আপনি কি কেনাকাটা করতে ভালোবাসেন, নাকি আপনি একজন শপ-অ্যালকোহলিক। যদি ক্রনিক শপ-অ্যালকোহলিক হন, তবে সেই বাড়াবাড়ি রকমের কেনাকাটার রোগটা সারাবার চেষ্টা করুন। কারণ এই লক্ষণগুলি যার মধ্যে আছে বস্তুত সেই ব্যক্তিটি এক ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এতে তার কষ্টার্জিত অর্থও অনাবশ্যকভাবে খরচ হয়ে যায়।

লাইফস্টাইল বজায়ের সর্বোত্তম উপায়

যে-কোনও মহিলাকে জিজ্ঞেস করুন কীসে তিনি সবচেয়ে সুখ পান? অবধারিতভাবে উত্তরটা হবে শপিং করে। অনেকেই কিছুদিন অন্তর অন্তর কেনাকাটা করতে বেরোনোর অদম্য ইচ্ছেকে দমন করতে পারেন না। জেনে রাখুন, এই ইচ্ছে একধরনের ম্যানিয়া বা অসুখ যার নাম কম্পালসিভ শপিং ডিসঅর্ডার। এই অসুখে পুরুষের চেয়ে মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হন। দেখা যায় এক্ষেত্রে দশজনের মধ্যে ছ’জনই মহিলা। ২০-৪৫ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে করা এক সমীক্ষার ফলাফল, ৭৫শতাংশ মহিলাই মনে মনে অনেক সময়ই শপিং করার কথা ভাবেন। কিছু কিনতে পারলে এক বিশেষ ধরনের সুখভোগ করেন এঁরা। কোভিড পরিস্থিতিতে অনলাইন-এ কোনাকাটা করলেও,স্বাভাবিক সময়ে উইকএন্ডগুলিতে বাড়ি বসে থাকার চেয়ে বাইরে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করাটাই সময় কাটানোর শ্রেষ্ঠ উপায় বলে মনে করেন এঁরা । বাড়ির বাইরে বের হওয়াটাতে এই ধরনের মহিলারা একধরনের আত্মবিশ্বাস ফিরে পান ও শেষে কেনার মাধ্যমে, তা যেন পরিপূর্ণতা পায়। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই কেনাকাটার পর সেইসব সামগ্রীর বেশিরভাগই পড়ে থাকে, ব্যবহৃত হয় না।

এসব শপ অ্যালকোহলিকদের মধ্যে, যেসব মহিলার স্বামীর দেওয়া হাত খরচ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তারাই একটু বুঝেশুনে কেনেন। অন্যরা কিন্তু চুটিয়ে শপিং উপভোগ করেই যান কারণ অনেকেরই হাতে এখন রয়েছে ক্রেডিট কার্ড। এছাড়া সমাজে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর উচ্চআয়কারী মহিলার সংখ্যা বাড়ার ফলে, শপিং-মলে, প্রদর্শনীতে, আমরা পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের ভিড়ই দেখি বেশি। তাই বাড়তি খরচের আর্থিকসম্পন্নতা ও ক্রমবর্ধমান হারে বাজারে নানান ভোগ্যপণ্যের আগমনের ফলে, শপ অ্যালকোহলিকদের সংখ্যাও বাড়ছে।

কেনার ঝোঁকের শুরু কীসে ?

সমীক্ষা বলছে, মনের চাপ, একাকীত্ব, আত্মবিশ্বাস হ্রাস পাওয়া ও সহযোগীদের সঙ্গে দলে পড়া, ইত্যাদি কারণে কেনাকাটার ঝোঁক চাপে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেনাকাটা করার পর এক ধরনের অপরাধবোধও ঘিরে ধরে।

কম্পালসিভ শপিং ডিসঅর্ডার কী?

যারা ডিপ্রেশনে ভোগেন, প্রায়ই তাদের মধ্যে কম্পালসিভ শপিং ডিসঅর্ডার হতে দেখা যায়। সমাজে অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের খামতিকে প্রায়ই অনাবশ্যক কেনাকাটা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে চান এঁরা। কেনাকাটা করলে, এঁদের  মনের কষ্টের অনুভূত কমে যায়। এই পরিস্থিতির চরম অবস্থায় তারা  কেনবার টাকা জোগাড়ের জন্য  মিথ্যের আশ্রয় নেন বা চুরি পর্যন্তও করেন। এতে অনেকসময় তাদের অন্যের সঙ্গে খারাপ হতে থাকা সম্পর্ক, আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। এমনকী তারা ঋণগ্রস্তও হতে পারেন। কিন্তু তাও তারা একধরনের আনন্দ পেতে, মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে শপিং করতে পেছপা হন না।

অসুখী বিবাহিত জীবন, মারাত্মক হীনম্মন্যতায় ও হতাশায় ভোগা মহিলারা, তাদের কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নানান শপিং মলে যান, অনাবশ্যক কেনাকাটা করেন ও টাকা ওড়ান। তুলনায় পুরুষরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এধরনের জীবনযাত্রা থেকে আপাতমুক্তি পেতে, খেলাধুলোর বা অন্য কাজকর্মের সাহায্য নেন।

‘মেন, উইমেন অ্যান্ড রিলেশনশিপ্স’ বইয়ের লেখক জন গ্রে বলেছেন, ‘আমাদের ইমোশনাল ক্ষতগুলির প্রতিক্রিয়াগুলি বেশিরভাগ সময়েই, ধবংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ, মোহগ্রস্ত হওয়া বা নেশাসক্ত হয়ে পড়ার মাধ্যমেই ফুটে ওঠে। মনে করা হয় মদ্যপানের মতো বেশিরভাগ নেশার কারণই হল মানসিক কষ্ট। অসুখি দাম্পত্য, বা জীবনে কোনও স্বপ্নপূরণ না হওয়ার ফলে হতাশায় ভোগা ব্যক্তিরা কষ্টমুক্তির জন্য আড্ডামারা, ডেটিং করা, অনিয়ন্ত্রিতভাবে জাংক ফুড খাওয়া ও অনাবশ্যক শপিং করার মতো নানা উপায়ের সাহায্য নিয়ে থাকেন।

প্রচুর অর্থ উপার্জনকারী ললিতা মিত্র’র উদাহরণটা নেওয়া যাক। ললিতা একজন ক্রনিক শপ অ্যালকোহলিক। তার সময় কাটানোর উপায় হল, এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরে বেড়ানো ও প্রচুর টাকা খরচ করে বিশাল পরিমাণে নানান সামগ্রী কিনে আনা। এই করতে গিয়ে অর্জিত টাকার একটা বড়ো অংশ স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া হয়, কারণ কিনে আনা পণ্যগুলি সাধারণত বাড়ির আলমারি ও তাক দখল করে পড়েই থাকে। কোনওদিনও ব্যবহূত হয় না, কারণ সেগুলো অনাবশ্যক। মনোবিশেষজ্ঞের মতে ললিতা হীনম্মন্যতায় ভুগছে। বেশ কয়েকটি বিষয়কে এর কারণ বলা যেতে পারে। এক, ললিতাকে দেখতে তেমন আকর্ষণীয় নয়, সে পড়াশোনায় তেমন চৌকশ হয়ে উঠতে পারেনি বলে কেরিয়ার তৈরি করতে পারেনি, তার কিছু পারিবারিক সমস্যাও রয়েছে ইত্যাদি। ফলে এসবের চাপ থেকে মুক্তি পেতেই তার এই উদ্দাম কেনাকাটার বাই।

শপ অ্যালকোহলিজম  প্রতিরোধের উপায়

  • কেনাকাটার বাতিক বড্ড বেড়ে গেছে মনে হলে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজে সাধারণত বুঝতে পারেন না তার ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু সেই ব্যক্তির কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজন আছে। তাই তার পরিজনদের উচিত তাঁকে বুঝিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া।
  • এরকম ব্যক্তির পরিবার পরিজনের উচিত তাঁর বিনোদনের সময়টা এমনভাবে পরিচালিত করা, যাতে তিনি কোনও দোকানে না যান। কেনাকাটি ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে তাঁর মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ব্যায়াম, বাগানে ঘোরা বা বাগানেরই জন্য কাজ করা, গান শোনা, মাসাজ নেওয়া ইত্যাদি কিছু করা যেতে পারে। এধরনের এক শপ অ্যাডিক্ট ব্যক্তি, হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে কেনাকাটার বাতিক থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। এভাবেও মনের কষ্ট কমানো ও দূর করা যায়।
  • এখন খরচ করা বা কেনাকাটা করার পদ্ধতি ও উপায়ের সংখ্যা অগুন্তি। প্রশ্ন হল, কেনার দরকার আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা। সংসারে কী বা কোন সামগ্রীর দরকার আছে তা নিয়ে বাড়িতে আলোচনা করুন। সবার মতামত সাপেক্ষেই কেনা উচিত। যে-সামগ্রীটি প্রয়োজন বলে সবারই মত, সেটির আবশ্যিকতা আছে। অন্যথায় সেটা কেনার ইচ্ছে দমন করুন বা কেবলমাত্র উইনডো-শপিং করে কেনার ইচ্ছে নষ্ট করে ফেলুন।
  • কেনাকাটার বাতিক থাকতে কখনও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করবেন না। সবসময় ক্যাশ ব্যবহার করুন। লোভ জাগিয়ে তোলা হোমশপিং চ্যানেল দেখবেন না। ডিসকাউন্ট স্টোর ইত্যাদিতে যাবেন না। যা যা কেনা আবশ্যিক তার তালিকা বানান। কেবল সেই তালিকা অনুযায়ী কেনাকাটা করুন। সঙ্গে বন্ধু বা পরিজনকে নিয়ে গেলে অনেক লোভ এড়ানো যায়।

মনোবিশেষজ্ঞরা বলেন কোনও বদ অভ্যাস সারাজীবনের জন্য নিজস্ব ট্রেডমার্ক হয়ে গেলেও সঠিকভাবে চেষ্টা করলে, তা নিশ্চয়ই বদলানো যায় বা ছেড়ে দেওয়াও যায়। তাই এই ক্ষতিকারক বাতিক দমন করে, তা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করুন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...