কী যেন নাম বললে তোমার বাবার? ইন্দ্রনাথ মুখার্জী? স্মিত হেসে মাথা নাড়াল পত্রালি।

আজ্ঞে হ্যাঁ। বাবা মুখোপাধ্যায় লিখতেন।

ভদ্রলোক দ্রুত হাতে স্টেপল করা কাগজগুলো উলটে যাচ্ছেন। প্রায় না দেখেই খসখস খসখস করে সই করছেন প্রত্যেকটায়। দুটো ভুরুর মধ্যিখানে গভীর ভাঁজ। মনক্ষুণ্ণ হচ্ছিল পত্রালির। তার মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কশিট, অত অত নম্বর একবারও চোখ পেতে দেখছেন না এই জ্ঞানী ব্যক্তি! জীবনের প্রথম দুটো বড়ো পরীক্ষায় এলাকা এবং স্কুলের নাম খবরের কাগজে তুলেছিল পত্রালি। একটি স্থানীয় চ্যানেল তাকে নিয়ে খবরও করেছিল। লাজুক মুখে বাইট দিয়েছিলেন পত্রালির মা। লুঙ্গির ওপর সাদা ফতুয়া জড়িয়ে হাসি মুখে তার বাবা বলেছিলেন, আমার মেয়ে সত্যিই আমার গর্ব! আমি নিজে শিক্ষক কিন্তু ওকে আর কতটুকু সময় পড়িয়েছি আমি?

যাক, এখন অবশ্য সবই অতীত। এইসব রেজাল্ট দেখে যদি কেউ সত্যি সত্যিই একটা চাকরি দিত পত্রালিকে! প্রতিবার চাকরির পরীক্ষায় বসার আগে এই এক ফর্মালিটি! গেজেটেড অফিসারের সই চাই। আগে দুতিনবার সুকুমারকাকুই করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো তিনি না ফেরার দেশে। অগত্যা স্টেশন রোডের এই আদিত্য সাহার অ্যাপযে্টমেন্ট নিতে হয়েছে পত্রালিকে। পত্রালি এনাকে চিনত না। ভাগ্যিস তৃপ্তি যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল!

সই শেষ করে আদিত্যবাবু কাগজের বান্ডিলটা টেবিলের উলটো প্রান্তে ঠেলে দিলেন। নাও, তোমার কাজ শেষ। এইবার আমি অফিসের জন্য তৈরি হই।

হাতজোড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পত্রালি বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। সকাল সকাল আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। মাফ করবেন।

আদিত্য সাহার বাড়িটার সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। রঙ্গন, জবা, নয়নতারা আরও কিছু নাম না-জানা ফুলের গাছ রয়েছে। মূল দরজা থেকে বেরিয়ে বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে গেটের সামনে উপস্থিত হয়ে একটা ফুটফুটে ছোট্ট ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেল পত্রালি।

আহা রে! দেখি দেখি, তোমার লাগেনি তো বাবু?

ছেলেটা খিলখিল করে হেসে ঘরের দিকে দৌড় দিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে আদিত্যবাবুর ডাক শুনতে পেল পত্রালি। এই যে শুনছ, একটু দাঁড়াও তো।

বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক। চোখদুটো ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মানে প্রভাতসখা হাইস্কুলের শিক্ষক, সাড়ে তিন বছর আগে যাঁর নামে মিটু অভিযোগ উঠেছিল?

মুহূর্তেই পত্রালির মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। মনে হল তার পায়ে নীচের মাটি দুলছে। চোখের সামনে দৃশ্যমান পৃথিবী এখন আবছা। দুটো কান তরল লাভার মতো তেতে উঠেছে। যে-কোনও সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। পেটের ভেতর কী যেন পাক খাচ্ছে সরীসৃপের মতো। জ্ঞান হারাতে হারাতেও মায়ে মুখটা মনে করে, আদিত্যবাবুর বাড়ির কারুকাজ করা লোহার গেটটা ধরে নিজেকে সামলে নিল পত্রালি। শান্ত আর নির্লিপ্ত সুরে বলল, হ্যাঁ, একটা সাজানো অভিযোগ।

বিশ্বাস করো কাকিমা, আমি এক বর্ণ মিথ্যে বলছি না। তুমি যখন মামকে নিয়ে পরীক্ষা দেওয়াতে যেতে, স্যার আমাকে…! একদিন নয়, দুদিন নয়, চার-পাঁচবার এই ভাবে অত্যাচারিত হয়েছি আমি। তাও স্যারের সম্মানার্থে আমি মুখ খুলিনি।

ইন্দ্রনাথবাবু কোনও কথার প্রতিবাদ করেননি। একবারও কনফ্রন্ট করার চেষ্টা করেননি। পাথরের মতো শীতল আর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খোলা জানলার সামনে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। পত্রালির মা তখন ঘেমে নেয়ে কেঁদেকেটে একশা। মহিলা সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে হাই-প্রেশারের রোগী। থাইরয়ে, কোলেস্টেরলে আধমরা। তিনি হাঁপাচ্ছিলেন। অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যেই ছোটাছুটি করছিলেন। বেসিনের সামনে গিয়ে ওয়াক তুলছিলেন। রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের ড্রাম টেনে আনতে যাচ্ছিলেন। চেঁচামেচি আর উত্তপ্ত আবহ দেখে পত্রালিদের পাশের বাড়ির লোকেরা উঁকি মারছিল। মিঠু কিন্তু এসব দেখেও দেখেনি। সে ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছিল এক সুরে। পত্রালিদের দীর্ঘ দিনের পরিচিত বিকাশকাকুর মেয়ে মিঠু। মা নেই। বাবা মদ্যপ। মুদি দোকান চালাতে গিয়ে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে প্রতি মাসে ক্লাবের ছেলেদের হাতে মারধোর খায়।

হাই স্কুল পেরিয়ে মিঠু, ইন্দ্রনাথ মুখার্জীর পায়ে এসে পড়েছিল। আমাকে আপনি পড়াবেন স্যার? বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে আমার। কিন্তু আমি পড়তে চাই।

পত্রালি অবাক হয়ে মিঠুর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এই কি সেই মেয়ে যে, দিনের পর দিন ওদের বাড়িতে এসে না খেয়ে থাকার অজুহাত দিয়ে গোগ্রাসে লুচি, তরকারি, পরোটা, আলু কষা গিলেছে। ইন্দ্রনাথ মুখার্জীর টাকায় কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর‌্যন্ত পৌঁছেছে? বাজারে বেরোলেই যার জন্য একটা চুড়িদার, একটা শাড়ি শখ করে কিনে এনে পত্রালির মা এতদিন ধরে বলে এসেছেন, থাক না। মা নেই। বাবাটা অসভ্য। ও তো আমাদের মেয়ে মতোই!

এসব যখন হচ্ছে, পত্রালি তখন কলেজের শেষ বর্ষে। তার কাছে সবটা জলের মতো পরিষ্কার। তাই মুখ লুকোনোর জায়গাটুকুও পায়নি সে। অবোধ সেজে না বোঝার ভান করতেও পারেনি। তার চেয়ে মাত্র বছর দুয়েের বড়ো একটা মেয়ে বাড়ি বয়ে এসে তার বাবাকে ধর্ষণের অভিযোগে জর্জরিত করে দিচ্ছে! তাদের সাজানো-গোছানো সংসারটা চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর পত্রালির কানে তখন ভাসছে পাড়া-বেপাড়া, দুবেলা যাতায়াতের পথে ট্রেনের চার-পাঁচ নম্বর বগিতে কলেজের ছাত্রদের মুখে শোনা, মিঠুর দুষ্কর্মের কাহিনি। নোংরা মেয়েছেলে শব্দবন্ধ না জুড়ে সাধারণত ওই মেযোর নাম নেয় না কেউই।

মিঠুর শরীরের ভাষা লক্ষ লক্ষ কথা বুঝিয়ে দিচ্ছিল পত্রালিকে। মিথ্যে বলতে গিয়ে অতি দক্ষ মানুষও কিন্তু ভাবার জন্য, বানানোর জন্য একবার থমকায়। পত্রালি একবারও বাবার সামনে প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়ায়নি। তার মনের কোণে কোথাও সেই ইচ্ছেটাই আসেনি। কারণ সে জানত, ওই জঘন্য কাজ ইন্দ্রনাথবাবু কিছুতেই করেননি। তার বাবা কোনও দিন কোনও ছাত্রছাত্রীকে তার থেকে আলাদা চোখে দেখেননি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই পত্রালি দেখেছে, ইন্দ্রনাথবাবু সন্তানজ্ঞানে ছাত্রছাত্রীদের আগলাচ্ছেন। ইন্দ্রনাথ মুখার্জী একজন আদর্শ শিক্ষক। আজও পত্রালি সে কথা মানে।

রিটায়ারমেন্টের তিনদিন আগের ওই প্রবল ধাক্কাটা ইন্দ্রনাথবাবু সামলাতে পারেননি। অসৎ হয়তো চাপে পড়ে আত্মহত্যা করে, কিন্তু সৎ তো মহাকালের কাছ থেকে করুণার বদলে মৃতু্য চেয়ে নিতে পারে। মিঠু চলে যেতে তিনি পড়ার ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিয়েছিলেন। পত্রালির মায়ে তখন পাগলপারা অবস্থা। বুকের বাম পাশে ব্যথা শুরু হয়েছে। বাড়িতে ডাক্তার এসেছিলেন। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন পত্রালির মাকে। মহিলার মানসিক দিকটা সেই থেকেই ক্ষতবিক্ষত। পত্রালির মা এখন একটা কচি শিশুর মতো হয়ে গিয়েছেন। খাইয়ে না দিলে খাবেন না। চান করবেন না। সারাদিন গুম মেরে বসে থাকবেন। মাঝে মাঝে কাঁদবেন। পত্রালি যখন আদর করে দুহাত বাড়িয়ে ডাকবে, তখন এমন করে স্থূল শরীর নিয়ে থপথপিয়ে ছুটে আসবেন, যেন প্রাইমারি স্কুলের কোনও ছোট্ট বাচ্চা!

মিঠুর ওই কাণ্ডের পরদিন সকালেও ইন্দ্রনাথবাবু নিজে থেকে বাইরে বেরোননি। বেলা গড়িয়ে দুপুর হব হব। সন্দেহ তখন শীর্ষে। ঘরের দরজায় একের পর ধাক্কা মেরে হুমড়ি খেয়ে মেঝের ওপর আছড়ে পড়েছিল পত্রালি। একদিকে অসুস্থ মা। আর একদিকে চিরদিনের মতো স্থির হয়ে যাওয়া একটা শরীর, ভালোবাসার ভালো লাগার ছোঁওয়া, শখানেক ডাকনাম, হাত ধরে ধরে হাঁটতে শেখানো লম্বাটে আঙুল আর অসীম স্নেহধারার অধিকারী তার বাবা। মামা, মামি, দূর সম্পর্কের দাদারা বুড়ি ছোঁওয়ার মতো ছুঁয়ে গিয়েছিল পত্রালিকে। অবশ্য মামার আবেগ বরাবরই একটু বেশি। তাই হয়তো দাদুর উইল অনুযাযী কিছু চাষ জমির ভাগ পেয়েছেন পত্রালির মা।

ইন্দ্রনাথবাবুর কর্মস্থল খালি করে ছুটে এসেছিলেন সহকর্মীরা। স্কুলের খোলা ময়দানে বাবার মরদেহ আগলে মাথা নীচু করে বসতে হয়েছিল পত্রালিকে। কারণ বেলা বাড়তে মিটু ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল যত্রতত্র, মফস্সলের আনাচে-কানাচে। তবে ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ে ইমেজ নষ্ট হয়নি। মাস ছয়ে যেতে না যেতেই আবার এক মাঝবয়সি লোককে ফাঁসাতে গিয়ে মিঠু নিজেই একটা ঘূর্ণির ভেতর তলিয়ে যায়।

আপনার সঙ্গে কথা বলে আমরা সত্যিই ইমপ্রেসড। আপনার রিটেন পরীক্ষার মার্কসও তো বেশ ভালো।

বেশ প্রশংসা নিয়ে পত্রালির মুখের দিকে তাকালেন ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখ্য প্রশ্নকর্তা। ঝাঁ চকচকে পোশাক পরিহিত চারজন জাঁদরেল অফিসার সামনেই বসে রয়েছেন। পত্রালি নম্র ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাল, অনেক ধন্যবাদ স্যার, থ্যাংক ইউ।

তবে একটা শেষ জিজ্ঞাস্য আছে আমাদের। আপনার বয়স তো খুবই কম। অভিজ্ঞতাও অল্প। প্রশাসনিক পদের চারপাশে লোভ কীভাবে ধূর্ত শ্বাপদের মতো ওঁত পেতে থাকে জানেন তো? যদি কোনও দিন পা পিছলে যায়, ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন, কী করবেন?

একে অন্যের সঙ্গে চোখ চাওয়াচায়ি করছেন অফিসাররা। স্মিত হাসল পত্রালি। তারপর সরাসরি প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ভীক অথচ সৌম্য গলায় জবাব দিল, আদর্শ আর প্রলোভনের মধ্যে থেকে আমি আদর্শকেই বেছে নেব স্যার। কারণ আমার আদর্শ হলেন আমার বাবা। কোনও মূল্যে আমি তাঁকে হারতে দিতে পারব না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...