জীবনের বিভিন্ন রং যদি দেখার এবং হূদয় দিয়ে অনুভব করার ইচ্ছা থাকে তাহলে শরীরকে কোনওভাবেই অবহেলা করা চলে না। শরীর শেষ মানে জীবনের সব রূপ-রস-রং ম্লান হয়ে যাওয়া। তারপর আছে স্ট্রেসফুল জীবনের ধু-ধু প্রান্তর। এর হাত থেকে যুগেরই রেহাই নেই তো মানুষ কোন ছার। স্ট্রেস, টেনশন, ডিপ্রেশন, ক্লান্তি, একেঘেয়েমি এই শব্দগুলি এখন সকলের মুখেমুখে। কাজের প্রেশারে মানুষ এতটাই ক্লান্ত যে কাজের উদ্যম নেওয়ার ক্ষমতাটাই তার হারিয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্কপ্লেসে হামেশাই দেখা যায় মাথাব্যথা, টেনশন, গ্লো-হীন চেহারা, খিটখিটে মেজাজ, নঞ্চর্থক মানসিকতা, পায়ের নীচে ব্যথা ও ফোলা, খুশকি, চোখের তলায় কালি ইত্যাদি সমস্যা।

অ্যারোমা থেরাপির সাহায্যে এই সমস্যাগুলির সমাধান করা যায়। এছাড়াও এই থেরাপির জন্যে যে ওষুধগুলি প্রয়োগ করা হয়, সেগুলি ব্যবহারেও অন্যান্য নানা উপকার হয়।

আমাদের জীবনের উপর ‘সুগন্ধে’র একটা গভীর প্রভাব রয়েছে। এটি আমাদের স্নায়ুমণ্ডলকে উত্তেজিত করে তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, যে-কোনও ভালো গন্ধ নাকে এলে ফ্রেশ ও টেনশন ফ্রি অনুভূতি হয়।

সুগন্ধ দুই ধরনের হয়। একটি শরীরের উপর প্রয়োগ করা হয়, অপরটি পরিবেশকে সুগন্ধে ভরিয়ে তুলতে ব্যবহূত হয়। বাড়িতে বসেও অ্যারোমা থেরাপি শরীরের উপর প্রয়োগ করা যায় যদি নিয়ম জানা থাকে।

স্প্রে-বোতল কীভাবে বানাবেন

প্রথম স্প্রে-বোতল – বোতল এমন হওয়া উচিত যার মধ্যে সূর্যের রশ্মি প্রবেশ করতে পারবে না যেমন অ্যালুমিনিয়ামের বোতল অথবা খুব গাঢ় রঙের বোতল। এতে ২ ফোঁটা টি ট্রি অয়েল, ২ ফোঁটা পচৌলি অয়েল (এক ধরনের হার্ব), ১/২ চামচ ডেড সি সল্ট, ১ গেলাস ফোটানো জল ঠান্ডা করে মিশিয়ে নিন। দিনে দুই বার মিশ্রণটি মুখে স্প্রে করুন এবং ১৫ দিন একনাগাড়ে করে যেতে পারলে নিজেকে স্ট্রেস-ফ্রি অনুভব করবেন এবং ক্লান্তিজনিত সমস্যা থাকবে না।

দ্বিতীয় স্প্রে-বোতল – রাগ, টেনশন, ক্লান্তি, চট করে বিরক্ত হওয়া, সহজে কিছু বুঝতে না পারা, ঘুম না-আসা, মন অশান্ত হয়ে থাকা ইত্যাদি সমস্যায় এই দ্বিতীয় স্প্রে-বোতলটি উপকার দেবে।

কীভাবে এটি বানাবেন – ২ ফোঁটা নেরোলি অয়েল (ভিটামিন সি সমৃদ্ধ) এবং ১ গেলাস ঠান্ডা করা ফোটানো জল স্প্রে-বোতলে ভালো করে মিশিয়ে নিন। সারাদিনে দু’বার হাতে এবং মুখে স্প্রে করুন। এ ছাড়াও একটি বাটিতে মিশ্রণটি ঢেলে নরম তোয়ালে অথবা টিশু পেপার এতে চুবিয়ে তাই দিয়ে হাত এবং মুখ পরিষ্কার করতে পারবেন। ঘরের মধ্যে যদি রুম ফ্রেশনার হিসেবে এটি স্প্রে করা হয়, তাহলে ঘুম তাড়াতাড়ি আসবে। বিশেষজ্ঞদের মতে রোজ শরীরে এই স্প্রে করলে তবেই লাভ পাওয়া যায়।

ব্যথা থেকে অব্যাহতি দেয়

ওয়্যাক্সিং অথবা থ্রেডিং করালে অনেকের ত্বকে জ্বালার অনুভূতি হয়, ব্যথা এবং ফুসকুড়ির সমস্যাও হয়ে থাকে। সুতরাং ওয়্যাক্সিং অথবা থ্রেডিং করাবার আগে বা পরে দ্বিতীয় বোতলটির মিশ্রণ, স্প্রে করলে সমস্যা থেকে বাঁচা যায়। যে-অংশে ওয়্যাক্সিং অথবা থ্রেডিং হবে শুধুমাত্র সেই অংশেই স্প্রে করা প্রয়োজন।

পেডিকিওর ও ম্যানিকিওর

একটি গামলায় গরম জলের সঙ্গে অল্প পরিমাণে ডেড সি সল্ট এবং ২-৩ ফোঁটা বেসিল অথবা ইউক্যালিপটাস অয়েল মেশান। অল্প একটু শ্যাম্পুও জলে মেশান। এই জলে হাত এবং পা অল্প সময় ডুবিয়ে রাখুন। স্ক্রাবার দিয়ে হাত ও পায়ের ত্বক ঘষে, তোয়ালের সাহায্যে খানিকক্ষণ মাসাজ করুন। নিয়মিত এই নিয়মে চলতে পারলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে।

অ্যারোমা থেরাপির জন্যে কোন কোন জিনিস লাগে

তুলসী – একাগ্রতার অভাব, অবসাদ, নাক বন্ধ, মাথা ভারী, সর্দি হলে ও ঠান্ডা লাগলে, গলা খুশখুশানিতে, ফ্লু, লো অথবা হাই ব্লাডপ্রেশারের সমস্যায় তুলসীর তেল ব্যবহার করা হয়।

ইউক্যালিপটাস – পাচন-প্রক্রিয়া এবং ত্বকের রোগের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।

গোলমরিচ – মাংসপেশির ব্যথা এবং যে-কোনও আঘাত অথবা ঘা-এর জন্য ব্যবহার করা হয়।

লেমনগ্রাস – রুম-ফ্রেশনার এবং পোকামাকড়ের কামড় থেকে বাঁচাবার জন্যে যে ক্রিম তৈরি করা হয়, তাতে লেমনগ্রাস ব্যবহূত হয়। এটি শরীরকে তরতাজাও বানায়।

লবঙ্গের তেল – দাঁতের ব্যথায়, বমি বমি ভাব আটকাতে অত্যন্ত উপকারী।

নীলগিরি – মাথাব্যথা কমাতে এবং মালিশের কাজে ব্যবহার করা হয়।

জেরেনিয়ম তেল – অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ দেয়। এছাড়া রক্তের ফ্লো-কে আটকাবার কাজেও আসে।

জেসমিন এবং চন্দন – রুম-ফ্রেশনার হিসেবে ব্যবহার হয় এবং শরীরে একটা ঠান্ডার আবেশ এনে দেয়। এই দুটি উত্তেজনা বাড়াতেও সাহায্য করে।

ল্যাভেন্ডার তেল – মাথাব্যথা ও মাইগ্রেনের কষ্ট লাঘব হয়, জ্বালা-যন্ত্রণায় অ্যান্টিসেপটিকের কাজ দেয় এবং ঘুম আনার জন্যেও ব্যবহার করা হয়।

লেবুর তেল – মুড ঠিক করে এবং শরীর তরতাজা করে। এছাড়া ডিপ্রেশন, মানসিক আঘাত, অবসাদে অথবা অতিরিক্ত চিন্তার কারণে অনিদ্রা রোগেও লেবুর তেল অত্যন্ত উপযোগী।

টি-ট্রি অর্থাৎ চা-পাতার গাছের তেল – এটি অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মুখের দুর্গন্ধ দূর করতেও সাহায্য করে।

থাইম তেল – ক্লান্তি, টেনশন এবং ডিপ্রেশন দূর করতে অত্যন্ত উপযোগী।

ইউরো তেল – যে-কোনও ফোলায়, ঠান্ডা লাগলে অথবা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে ব্যবহার করা হয়।

গোলাপ – এটি মনকে শান্ত রাখে এবং শারীরিক আরাম প্রদান করে। হজমের টনিকেও ব্যবহার করা হয়। স্নায়ুর সমস্যা, অনিদ্রা, পেটের গন্ডগোল, অবসাদ, মাথাব্যথা, হাঁপানি, যৌনশক্তি বাড়ানো ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এটি অত্যন্ত কার্যকরী।

পুদিনা – এনার্জি বাড়াবার সঙ্গে শরীর-মন ফ্রেশ করে।

অ্যারোমা থেরাপি ফেসিয়াল

আরাম এবং শরীরকে ঠান্ডা রাখার জন্যে অ্যারোমা ফেসিয়াল করা হয়। অনেক ধরনের তেল অ্যারোমা ফেসিয়ালের জন্য ব্যবহার করা হয় যেমন ল্যাভেন্ডর, কেমোমাইল অথবা টি-ট্রি অয়েল মালিশের সাহায্যে ত্বকের ভিতরে পৌঁছে রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে তোলে এবং ক্ষতিকারক পদার্থ ত্বক থেকে টেনে বার করে। ১৫ দিনে একবার এই ফেসিয়াল করানো চলে। সব বয়সের মহিলারাই এই ফেসিয়াল করাতে পারেন।

ফেসিয়ালের পর যদি স্টিম নিতে চান তাহলে স্টিমার মুখের থেকে ১৪ ইঞ্চি দূরত্বে রাখা উচিত। স্ক্রাব এবং স্টিম এই দুটোই রোমকূপের ছিদ্র প্রসারিত করে এবং ফেস মাস্ক-এর সাহায্যে এই ছিদ্র বন্ধ করা হয়। সুতরাং স্ক্রাব এবং স্টিম নেওয়ার সময়, সময়ের হিসেব রাখা খুবই জরুরি।

ফেসিয়াল করার পর বাড়িতে এসে মুখে সাবান ব্যবহার করবেন না। রাতে ক্রিম লাগিয়ে শুলে ব্রণ-ফুসকুড়ি হওয়ার ভয় থাকে। এই পরিস্থিতিতে অ্যারোমা থেরাপির প্রথম স্প্রে-বোতলটি ব্যবহার করতে পারেন।

কোথায় স্প্রে করবেন

১) মাথায় খুশকি হলে, স্ক্যাল্পে স্প্রে করুন।

২) ব্রণ অথবা অ্যালার্জি হলে, অ্যাফেকটেড জায়গায় স্প্রে করুন। জ্বালা এবং চুলকানি থেকে অব্যাহতি পাবেন।

৩) জয়েন্টে ব্যথা হলে সেখানে স্প্রে করুন।

৪) পায়ের আঙুলের মধ্যে যদি ফাংগাল ইনফেকশন হয় তাহলে সেখানে এই মিশ্রণটি স্প্রে করুন।

৫) ত্বক তৈলাক্ত হলে সারা শরীরে স্প্রে করুন।

৬) গুমোট গরমে চোখে, মুখে, নাকে ঘাম হলে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন মুখে এই স্প্রে দিতে পারেন।

৭) সাধারণ ত্বকেও এই স্প্রে ব্যবহার করা যায়।

কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন

ক) সালফারযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। সুতরাং পেঁয়াজ, বাঁধাকপি, ব্রোকোলি অবশ্যই খাওয়া উচিত।

খ) রাত্রে ক্রিম লাগিয়ে শোবেন না। মুখ পরিষ্কার রাখবেন।

গ) রাত্রের খাবার দেরি না-করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নেওয়া উচিত।

ঘ) প্রচুর পরিমাণে জল খাবেন অন্তত ৩ থেকে ৪ লিটার।

ঙ) ভাজাভুজি খাবেন না।

চ) গরমের সময় বেশি করে ডায়েটে ফ্লুয়িড রাখুন।

ছ) থ্রেডিং করাতে গিয়ে কেটে গেলে অন্তত ১ সপ্তাহ কাটা জায়গায় টোনার ব্যবহার করুন নয়তো কালো দাগ হয়ে যাবে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...