শেষ রাতের আবছা অন্ধকার। লোকটা এক বুক ঘৃণা আর আদিম এক প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে বন্দুকটা ভালো করে আঁকড়ে ধরে। আজ সে দৃঢ়সংকল্প। খতম করবে ওই নোংরা লোভী আর তস্কর জীবটাকে! তার হাত থেকে নিস্তার নেই বাছাধনের।
দিন দিন ওর সাহস বেড়ে যাচ্ছে। পোলট্রির অর্ধেক মুরগির বাচ্চা খেয়ে সাবাড় করেছে এই ক’দিনে। এভাবে চললে পোলট্রির সব মুরগি অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। আর তার এতদিনের লাভবান ব্যাবসা বন্ধ হয়ে, সে দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে যাবে। তাই আজ একটা শেষ নিষ্পত্তি সে করবেই!
ভোর হবার এখনও অনেক দেরি। অপেক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে লোকটার স্নায়ুগুলো কিঞ্চিৎ শ্লথ। আর কিছুক্ষণ পরেই পুবদিকের আকাশ হালকা হবে। আর হালকা হলেই সে বেরুবে রোজকার মতো।
মুরগির বাচ্চাগুলো কারা যে খেয়ে যাচ্ছে তা প্রথমে বুঝতে পারেনি লোকটা। বহু ঘুমহীন রাত অপেক্ষা করে ওত পেতে শেষে সে বুঝতে পারে শিয়াল না, খটাশ না একটা কালো হুতুম পেঁচাই ঘাতক। তার সমস্ত মুরগির বাচ্চা খেয়ে যাচ্ছে।
আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পর লোকটা জেনেছে পোলট্রির পেছনে কিছুটা দূরে যে বুড়ো খিরিশ গাছটা আছে তার একটা উঁচু মোটা ডালের কোটরে সে থাকে। ওরা দুজন। একটা ছেলে অন্যটা মেয়ে পেঁচা।
এতক্ষণে পুবদিকের আকাশ ফিকে হতে শুরু করেছে। একটা লালের আভা। এবার পেঁচাটার বেরুবার সময়। আবছা অস্পষ্টতার বুক চিরে একটা বিশ্রি কর্কশ ডাক ভেসে এল। শয়তান পেঁচাটার ডাক। লোকটা সতর্ক হয়। হাতের মুঠোর বন্দুকটা শক্ত হাতে চেপে ধরে। এবার সে ওই ধূর্ত লোভী শঠ পেঁচাটাকে নির্দয়ভাবে মারবে। তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে, তার সীমাহীন অপরাধ আর কৃতকর্মের জন্য।
পেঁচাটা তার কোটর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সন্তর্পণে পাখনাটা মেলে সে উড়ে আসছে, পোলট্রি ঘরের চালার মাথায়। যতটা শব্দ কম করা যায় সেইভাবে নিঃশব্দে উড়ে আসছে। এই আবছা অন্ধকারে উড়ন্ত টার্গেটকে গুলি করা মুশকিল। তবুও লোকটা আজ বদ্ধপরিকর। ঠিক তার মাথার ওপর দিয়ে কালো ছায়াটা যখন উড়ে যাচ্ছে, তখনই বন্দুকের ট্রিগারটা সে টিপে দিল অনেকটা আন্দাজে। নিশানা ব্যর্থ হয়েছে মনে হয়। কারণ মাটিতে আছড়ে পড়ার কোনও শব্দ বা ডানার ঝাপটানি তার কানে যায়নি।
পুব আকাশ আরও অনেকটা ফর্সা হয়েছে। লোকটা পায়ে পায়ে পোলট্রি ফার্মের দিকে এগোল। মুরগির বাচ্চাগুলো ঠিক আছে কিনা একবার গুনে এল। চারপাশটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল কিছু পড়ে আছে কিনা। আর ঠিক সেই সময় কাছে কোথাও ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে এল। প্রাণীটা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। লোকটার মন আনন্দে ভরে গেল। যাক তাহলে নিশানা ব্যর্থ হয়নি। শিকার গুলি খেয়েছে। অব্যক্ত বর্বর এক জিঘাংসায় তার মন ভরে গেল।
কাছে গিয়ে লোকটা দেখল, পেঁচাটা বেশ বড়ো সাইজের। মাটিতে পড়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। বৃথা চেষ্টা করছে ওড়বার। ওর ধূসর রঙের ডানা দুটোর একটাতে গুলি লেগেছে। সে ডানাটা অকেজো হয়ে দেহ থেকে ঝুলছে। সারা ডানাটা মাটি আর রক্তে মাখামাখি। ওর বিশ্রি গোল মুখের হলদেটে চোখদুটোতে যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই। লোকটা দেখল, সে চোখে হিংস্র একটা বিদ্বেষ আর ক্রোধ জমা হয়েছে।
এখন আর আলো আঁধারির অস্পষ্টতা নেই। পরিষ্কার ভোর। আর সেই ফুটে ওঠা ভোরের আলোয় পেঁচার সঙ্গে মানুষের প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হল। দুজনের চোখে বিজাতীয় হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর জিঘাংসা কাজ করছে। কিন্তু লোকটার চোখে অতিরিক্ত কিছু একটা ছিল। তা হল শত্রু নির্যাতনের উৎকট আনন্দ আর পরিতৃপ্তি!
আহত প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে অপরিসীম ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লোকটা বলে উঠল, ‘কিরে কেমন জব্দ! কেমন লাগল গুলি খেতে? আর একটা গুলি খাবি?’
পেঁচাটা তার ভালো ডানাটা ঝাপটে মাটি থেকে একটু ওঠার চেষ্টা করল। কিছুটা উঠেই আবার পড়ে গেল মাটিতে। পেঁচাটার এই ব্যর্থতা ও হতাশা দেখে লোকটা জোরে শব্দ করে হেসে ওঠে বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে।
এবার গলা বাড়িয়ে রাগে পেঁচাটা তেড়ে আসে লোকটার দিকে। তার পায়ের জুতোয় ঠোঁট দিয়ে জোরে ঠোক্বর মারে। লোকটা লাথি মেরে পেঁচাটাকে দূরে ফেলে দেয়। অসহায় ভাবে মড়ার মতো কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে পেঁচাটা।
লোকটা একবার বন্দুক দেখায়। পেঁচাটার চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। বন্দুকের নলটা তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে খোঁচা দেয়। পেঁচাটার হলদে চোখদুটোতে শুধু জ্বালা। অসহায় আক্রোশ! কিন্তু ভয় কোথাও নেই।
প্রচণ্ড রেগে গেল এবার লোকটা। তার অহংকারে ঘা লাগল। সে মনে মনে স্থির করে ফেলল, এটাকে সে এখনই মারবে না। একে বাঁচিয়ে রেখে তিলে তিলে যন্ত্রণা দেবে। যেমন কষ্ট সে পেয়েছে এত দিন। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনা নিয়ে। তেমনি করে একে দগ্ধে দগ্ধে যন্ত্রণা দিয়ে এর পাপের শাস্তি দেবে। এর ঔদ্ধত্য আর দম্ভকে চিরতরে ভেঙে দেবে!
জখম ডানাটা এড়িয়ে অন্য ডানাটা ধরে সে পেঁচাটাকে তুলতে গেল। আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড আক্রোশে পাখিটা তার তীক্ষ্ণ নখ লোকটার হাতে বসিয়ে দিল। চামড়া ভেদ করে সুচলো নখ মাংসের অনেক গভীরে ঢুকে গেল। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। যতই সে চেষ্টা করে পেঁচাটাকে ফেলে দিতে, বিচ্ছিন্ন করতে তার শরীর থেকে, ততই তাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে। আঁচড়াতে কামড়াতে থাকে। লোকটার হাত থেকে রক্ত ঝরে। পেঁচাটার পালকে রক্ত। লোকটা এবার চেঁচাতে থাকে। শাপশাপান্ত করে। তার একবার মনে হয় গিয়ে দেয়ালের গায়ে জোরে আছাড় মারে জীবটাকে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। একে সে সহজে মারবে না। বাঁচিয়ে রেখে যন্ত্রণা দেবে। তারপর পরিশেষে চরম শাস্তিদান।
এবার সে দুটো হাত দিয়ে পেঁচাটাকে চেপে ধরে শক্ত করে। তারপর তার মুখে একদলা থুতু ছেটাল। পাখিটা বার দুই চোখ পিট পিট করল। কিন্তু ভয় পেল না একটুকুও। লোকটা রাগে কাঁপতে কাঁপতে তার ফার্ম হাউসের বারান্দায় এক কোণে ঝোলানো একটা বড়ো লোহার খাঁচায় পেঁচাটাকে ঢুকিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিল।
পেঁচাটাকে খাঁচাবন্দি করার পর লোকটা কিছুটা শান্ত হল। বন্দুকটা যথাস্থানে রেখে এল। তারপর জল দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফার্স্ট-এড বক্স বের করে আনল। প্রথমে সে রক্তাক্ত পাখিটার ডানা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিল। তারপর নিজের হাতেও অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগাল। ব্যান্ডেজ বাঁধল।
সেদিন বিকেলে কাছের শহর থেকে কয়েকজন খদ্দের মুরগি কিনতে এল তার পোলট্রি ফার্মে। খাঁচার মধ্যে পেল্লাই ওই পেঁচাটাকে দেখে তো তারা তাজ্জব। জিজ্ঞেস করল, ‘এটাকে ধরলে কী ভাবে?’
লোকটা তার খদ্দেরদের কাছে পেঁচাটার যাবতীয় কীর্তিকলাপ খোলসা করে বলল। ব্যান্ডেজবাঁধা হাতটাও দেখাল। সব শুনে খদ্দেরদের মধ্যে একজন বলল, ‘এখন এটাকে নিয়ে কী করতে চাও?’
জবাবে লোকটা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘আমার হাতটা আগে ভালো হয়ে যাক। তারপর এটাকে গুলি করে মারব। পায়ের নখগুলো কেটে চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখব স্মৃতি হিসেবে।’
পোলট্রি মালিকের মুখে এধরনের কথা শুনে খরিদ্দার লোকটির মনে দৃঢ় ধারণা হল, মুরগির বাচ্চার শোকে ভদ্রলোকের মাথার ঠিক নেই। সে আর কথা না-বাড়িয়ে চলে গেল।
টুকিটাকি কিছু কাজ শেষ করে লোকটি আবার পেঁচাটার খাঁচার কাছে এল। খাঁচাটার দিকে তাকাতে তার গা রিরি করে উঠল রাগে। দেখল, পেঁচাটা তার দিকে স্থির ভাবে চেয়ে আছে। পায়ের নখ দিয়ে খাঁচার গা আঁকড়ে ধরে আছে। লোকটা রেগে গিয়ে খাঁচাটা নামিয়ে নীচে বসাল। তারপর জোরে লাথি কষাল। পেঁচাটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। তার চোখে অতলান্ত ঘৃণা।
সেদিন সারারাত লোকটা শুনতে পেল পেঁচাটা তার সাথিটাকে ডাকছে। ওপাশে গাছের আড়াল থেকে সাড়াও আসছে। লোকটার মনে খুব আনন্দ হল পেঁচাটাকে জ্যান্ত ধরতে পেরেছে বলে।
পরদিন সকালে উঠে লোকটা খাঁচার কাছে গেল। আজও সে পেঁচাটার চোখে কোনও ভয় দেখল না। আর সে জন্য সে হতাশ হল। হতাশা তাকে এক সময় ক্ষিপ্ত করে তুলল। সে চিৎকার জুড়ে দিল। ‘দাঁড়া, দাঁড়া। সবুর কর। আমি তোকে ভয় পাইয়েই ছাড়ব।’
লোকটা খাঁচাটা মাটিতে নামাল। খাঁচার বাইরে জল রাখল। খাবার হিসেবে একটা ছোট্ট মুরগির বাচ্চা। খাঁচার খুব কাছে কিন্তু পাখিটার নাগালের বাইরে। পেঁচাটা নির্বিকার চোখে সব দেখল। ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় সে কাতর। তবু লোকটার চালাকি সে ধরে ফেলেছে। ভয় বা কাতরতা তাকে গ্রাস করল না। সে একটা বড়ো তাচ্ছিল্য খাঁচার বাইরের লোকটার দিকে ছুড়ে দিল।
এরপর আবার একদিন মুরগি কিনতে এক খদ্দের এল। ইনি বেশ সম্ভ্রান্ত। মনে হয় অপেক্ষাকৃত বড়ো ব্যবসায়ী। লোকমুখে পেঁচাটার কথা শুনে তিনি লোকটার কাছে প্রস্তাব দিলেন, ‘আপনি পেঁচাটা আমাকে পাঁচশো টাকায় বেচে দিন। এতবড়ো সাইজের পেঁচা সাধারণত পাওয়া যায় না। রেয়ার। তাছাড়া আমার এজাতীয় রেয়ার পাখিদের একটা কালেকশন আছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবব, যদি ওটা আমাকে বেচেন।’
লোকটা ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘না মশাই। মাফ করবেন। আমি ওকে হাতছাড়া করতে চাই না।’
ক্রেতা ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, বোধহয় দাম পছন্দ হয়নি। তাই সে রাজি হচ্ছে না বেচতে।
‘আচ্ছা বেশ, আমি আপনাকে সাতশো টাকা দেব। তাহলে দেবেন তো?’
এতেও লোকটা রাজি হল না। ‘না, মাফ করবেন। আমি ওকে বেচব না।’
‘কিন্তু কেন? আমি যদি হাজার দিই?’
‘তাহলেও না। হাজার কেন, পাঁচ হাজার দিলেও না। ওটার জন্য আমার হাতের অবস্থা দেখেছেন? টিটেনাস ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। আমার ফার্মের অর্ধেক মুরগির বাচ্চা ও খেয়ে ফেলেছে।’
‘বেশ তো, বুঝেছি। ও আপনার অনেক ক্ষতি করেছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ও তো অবুঝ পাখি একটা। ও খিদের জ্বালায় আপনার ফার্মে ঢুকে মুরগির বাচ্চা খেয়েছে। অন্যায় তো কিছু করেনি। খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। তাছাড়া অমন সুন্দর দেখতে’ –
লোকটার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। – ওই শয়তান পাখিটাকে আপনি বলছেন সুন্দর দেখতে! কি বিশ্রি চোখ ওর। ওকে আমি গুলি করে মারব।
‘তা হোক। রাগের মাথায় বোধবুদ্ধি হারিয়েছেন। একটা পাখিকে কেন অযথা গুলি করে মারবেন?’
‘মারব, মারব, নিশ্চয়ই মারব। ও আমার বড়ো শত্রু। নিজের হাতে ওকে শাস্তি দেব। আপনি এখন যান’-
বেচারা ভদ্রলোক বেগতিক দেখে কেটে পড়ে।
লোকটা এবার দিন গোনে। কবে ওকে খতম করবে। খতম করার আগে ওর মনোবল ভাঙতে হবে। ও আজকাল কিছুই খায় না। খাবারের দিকে তাকায় না। অথচ একদৃষ্টে লোকটার দিকে চেয়ে থাকে। যখন সে খাঁচার কাছে আসে পেঁচাটা একটা বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টি ছোড়ে।
লোকটার মাথায় এক নতুন মতলব আসে। সেও আরও হিংস্র আরও ভয়ংকর প্রতিশোধ নিতে চায়। পুরুষ পেঁচার মেয়ে সঙ্গীটি আজকাল প্রায়শই খাঁচার আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। কখনও দূরে পাঁচিলটার উপর এসে বসে। খুব সকালে কিংবা সন্ধের দিকে প্রায়ই ডাকে। কিন্তু পুরুষটি তেমন ভাবে সাড়া দেয় না। ভাবটা যেন একদম এদিকে আসিস না। লোকটা ভয়ানক বজ্জাত! হাড় শয়তান!
আজকাল লোকটা সব সময় নিজের হাতের কাছে বন্দুকটা রাখে। সাবধানে থাকে। ওত পাতে। সুযোগ এলে যেন ফসকে না যায়। প্রথমে সে মাদি পেঁচাটাকে শেষ করে পুরুষটির সামনে ফেলবে। দেখতে চায় ওর যন্ত্রণা হয় কি না! কষ্ট হয় কি না! তারপর তো ওর পালা!
সুযোগও এসে গেল অচিরেই। তিন-চার দিন পর। মেয়ে পেঁচাটা ক্ষুধা উদ্বেগ বা কৌতূহলে পুরুষ সঙ্গীটিকে খুঁজতে খুজতে খাঁচার কাছাকাছি চলে এসেছিল। তাকে দেখে পুরুষ সঙ্গীটি ঝটপট করছিল। তাকে কেমন উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মেয়ে সঙ্গীটির নিরাপত্তার কথাই কি সে ভাবছিল! লোকটাকে বিশ্বাস নেই। মেয়ে পেঁচাটা বার দুই ডেকে পাঁচিলের ওপর গিয়ে বসল। লোকটার কানে গেল সেই ডাক। ভোর হয় হয়। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে বিছানায়। মুহূর্তে বন্দুকটা হাতে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। ‘দাঁড়া, দিচ্ছি তোকে সাবড়ে!’ লোকটার ঠোঁটে ব্যঙ্গ। খাঁচায় বন্দি পেঁচাটা বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছে। সে এবার ডাক বন্ধ করে দেয়। প্রত্যুত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। যাতে মেয়ে পেঁচাটা সাড়া না পেয়ে ওখান থেকে চলে যায়।
কিন্তু লোকটা আর বিলম্ব চায় না। পাঁচিলের ওপর বসা মেয়ে পেঁচাটা তার নজরে এসেছে। অন্যদিন উড়ে যায়। আজ কিন্তু সে উড়ছে না। বৃথা কালক্ষেপ না করে লোকটা তাক করে মেয়ে পেঁচাটার দিকে। তার দোনলা বন্দুকের দুটো নলই সে ব্যবহার করে। একটা শব্দ, কিছু ধোঁয়া। মুহূর্তে মেয়ে পেঁচাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এবার আর আধমরা নয়। অব্যর্থ অমোঘ মৃত্যু।
লোকটার হাতে বারুদের গন্ধ। চোখে অদ্ভুত খুশি নিয়ে সে মেয়ে পেঁচাটার মৃতদেহ এনে পুরুষ পেঁচাটার খাঁচার সামনে ফেলে।
‘কিরে? দেখলি? দ্যাখ্ কেমন লাগে?’ লোকটার চোখ-দুটো দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে প্রতিশোধের আগুন।
খাঁচার বন্দি পাখিটা তার মৃত সঙ্গিনীটির দিকে একবার তাকায়। তারপর লোকটাকে দেখে। ওর হলদে চোখদুটোতে কোনও পরিবর্তন নেই। সেই সীমাহীন ঘৃণা আর অঢেল বিতৃষ্ণা! ওর ওই বুনো চোখদুটোতে লোকটা ভয় আনতে চেয়েছিল। ওর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে সর্বহারার হাহাকার বাজুক সেটাই চেয়েছিল লোকটা। কিন্তু না। তা হয়নি। কিন্তু লোকটা নিজেকে এবার পরাজিত ভাবল। সে ভেবেছিল খাওয়া বন্ধ করে, অত্যাচার চালিয়ে সঙ্গিনীকে নিধন করলে ওর মনোবল ভেঙে যাবে। ওকে ধবস্ত বিবর্ণ দেখাবে। তা না হওয়ায় লোকটা নিজের মনে পরাজয়ের একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করল। এক সামান্য নিশাচর তস্কর পেঁচার কাছে সে হেরে গেল! লোকটা সদর্পে ঘরের মধ্যে ঢুকে তার দোনলা বন্দুকে আবার দুটো টোটা ভরে নেয়। বাইরে বেরিয়ে এসে সে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘শয়তান এবার তোকে শেষ করব!’
খাঁচার তারের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে বন্দুকের নলটা ঢুকিয়ে দিতে পেঁচাটা সরোষে এসে নলটাকে আক্রমণ করল। কিন্তু লোহার নলের কোনও ক্ষতি সে করতে পারল না। হতাশ হয়ে খাঁচার অন্যপাশে সরে গেল।
লোকটা বন্দুকের নলটা খানিকটা পেছন দিকে সরিয়ে আনল। যাতে পেঁচা থেকে বন্দুকের দূরত্ব যেন কয়েক ফুট থাকে। শেষবারের মতো সে ওই কুৎসিত বদমায়েশ লোভী বেয়াড়া পেঁচাটার চোখে কোনও অন্তিম ভয় আছে কিনা দেখল। না, কিছু নেই। শুধুই ঘৃণা। লোকটার সমস্ত বোধবুদ্ধি দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ক্রোধান্ধ হয়ে সে ট্রিগার টেপার পরিবর্তে সেটাতে একটা জোরে ধাক্বা দিয়ে বসল। গুলি রিবাউন্ড বা রি-কয়েল করা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। জিঘাংসাপ্রিয় রাগান্ধ লোকটির বিবেচনাতে সে কথা আসেনি। আর তাতেই ঘটল বিপদ।
প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি কী ব্যাপার হল। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঝনাৎ করে একটা শব্দ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকটা অনুভব করল কি যেন একটা অকস্মাৎ ভয়ংকর তীক্ষ্ণ ও তীব্র আঘাত করল তার বুকে। সে আঘাতের তীব্রতা এতটাই ছিল যে লোকটা টলে পড়ে গেল। তার হাত থেকে বন্দুকটা ছিটকে পড়ল দূরে। সে বুকে হাত দিয়ে দেখল তার হাত রক্তে ভিজে উঠছে। বুকে প্রচণ্ড আঘাত আর যন্ত্রণা অনুভব করল। নিশ্বাস আটকে আসছে। গলা দিয়ে গরম তরল লাল বর্ণের পদার্থ উঠে আসছে। চোখের সামনের পৃথিবীটা একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে।
অন্তিম অন্ধকার নেমে আসার আগে, সম্পূর্ণ চেতনাহীন হবার আগে লোকটা বুঝতে পারছিল ভয়ংকর দুর্ঘটনাটা কী ঘটেছে। খাঁচার ঠিক পেছনে যে সরু লোহার পাত ছিল, তাতে গুলিটা লেগে ঠিকরে এসে উলটো দিকে দাঁড়ানো তারই বুকে ঢুকেছে। শিকারি নিজেই শিকার হয়ে গেছে!
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! হঠকারিতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে পেঁচাটা শুধু বেঁচে যায়নি, গুলির আঘাতে লোহার খাঁচাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বন্দি পাখি এখন মুক্ত। পেঁচার জখম ডানাটা এই কদিনে অনেকটা ভালো হয়েছে। ভাঙা খাঁচা থেকে গুটি গুটি পায়ে সে বেরিয়ে এল। পিট পিট করে চোখ মেলে মরনোন্মুখ মানুষটার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখন আর তার চোখে কোনও ঘৃণা নেই। বিদ্বেষ নেই। অভিযোগের লেশমাত্র নেই। যা কিছু বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, জিঘাংসা বা মানসিক বিকার সবই ওই লোকটার মধ্যেই ছিল।
একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে।