সমাজ বদলাচ্ছে। মানুষের চিন্তাধারাটাও চিরাচরিত নিয়মের শিকলে আজ আর আবদ্ধ পড়ে নেই। কিছুটা নিজেদের ইচ্ছেতে এবং আংশিক সময়ের প্রেশারে নিজেদের মানসিকতাকে বদলে নেওয়াই বুদ্ধিমানের রাস্তা বলেই বুঝে গিয়েছেন সকলে।
সন্তানের দায়িত্বে মায়ের অবদানের তুলনা চলে না। অতীত বর্তমান উভয়কালেই মা-ই সন্তানের সবথেকে কাছের প্রিয় মানুষ। তাই বহু যুগ থেকেই এই ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, মা-কেই শিশুর পুরো দায়িত্ব নিতে হবে। সমাজের নিয়মটাই এমন হয়ে গিয়েছিল যে সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব পুরোপুরি মা-কেই একা সামলাতে হতো– তা সংসার অথবা বাইরে তার যতই কাজ থাকুক না কেন। এই দায়িত্ব ভাগ করে নিতে সকলেই নারাজ। খুশি মনে মায়েরা একাই এই দায়িত্ব নিজেদের উপর তুলে নিয়েছিল কারণ তখন খুব কম সংখ্যক মহিলাই চাকরি করত। বাড়িতেই তাদের সময় কাটত বেশি।
সময়ের সঙ্গে প্রয়োজন হয়েছে অর্থ উপার্জনের। শিক্ষার প্রসারতা বেড়েছে। মেয়েরাও শিক্ষিত হয়ে উঠেছে এবং প্রয়োজনের তাগিদে আজ স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই চাকরি-র পথ বেছে নিতে হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব কি কিছু কম হয়েছে? কখনওই না। পরিবর্তন যেটার হয়েছে, সেটা জীবনকে পরখ করার দৃষ্টিভঙ্গীর। লাভের লাভ হয়েছে চাকুরিরতা মায়েরা সন্তানের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার নতুন উপায়, অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে। স্বামীরা চেষ্টা করছেন স্ত্রীয়ের ব্যস্ত জীবনে অল্পবিস্তর হলেও রিলিফ এনে দেওয়ার। বাচ্চার দায়িত্ব স্ত্রীয়ের সঙ্গে শেয়ার করছেন স্বামীরা। সমাজও এখন অনেক বেশি তৎপর। ক্রেশ, ডে-বোর্ডিং স্কুল তৈরি হয়েছে, যেখানে বাচ্চাদের সারাদিন দেখাশোনা করা হয়। বাচ্চার অভিভাবকেরা দুজনেই চাকুরিরত হলে, এ এক অনন্য বিকল্প।
ক্রেশঃ বেশ কিছু বছর হল ভারতেও ক্রেশ-এর কনসেপ্ট শুরু হয়েছে। যেখানে মা-বাবা দুজনেই চাকরি করতে বেরোন, সেখানে বাচ্চার একা থাকাটা একটা সমস্যা। সুতরাং মায়েরা ক্রেশে নিজের বাচ্চাকে নির্দ্বিধায় রেখে যেতে পারেন কারণ ক্রেশে বাচ্চাদের সারাদিনের দেখাশোনা করার সুব্যবস্থা থাকে। অর্থের বিনিময়ে এই পরিষেবা দেওয়া হয়। সংখ্যায় কম হলেও বর্তমানে এদেশে সরকারি ও বেসরকারি কিছু অফিসে নিজস্ব ক্রেশ আছে। এখানকার কর্মরতা মহিলারা নিজেদের সন্তানকে সারাদিন সেখানে রেখে কাজ করার সুবিধা পায়। আবার আসার সময় সন্তানকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে চলে আসে। এর বদলে অফিস সামান্য পরিমাণ অর্থ চার্জ করে।
অফিস ছাড়াও বহু পাড়াতেও প্রাইভেট ক্রেশ আজকাল পাওয়া যায়। সাধারণত ক্রেশগুলিতে ২ মাস বয়স থেকেই বাচ্চাদের দেখাশোনা করার ব্যবস্থা থাকে। সদ্য মায়েরা অফিসে ৩-৪ মাসের বেশি ছুটি পান না সুতরাং তারপর থেকেই তাদের ক্রেশের খোঁজ করা শুরু করে দিতে হয়।
এখন ওয়ার্কিং মাদারের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা দেখে ক্রেশ খোলাটা একটা কেরিয়ার অপশনে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিটি বড়ো শহরে, এমনকী মফস্সলেও ক্রেশের রমরমা এখন লক্ষণীয়।
ডে-বোর্ডিং স্কুলঃ ক্রেশের অনেক পরে ডে-বোর্ডিং স্কুলের কনসেপ্ট এসেছে। ডে-বোর্ডিং-এ ৩ বছরের বেশি বয়সের বাচ্চাদের নেওয়া হয়ে থাকে।
বোর্ডিং স্কুলের সুবিধা হল, ক্রেশে যেখানে বাচ্চাদের খালি দেখাশোনাই করা হয়, বোর্ডিং স্কুলে দেখাশোনার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাও করানো হয় এবং ডিসিপ্লিন-ও শেখানো হয়। খেলাধুলো, গঠনমূলক কাজও তাদের শেখানো হয়। অনেক সময় বোর্ডিং স্কুলে যা-যা শেখানো হয়, স্কুলে ভর্তি হতে গেলে সেগুলি থেকে প্রচুর সাহায্যও পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় বড়ো স্কুলগুলোর সঙ্গেই
ডে-বোর্ডিং ফেসিলিটি দেওয়া হয়। স্কুলে পড়াশোনার পর ছুটি হয়ে গেলে বোর্ডিং-এ ব্যবস্থা থাকে খাওয়াদাওয়া, বিশ্রামের। তারপর স্কুলের সমস্ত হোমওয়ার্ক, পড়াশোনা ওখানেই করিয়ে দেওয়া হয়, যাতে বাচ্চাদের বাড়ি এসে আর কিছু পড়াশোনা করতে না হয়। অফিস ছুটি হলে বাবা-মার সঙ্গেই বাচ্চা বাড়ি চলে আসতে পারে অথবা বোর্ডিং স্কুল থেকেই তাদের নিজস্ব কনভেয়ন্স-এ বাচ্চাদের বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা থাকে। এক্ষেত্রে বাড়িতে বাচ্চাকে পড়াশোনা করাবার দায়িত্ব থেকেও মা মুক্ত হতে পারেন। ডে-বোর্ডিং-এ রাখতে হলে আর্থিক সঙ্গতি থাকা প্রয়োজন কারণ অর্থের পরিমাণ ডে-বোর্ডিং-এর ক্ষেত্রে একটু বেশি।
আপনজনের দায়িত্বে বাচ্চাকে রাখাঃ সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, পরিবার-পরিজনও এগিয়ে আসছেন চাকুরিরতা মায়েদের সমস্যা হ্রাস করার জন্যে। মেয়েদের বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি দু’পক্ষই এখন অনেক বেশি সচেতন, যাতে বাড়ির মেয়ে, বাড়ির বউ নিশ্চিন্তে কর্মস্থানের কর্তব্য পালন করতে পারে। বাড়ি, সন্তান নিয়ে অযথা তাকে দুশ্চিন্তা না করতে হয়। শাশুড়ি, শ্বশুর এখন অনেক মডার্ন, তারা তৎপর নাতি-নাতনিকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। তাদের মনোভাব ছেলের বউয়ের প্রতি অনেক উদার হয়েছে। বউমা অফিস বেরিয়ে গেলে বাচ্চারা ঠিকমতো খেলো কিনা, স্কুলের সময় হলে স্কুলবাস না এলে স্কুল অবধি এগিয়ে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা, জলখাবার খাইয়ে অল্প বিশ্রামের পর পড়তে বসানো এসব দায়িত্ব এখন অনেক
ঠাকুমা-ঠাকুরদাই পালন করছেন। বাপের বাড়ি কাছাকাছি হলে মেয়ের মায়েরা এসেও বাচ্চার সারাদিনের দেখাশোনা করছেন। চাকুরিরতা মায়েরাও সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থেকে বাইরের কাজে মন দিতে পারছেন কারণ বাড়ির আপনজনের কাছেই বাচ্চারা সুরক্ষিত রয়েছে।
সুতরাং ক্রেশ, ডে-বোর্ডিং স্কুল এবং নিজের বাড়ির সদস্যরা এখন ওয়ার্কিং মাদারদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে। কিন্তু প্রথম দুটো জায়গায় বাচ্চাকে রাখতে হলে নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে হবে এবং বাচ্চাকেও বোঝাতে হবে যে নিজেদের থেকে দূরে রাখা মানে তাকে একলা ছেড়ে দেওয়া, এমন নয়। বাচ্চা যদি একবার ভেবে নেয় মা-বাবা তাকে ভালোবাসে না বলেই ক্রেশ বা বোর্ডিং-এ দিয়েছে তাহলে সমস্যা কমার বদলে বাচ্চার পক্ষে এই ভাবনা ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।
সাবধানতা অবলম্বন করতে হবেঃ
- বাচ্চাকে দেওয়ার আগে ক্রেশের খোঁজখবর নিন। সেখানে গিয়ে বাচ্চা সুস্থ ও সুরক্ষিত থাকবে নিশ্চিত হলে তবেই ক্রেশে দিন।
- ক্রেশের মালিকের মোবাইল নম্বর নিয়ে রাখুন এবং নিজের নম্বর তাকে দিন। ক্রেশে যে মহিলা কাজ করেন তিনি কেমন খোঁজখবর নিন।
- বাচ্চার কোনও অসুস্থতা থাকলে ক্রেশের সঞ্চালক-কে আগে থেকেই জানিয়ে রাখুন।
- ঠিক সময় বাচ্চাকে ক্রেশে ছাড়ুন। চেষ্টা করুন যতটা কম সময় বাচ্চাকে ক্রেশে রাখা যেতে পারে। বাচ্চার পছন্দের খাবার তার সঙ্গে দিয়ে দিন।
- সারাদিনে ফোনে অন্তত কয়েকবার বাচ্চার খবরাখবর করুন। বোর্ডিং স্কুলও দেখেশুনে বাছুন।
- ক্রেশে বাচ্চাকে রাখতে বাধ্য হলেও, নিজের কাছে বাচ্চাকে যতক্ষণ রাখবেন মাতৃস্নেহে ভরিয়ে তুলুন যাতে আপনাকে না-পাওয়ার কষ্ট তার মনে না-থাকে।
- অসুস্থ অবস্থায় বাচ্চাকে ক্রেশে পাঠাবেন না।
- ক্রেশে আপনার বাচ্চার ঠিকমতো দেখাশোনা হচ্ছে কিনা চেক করতে মাঝেমধ্যে ক্রেশে যান।