অভিরূপ তাকিয়ে দ্যাখে– একজন যুবতি তাঁর খোঁজ করছে। ইশারায় পাশের লোকটিকে সে উঠে যেতে বলে। সামান্য বিরক্ত হয়ে লোকটি উঠে যায়। যদিও মুখে প্রকাশ করার সাহস পায় না। সম্পাদক ব’লে কথা। তাছাড়া রবিবারের পাতার দায়িত্বে সে। সামান্য লেখা ছাপানোর জন্যও তেল মারতে হয়। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। ফ্রিল্যান্সাররা মাছির মতো সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করে তার পেছনে। অভিরূপ বেশ মজা পায়, উপভোগও করে। চশমার ফাঁক দিয়ে ফের একবার যুবতিকে দ্যাখে। চেনা কি? প্রেসক্লাবে বা অন্য কোথাও ট্রামেবাসে কিংবা পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ? মনে পড়ছে না। মোটামুটি সুন্দরী, একটা আলগা জৌলুস আছে। একান্তে নিভৃতে কথা বলা যায়। যুবতিটি নমস্কার ক’রে সামনের চেয়ারে বসে। অভিরূপ একটা সিগারেট ধরায়। যুবতি বলে– আমার নাম সুপর্ণা। সুপর্ণা মজুমদার।

– আমার কাছে? আমাকে চেনেন?

নীলাদি পাঠিয়ে দিলেন। নীলা সরকার। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন। আপনাদের অফিসে চাকরি করেন। শিল্পসংস্কৃতির পাতা দ্যাখেন। সিডি ক্যাসেট ইত্যাদি রিভিউ করেন। আর তাছাড়া আপনি বাংলা সাহিত্যের এতবড়ো একজন নামজাদা লেখক। এ-বছর বইমেলায় কোন্ এক পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনার গল্পগ্রন্থের উদ্বোধনও হল। ‘ভালোবাসার ঋতুস্নান’ আমি পড়েছি। সত্যিই অন্যধারার। এছাড়া সোপান, জীবনানন্দ পুরস্কার… অভিরূপ লক্ষ্য করে– সুপর্ণা বেশ তৈরি হয়েই এসেছে। বেশ স্মার্ট।

– আমার গল্প আপনার ভালো লাগে?

সুপর্ণা ঠোঁটটা একবার জিভে বুলিয়ে নিয়ে বলে– ভালো লিখলে কেন লাগবে না। ইদানীং বাংলা গল্পের যা ছিরি! সস্তা প্রেমের গল্প। রিয়েলি ট্র্যাশ।

প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। বিশেষত কোনও সুন্দরী যুবতির মুখোমুখি ব’সে। সুপর্ণা ব’লে চলে– আপনার গল্পের স্টাইলই আলাদা। বেশ ভাবায়। বিষয়ও বেশ গম্ভীর, সিরিয়াস।

– আর্ট ফিল্মের মতো কি?

– আর্ট-কমার্শিয়াল বুঝি না। তবে দর্শকের মতো পাঠকের সংখ্যাও হাতেগোনা মুষ্টিমেয় হয় যদি, ক্ষতি কী? দে আর ইনডিড্ কমিটেড্।

– বাঃ, তফাতটা সত্যিই ধরেছেন তো! আসলে কী জানেন, পাঠকই তো সব। তা, এদের সংখ্যাই যদি আর্ট ফিল্মের মতো হাতেগোনা হয়, চিন্তা হয় বই-কি। ওদের সার্টিফিকেট-ই তো আসল।

অভিরূপ সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে বলে– কী খাবেন, কফি না চা? সুপর্ণা সামান্য ইতস্তত করে। অভিরূপ অর্ডার দেয়। কফিতে হালকা চুমুক দিয়ে সুপর্ণা বলে– একটা গল্প এনেছিলাম।

অভিরূপ এবার চাঁছাছোলা অফিসিয়াল ভঙ্গিতে জবাব দেয়– ফাইলে অনেক গল্প জমা হয়ে আছে। প্লিজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ। সুপর্ণা কিছুটা হতাশ হয়। অভিরূপ বলে চলে– আপনার লেখা কোথাও পড়েছি বলে মনে হয় না। আই মিন কোনও লিট্ল ম্যাগাজিনে। হাত পাকানোর ওগুলোই তো আসল জায়গা।

সুপর্ণা বলে– দু’একটা জায়গায় পাঠিয়েও ছিলাম। মেম্বার হতে হবে। বিজ্ঞাপন-টন জোগাড় করে দিলেও চলে। গ্রুপিং আছে। একটা লেখা ছাপানোর জন্য যে এত কসরৎ, আগে জানতাম না। অভিরূপ চশমার উপর ভ্রূ কুঁচকে বিস্মিত হয়ে জানতে চায়– তাই না-কি? সুপর্ণা বলে চলে– আসলে নীলাদির উৎসাহে… শুনেছি আপনি বড়ো ভালো…। অভিরূপ হঠাৎ হো হো ক’রে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে– কিছু মনে করবেন না। কথা দিতে পারছি না। নির্বাচিত হলে ছাপা হবেই।

– কতদিন পরে জানতে পারব?

– মাস তিনেক।

এর মধ্যে রোগা লম্বা এক গাল দাড়ি, কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনি ব্যাগ নিয়ে এক যুবক কাচের ঘরের বাইরে অপেক্ষার পর মোটামুটি অধৈর্য হয়ে দরজা সামান্য ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বলল– অভিদা…

অভিরূপ খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে– তুমি!

– আজ্ঞে আমার গল্পটা।

– বললাম না বাইরে অপেক্ষা করতে।

– আজ্ঞে ছ’মাস হয়ে…

– কী জ্বালাতন! কী যেন নাম গল্পটার?

– ‘বসুন্ধরা তুমি দিলে’।

– ও। কিছু মনে কোরো না, আর একটা গল্প জমা দিও। কোথায় যে রেখেছি…

যুবকটি আদ্যন্ত বিস্মিত ও হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বিদায় নেয়।

সুপর্ণা বিনীতভাবে বলে– বাব্বা, আপনাকে কতকিছু ফেস করতে হয়।

– সম্পাদকের দায়িত্ব সাংঘাতিক।

হঠাৎ ক্রিং ক্রিং শব্দে ফোন বেজে ওঠে। অভিরূপ রিসিভার তুলে বলে– হ্যালো। ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর শোনা যায়– সুকান্ত বলছি।

– কে সুকান্ত?

– সুকান্ত বসু। এর মধ্যে ভুলে গেলেন। গত শনিবার চাংওয়া বার-এ কত আড্ডা মারলাম। আপনার মাইরি দম আছে। তিন পেগ এক নিঃশ্বাসে সোডা না-মিশিয়ে…

– মনে পড়েছে।

– আমার গল্পটা।

– যাবে। আগামী সপ্তাহে অথবা তার পরের সপ্তাহে। ডেফিনেটলি।

– ধন্যবাদ।

সুপর্ণা বলে– আজ উঠি তাহলে। অভিরূপ প্রত্যুত্তরে বলে– উঠবেন? চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই।

– নো থ্যাঙ্কস্। তার কোনও দরকার হবে না।

– ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনার ফোন নম্বর…

সুপর্ণা ফোন নম্বর দেয়।

রবিবারে স্বভাবতই ঘুম ভাঙে দেরিতে। একটা ফুরফুরে আয়েশি ভাব জড়িয়ে থাকে সারা দেহে। বেড-টি হাতে নিয়ে সুপর্ণা টিভির সুইচ অন করে। ‘গুডমর্নিং কলকাতা’ হচ্ছে। এর আগে, ঘুম থেকে উঠেই খবরের কাগজটা নিয়েই সাপ্লিমেন্টটা আগে খুলে দেখত। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা উত্তেজনা। গল্পটা প্রকাশিত হল কি-না। মাসখানেক ধরে একই অভ্যাস। ছাপা হচ্ছে না। ক্রমশ আশা ছেড়েই দিয়েছিল। হঠাৎ ছোটোভাই বিল্টু ঘরে ঢোকে কাগজ নিয়ে– দিদি তুই তো ছুপা রুস্তম মাইরি! সুপর্ণা কিছু বুঝতে পারে না।

– তোর গল্প ছাপা হয়েছে। আমরা কেউ জানিই না!

– কই দেখি? সুপর্ণা বিল্টুর কথা বিশ্বাসই করতে চায় না– ইয়ার্কি মারিস না। বিল্টু রসিকতা করে– মহাশ্বেতা নাকি আশাপূর্ণা?

– দে আমার কাগজটা। বিল্টু দেয় না– উহুঁ, এত বড়ো সুখবর। বল কী খাওয়াবি?

– তুই যা চাইবি।

– কী করে ম্যানেজ করলে গুরু?

সুপর্ণা মুখ ফসকে বলে ফ্যালে– অভি…

– অভি…।

– অভিরূপ। অভিরূপ ভট্টাচার্য।

– বাঃ দিদি জবাব নেই। একেই বলে এক ঢিলে দুই পাখি।

– এই ভালো হচ্ছে না বিল্টু।

সুপর্ণা টান মেরে কাগজটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কাড়াকাড়িতে হঠাৎ ফ্যাড়ফ্যাড় করে ছিঁড়ে যায় কাগজটা। রাগ সামলাতে না-পেরে বিল্টুর গালে ঠাস করে একটা চড় মারে। নিজেও শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে– এ কী করলি তুই? আমার জীবনের প্রথম গল্প। …হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। রিসিভার তুলে সুপর্ণা বলে– হ্যালো!

– গুড মর্নিং মিস মজুমদার। কীরকম সারপ্রাইজ দিলাম? এবার, খুশি তো?

– ও মিঃ ভট্টাচার্য! কী অকৃতজ্ঞ আমি! ছিঃ ছিঃ! ফোনটা আমারই আগে করা উচিত ছিল। প্লিজ এক্সকিউজ মি।

– তাতে কি? এটা তো আমার কর্তব্য। আপনার প্রতিভার মূল্যায়ন হওয়া উচিত।

– সো কাইন্ড অফ ইউ, মিঃ ভট্টাচার্য। আপনি এত ভালো…

অভিরূপ হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে।

– জীবনের প্রথম গল্প ছাপা হল, অথচ…

– হোয়াটস্ রং উইথ ইউ, মিস মজুমদার?

– ভাইয়ের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে কাগজটা ছিঁড়ে…

– ও এই ব্যাপার। কতগুলো কমপ্লিমেন্টারি কপি লাগবে?

– একটাই যথেষ্ট।

– পেয়ে যাবেন। এইবারে অভিরূপ ঝোপ বুঝে কোপ মারার কথা বলে– আপনার গল্পটা অসাধারণ। আয়্যাম সো মুভ্ড। আপনার প্রতিভা আছে। আই ওয়ান্ট টু এক্সপোজ ইউ। বাংলা সাহিত্যে মহিলা লেখকের সংখ্যা হাতে গোনা। আরও লিখুন। আমি ছাপব। সম্ভব হলে রেগুলার কোনও কলাম। আয়্যাম অলওয়েজ উইথ ইউ। আপনি অসাধারণ।

সুপর্ণা নিরুত্তর। গ্যাস বেলুনের মতো হাওয়ায় ভাসতে থাকে শুধু। চোখের সামনে নাচতে থাকে প্রতিষ্ঠা, প্রশংসা, পুরস্কার।

এর মধ্যে আরও দুটো গল্প প্রকাশিত হয়েছে। পার্ক স্ট্রিটের অলি পাবের দো-তলায় এক নির্জন আলোছায়ার অন্ধকারে কোণের টেবিলে বসে দুজনে। কথা জড়িয়ে আসছে অভিরূপের। সুপর্ণার কাঁধে মাথা। হাত জড়িয়ে বুকের খুব কাছাকাছি। সুপর্ণা সোডামিশ্রিত তরলের অবশিষ্টাংশ গলায় ঢেলে বলে– অভি, আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আমাকে স্বপ্ন দ্যাখাও। প্লিজ। অভিরূপ মাথা নেড়ে, শুধু বলে– হুঁ।

– কবে দ্যাখাবে?

– আজ কাল পরশু। যেদিন দেখতে চাইবে।

– সেই স্বপ্নটা… মঞ্চে আমি শুধু একা আর হলভর্তি লোক। শুধু হাততালি আর হাততালি।

– ক্যামেরা ভিডিও।

– ফ্ল্যাশের আলো আমার একদম সহ্য হয় না। চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

– অন্ধকারই ভালো, কী বলো?

অভিরূপ হালকা করে সুপর্ণার ঠোঁটে চুমু খায়। সুপর্ণা আপত্তি করে না।

– আমার পরের গল্পের নায়ক কে জানো?

– না।

– অভি। আমার অভি। কী, ছাপবে তো?

– সাবধান! বেশি অশ্লীল যেন না হয়।

– সুপর্ণা হঠাৎ পাগলের মতো হো হো করে হেসে ওঠে। অভিরূপ ঘড়ি দ্যাখে– ইটস টু লেট। সুপর্ণা আবদারের ভঙ্গিতে বলে– আর একটু থাকো না, প্লিজ অভি। নাইট ইজ টু ইয়াং। অভিরূপ তার হাত ধরে টানে– চলো!

– কোথায়!

– কেন, আমার ফ্ল্যাটে। সুপর্ণা নেশারু লাল লাল চোখে জানতে চায়– আমার সব গল্প ছাপবে তবে?

– গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, রিভিউ, ফিচার, আর্টিকল যা দেবে সব।

– না শুধু গল্পই দেব। আমি সুচিত্রা ভট্টাচার্য হতে চাই।

– আচ্ছা তা-ই হবে। সুচিত্রা সেন বানাব তোমায়।

– সুচিত্রা সেন নয়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য। প্রমিস?

– প্রমিস। আমার কথামতো চলো, আমি তোমায় বিখ্যাত করে দেব।

– সত্যি বলছ। মাইরি?

– প্রতিষ্ঠা প্রশংসা পুরস্কার তোমার পায়ের কাছে আদুরে বিড়ালছানার মতো গা ঘষবে।

– দারুণ মজা, তাই না!

– কদিন অপেক্ষা করো, ধারাবাহিক লেখার ব্যবস্থা করে দেব।

– আমি জানি তুমি খুব ভালো। তোমায় বিশ্বাস করি।

অভিরূপ সুপর্ণার মাখনের মতো নরম তুলতুলে গালে মুখ ঘষে বলে– প্লিজ সুপর্ণা, আর দেরি সহ্য করতে পারছি না। লেট আস…। সুপর্ণা ফের আদুরে গলায় বলে– আমায় কোনওদিন ছেড়ে যাবে না অভি।

– ধ্যাৎ, কী যে বলো!

– তোমরা পুরুষ মানুষেরা সব পারো। আমার চেয়ে আরও সুন্দরী আরও ভালো গল্পকার তোমার কাছে আসবে। সেদিন নিশ্চয়ই আমায় ভুলে যাবে। অভিরূপ নিরুত্তর। সুপর্ণা বলে চলে– আমার সঙ্গে বিট্রে কোরো না অভি। আই কান্ট টলারেট। তোমার বিশাল মহীরুহ জড়িয়ে অর্কিডের মতো শোভাবর্ধনের স্পর্ধা করি না, পায়ের তলায় ঘাসের বিছানাই আমার শান্তিনিকেতন। দেওয়া-নেওয়ার খেলায় আমায় ব্যবহার কোরো না। আমার ভিতরেও একটা সুন্দর মন আছে, প্রেম-ভালোবাসা আছে। মেয়েদের কাছে নষ্ট হওয়া যত সহজ, ভালো হওয়া ততটাই কঠিন। আমি স্বপ্ন দেখি অভি। বিখ্যাত হতে চাই। জানি, পথে অনেক চড়াই উৎরাই। তবু যে-কোনোও ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নদীতে ভাসমান পোড়া কাঠ বা গলিত মরদেহ আঁকড়ে ধরেও মানুষ বেঁচে থাকে। অভিরূপ তখনও নিরুত্তর। তার এক হাতে মদের গ্লাস আর অন্য হাত জড়িয়ে সুপর্ণার কোমর।

প্রধান সম্পাদক অলোকেশ ঘোষ সিগারেটের রাংতায় মোড়া জর্দা পান খুলে মুখে পোরে। পানের বোঁটায় লাগানো চুন সামান্য জিভে ঠেকিয়ে পিক ফ্যালে টেবিলের পাশে রাখা পিতলের পিকদানিটাতে। বিশাল টেকো মাথায় হাত বোলায়। সামনে বসা অভিরূপ লক্ষ্য করে, তার মুখটা ক্রোধ আর বিরক্তিতে ভরা। বুকটা অজানা আশঙ্কায় হঠাৎ কেঁপে ওঠে। চিফ এডিটর বলে কথা। অলোকেশ ফের একবার পিকদানিতে পিক ফেলে বলে– এসব কী শুরু করেছ অভি? অভিরূপ আমতা আমতা করে বলে– কী স্যার?

– সুপর্ণা মজুমদার কে?

– নতুন লিখছে।

– দেড় মাসের মধ্যে পর পর তিনটে গল্প!

– ভালো লিখছে স্যার তাই।

– শাট্ আপ। এটা অফিস, ব্রথেল নয়। মিস মজুমদার তোমার পেয়ারের লোক হতে পারে, কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে কেউ যা খুশি তাই করবে? গোটা রবিবারের পাতার দায়িত্ব দিয়েছি বলে কি হাতে আকাশ পেয়েছ? কী ভাবো কী নিজেকে? দিবাকর মুখার্জির কাছে তো সামান্য ফ্রিল্যান্স করতে। এখন সম্পাদক হয়ে কি আরও দুটো পা গজিয়েছে?

অলোকেশ ফের একবার পিকদানিতে পিক ফেলে বলে– কফিহাউসে প্রায়ই তোমার নামে অভিযোগ শুনি। গল্প জমা নিয়ে ছাপো না। কখনও বলো, হারিয়ে গেছে। বিনয়দের গ্রুপটা তো তোমার উপর প্রচণ্ড রকম চটে আছে। কোনদিন আচমকা মেরে বসবে। লজ্জা-ঘৃণা কি কিছুই নেই?

অভিরূপ মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে থাকে। এত অপমানিত সে জীবনে কখনও হয়নি। চোখ-কান দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। এসি চলছে। তবুও ঘাম ছুটছে দরদর করে। অলোকেশ না থেমে বলে চলে– ইদানীং সময় নেই, অসময় নেই যখন খুশি বেরিয়ে যাচ্ছ। কে এক বেঁটে মতো দীপক দাস না কুণ্ডু ডাকলেই বার-এ গিয়ে ঢুকছ। মাল খেয়ে ঢুকছ ডিউটি আওয়ার্সে। একের পর এক অভিযোগ। অভি তোমার যোগ্যতা আছে, প্রতিভা আছে, নিষ্ঠা আছে। এভাবে নিজের সর্বনাশ কোরো না। ম্যানেজিং কমিটির বোর্ডে ডিসিশন নেওয়া হয়েছিল, তোমায় ইমিডিয়েট স্যাক করা হবে। আমিই কিন্তু বলে-কয়ে কোনওরকমে বাঁচিয়ে দিয়েছি। তোমাকে গুয়াহাটিতে আমাদের ব্রাঞ্চ অফিসে ট্রান্সফার করা হল। কালই জয়েন করবে। উইশ ইউ গুড লাক অভি।

সপ্তাহখানেক অভিরূপের কোনও খোঁজ নেই। সুপর্ণা ভেবে কোনও কূলকিনারা পায় না। সে এখনও স্বপ্ন দ্যাখে। প্রতিষ্ঠা প্রশংসা পুরস্কার তার চোখের সামনে নাচতে থাকে। অথচ অভি নেই। কে গল্প ছাপবে? জলজ্যান্ত মানুষটা ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল। মনে মনে সে অন্যরকম ভেবেছিল। ওর শরীরের গন্ধ আজও সারা গায়ে লেপটে থাকে। কথা দিয়েছিল অভি। তার জীবনের গল্পের নায়ক হিসাবে ভেবেছিল। তবে কি? সন্দেহ দানা বাঁধে ক্রমশ। তবে কি সব পুরুষই সমান, সব সম্পাদকেরই একই মানসিকতা? দেওয়া-নেওয়ার খেলা শুধু, মদ আর মেয়েমানুষ কেবল? সুপর্ণার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু না, হেরে গেলে চলবে না। এ লাইনে টিকে থাকতে হলে আরও কত নীচে নামতে হবে, কে জানে? অন্তর্বাসের ভিতর তার নতুন গল্পের পাণ্ডুলিপিটা আলতো করে ঢুকিয়ে নেয়। সুপর্ণা এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। সে সরাসরি কাগজের অফিসে আসে। অভির ঘরে ঢোকে। কিন্তু অভি নেই। অভির বসবার চেয়ারে অন্য একটি যুবক। অভির চেয়েও আরও সুন্দর দেখতে, আরও সুপুরুষ। সুপর্ণা জিভ দিয়ে ঠোঁটটা আলতো করে চেটে নেয়। যুবকটি ফাইল থেকে চোখ না সরিয়ে বলে– কী চাই? সুপর্ণা টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে। ইচ্ছাকৃতভাবে বুকের আঁচলটা খসে পড়ে। বাঁকা হাসি হেসে বলে– গল্প। সুপর্ণার দিকে না তাকিয়ে যুবকটি নির্লিপ্তভাবে বলে– রেখে যান। সুপর্ণা ভিতরে ভিতরে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে ওঠে। তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার ভঙ্গিতে বলে– অন্তত একবারটি দেখবেন না আমায়, আমি কি লিখেছি? ফাইল থেকে এবারও চোখ না সরিয়ে যুবকটি একইরকম নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয়– গল্পের পাণ্ডুলিপি যখন, গল্প ছাড়া আর কি হতে পারে? আর তাছাড়া আমার কাছে গল্পই বিচার্য, গল্পকার নয়। হতবাক সুপর্ণা খসে-পড়া বুকের আঁচলটা আস্তে আস্তে তুলে নেয়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...