রাত থেকেই ডা. রায় খুব টেনশনে। ১৫ বছরের মেডিকেল হিস্ট্রি। এতটা টেনশন আগে কখনও হয়নি। কাল হাসপাতালের চার নম্বর বেডের পেশেন্টের কাছ থেকে আসার পরই মেজাজ খিঁচড়ে আছে। রুটিন রাউন্ড ছিল কাল রাতে। চাকরি জীবনের প্রথম প্রথম বেশ একটা ভগবান ভগবান ফিল হলেও, এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে ভরা সংসারে ভগবানের চেয়ে যমরাজকে বেশি শ্রদ্ধা হয়। মাঝে মাঝে নিজেকে ভিন্ন গ্রহের প্রাণী বলেও মনে হয়। ইমোশনলেস ইমোশনাল ক্যারেক্টার।

এখন পেশেন্ট দেখে সেই মজা আর নেই। চেম্বারে গেলে, ফিরে এসে আত্মগ্লানিতে ভুগতে হয়। এমন কিছু পেশেন্ট থাকে, যার জন্য মনে হয় কেন সাতটা বছর কষ্ট করে পড়লাম। এই যেমন কাল বিকেলের চেম্বারের ঘটনা।

পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোক (হাড়ে হাড়ে চিনি মালটাকে) এসে বললেন, ডাক্তারবাবু আমি রাজনীতির লোক। এমন কিছু ওষুধ দিন যাতে করোনার ইনফেকশন না হয়। বুঝতেই পারছেন জনসেবা করতে হচ্ছে। রোজ গাদা গাদা লোককে ত্রাণ দিচ্ছি। একটু সেফ থাকতে চাই।

খারাপ কথা ঢোক গিলে বললাম, দাদা ও-রোগের কোনও মেডিসিন এখনও নেই। একটু সেফ থাকবেন, আর কী। সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টার, আচ্ছা বাতের ওষুধ খাব? ট্রাম্প বলেছিলেন বাতের ওষুধে করোনা মরে? স্বগত উক্তি করি, তা ট্রাম্পকেই দেখাগে যান। আবার ঢোক গিলে বললাম, না দাদা প্রচুর সাইড এফেক্টস। কিছু না হলে খাবেন না। সিক্সথ্ সেন্স বলছিল, লোকটা আরও কিছু বলবে। তাই আগেভাগেই প্রেশার চেক করে, একটা মাল্টি ভিটামিন আর ওমেপ্রাজোল লিখে বললাম, এগুলো খান ১৫ দিন। সমস্যা হলে আবার আসবেন।

ভিজিট দেবে কিনা ভাবছিলাম! কিন্তু উনি যা বললেন তার জন্য একদমই তৈরি ছিলাম না। ভিজিটের বদলে বললেন, ডাক্তারবাবু একটু অন্য কারণে এসেছিলাম। মানে কমিউনিটি কিচেন টাইপের একটা আইডিয়া আছে। যদি কিছু স্পনসর করেন আর কী। আপনার এত মার্কেট। মানে ওটার জন্যই এসেছিলাম, ভাবলাম একবার দেখিয়ে নিই। আপনি সাক্ষাৎ ভগবান।

আবার ঢোঁক গিললাম।লকডাউন-এর জেরে পেশেন্ট প্রায় নেই। যারা অপেক্ষা করছেন তারা সত্যি খুব সিরিয়াস। কথা বাড়ালাম না। নেক্সট বলতে যাব, তখনই ফোন। হাসপাতাল থেকে হারুনদা দাদা একজন পেশেন্ট আছে, মহিলা, সিরিয়াস। সেন্সলেস, শ্বাসকষ্ট সঙ্গে বমি। আসতেই হবে। শিফটে আপনার নাম দেখলাম। বাকিটা শুনলাম না। মেডিকেল লাইনে আসার পর ভয়ডর অনেকটা কমে গেছে। শুধু দুবছরের মেয়ের মুখের দিকে তাকালে একটু বুকটা চিনচিন করে।

লকডাউন-এর পর থেকে হাসপাতালের চেহারাটা কেমন যেন বদলে গেছে। একটা গমগমে হাসপাতাল হঠাৎ করে মর্গ মর্গ হয়ে উঠেছে। আমাকে আসতে দেখেই হারুন আর নিবেদিতা এগিয়ে এল। নিবেদিতা জুনিয়র নার্স, ভালো মেয়ে নিবেদিতাকে বললাম, কী ব্যাপার? নিবেদিতা বলল, স্যার মেয়েটার শরীরটা ঠান্ডা কিন্তু সেন্সলেস। মাঝে মাঝে আঁতকে উঠছে আর সঙ্গে কেউ নেই। আমি স্যালাইন দিয়েছি আর অক্সিজেন মাস্ক হালকা করে পরিয়ে রেখেছি। একাই হাসপাতালে এসেছিল। এসে কিছু বলার আগেই সেন্সলেস। চার নম্বর বেড খালি ছিল, আপাতত ওই বেডেই রেখেছি।

জুনিয়র সিস্টারগুলোর আক্কেল দেখলে মাঝে মাঝে গা রি রি করে। রাগের সুরে বললাম, তুমি কি নতুন নিবেদিতা? এই প্যান্ডেমিক সিচুয়েশনে তুমি প্রোটেকশন ছাড়াই যাকে তাকে বেডে তুললে কেন? আর পেশেন্ট পার্টি নেই। রিস্ক নিলে কেন? পুলিশে খবর দিলে না কেন? নিবেদিতা আর হারুন আমতা আমতা করে বলল, স্যার গ্রামীণ হাসপাতাল। এদিকে এখনও করোনার বাড়াবাড়ি নেই। তাই আর কী। এছাড়া, স্যার পিপিই এখন আবার সাপ্লাই নেই। মেয়েটাকে কি চোখের সামনে মরতে দেব স্যার? আরও একটু জোরে ধ্যাতানি দিতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় চার নম্বর বেডের পাশ থেকে আয়াদিদি ডাক দিল, ডাক্তারবাবু পেশেন্টের জ্ঞান এসেছে।

যা ভাবছিলাম তাই, মালতি কুজুর। মহারাষ্ট্র থেকে দুদিন আগে ফিরেছে। মাথাটা খালি খালি লাগছিল। যতটা পারি সামলে বললাম, বেড আলাদা করার ব্যবস্থা করো। সোয়াব স্যাম্পল কালেক্ট করার জন্য লোক আনতে হবে। সিএমও-কে ফোনে পুরো ডিটেলস দিয়ে খালি মাথায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হল, আমার মেয়েটা বড্ড মাংস ভক্ত। এত রাতে মনে হয় মাংস আর পাব না। অনেকদিন থেকে একটা বার্বি আনতে বলেছে। আজকেই সব মনে পড়ছে কেন কে জানে! মনটা বড্ড কু ডাকছে।

 

রাতে নিজেকে একাই রেখেছিলাম। সোনা মা আমার কেঁদে ফাটিয়ে দিয়েছিল। বাবা কেন রাগ করে আছে এই বায়নায়। কান চেপে দরজা বন্ধ করে এক প্যাকেট ধুম্র শলাকা শেষ করেছি। সকালে মেয়ে ওঠার আগেই পালিয়ে এসেছি। বউকে বললাম একটু সামলে নিতে। ভাড়ায় থাকি। বাড়িওয়ালি খুব সুবিধার না। হাসপাতালে কোভিড পেশেন্ট দেখছি শুনলে আগে ভালোমন্দ শুনিয়ে যাবে। হয়তো বা বাড়ি খালি করার অর্ডারও আসবে। এই লকডাউন-এর মার্কেটে ওদের কোথায় সরাব সেটাও চিন্তার কথা। না… মাথা আর কাজ করছে না।

হাসপাতালে ঢুকেই খোঁজ নিলাম মালতি কুজুরের। জানতাম কাল রাতেই ওকে কোয়ারেন্টাইন-এ নিয়ে গেছে। তাও টেস্টের রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত টেনশন চিরচির করছিল। এর মাঝে একটা অজানা নম্বরের ফোন। সেই নেতামশাই। ফোন করে জিজ্ঞাসা করল, কাল পেশেন্ট ছোঁয়ার পর ওনাকে দেখিয়েছিলাম, না আগে।

উত্তর না দিয়ে কেটে দিলাম। হারুন এসে বলল, স্যার টেনশন নেবেন না। আমি কাল রাতেই হোমিওপ্যাথি মেরে দিয়েছি। সিস্টার দিদিকেও বলেছি। স্যার আপনিও একটু নেবেন।

সিএমও-কে অনেকগুলো ফোন করেও পেলাম না। নিবেদিতা মাঝে ফোন করছিল। মনে হয় বেচারির বিয়েটা আরও পিছোবে। ফেসবুক খুললাম। গ্রামের ফেসবুক বিপ্লবীরা নিজেদের মার্ক সেফ মারা পোস্ট দেওয়া শুরু করেছে দেখছি। আমিই শুধু বুঝি না, এত তাড়াতাড়ি এসব খবর ছড়ায় কী করে! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সৈকতের ফোন। এই জাতীয় মানুষদের আমি একদমই পছন্দ করি না। আঁতেল বুদ্ধিজীবী ডাক্তার। পাশের ব্লকেই পোস্টিং। বুঝতে পারছি হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে এই প্রবাদটা কতটা সত্যি। ফোন রিসিভ করে বললাম, বলো। ও পাশ থেকে ছ্যাবলা আওয়াজ, কাকা বাঁশ খেলে তো? চিন্তা নেই আমি আছি তো না কী? যাচ্ছি কাকা। ১০ মিনিট। অফিসে থেকো।

 

৩০ মিনিট পর সৈকত হাজির। যাকে নিয়ে এল তাকে দেখে শক খেলাম! কাল রাতের মালতি কুজুর। আমতা আমতা করে বললাম, এটা কী হল? সৈকত বলল, কাকা এটা জাবিনা বিবি। কার বিবি কেউ জানে না। ভিক্ষা করে কাটাত। লকডাউন-এ নতুন ফন্দি। মহারানি অজ্ঞান আর জ্বর হবার ভান করে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে ১৫ দিন ধরে ফ্রি খাবার খায় আর একটা করে টেস্ট কিট নষ্ট করে। আগেরবার আমার এখানে এসেছিল সুলেখা মাঝি হয়ে এবার তোমার ওখানে এসেছে মালতি কুজুর হয়ে এই এরাই সরকারকে বাঁশ দেয়। আমি দেখেই চিনেছি। তাই ধরে নিয়ে এলাম। নাও রিলিজ করো কাকা। আর সাথে এক প্যাকেট নেভি কাট পাওনা।

বাড়ি যাওয়ার সময় মেয়ের জন্য বার্বি ডল কিনলাম। সঙ্গে দুজায়গায় ফুল প্লেট মটন বিরিয়ানি। এক প্লেট মেয়ের জন্য। আর এক প্লেট জাবিনা বিবির।

১৫ বছরের ডাক্তারিতে ভালো ভাবেই জানি, নাকে জল নিয়ে হয়তো করোনার অভিনয় করা যায়। কিন্তু খিদের চোটে অজ্ঞানের অভিনয় করা যায় না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...