অর্পিতা অবাক হয় তার ৭ বছরের শিশুপুত্রের কথায়। কথাবার্তা শুনলে কে বলবে ওইটুকু একটা দুধের শিশু। মনে হয় যেন শেখানো বুলি বলছে। স্কুলে, বাইরে বড়োরা যা আওড়াচ্ছে হুবহু তারই নকল দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। কোথায় শিশুসুলভ চিন্তাধারা হারিয়ে যাচ্ছে শিশুমন থেকে, তা ভেবে পায় না অর্পিতা। স্কুলেও এই একই ব্যাপার। সব বিষয়গুলি খালি মুখস্থ করে গোগ্রাসে গিলছে। নিজস্ব চিন্তা, মেধা খাটিয়ে কিছু করতে চায় না। পরীক্ষার জন্য সেই বাঁধাগতে নোটস মুখস্থ করছে। পরীক্ষা শেষ, জ্ঞানের ভান্ডারও শেষ।
এ শুধু তার একার সমস্যা নয়। ঘরে ঘরে বাচ্চাদের নিয়ে এই একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বহু অভিভাবকদেরই। যত তাড়াতাড়ি বাচ্চারা চিন্তা করতে শিখবে ততই বাচ্চার জন্য মঙ্গল। কিন্তু আমাদের এডুকেশন সিস্টেম এমনই যে, শিশুরা মাথা খাটিয়ে চিন্তা করার প্রবণতা হারিয়ে ফেলছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘তোতা কাহিনী’-রই নামান্তর। অথচ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এবং জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে চিন্তাশক্তি থাকা প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই হল চিন্তাশক্তি উন্নত করার সবথেকে ভালো জায়গা। শুধু প্রয়োজন, চিরাচরিত একঘেয়ে উপায়গুলি ত্যাগ করে, বাচ্চারা পছন্দ করবে এমন কিছু রাস্তা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বার করা। এর ফলে শিশুরাও স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে নির্ধারিত পড়ার বইয়ের বাইরে গিয়ে শিক্ষকরা পড়ান না। বাঁধাগতে বছরের পর বছর একই নোটস ব্ল্যাকবোর্ডের গায়ে লিখিয়ে চলেছেন। ক্লাসের জন্য নির্ধারণ করা বই দেখে শিশু যেটুকু শিখছে, সেটুকুই শিক্ষা তারা শিক্ষকদের কাছেও পাচ্ছে। এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর চিন্তাশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে না। ‘মনে রাখা বিদ্যা’ শিশু কতটা রপ্ত করে আওড়াতে পারছে, এটাই যেন পরীক্ষা করে নেওয়া হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে।
শিক্ষকের ঘাড়ে বোঝা চাপানো হচ্ছে যে, সময়ের মধ্যে পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস শেষ করে দিতে হবে। ভেবেই নেওয়া হয়েছে সময়ে-সময়ে টিচার ক্লাসে পরীক্ষা নেবেন এবং পরীক্ষার খাতা চেক করবেন কিন্তু এটা কি সত্যিই বিদ্যার্থীদের চিন্তাশক্তি বাড়াতে কোনও কাজে লাগছে? শিক্ষার ক্ষেত্রে তেমন কোনও উপকার পাওয়া যায়নি উপরন্তু শিশুসুলভ মনের কল্পনাশক্তিও উধাও হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে এক-একটি ক্লাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে এবং তার মধ্যেই পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস শেষ করার চাপ থাকে শিক্ষকদের উপর। সুতরাং শিক্ষক এবং বিদ্যার্থীদের মধ্যে, প্রশ্ন উত্তরের পালা অথবা বিষয়ের গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ, কোনওটাই হয়ে ওঠে না। পরীক্ষার প্রেক্ষিতেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং উত্তরও সীমার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়। ছোটো থেকে শিশু কল্পনা করবে, প্রশ্নবাণে বড়োদের জর্জরিত করবে এমনটাই হওয়ার কথা। অথচ ছোটো ক্লাসের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুমনটাকেই শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতে চাইছে।
চিন্তা অথবা কল্পনাশক্তি বাড়াতে
ক্রমাগত শিশুদের মন থেকে কল্পনাশক্তি হারিয়ে যাওয়ার কারণে, এখন কিছু স্কুলে বাচ্চাদের পড়াশোনার নতুন পদ্ধতি এক্সপেরিমেন্টাল বেসিসে গ্রহণ করা হচ্ছে। বাচ্চারা যে-যেটা করতে ভালোবাসে, শিক্ষকরা তাদের সেই বিষয়ে এনকারেজ করছেন যাতে তারা নিজে থেকে সেই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে। শুধু ক্লাসে নোটস আউড়ে গেলে হবে না। ছবি এবং অডিও-র সাহায্য নিয়ে সেই বিষয়টি সোজা-সাপটা ভাষায় বাচ্চাদের বোঝাতে হবে। ব্ল্যাকবোর্ডের ব্যবহার আরও বেশি করতে হবে।
যে-বিষয়টি শিশুটি ভালোবাসে, সেটা পড়ে নিজে থেকে যাতে সে তার উপর নোটস বানায়, তার জন্যে বাচ্চাটির আগ্রহ বাড়াতে হবে। বিষয়টি নিয়ে শিশুটি যত নাড়াচাড়া করবে ততই গভীরভাবে বিষয়টি শিশুর মস্তিষ্কে গেঁথে যাবে। এমনও হতে পারে, ক্লাসে সবাইকে একটি টপিক দিয়ে দেওয়া হল। বিদ্যার্থীদের বলা হল, বিষয়টি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে। সেটা পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে বাইরের যে-কোনও সোর্স থেকেও হতে পারে। ক্লাসে এসে একজনকে ডাকা হল বিষয়টি সম্পর্কে যা তথ্য জোগাড় হয়েছে সেটাই ক্লাসের অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে শেয়ার করতে। ফলে একজনের মুখ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে জানাও হল, আবার অন্যান্য বাচ্চারা নিজেদের মতামতও সকলের সঙ্গে বন্টন করে নিতে পারল।
নীচু ক্লাসে সময়ের অভাবে হয়তো এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না কিন্তু কলেজে এই ধরনের পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়। বইয়ের প্রতিটি চ্যাপ্টারও যে এই একই ভাবে পড়াতে হবে এমনও কোনও বাধ্যবাধকতা থাকে না।
পুরো বিষয়টিতে আসল উদ্দেশ্য হল, শিশুর চিন্তাশক্তি বাড়িয়ে পড়াশোনাটাকে আরও গ্রহণযোগ্য এবং চ্যালেঞ্জিং করে তোলা। এই ব্যবস্থায় শিশুকে চালিত করতে পারলে, বিষয়টির জ্ঞান আজীবন শিশুর জীবনকে সমৃদ্ধ করবে এবং স্বাধীনভাবে জীবনকে পরিচালনা করার শক্তি জোগাবে শিশুর মধ্যে।