করোনা ভ্যাকসিন সাতশো কোটি মানুষের হাতে পৌঁছোতে সময় লাগবে। এরপর আছে অসাধু ব্যবসায়ীদের নানা কুকীর্তি। ফলে সাধারণ মানুষ নিজেকে সুরক্ষিত করতে এখনও ঢের দেরি।করোনা অনেক রকমের ক্ষয়ক্ষতি করেছে ঠিকই কিন্তু পুরোটাই হয়তো নেতিবাচক নয়। আমাদের এর থেকে অনেক কিছু শিক্ষা হয়েছে৷
কিছুদিনের জন্য মানুষের জীবনশৈলীকে অনেক সাধারণ ও পরিমিত ব্যয়ের স্তরে নামিয়ে এনেছিল মহামারি। সোশালাইজিং কমেছিল। ফলে বাজে টাকা খরচের প্রবণতাও কমেছিল। বহু গরিব ও অস্বচ্ছল পরিবার, যারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিল কন্যা-বিবাহের ব্যয়ভার বহন করবেন কী করে ভেবে, করোনা তাদের কাছে প্রায় আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছিল।
একটু খেয়াল করলেই দেখবেন এই পরিস্থিতিতে খরচ কমানোর লক্ষ্যে বহু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, মেয়ের বিয়ের আয়োজন করছিলেন। কম সংখ্যক আত্মীয় পরিজনকে ডাকায়, খরচ হ্রাস হয়েছিল। সামাজিকতার দায় সেরেছিলেন কম অর্থব্যয়ে৷
আসলে সামাজিক রীতিনীতির চাপে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম যে বিবাহের অনুষ্ঠান আসলে দুটি মনের মিলন। নতুন জীবনে প্রবেশ করতে চলা ওই নব-দম্পতিকে আশীর্বাদ করাই এই সামাজিক অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। সামাজিকতার দায় এমনভাবে ফাঁসের মতো চেপে বসেছিল, তাতে বৈভব প্রদর্শনটাই যেন মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। গোটা পরিবারে কেউ যেন বাদ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা, তদের খাওয়া, থাকার ব্যবস্থা করা, বিয়ে আসরের জাঁকজমক, উপহার সামগ্রী, পানভোজন সবই বিপুল ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছিল। আচার অনুষ্ঠান যে-ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তাতে প্রায় সপ্তাহভর চলত এই অনুষ্ঠান। ধার-দেনা করে হলেও এই দায় বহন করতে বাধ্য হতো বর-কনে উভয়ে পরিবার।
আত্মীয় পরিজনরা তৃপ্ত হলেন কিনা, ভুলত্রুটি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠল কিনা এ সবই যেন মূল চিন্তার বিষয় হয়ে উঠছিল। অথচ চারচক্ষুর মিলনের এই আচার হওয়া উচিত একান্তই ব্যক্তিগত। যারা একসঙ্গে ঘর করবেন সেই দুটি পরিবারের পারস্পরিক আলাপ পরিচয়ে যা সীমাবদ্ধ রাখলে চলত তা-ই হয়ে উঠছিল এক বিরাট সামাজিক মিলন অনুষ্ঠান।
শুধু জমানো পুঁজি শেষ করে কন্যার পিতাকে আজীবন ঋণের বোঝা টানতে হতো। বিপুল ব্যয় করলেই যে বর-বধূ সুখী হবেন এর গ্যারান্টি যখন নেই, তখন এই ব্যয়ে যৌক্তিকতা কোথায়? করোনা যদি এই শিক্ষা আমাদের সমাজে পাকাপাকি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে আখেরে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। ওই টাকা যদি বাচ্চাদের পড়াশোনায় ব্যয় করার সুযোগ পান নবদম্পতি, তাহলে ভাবি সমাজ উপকৃতই হবে। নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। যে-কোনও বদল কিন্তু আনতে পারি আমরাই।
করোনার দ্বিতীয় দফার আক্রমণের পরিস্থিতিতেও এমন সংযমের জীবনশৈলী চালিয়ে যেতে পারলে আখেরে লাভ আমাদেরই। স্ট্রেস দূর করার জন্য আপনজনদের বেশি করে পাশে পাবে মানুষ। দেখনদারির সামাজিকতা থেকে বিরত থাকলে, সঞ্চয়ও বাড়বে। বাহুল্যবর্জিত জীবনযাপন, বিলাসব্যসন ত্যাগ করলে আমাদের বাকি জীবনটা অল্পতে সন্তুষ্ট হয়ে দিব্যি কেটে যাবে। মহামারি মৃত্যুমিছিল এনেছে ঠিকই, আর্থিক পরিস্থিতি বেহাল করেছে ঠিকই, কিন্তু এর উলটো পিঠেই রয়েছে আত্মসমীক্ষণের একটা বড়ো সুযোগ।