…কিন্তু দীপ্তি লোকে তো তা শুনবে না?

লোকের কথায় আমি বদার করি না মা! একটা কাজ করতে পারো! তুমিও আমার সঙ্গে যেতে পারো! ওর মুখে তো কত শুনেছি, তুমি ইন্টারস্কুল কম্পিটিশনে ব্যায়াম করতে। কত প্রাইজও…!

পাগল? সংসার ছেড়ে ওইসব? আমার কথা বাদ দাও। তুমি শৌর্যকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে এত কথাই উঠত না।

সংসার ছাড়ার কথা কী আমি বলেছি? ফিরে এসে কথা বলছি!

বাবু জানে তুমি যাচ্ছ?

আমি আর কোনও উত্তর দিইনি। স্যান্ডেলে পা গলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। ফিরে এসে কথা বলছি এই একটা কথাতেই শাশুড়িমা নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন, সাত বছরের পুরোনো বউমা কতটা অপোজ করছে তাঁর কথা।

কী আশ্চর্য তাই না?

শৌর্যর মা-ও তো এগুলোর সঙ্গে যুঝেছেন? উনিও বোঝেন না? নাকি বুঝতে চান না?

বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাচ্চা হওয়া নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর, তারপর প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা, বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া, টুকটাক ফুচকা খাওয়া সবেতেই আপত্তি। পরশু যখন কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখে রাতে খাবার টেবিলেই কথাটা পাড়ি, জানো শৌর্য, তোমাদের বর্ণালী ক্লাব থেকে মাউন্টেনিয়ারিংয়ে জন্য তিরিশ জনের একটা উইমেন টিম যাচ্ছে। আমিও ভাবছি…

তখন কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্য আগডুম বাগডুম কথা বলে বিষয়টা ধামাচাপা দিয়েছিল শৌর্যই।

বিয়েটা কি একটা এগ্রিমেন্ট?

আমিও বাবার একমাত্র সন্তান; বারো বছর বয়স থেকে ট্রেক করেছি অযোধ্যা, বিহারিনাথ, সান্দাকফু, সাবারগ্রাম ছাড়াও আরও অনেক। যথেষ্ট সম্ভ্রম রেখেই। কই কেউ তো আমার গায়ে হাত ছোঁয়াতে পর্যন্ত সাহস পায়নি!

অথচ সেই যে শৌর্যর মেজো মাসির বিয়েতে ওর মামাতো দাদা আমার বুক ছুঁতে এগিয়েছিল? সেফটির প্রশ্নই যদি ওঠে, তাহলে সে তো যে-কোনও জায়গাতেই হতে পারে!

শৌর্যকে বিয়ের আগেই বলেছিলাম, আমি কিন্তু ফ্রি বার্ড! পারবে তো আমাকে সামলাতে?

একদিকে ঘাড় হেলিয়ে প্রেমে লাবডুব খেতে খেতে শৌর্য দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল আমায়।

যে করেই হোক, আজ আমি ক্লাবের ফর্ম ফিল-আপ করবই।

 

চিটচিটে গরম; কান মাথার পেছন দিয়ে অস্বস্তিকর ঘাম গড়াচ্ছে। পা ঘষে ঘষে চলার শব্দটা কানে যেতেই সামনে তাকাই। উলোঝুলো চুল, ছেঁড়া সালোয়ার পড়া পাগলিটা হাঁটছে; চারপাশটা কেমন করে দেখছে যেন! ওর কি খিদে পেয়েছে?

আমি একটু এগোতেই চোখাচোখি হল। হাতের ইশারায় মুখে আঙুল দিয়ে কথা বলতে বারণ করে টুক করে ঢুকে পড়ল টুকাইদের বাড়িতে।

বড়ো কৌতূহল হল! ওর ফ্যাকাশে চোখদুটো যেন আকর্ষণ করছিল আমায়।

ভর দুপুর,শুনশান। টুকাইরা ঘুমোচ্ছে নির্ঘাৎ। উঠোন পেরিয়ে নিজের অজান্তেই কখন যে পাগলিটার পিছু নিয়েছি, খেয়ালই নেই।

মরচে পড়া একটা লোহার শব্দ হতেই চমকে দেখি, ও দাওয়ায় উঠেছে। খাঁচার দরজাটা খুলে ফেলেছে। লালকাঠি গলার বাচ্চা টিয়াটাকে বগলদাবা করে রাস্তার দিকে দৌড় লাগিয়েছে।

বুকটা লাফিয়ে ওঠে আমার; পিছু পিছু দৌড়োই! সে দুহাত উঁচু করে ধরে।

কিন্তু না! টিয়াটা ওড়ে না। ভীতু ভীতু চোখে পাঁচিলের উপর বসে।

খাঁচার মধ্যে থাকতে থাকতে আমরাও কি এমনই ভীতু হয়ে যাই? উড়তে ভুলে যাই! নাকি একটু একটু করে ভুলে থাকার চেষ্টা করি নিজেকে? আজ শাশুড়িমা! কাল হয়তো বা আমিও…!

দুটো শালিখ কিচমিচিয়ে ওর পাশে এসে বসে।

দুটোয় মিলে খুব করে ডানা ঝাপটায়; মাথা দুলিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে কী সব বলতে থাকে। একবার… দুবার… তিনবার চেষ্টা করে, বাচ্চা টিয়া ডানা ঝাপটে উড়ে যায় দূর আকাশে। উড়ে যায় শালিখ দুটোও।

ভীতু পাখিগুলোর সামনে যদি ডানা ঝটপট করা যায়; তাহলে কি ওরা উড়তে শিখবে? বাঁচতে শিখবে?

চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে আমার।

এক এক করে ভীতু হাতগুলোকে আমিও কি পারি না পাগলিটার মতো করে দরজা খুলে দিতে?

হাততালি দিয়ে ওঠে পাগলিটা!

দুটো হাত নেড়ে ডানার মতো করে বলে ফুড়ুউউউত…!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...