স্বর্ণলতা সোনা মামিমার ভালো নাম। ডাকনাম সোনা। উনি আমার মামার প্রথম পক্ষের স্ত্রী। কেউ বলে, স্বর্ণলতা থেকে ছোটো করে সোনা হয়েছে। আবার কেউ বলে, কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙের জন্য এই নাম শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দিয়েছে। মামিমা মানুষ হিসেবে খুব ভালো। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। বছরে অন্তত একবার আমাদের বাড়ি আসতেনই। আর সেই দিনগুলো ছিল, বিশেষ করে আমার কাছে খুব মজার– মহা আনন্দের।

মামিমার বাপের বাড়ি কলকাতার শোভাবাজারে। আমার মায়ের বাড়ি কিন্তু অজপাড়াগাঁ। বাস থেকে নেমে হয় গরুর গাড়ি, নয়তো পালকিতে চেপে যেতে হতো প্রায় পাঁচ মাইল। মাঝে পড়ে নদী। নদীর ওপারে বনের প্রান্ত ঘেঁষা গ্রাম। নাম মধুবন। বন-প্রকৃতির কোলে আদরের দুলালির মতো গ্রামটি। মনকাড়া এখানের প্রাকৃতিক শোভা।

তবে প্রকৃতিপ্রেমিক বা কবি-সাহিত্যিকদের মন কেড়ে নিলেও, কলকাতার মানুষের পক্ষে এই বিভুঁইয়ে এসে মানিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। আমারই মাঝে মাঝে ভালো লাগত না। মায়ের সাথে গেলেও বাড়ি ফেরার জন্য মন কাঁদত। মায়ের তো বাপের বাড়ি, জন্মভূমি। তার ভালো লাগলেও আমার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। থাকতে মন চাইত না।

সোনা মামিমার ক্ষেত্রে ঘটে ছিল তাই। মামিমা কলকাতার মানুষ। শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে ষোলোয় পা দিয়েই এসে পড়েন মামা বাড়ির কুলবধূ রূপে মধুবনে। সে এক ইতিহাস। মায়ের মুখে শোনা ওই চমকপ্রদ ঘটনা।

গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধনীর বাড়ি। ছেলে শিক্ষিত। চাকুরে। এসব দেখেই মামিমার বাবা গণ্ডগ্রাম হওয়া সত্ত্বেও এখানে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমবার যখন বধূবেশে মামিমা এবাড়িতে পা দেন তখন তো হইচই, লোকজনে ভরা শ্বশুরবাড়ি তাঁর মন্দ লাগেনি। কিন্তু অষ্টমঙ্গলার পর বিপরীত ছবি। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাঁর। মন বসে না কোনওকিছুতেই। বাড়ির একমাত্র বউ মামিমা। শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্বামী নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। তার উপর স্বামী সারাদিন থাকে বাইরে। মধুবন থেকে অনেকখানি দূরে তার চাকরিস্থল। ফিরতে ফিরতে হয় সন্ধে।

পাড়াপড়শির বাড়িতে বেড়াতে যাবার চল তেমন ছিল না। সিনেমা দেখতে গেলেও অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হতো। সারা দিন শাশুড়ি আর বউ। এছাড়া জনা কতক মুনিশ-মানদার। আর বাড়ির পুরোনো ঝি মানদা। তবে আমার মা যখন বাপের বাড়ি যেত, সে সব দিনগুলো মামিমার খুব আনন্দে কাটত। কিন্তু তা তো বছরে মাত্র একবার কি দু’বার।

দিনের বেলা যদিও বা হইচই হাসি আনন্দে কেটে যেত, সন্ধের পর থেকে মামিমার একা একা খুব কষ্ট হতো। বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ের বাঁশ-ঝাড় থেকে মাঝে মাঝে শিয়াল ডেকে উঠত। তার সঙ্গে প্যাঁচা আর ঝিঁঝির ডাক। ফলে মামিমার শ্বশুরবাড়িতে মন টিকত না। বাপের বাড়ি গেলে আর আসতে চাইতেন না।

মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে তেমন মন নেই তার একটাই কারণ, মেয়ে ভয় পায়। এমন অজপাড়াগাঁয়ে থাকা তার পক্ষে দুরূহ। মামা আনতে গেলে, এবার থাক না, আর ক’টা দিন যাক তারপরে যাবে বলে মামিমার বাবা মামাকে দু’একবার ঘুরিয়েও দেন। দাদুর রাগ হয়। কড়া ভাষায় বেয়াইকে পত্র দেন।

– যদি আপনার মেয়েকে না পাঠান তাহলে আবার ছেলের বিয়ে দেবার কথা ভাবব।

পত্র পেয়েই মামিমার বাবা তখন নিজে এসে দাদুকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুরোধ করেন– আপনি যদি মাসে একবার অন্তত মেয়েকে দিন দুয়ের জন্যও বাপের বাড়ি যাবার অনুমতি দেন তাহলে আমাদের পাঠাতে কোনও বাধা নেই। আসলে শহরে মানুষ তো, তাই একটু অসুবিধে হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকে ভয় পায়। পরে পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে যাবে।

– ঠিক আছে। আমি বউমার কাছে দিন-রাতের জন্য একজন কাজের মেয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দেব। আপনারা মেয়ে পাঠিয়ে দিন। নচেৎ ছেলের বিয়ে দিতে বাধ্য হব।

কতকটা মনমরা হয়েই মামিমা আসেন শ্বশুরবাড়িতে। দাদু কিন্তু তার কথার খেলাপ করেননি। একজন দাসীর বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তবে সেই মেয়ের সঙ্গে কি গল্পই বা করবে মামিমা? গ্রামের মানুষের গল্প বলতে তো চোর-ডাকাত, নয়তো ভূত-পেত্নি। এতে মামিমার ভয় আরও বেড়ে যেতে থাকে।

সেবার দু’দুটি ঘটনা মামিমার শ্বশুরবাড়িতে থাকার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বলতে দ্বিধা নেই, মামিমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

দিদিমা, মামিমাকে খুব ভালোবাসতেন। তবে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারতেন না। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর মামিমাকে নিয়ে ছাদে উঠে হাঁটতেন। কখনও কখনও মাদুর পেতে বসে গল্প করতেন। পাশের বাড়ির রাঙা দিদিমাও এই আসরে কোনও কোনওদিন যোগ দিত। এতে মামিমারও খুব ভালো লাগত।

এরকম একদিন মামার আসতে দেরি দেখে দিদিমা মামিমাকে নিয়ে ছাদ থেকে মামা আসছেন কিনা দেখছিলেন। কিন্তু নীচের থেকে কারও ডাকে দিদিমা নেমে গেলে মামিমা দূরে বয়ে যাওয়া নদীর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। কারণ ওই পথেই তো মামা বাড়ি ফিরবেন।

নদীর ওই পাড়ে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত। আর এপারে মামাদের বিশাল আম বাগান। মামিমা জীবনে এত বড়ো আম বাগান দেখেননি। যখন আম ঝরানো হতো তখন ঝাঁকা ঝাঁকা আম আসত মামাদের বাড়িতে।

নদীর থেকে হঠাৎ সোনা মামিমার দৃষ্টি পড়ে আম বাগানে। পাশে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়ে নন্দা। শুক্লপক্ষ চলছিল। তাই ছাদ থেকেও বাগানটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সেই আলোতে মামিমা হঠাৎ দেখতে পান, একটি মেয়ে সাদা কাপড়ে সারা গা ঢেকে বাগানের ভিতরের দিকে দৌড়োচ্ছে। ওই দৃশ্য নন্দাকে দেখালে সে ভূত ভূত বলে চিৎকার করে মূর্ছা যায়। মামিমাও চোখ ঢেকে বসে পড়েন। কিন্তু দিদিমা এসে কোনও কিছুই দেখতে পাননি।

ঠিক এর দিন দুই পরে আরও একটি ঘটনা ঘটে মামিমার চোখের সামনে। এক বিরাট ডাকাতি হয় মামাদের পাশের বাড়িতে। দলটি নাকি চল্লিশ জনের। হাতে মশাল নিয়ে রণপা চেপে এসেছিল। প্রায় দু’ঘন্টা ধরে ডাকাতি করে সেই সাথে গৃহস্থকে মারধোর দিয়ে সর্বস্বান্ত করে দলটি চলে যায়।

এসব দেখে মামিমা কান্নাকাটি শুরু করেন। ফলে কয়েক দিনের জন্য মামিমাকে বাপের বাড়িতে রেখে আসতে হয়। তারপর থেকে মামিমা আর মধুবনে আসেননি। বাপের বাড়ির লোকেরাও আর পাঠাতে চায়নি। বিশেষ করে মামিমার বাবা তো মেয়ের নামে বেশ কিছু টাকা ও বসতবাড়ি সংলগ্ন একটি বাড়িও কিনে দিয়েছিলেন। তাই মামা আনতে গেলে উনি বলেন– মেয়ে যখন ওখানে থাকতেই পারবে না তখন আর জোর করে ওখানে পাঠাই কি করে বাবা? এখানেই থাক। নইলে কবে দেখব মেয়েটা ভয়ে মারাই গেছে।

সব জানার পর দাদু প্রায় জেদ নিয়ে সেই মাসেই মামার বিয়ে দেন। এ বিয়েতে নাকি মামার মত ছিল না। কিন্তু বাপের মুখের ওপর কথা বলার সাহস তখনকার ছেলেদের ছিল না। তাই বিয়েটিও হয়ে যায়। এরপর থেকে মামাবাড়ির সাথে যোগাযোগ উঠে যায় সোনা মামিমার। তবে দিদিমা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন নাকি সোনা বউয়ের জন্য কাঁদতেন। সে বউ এখনকার বউয়ের চেয়ে রূপেগুণে সব দিকেই সেরা ছিল তাঁর কাছে। মামাও বোধ হয় মামিমাকে একেবারে ভুলতে পারেননি।

নতুন মামিমার তিন ছেলের পর, একমাত্র মেয়ে পুষ্পদি। বড়ো ছেলে যে-বছর এম.এ. পড়ার জন্য কলকাতার কলেজে ভর্তি হয় সেবছরই মামা মারা যান। এরপর ওই ছেলেই সোনা মামিমার সাথে যোগাযোগ করে মামিমাকে জোর করে মাঝে মধ্যে বাড়িতে নিয়েও আসে। এখন বয়সের জন্যই হোক আর নিঃসন্তান বলেই হোক ছেলেদের কাছে থেকেও যেতেন কিছুদিন করে। সৎ ছেলেমেয়েদের ভালোবাসতেন খুব। ছেলেমেয়েরাও সোনামা বলতে অজ্ঞান। মা তো কাজ-যোগের বাড়ি হলে মামিমাকে আমাদের বাড়ি আনতে পাঠাতেন। উনি নিজেও বছরে একবার অন্তত আসতেন।

আমরা ছোটোরা যখন মামিমাকে দেখলাম তখন তিনি বিগত যৌবনা একজন বিধবা। তবে দুধে আলতা গায়ের রং তখনও মামিমাকে অন্যের থেকে আলাদা করে রেখেছে। পিঠ ভর্তি কালো চুল। মুখে একটা কমনীয় মাধুর্য।

শ্বশুরবাড়ি মামিমার এখন ভালো লাগে। তাছাড়া মধুবনের এখন অনেক উন্নতি হয়েছে।  গ্রামের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা। দিনে তিন চারটি বাস যাতায়াত করে। ঘরে ঘরে বিজলি বাতি। ল্যান্ড ফোনও এসেছে চার-পাঁচটি ঘরে।

মামার বড়ো ছেলের বিয়ে। কিছুদিন আগে একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে ধুমধাম করে, বড়ো ঘরে। সেবারও মামিমা এসেছিলেন। বেশ কয়েকভরি গয়না দিয়ে মেয়েকে আশীর্বাদ করেছিলেন। এবার এসেছেন মামার ছোটো ছেলের সাথে। বিয়েটা বেশ জাঁকজমক করেই হচ্ছে। আত্মীয় কুটুম্ব এসেছে প্রচুর। কেউ বাদ যায়নি। মায়ের বয়স হলেও মাকে নিয়ে আমরা গিয়েছি।

বিয়ের দিন বরযাত্রী সহ দাদা যখন যাত্রা করল রাত তখন প্রায় আটটা। বরযাত্রীরা বাসে আর দাদা ট্যাক্সিতে। পুষ্পদি-সহ আমরা মেয়েরা যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেও, বড়োরা তা বাতিল করে দেয়। কারণ মেয়ের বাড়ি যাওয়ার পথে ভীষণ জয়পুরের জঙ্গল। অতএব রিস্ক নেওয়া উচিত নয়। বিফল মনোরথ হয়ে আমরা রয়ে গেলাম।

খাওয়াদাওয়ার পর রাতে পুষ্পদি সহ আমরা কয়েকজন সোনা মামিমার সাথে বৈঠকখানায় শুয়েছি। বাড়িতে পুরুষ বলতে কয়েকজন বুড়ো। মা-মামিরা সব ওপর ঘরে শুয়েছে। পুরুষের চেয়ে মেয়েরা সংখ্যায় বেশি। সারাদিন খাটাখাটনির জন্য অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা দু’চারজন তখনও জেগে। মামিমার মুখে গল্প শুনছি। আসলে মামিমা খুব জমিয়ে গল্প বলতে পারতেন। রাত বাড়ার সাথে সাথে গল্পও বেশ জমে উঠেছে। গল্প শোনার মাঝেই আমার একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, সেই সময়ই কানে এল ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার।

– বাবা গো, মেরে ফেললে গো। কে আছো বাঁচাও।

জেগে উঠে বিছানায় বসলাম। বুঝতে অসুবিধা হল না যে আমাদের বাড়িতেই ডাকাত পড়েছে। ভয়ে কাঁপতে থাকি। কি হবে এবার? দেখি পুষ্পদি ভয়ে সোনা মামিমার কোলে মাথা গুঁজে বসে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। মেয়েদের সবারই গায়ে কিছু না কিছু গয়নাগাটি রয়েছে। বিশেষ করে পুষ্পদির গায়ে। ওর তো আবার নতুন বিয়ে হয়েছে। মামিমা মুহূর্তের মধ্যে সকলের গয়নাপত্তর খুলিয়ে নিয়ে কাপড়ে জড়িয়ে বৈঠকখানার দরজা একটু ফাঁক করে চারদিকে দেখেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন। পুষ্পদি সাথে সাথে মামিমার নির্দেশমতো দরজা বন্ধ করে দিল। আসলে বৈঠকখানাটা ছিল বাড়ির একেবারে বাইরের দিকে। তাই হয়তো এই দুঃসাহসিক কাজটা করতে পারলেন মামিমা।

আমাদের তারস্বরে চিৎকার চ্যাঁচামেচির ফলে ডাকাত দলটি আর বৈঠকখানার দিকে এল না। তার উপর সারা পাড়া জেগে উঠেছে। ধরা পড়ার ভয়ে দলটি চম্পট দিল। কিন্তু যাবার সময় আশা মতো গয়নাগাটি আর টাকাকড়ি না পেয়ে অনেক আসবাবপত্র ভাঙচুর করে গেল। তবু নগদ টাকা, গয়নাপত্তর খুব কমও তো পায়নি। কেবল সোনা মামিমার সাহসিকতা আর বুদ্ধিমত্তার জন্য আমাদের, বিশেষ করে পুষ্পদির গায়ের বহুমূল্য অলংকারগুলি রক্ষা পেল।

পরের দিন সকালে সব ঘটনা জানাজানি হলে শুধু মামাবাড়িতে নয়, গোটা পাড়ায় আলোড়ন পড়ে গেল। ওই অন্ধকার রাতে পুকুর পাড়ে বাঁশবনের ঝোপে সোনা মামিমা একাকী রাত কাটালেন কী করে? ভাবতে আমারও দেহে শিহরণ জাগে। অথচ ওই বাঁশবনের পুকুরের ভয়ে মামিমা একদিন সংসার ছেড়ে ছিলেন। কেমন যেন রহস্যময়। তাইতো অনেকে প্রশংসা করলেও নিন্দুকেরা কটূক্তি করতে ছাড়ল না।

– এই সাহসের সিকিভাগ যদি দেখাত সেদিন, তাহলে তো আর এ বাড়ি ছাড়তে হতো না। মেয়ে কিনা ভয় পায়। নাকি বাপির বাড়িতে অন্য কিছু ছিল?

নিন্দুকেরা যাই বলুক, সেদিন আর এদিন যে অনেক তফাত, অনেকটা সময়, তা তারা বোঝে না।

তবে মামিমা এই নিন্দা বা প্রশংসার কোনওটিতেই কর্ণপাত করেননি। তিনি যা করেছেন ওই মুহূর্তে তাঁর যা মনে হয়েছে। ভালো মন্দ বিবেচনার সময় কোথায়?

– এ সব কথা তোমরা আর আমায় জিজ্ঞাসা কোরো না। ভগবানই আমাকে বুদ্ধি ও সাহস জুগিয়েছেন। নইলে কি পারতাম। সবই তাঁর ইচ্ছা।

এরপর আর কেউ কোনও কথা বলার সাহস পায়নি।

অষ্টমঙ্গলা শেষ। আমরা বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি। মামিমাও পরের দিন কলকাতায় বাপের বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু দুই মামিমা, পুষ্পদি আর নতুন বউদি সেদিনটা থেকে যাবার জন্য এমন ভাবে অনুরোধ করতে থাকলেন যে, মা সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন। বিশেষ করে আবার কবে একসাথে দেখা হবে কে জানে? আমারও ভালো লাগল এই সিদ্ধান্ত।

সন্ধ্যাবেলা আমরা ছোটদার ঘরে নতুন বউদির গান শুনছি। মা আর দু’মামিমা ছাদে গল্প করছেন। হঠাৎ কাকতালীয় ভাবে সোনা মামিমার চোখে পড়ে পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার সেই একই রকম ঘটনা। শাড়ি পরা একটি মেয়ে আম বাগানের ভিতর দিয়ে একাকী দৌড়োচ্ছে। তবে এর শাড়িটা রঙিন। এটা দেখেই তিনি, মা ও ছোটো মামিমাকে দেখালেন। এবার আর সোনা মামিমা ভয় পেলেন না। বরং বিয়েবাড়ির অন্যান্যদের জানালেন। তখনও বাড়িতে লোক কম ছিল না। ঘটনা শুনে সবাই ছুটল বাগানের দিকে। পাড়ার লোকেরাও ওদের সঙ্গ নিল।

প্রায় আধ ঘন্টা পরে সকলে ফিরল, সঙ্গে নিয়ে একটি রঙিন শাড়ি পরা অল্পবয়সি মেয়েকে। মেয়েটি পাড়ারই সম্ভ্রান্ত বোসবাবুর ছোটো মেয়ে। সে তার প্রেমিকের সাথে ঘর বাঁধার উদ্দেশ্যে এই রাত্রিতে একাকী বেরিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে। ভালোবাসে তাকে সে। অথচ বাবা-মায়ের ইচ্ছে তার বিপরীত। তাই তার এই সিদ্ধান্ত।

এরপর যা হয় তাই। মেয়েটিকে সকলে মিলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবা-মায়ের কাছে রেখে আসে। ঘটনাটা যাই হোক, সোনা মামিমার ভাবনা কিন্তু দানা বাঁধল পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনায়। সেই মেয়েটিও নিশ্চয় ভূত বা পেত্নি ছিল না। হয়তো এরকমই একটি সাধারণ মেয়ে। নিজের ভালোবাসার জনকে পেতে রাতের বেলা বেরিয়েছিল অভিসারে। আর সেটিকে অন্যভাবে ভেবেই তার জীবন আজ রিক্ত, শূন্য। ভাবতে ভাবতেই তার চোখে জল এসে যায়।

এই ঘটনার পর সোনা মামিকে আর শত অনুরোধেও এখানে রাখা যায়নি। অনুতাপে দগ্ধ মামিমার হয়তো মনে হয়েছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত কীভাবে তার জীবনের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। ওই ভুলের জন্যই তার এত ভালো স্বামীর ঘর করা হয়নি। সব কিছু পেয়েও সে আজ নিঃস্ব। এই ভাবনার মাঝেই বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন সোনা মামিমা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...