীর্ঘস্থাযী হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজ করে নিত সুদেষ্ণাই। তাই কোনও দিন সেভাবে ওর মুখ গম্ভীর দেখেনি। স্পেশাল কোর্স শেষের ঠিক একমাস পর এলগিন রোডের এক ক্যাফেতে রবিবারের দুপুরে হাজির হয়ে দেখতে পেয়েছিল গম্ভীর মুখ। বাইরেও আকাশের মুখ ভার। অসাধারণ সুন্দর মিউজিকের সঙ্গতেও দুকাপ ব্ল্যাক কফি শেষ হয়েছিল নিঃশব্দে।

এই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউটা ক্র‌্যাক করতে পারলাম না। অথচ পোস্টিং কলকাতাতে ছিল, আর প্যাকেজও ছিল অ্যাট্রাকটিভ। সুদেষ্ণা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নীচের ঠোঁট।

মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল অর্পণ, তো?

তো কিছুই নয়। দিল্লিতে একটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেছি। ওরা ইন্টারেস্টেড। এক সেকেন্ড থেমে সুদেষ্ণা যোগ করেছিল, আমিও।

সোজা হয়ে বসেছিল অর্পণ, ভালো খবর। কিন্তু কলকাতাতে আরও দুএকটা ট্রাই করলে হতো না?

ইনস্টিটিউটে শর্মা স্যার বলছিলেন, দিল্লির অফারটা নিয়ে নেওয়া উচিত। ওদের নাকি প্রোমোশনাল ক্যাম্পেনিং স্টাইলটা গোটা ইন্ডিয়ায় খুব খাচ্ছে। আর আহমেদাবাদ আইআইএম-এর দুজন প্রাক্তন মিলে অফিসটা খোলায়, শেখার স্কোপটা বেশি হবে।

অন্যমনস্ক হয়ে খালি কফি কাপটা একবার নাড়াচাড়া করে অর্পণ বলেছিল, ও, তাহলে তো ডিসিশন নিয়ে নিয়েছিস।

এভাবে ভাবছিস কেন, যে-কোনও অবস্থাতেই কলকাতা ফিরে আসতে পারি। আরও অনেক বেটার এক্সপেরিযে্ন্স নিয়ে। অফিসের দুদুটো অ্যাসাইনমেন্ট একসঙ্গে চলতে থাকায় রাতের ফোন ছাড়া সে সপ্তাহে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। বর্ধমানে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল সুদেষ্ণা। দিল্লি যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে ওর বাবা-মা ছাড়তে এসেছিল। আগে থেকে কোনও পরিচয় না থাকায় সামনে যেতে বেশ অস্বস্তি হয়েছিল।

দিল্লিতে সেটলড হয়ে ফোনে বেশ কয়েবার কথা হয়েছিল। সে ফোনও কমে আসছিল তিন-চার মাস পর। তারপর দুদুটো নম্বর অস্তিত্বহীন।

শোক করেনি অর্পণ। নিজের প্রেমের নির্লিপ্তিতে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিল। কিন্তু ভাবার এত সময় ছিল না। নিজের কেরিয়ার গ্রাফ রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। কোম্পানি চেঞ্জ করে সাধারণ বেসরকারি অফিসে চাকরি থেকে অনেকগুনে বেশি রোজগার মোটেও মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। দুবছরের মাথায় ফ্ল্যাট নিয়ে পরের ছবছর শুধু তার ইএমআই গুনে গেছে নিঃশব্দে।

১৮ লাখের টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে উঠে এসে প্রথম প্রথম উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া ডেলি প্যাসেঞ্জারির যুদ্ধটা বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই ভালো লাগত। রাতে ফ্ল্যাটে একা থাকার পীড়া যে-একেবারেই দেখা দেয়নি তা নয়। কিন্তু ক্লান্তি খুব দ্রুত ঘুমের পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে ফেলত।

এ রকম অবস্থাতে ছটা বছর কেটেছিল অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে। নতুন করে কারও-র সঙ্গে জড়ানোর সময় ছিল না। ছুটির দিনে বাজার, গোছগাছ, রান্নার লোককে বুঝিয়ে দেওয়া আর বাকি সময়টা ল্যাপটপে প্রোজেক্ট ডিজাইন। গোঘাট থেকে বউদি আর মায়ের অনবরত ফোন ভেসে আসছিল।

বিয়ের প্রস্তাবে খুব বেশি চমকায়নি। হিসেব কষে দেখেছিল ফ্ল্যাটের ঋণশোধে বাকি আর সাত বছর। ইনক্রিমেন্ট স্টেডি রেটে বাড়ছে। জিডিপির লোয়ার গ্রোথের দাঁত ওদের ইন্ড্রাষ্ট্রিতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। শরীর-মন একযোগে বলে উঠেছিল বিয়ের এটাই সঠিক সময়। আর তা ছাড়া এতগুলো বছর অন্য কারও-রও তো মনে পড়েনি। সুতরাং দায়ের প্রশ্ন আসছে না বোধহয়। আর নিশ্চিত সমাধান তো এবার হাতের কাছেই।

চন্দননগরে ঐশিকিদের বাড়িতেই ওকে প্রথম দেখা। মোটামুটি খবর নেওয়ার পর মনে হয়েছিল পারফেক্ট চয়েস। বাংলায় অনার্স গ্র‌্যাজুয়েট। তবুও বাইরে দুতিনবার মিট করে নিয়েছিল। লম্বা চুল, হাইট, রং-এ জোরদার লাগলেও, সুদেষ্ণার সঙ্গে তুলনায় যায়নি। চন্দননগর ষ্ট্র‌্যান্ডেই রবিবারের এক সন্ধেতে জিজ্ঞাসা করেছিল ঐশিকীকে, ওর অতীত জীবনের কথা। কোনও পাস্ট অ্যাফেয়ার, এ বিয়েতে রাজি কিনা, ছোটো ছোটো প্রশ্নে জানার চেষ্টা করেছিল।

ঐশিকির সোজা-সাপটা সরল উত্তরে কিছুতেই নিজের অতীতকে সামনে আনার সাহস দেখাতে পারেনি। বিয়ের পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও নিষ্কলঙ্ক ঐশিকীর আচরণে, নিজের অতীতকে বার বার গিলতে হয়েছে। একটা অ্যাফেয়ার কী করে অপরাধবোধে পরিণত হয়, ভেবে বের করতে পারেনি। অগত্যা ছুটে যাওয়া ডা. চ্যাটার্জির কাছে।

 

ঘুমানোর ভান করেই শুয়েছিল। একটা হালকা উত্তেজনা তো বটেই, দুপুরে ভালো রকম ঘুমের জন্যও ঘুম আসতে চাইছিল না। কাল খুব সকালে উঠে প্রোজেক্টের একটা কাজ ছকে নিতে হবে বলেছিল। তাই ঐশিকি আজ আর কোনও উষ্ণতা চায়নি। ভীষণ কম্প্রোমাইজিং আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মেয়ে। সম্পর্কের সতেজতা আর স্নিগ্ধতা দুটোই সমান ভাবে মেনটেইন করতে পারে। এভাবেই তিন মাস অর্পণকে যেন অদৃশ্য হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

মধ্য কুড়িতে সম্পর্ক উন্মাদনা খোঁজে হয়তো, মধ্য তিরিশে স্থিতাবস্থা। সংসারের বৃত্তে এ ভাবেই বোধহয় ঢুকে পড়তে হয়। আজকের রাতের পর নিশ্চই পুরোপুরি ঢুকে পড়বে। সন্ধেবেলা চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঐশিকির চোখ এদিক ওদিক ঘোরে। বিশেষত ছুটির দিনে। মনে হয়েছিল রাতই সঠিক সময়।

রোজের মতো আজও ঐশিকি টয়লেটে উঠল। এসি অফ করল। মিনিট চারেক সময় ব্যয় করে টয়লেটে ও। এটুকু সময়ই যথেষ্ট। এক মিনিট অপেক্ষা করে উঠে পড়ল অর্পণ। ভাগ্যিস অ্যাটাচড্ বাথ নয়। মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিল। টয়লেটের আলো জ্বলছে, জলও পড়ছে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। নিজের ল্যাপটপে কম্পোজ করেছিল প্রায় তিন পাতার কনফেশন। প্রিন্ট আউটও বের করে রেখেছিল। দ্রুত হাতে ছিঁড়ে পাতাগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলল। সামনে চাঁদের আলোয় ভরা গঙ্গা। দ্রুত হাওয়ায় বড়ো মায়াবী এ চরাচর। টুকরোগুলো হাত থেকে ছোড়ার আগের মুহূর্তেই, স্থির হতে হয়।

পাশের ঘরের জানালা দিয়ে উড়ে আসে প্রায় একই রকম কাগজের টুকরো। অসংখ্য। চমকে ঘাড় ঘোরাতেই পাশের জানালা থেকে সরে যায় ঐশিকির মুখ। হাতের ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোকে এবার ছেড়ে দেয় অর্পণ। দুটো স্বীকারোক্তি প্রায় একইরকম হয়ে মিলেমিশে প্রবল হাওয়ায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, মিশে যায়। যেমন করে বসন্তের হাওয়া আর চাঁদের আলো মিশে যাচ্ছিল…

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...