লিভিং উইথ দ্য লেন্স বলতে যা বোঝায়, তাঁর জীবনে ঠিক সেটাই ঘটেছিল। ক্যামেরা পাশে নিয়ে ঘুমোনো এবং সারাক্ষণ ওটার ভিউ ফাইন্ডারের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখা। একলব্যের মতো  ‎সত্যজিৎ  রায়-কে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তাঁর মননে। দিল্লিতে বর্ন অ্যান্ড ব্রট-আপ এই বাঙালি তনয় অমিত রায়, মুম্বইয়ে এখন অন্যতম ব্যস্ত সিনেমাটোগ্রাফার।

সরকার, সরকার রাজ, ডরনা জরুরি হ্যায়, দশ কাহানিয়া এমন বহু ছবির ক্যামেরা-কুশীলব তিনি। রানিং শাদির নির্দেশক এবং শি ওয়েসিরিরিজেও সাড়া ফেলেছেন। এক নির্ভেজাল আড্ডায় শেয়ার করলেন তাঁর নানা কথা।

 

আপনি তো সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, সিনেমার সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে হল?

 আমার কাকা দীপক রায় ছিলেন একজন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জয়ী ডকুমেন্টারি মেকার। আমাদের পরিবারটাও ছিল ভীষণ রকম ফিলম ভিউয়িং ফ্যামিলি। পাহাড়গঞ্জে যেখানে থাকতাম, পাশেই ছিল একটা সিনেমা হল। মা-কাকিমারা প্রতিদিনই ম্যাটিনি শো দেখতেন। পরে সি আর পার্ক-এ শিফট করার ফলে পারস আর সাবিত্রি দুটো হলই নাগালের মধ্যে চলে এল। বাড়ির সকলে নিয়মিত সেখানে সিনেমা দেখতাম। পরে ভিসিআর জেনারেশন যখন এল, বাড়িতে মেশিনটা ভাড়া করে এনে ছবি দেখতাম। আমি ভীষণ ভাবে বচ্চনজির ফ্যান ছিলাম। ৮০র দশকের আমি সব ছবি দেখেছি। স্কুল থেকে সোজা যেতাম ভিডিযো লাইব্রেরি, সেখান থেকে ক্যাসেট নিয়ে বাড়ি। আমার ঠাকুমা আমায় শোলের গল্প বলতেন যখন ছোটো ছিলাম। পরে শোলের সমস্ত ডায়লগ আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

এছাড়া কাকার প্রচণ্ড প্রভাব ছিল আমার উপর। উনি প্রতি বছর এনএফডিসির স্ক্রিপ্ট রাইটিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। আমি যখন পনেরো, তখন ওঁর একটা স্ক্রিপ্ট খুঁজে পাই। ওটা পড়ার পর আমি ফ্যাসিনেটেড হয়ে যাই। একটা অনুভব হয়, ফিলম তৈরির ব্যাপারে। বুঝতে শুরু করি পর্দায় যা দেখি তার আগেও একটা বিরাট পর্যায় থাকে। আন্তর্জাতিক ফিলম ফেস্টিভ্যাল সেই সময় দিল্লিতে হতো। আমাদের বাড়িতে কাকার ফিলম ইন্সটিটিউশন-এর বন্ধুরা আসত। ফলে ফিলম-এর আলোচনা, পোস্টার, এসব নিয়ে একটা ফ্যাসিনেশন শুরু হল।

প্রথম পেশাদার কাজ কোনটি?

দিল্লির একটা প্রোডাকশন হাউস-এ ঢুকি যারা জি-টিভির জন্য ট্র‌্যাভেলগ বানাতেন, নমস্তে ইন্ডিয়া নামে। ওরা একবার শুট-এ মরিশাস যাবে ঠিক হল। কিন্তু খুব ছোটো ক্রু। আমি প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম। ফলে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু আমি ছিলাম সর্ব ঘটে। ফলে আমাকে কাজে লাগবে ভেবে ডিরেক্টর, অনু মালহোত্রা আমায় ক্যামেরা অ্যাটেন্ড্যান্ট হিসাবে নিয়ে গেলেন। ঘটনাচক্রে কবীর খান তখন ছিলেন ওটার ক্যামেরাম্যান। শুটের মধ্যে একদিন এমন হল, কবীর কিছুতেই ভালো সূর্যাস্তের দৃশ্য পাচ্ছিলেন না। তো হাল ছেড়ে উনি পুল-এ গেলেন একটু ফ্রেশ হতে। আমি ক্যামেরা প্যাক করতে গিয়ে কয়েকটা সানসেট তুলে ফেললাম। পরে কবীর ওইগুলো দেখে দারুণ উত্তেজিত হয়ে ওই জায়গায় আবার শুট করলেন । সন্ধেবেলায় ফুটেজ দেখে অনু দারুণ খুশি। সেই প্রথম আমার কাজের মূল্যায়ণ হল। আই ওয়েন্ট অ্যাজ অ্যান অ্যাটেন্ড্যান্ট, কেম ব্যাক অ্যাজ আ ক্যামেরাম্যান।

মুম্বইয়ের শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল?

বম্বেতে প্রথম দিকে এডি হিসাবে কাজ পেলাম বম্বে বয়েজ ছবিতে। পয়সা পাইনি যদিও (হাসি)। একটা অ্যাপার্টমেন্ট-এ আমরা চারটে ছেলে থাকতাম সবাই স্ট্রাগলার। বম্বে বয়েজ-এ আরও এডি ছিলেন আপ্পু ঢোলাকিয়া, জোয়া আখতার, রিমা কাগতি দারুণ টিম। আমি তখন একেবারেই নতুন।তখন বড়ো বড়ো হাউসগুলোর ক্যামেরায় অ্যাসিস্ট করত, হয় এফটিআইআই-এর ছাত্ররা বা বড়ো ডিরেক্টরের অ্যাসিস্ট্যান্টরা। তবু একটু আধটু কাজ পেতে শুরু করলাম। একটা মিউজিক ভিডিয়ো শুট করি লাদাখে, তারপরই অফার আসে শাহরুখ-মাধুরী-সলমান অভিনীত ছবি হম তুমহারে হ্যায় সনম-এর প্রোমো তৈরি করার। ওটাই আমার ব্রেক। কেন ঘোষ ওটা দেখেন এবং আমায় ইশক্ ভিশক-এর জন্য সাইন করান।

রাম গোপাল ভর্মার সঙ্গে আপনার প্রচুর ছবি ওঁর ব্যাপারে কী বলবেন?

উনি আমার জীবনে একটা ইন্টারভ্যাল পয়েন্ট-এর মতো। মানে ওঁর সঙ্গে কাজের আগে আর পরে হিউজ ডিফারেন্স। আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা ওঁর ছবির মধ্যে দিয়ে এস্ট্যাবলিশ করার সুযোগ হয়। হিন্দি ছবি তখন যেমন হতো, সব কিছুকে গ্লসি করে সুন্দর করে দেখানোর চেষ্টা চলত। আই ইউজ টু হেট দিস বাবলগাম কালার৷কাজের তপ্তি হচ্ছিল না। রামু কমপ্লিটলি সেই ঘরানাটাকে ভেঙে বেরিয়ে এল। ডার্কনেস অফ লাইফ-কে পুরোপুরি এক্সপ্লোর করার সুযোগ পেলাম সিনেমাটোগ্রাফির মাধ্যমে।এখন তো আধুনিক ওয়েব সিরিজও ওই পথেই হাঁটছে৷ উই ওয়ার বোথ রেবেল্স, সো দ্যাট মেড আস জেল।

সরকার আপনার একটা শট তো ভোলা যায় না, যেখানে সরকার হাত তুলে দাঁড়ান সাধারণ মানুষের দিকে মুখ করে 

..আর হাতটা সিম্বলিকালি লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে যায়। বাট মজা কী জানেন, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্টাল শট ছিল। প্র্যাকটিক্যালি শুটিংয়ের সময় প্রতিদিনই একবার করে বচ্চনসাব তাঁর ফ্যানদের উদ্দেশ্যে ওভাবে হাত নাড়তেন। একদিন ক্যামেরা নিয়ে খুটখাট করতে করতে ওই দৃশ্যটা আমি তুলে ফেলি। পরে ওটাকে দারুণ ভালো ভাবে ছবিতে কাজে লাগায় রামু। বাট ইট ওয়াজ নট আ শট প্রি-প্ল্যানড।

Bollywood DOP Amit Roy

বচ্চনের সঙ্গে এতগুলো ছবি করেছেন, কিছু স্মৃতি শেয়ার করুন

এটার একটা মজার ফ্ল্যাশব্যাক আছে। আমার ছোটোবেলায় নাম ছিল রাজা, তো ওই নামটা আমার একদম পছন্দ ছিল না। আমার ঠাকুমা আমায় বড়ো স্কুলে ভর্তি করানোর আগে বলেন, নামটা তোর পছন্দ,  নাকি পালটাব? আমি এক কথায় পালটাতে রাজি হয়ে যাই, বলি আমার নাম রাখো অমিতাভ কারণ আমি ওর ফ্যান ছিলাম। ঠাকুমা নিজেও ছিলেন অমিতাভের ফ্যান। হেসে বলেন, তাহলে তো পৃথিবীতে দুইটা অমিতাভ হইয়া যাইব। ওইটা বরং অমিতাভই থাকতে দে। তুই অমিত হইয়া যা।

কাট-টু অনেক বছর পর যখন প্রথমবার অমিতাভ বচ্চনজির সঙ্গে কাজের সুযোগ হল সরকার-এ, প্রথম দিন শুটিংয়ে হল একটা মজার কাণ্ড। রামু যতবার আমায় অমিত বলে সম্বোধন করে, অমিতাভ চমকে তাকান ওঁকে বলা হচ্ছে ভেবে। সে এক দারুণ কনফিউশন। শেষে অমিতাভ নিজেই হেসে বলেন, দেয়ার আর টু মেনি অমিতস ইন দ্য সেট। পরে কতগুলো অ্যাড কমার্শিয়াল করেছি ওঁর সঙ্গে। জাস্ট ডায়াল, মুত্থুট এর অন্যতম।

আর একটা মজার স্মৃতি আছে। একবার অভিষেক আমাকে আর এক বন্ধু অমিত শর্মাকে দিওয়ালির নেমন্তন্ন করল। এবার আমরা তো খুব নার্ভাস, যতই হোক বচ্চনজির বাড়ির অনুষ্ঠান। সত্যিই ঢুকতে পারব তো? যাইহোক গিয়ে বুঝলাম অমিতজি ইজ আ ভেরি ওয়ার্ম পার্সন। ওই ঘরের ভেতর দেখি মেঝেতে গদি পাতা। বুঝলাম এখানে তাসের আসর বসবে। আমরা পকেট হাতড়ে দেখি মোট ৭০০ টাকা রয়েছে। লজ্জায় মরি, এই নিয়ে কি অমিতজির সঙ্গে তাস খেলা যায়!

মনে পড়ল ড্রাইভারকে সেদিন সকালে বোনাস দিয়েছিলাম। শেষে ওকে ডেকে টাকাটা চেয়ে নিলাম। খেলা শুরু হল। অমিতজি, ওঁর দাদা অজিতাভ, আশুতোষ গোয়ারিকর, ঐশ্বর্যর বাবা, বিপুল শাহ আর আমরা। বিপুল শাহ-ই জিগ্যেস করলেন সংকোচ কাটিয়ে অমিতজি কত টাকা বাজি ধরব? মজার ব্যাপার হল, অমিতজি ইজ সাচ আ ডিসেন্ট ম্যান, বললেন, আরে বাবা দশ টাকাই ধরো আমি এর বেশি অ্যাফোর্ড করতে পারব না। শেষমেশ ৫০ টাকা বাজিতে খেলা হল। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না অমিতজির পাশে বসে তাস খেলছি! ইট ইজ অ্যান অ্যামেজিং মেমরি।

আপনার বিচারে আপনার সেরা কাজ কোনটি?

নিঃশব্দ ছবিটা আমার খুব প্রিয়। আই স্টিল ফিল, এটা অমিতজির সবচেয়ে আউটস্ট্যান্ডিং পারফর্মেন্স। আমার নিজের এই কাজটা করতে পেরে ভালো লেগেছে।

আপনি তো বহু অ্যাড ফিলম করেছেন আবার শি নামে একটা ওয়েব সিরিজও করলেন প্রথমটায় খুব কম সময়ে বক্তব্যটা বলতে হয়, দ্বিতীয়টায় বহু এপিসোড ধরে দর্শককে টেনে রাখতে হয় কোনটা বেশি চ্যালেঞ্জিং?

কমার্শিয়াল ইজ মোর চ্যালেঞ্জিং। এটাকে ঠিক আর্ট ফর্ম বলা যায় না। এটা ডিরেক্টর ড্রিভেন মিডিয়াম নয়, এটা অনেকটাই ক্লায়েন্ট ড্রিভেন। ফলে অনেকসময় দেখা যায় ডিরেক্টর যেভাবে কনসেপ্ট-টা ভেবেছিলেন, ফাইনাল প্রোডাক্টটা তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু হল, এজেন্সি ও ক্লায়েন্টের কাটছাঁটের পর।

কিন্তু ওয়েব সিরিজ আমার মতে সবচেয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করার এবং সৃজনশীলতা প্রকাশের জায়গা। কারণ ফিচার ফিলমেও ফ্রাইডের প্রেশারটা মারাত্মক।

মুম্বইতে তো বাঙালি সিনেমাটোগ্রাফাররা দাপিয়ে কাজ করছেন অভীক মুখোপাধ্যায়, শীর্ষ রায়, রঞ্জন পালিত বা সুদীপ চট্টোপাধ্যায় কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুভব হয়?

না না একেবারেই না। অভীকদা খুব সিনিয়র, শীর্ষ বা সুদীপ খুব ভালো বন্ধু। আবার সবার বাবা হলেন সুব্রত মিত্র (হাসি)। সত্যি বলতে কী মনে হয় উই হ্যাভ দ্য জিনস। এটা পেডিগ্রি আমাদের যে, একসাথে এতজন গুণী বাঙালি ক্যামেরাপার্সন রয়েছেন ইন্ডাস্ট্রিতে।

আপনার পরের কাজগুলো সম্পর্কে একটু বলুন 

আপাতত লকডাউনটা পুরো কাজে লাগাচ্ছি স্ক্রিপ্ট লেখায়। একটা পিরিয়ড পিস তৈরি করার প্ল্যান ৮০র দশককে ঘিরে। আর শি ওয়েব সিরিজের সিজন টু-এর কাজ বাকি রয়েছে। ইমতিয়াজ আলির পরের ছবিতে ক্যামেরা করব হয়তো। আপাতত এই প্ল্যান।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...