খেয়াল করলেই দেখবেন, আমরা অসুস্থ হই মূলত আমাদের বদভ্যাসগুলির কারণে। খাওয়াদাওয়ার সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখা, দূষিত জল বা খাবার গ্রহণ করা, ব্যাক্টিরিয়া-যুক্ত খাদ্যদ্রব্য সেবন করা– এসবই প্রকারান্তরে আমাদের অসুস্থতার জন্য দায়ী। গবেষণা বলছে, ব্যাক্টিরিয়া-যুক্ত খাবার গ্রহণ করার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই, শরীরে তার প্রভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে বমি, জ্বর এবং পরবর্তী সময়ে বড়োসড়ো সংক্রমণে আক্রান্ত হই আমরা। বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা সম্ভব হয় না। দ্বারস্থ হতে হয় হাসপাতালের।
আমাদের ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কোভিড ১৯-এর মতো মারণ রোগ, তখন আরও বেশি করে আমরা বুঝতে পেরেছি, ইমিউনিটি বাড়িয়ে তোলার গুরুত্ব। পরিচ্ছন্নতাও হয়ে উঠেছে জীবনের অঙ্গ।
এই পরিস্থিতিতে যখন আপনি বাড়িতে রান্না করছেন, তখনও সতর্কতা অবলম্বন করা বিশেষ ভাবে জরুরি। সাফসুতরো রান্নাঘরও যেমন প্রযোজন, ঠিক ততটাই নজর দেওয়া দরকার কাঁচামালের হাইজিন-এর উপরও। অল্প গাফিলতিই কিন্তু ডেকে আনতে পারে বড়োসড়ো বিপদ।
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের মতে প্রতিবছর দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রতি দশজনের মধ্যে একজন এবং প্রতিবছর পেটের ইনফেকশনজনিত বড়োসড়ো রোগে মৃত্যু হয় ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের। তাই ফুড হাইজিন কী ভাবে বজায় রাখা সম্ভব, সেটা জানা আবশ্যক।
ফল সবজি কীভাবে স্টেরেলাইজ করবেন
ফল এবং সবজি ব্যবহার করার আগে অবশ্যই ভালো ভাবে ধুয়ে নিতে হবে। করোনার কারণে বাজার থেকে আনার পর অন্তত একদিন বাইরে রেখে, তারপর ধুয়ে ফ্রিজে তুলুন। এই সতর্কতা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্যই জরুরি। এছাড়াও ফলে সবজিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের ক্ষতিকারক প্রভাব, ধোওয়ার ফলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পরিষ্কারের পদ্ধতি
- প্রত্যেকটি সবজি কল চালিয়ে জলের নীচে রগড়ে ধুয়ে নিন। এর ফলে সেগুলি জার্মমুক্ত হবে। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, বিশেষ কোনও ডিটারজেন্ট বা লিকুইড সোপ দিয়ে ফল-সবজি ধোওয়ার প্রয়োজন নেই। সেটা করলেই বরং ওই কেমিক্যাল আপনার হরমোনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পরিষ্কার জলে ধুলেই এতে উপস্থিত জার্ম এবং ব্যাক্টিরিয়া থেকে মুক্তি পাবেন। তবে এগুলি ধোওয়ার পর নিজের হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে ভুলবেন না
- আরেকটি উপায় হল, জল হালকা গরম করে, এতে সমপরিমাণে ভিনিগার ও বেকিং পাউডার মিশিয়ে নেওয়া। ২০ মিনিট সবজিগুলি এতে ডুবিয়ে রেখে পরিষ্কার জলে ধুয়ে নিলেই হবে
- সমপরিমাণ হলুদগুঁড়ো, ভিনিগার ও নুন হালকা গরম জলে মিশিয়ে এতেও
- সবজি-ফল ভালো ভাবে ধুয়ে নিতে পারেন, বা ২০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে পারেন। এরপর পরিষ্কার জলে অবশ্যই ধুয়ে নেবেন। স্টোর করার আগে সম্পূর্ণ শুকিয়ে নেবেন
গ্রসারি আইটেমও পরিষ্কার করুন
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের মতে গ্রসারি আইটেমগুলিও বাজার থেকে আনার পর পরিষ্কার করা দরকার। এর ফলে ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানো যাবে। খাদ্যসামগ্রী কেনার জন্য সাধারণত হয় আপনি নিজে দোকানে যান, অথবা অনলাইনে অর্ডার করে প্যাকেটবন্দি জিনিসপত্র আনান। যেভাবেই কিনুন না কেন, ভাইরাসমুক্ত করার প্রক্রিয়াটি বাদ দেবেন না। বাইরে থেকে আসা এইসব সামগ্রী কয়েক ঘন্টার জন্য প্লাস্টিক শিট পেতে ফেলে রাখুন। তারপর অ্যালকোহল স্প্রে করে নিন ওয়াইপস-এ। ওটা দিয়ে ভালো ভাবে মুছে তারপর স্টোর করুন। চেষ্টা করুন প্যাকড সামগ্রী কিনতে যাতে, ডিসইনফেক্ট্যান্ট-এর সাহায্যে সহজে পরিষ্কার করা যায়।
দুধের প্যাকেট পরিষ্কার করুন
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলির অন্যতম হল দুধ। প্যাকেটবন্দি দুধ আগেই ফ্রিজে তুলবেন না। সেফটি ফার্স্ট। তাই সকালটা শুরু করেন যে-উপকরণ দিয়ে, সেটির ব্যাপারে সতর্ক হোন। ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, দুধ-এর হাইজিন বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। যখনই প্যাকেট দুধ নিয়ে আসবেন, ভালো ভাবে প্যাকেট ধুয়ে নিন। প্যাকেটের গায়ে লেগে থাকা জল পুরো শুকিয়ে না যাওয়া অবধি ফেলে রাখুন। তারপর টিশুপেপারে একটু স্যানিটাইজার স্প্রে করে একবার এর গায়ে বুলিয়ে নিন। একটি পরিষ্কার পাত্রে দুধ ঢেলে, ফুটিয়ে তারপর ব্যবহার করুন।
বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করলে
রেস্তোরাঁয় বসে খাবার যাতে না খেতে হয়, তাই এই করোনা আবহে অনেকেই বাড়িতে অনলাইন খাবার অর্ডার করছেন। খাবার ডেলিভারড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক কন্টেনার স্যানিটাইজ করুন এবং নিজেও পরিষ্কার করে হাত ধুয়ে নিন।
খাবার অর্ডার করার সময় চেষ্টা করুন কনট্যাক্টলেস ডেলিভারি এবং অনলাইন পেমেন্ট-এর অপশন নিতে। খাবার আসার পর আপনার বাড়ির বাসনে সেটা ঢেলে, গরম করে, তবে খান। খাবারের প্যাকেট অবশ্যই ডিসপোজ করে দেবেন। কিচেন স্ল্যাব বা ডাইনিং টেবল, যেখানে প্যাকেট রেখেছিলেন, সেই জায়গাটা অবশ্যই ডিসইনফেকট্যান্টের সাহায্যে পরিষ্কার করে নেবেন।
খাবারে যেন পোকামাকড় মুখ না দেয়
রান্নাঘরে খাবার খোলা অবস্থায় রাখবেন না। আরশোলা, টিকটিকি, মাকড়সা থেকে ভয়ংকর বিষক্রিয়া তৈরি হতে পারে খাবারে। খাবারে ফাংগাস পড়া থেকে সাবধান হোন। বাসি খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে আগে নর্মাল তাপমাত্রায় আনুন, তারপর গরম করে খান।
খাবার জলের পরিচ্ছন্নতা
খাবার জল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ফলে বিশুদ্ধ পানীয় জল সেবন করাই কাম্য। নিয়মিত ফিল্টারের ক্যান্ডেল বদলান।
যে-ওয়াটার পিউরিফায়ার ব্যবহার করছেন, সেটি খুব পুরোনো হয়ে গেলে, তার শোধন ক্ষমতা কমে যায়। প্রয়োজনে বদলে নিন।
যে-পাত্রে জল স্টোর করছেন, সেটার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। মনে রাখবেন দূষিত জল থেকেই বমি, ডায়ারিয়া ও পেট সংক্রান্ত নানা সমস্যার সূত্রপাত হয়।
কিচেনের পরিচ্ছন্নতাও জরুরি
ফুড হাইজিনের সঙ্গে সঙ্গে কিচেনের পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিকেও হেলাফেলা করলে চলবে না। প্রতিদিন কাজের পর সাবানজল দিয়ে আভেন টপ, কিচেন স্ল্যাব মুছে নিন। প্রত্যেকদিনের জঞ্জাল প্যাকেটের মুখ বন্ধ অবস্থায় ডিসপোজ করুন। কারণ এতেই ব্যাক্টিরিয়া জন্ম নেয়।
চপিং বোর্ড, ছুরি, গেলাস, প্লেট প্রভৃতি সমস্ত বাসন, ব্যবহারের আগে একবার করে ধুয়ে নিন। কাটলারি গরম জলে ডুবিয়ে রেখে ডিসইনফেকট্যান্ট করুন। সাবান বোলানোর স্ক্রাবার, সাবানের পাত্র, এগুলি পরিচ্ছন্ন রাখা বিশেষ ভাবে জরুরি। কারণ আপনার খাবারের পাত্র ওই স্ক্রাবার দিয়ে পরিষ্কার করা হয়।
কিচেন ক্যাবিনেট, বাসন রাখার তাক, ফ্রিজ সবই নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবধানে পরিষ্কার করুন। মাঝেমধ্যে পেস্ট কন্ট্রোল করান যাতে পোকামাকড়ের উপদ্রব না হয়। প্রতিদিন ফিনাইল বা ফ্লোর ক্লিনার দিয়ে রান্নাঘরের মেঝে মুছে নিন।