সবিতা একটা বড়ো থলে কাঁধে করে ঘরে ঢুকতেই আঁতকে উঠলাম। ‘হ্যাঁরে, তোর কাঁধে ওটা কী? ওটার মধ্যে কী আছে?’

‘আজ্ঞে, দিদি আমার বাপের বাড়ির দেশের আম। তুমি তো খেতে ভালোবাসো তাই।’

সবিতার ঠোঁট উলটে কথা বলার কায়দা দেখে খুব হাসি পেল। কিন্তু সবিতা সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং স্বমহিমায় তার নিজের ছন্দেই গড়গড় করে বলে চলল, ‘দেশ থেকে ছোটো ভাই আর ভাইপো এসেছে কিনা। মা ওদের হাত দিয়ে অনেক কিছু পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি আর তনুদিদি আম পছন্দ করো তো, তাই খানিক নিয়ে এলুম।’

‘হ্যাঁরে এটা খানিক?’ মনে মনে হাসি পেলেও, থলে ভর্তি আম নিয়ে আসার ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারছিলাম না। আসলে খুব কাছের লোক ছাড়া এইভাবে কারওর থেকে কিছু নেওয়ার অভ্যাস কোনওদিনই আমার ছিল না।

‘খানিক নয় তো কি গো দিদি! দু-তিন বস্তা ভর্তি করে নিয়ে এসেছে যে। তোমাদের খাওয়া শেষ হলে আমকে বোলো, আবার আনব।’ গর্বের সঙ্গে সবিতা এমন ভাবে কথাগুলো বলল যে, আমি আর সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারলাম না।

‘না না এটাই অনেক। আর আনিস না বাবা।’ ঠিক সেই সময় ডোরবেলটা বেজে উঠল। ‘সবিতা দ্যাখ তো বাবা কে এসেছে।’

দরজা খুলতেই দুজন অপরিচিত ব্যক্তি ফলের ঝুড়ি আর ড্রাই ফ্রুটের কয়েকটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে সেগুলো টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে দিল। তাদের আচরণ দেখে বেশ বিরক্তই হলাম।

‘এসব কী? আর আপনারাই বা কে?’

আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আগন্তুক জবাব দিল, ‘আজ্ঞে, ম্যাডাম, ব্যস একটু খাবার জিনিস আর কী। প্লিজ এটাকে অন্যভাবে নেবেন না। বলেই ছেলের দিকে তাকিয়ে, ‘রাজ দাঁড়িয়ে  আছিস কেন? তোর ডকুমেন্টস-টা ম্যাডাম-কে দে।’

ছেলেটি আমার অনুমতি ছাড়াই সামনের চেয়ারটাতে ধপাস করে বসে পড়ল।

‘এক মিনিট, আগে আমার কথা শুনুন। কলেজের কাজ আমি বাড়িতে করি না। আপনারা কলেজে দেখা করুন, আর হ্যাঁ এইসমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যান।’

‘প্লিজ, ম্যাডাম দু-মিনিট সময় দিন।’ বলেই ছেলের হাত থেকে মার্কশিট-টা নিয়ে ‘এই দেখুন মাত্র ১ নম্বরের জন্য ছেলেটার অ্যাডমিশন আটকে গেছে। এখন আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন, তাহলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ…।’

ওদের স্পর্ধা দেখে মাথাটা ভীষণ ভাবে গরম হয়ে উঠল। কিন্তু বাড়ির মধ্যে কোনওরকম সিনক্রিয়েট হোক, এটা চাইছিলাম না, তাই তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ‘দেখুন আমি আগেই বলেছি কলেজের ব্যাপার আমি কলেজেই মেটাই। আর একটা কথা, এক নম্বরের জন্য অ্যাডমিশন হয়নি এমন ছেলেমেয়ের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। আমি যদি সুপারিশ করে আপনার ছেলেকে অ্যাডমিশন দিই, তাহলে কি অন্যদের সঙ্গে অন্যায় করা হবে না? আপনার ছেলের ভালোর জন্যই বলছি, যে কলেজে চান্স পেয়েছে, সেখানেই অ্যাডমিশন করিয়ে নিন।’

‘এরকম করার হলে তো কবেই করিয়ে নিতাম ম্যাডাম। তাহলে আর আপনার কাছে আসা কেন? আসলে আপনার কলেজের একটা সুনাম রয়েছে, সঙ্গে প্রিন্সিপাল হিসাবে আপনারও। সেইজন্যই আমি চাই, আমার ছেলেটা আপনার ছত্রছায়ায় থেকে সঠিক পথে পরিচালিত হোক। তাহলে ওর ভবিষ্যৎ নিয়েও আমার কোনও চিন্তা থাকবে না।’

‘প্লিজ, এভাবে প্রেশার ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবেন না। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবিতা, আমি তৈরি হতে যাচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দিস।’

ওদের যেতে বলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ঢুকতে ঢুকতে দু-তিনবার ম্যাডাম, ম্যাডাম ডাকও কানে এল শেষে একটা হুমকিও শুনতে পেলাম। ‘এর ফল কিন্তু ভালো হবে না ম্যাডাম।’ ইচ্ছা করেই সেটা না শোনার ভান করলাম।

বাবা ছোটোবেলায় কবিতাটা শিখিয়েছিলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির আজও ভুলিনি, মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র সেই কবেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অন্তরে। স্নান করে বেরোনোর পর মুডটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সবিতা তখন ঘর ঝাড়পোঁছে ব্যস্ত। কিন্তু ওর মুখটা কেমন যেন একটা…। হঠাৎ করে আকাশে মেঘ জমার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

‘কী হল? ওরা চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ গেছে। একটু যদি সাহায্যই করতে দিদি, তাহলে কী আর এমন হতো শুনি? বেচারা! অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। সঙ্গে যেসব জিনিসপত্র এনেছিল, সেগুলোও দিয়ে দিতে হল।’

সবিতার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। সবিতাকে আমি কোনওদিনই কাজের লোক হিসাবে দেখিনি। বরং ছোটোবোনের মতোই দেখে এসেছি। তাই ওর জোরটাও আমার উপর একটু বেশিই।

‘ওহ তাই বল! সব জিনিসপত্র ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বলে তোর গোঁসা হচ্ছে।’

‘তামাশা কোরো না তো দিদি। সত্যিই তুমি যদি ওই বেচারাদের মুখটা দেখতে।’

শোন, বেচারা-টেচারা কেউ নয়। জাস্ট নিজের কাজ হাসিল করার জন্য ঘুষ দিতে এসেছিল বুঝেছিস। তুই খুব বোকা, এসব বুঝবি না। জানিস ওই উপহারগুলোর বদলে আমাকে দিয়ে কী করিয়ে নিতে চাইছিল। দ্যাখ, তুইও তো আমার জন্য ফল এনেছিস। কিন্তু তোর আনার মধ্যে কোথাও কি…’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ডোরবেলটা আবার বেজে উঠল। সবিতা দরজা খুলতে গেল বটে, কিন্তু আমার সন্দিগ্ধ নজরও দরজার দিকে আটকে রইল। দরজা খুলতেই সামনে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় লোক। একজনকে অবশ্য লোক বললে ভুল হবে। তাকে দেখে মনে হল বছর উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। কিন্তু দুজনেরই পোশাকআশাক কেমন যেন একটু প্রত্যন্ত গাঁ ঘেঁষা। ভাবলাম এরা আবার কারা রে বাবা!

‘সাবু দি, এটাই ম্যাডাম না?’

‘ম…ম… ম্যাডাম’ দূর থেকে দাঁড়িয়েই হাতজোড় করে প্রণাম সারল তারা।

এ পর্যন্ত এইটুকুই বোধগম্য হল যে সবিতার ডাক নাম সাবু আর এরা তারই পরিচিত কেউ।

‘ওহ্ দিদি আমার ভাই আর ভাইপো, তোমাকে বলেছিলাম না দেশ থেকে এসেছে।’

‘ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছিলি বটে’ বলে সম্মতি জানাতে ঘাড় নাড়ালাম। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে, এদের এখানে আসার কারণটা কী!

ততক্ষণে সবিতার ভাই ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে, ‘আম খেয়েছেন ম্যাডাম? আমাদেরই বাগানের।’

ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল সবিতা আমার সাইডে দাঁড়িয়ে ইশারা করে ওদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। না তারা কিছু বুঝতে পারছে, না আমি। উত্তরে আমের বেশ তারিফ করে, বেশিমাত্রায় পাঠানোর কথাও জানালাম।

‘আরে না না ম্যাডাম, চাষেরই তো জিনিস। সিজনে জাম আর পেয়ারার ফলনও বেশ ভালো। পরের বার ১-২ ঝুড়ি পাঠিয়ে দেব’খন। চাইলে বাড়িতে বানানো খাঁটি ঘিও পাঠাতে পারি।’

‘না না। ধন্যবাদ। এই যথেষ্ট।’ ঘড়ি দেখতে দেখতে আলগোছে বলি, ‘সবিতার সঙ্গে কিছু দরকার আছে তাই তো? ঠিক আছে, বসে ওর সঙ্গে কথা বলে নিন। আমি আসছি।’

বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়াব এমন সময় সবিতার ভাই হাতজোড় করে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘দরকারটা আপনার সঙ্গেই ছিল ম্যাডাম। আপনি কৃপা করলে মা-মরা এই বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ তৈরি হয়ে যেত। দয়া করে যদি এই গরিবের উপর একটু কৃপাদৃষ্টি করেন। ছেলেটা আমার পড়াশোনায় একটু কমজোর বটে, কিন্তু খুব ভালো মনের।’ বলে একটু থামে। নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘দিদি বলেছিল আপনি নাকি কলেজের প্রিন্সিপাল।’

‘আপনারা কলেজে গিয়েছিলেন? ওনারা কী বললেন?’

‘বললেন লিস্টে নাম নেই।’

‘রিজার্ভেশন কোটায় দেখেছিলেন।’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। একদম শেষের দিকে। আপনি সব পারেন ম্যাডাম। শুধু বাচ্চার মাথায় একটু হাত রেখে দিন। তাহলেই…’ কথাগুলো বলতে বলতেই আমার হাতদুটো জোর করে চেপে ধরে ছেলের মাথায় রাখার চেষ্টা করে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় আমার।

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা?’

‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম, ক্ষমা করে দিন। গাঁয়ের লোক তো, তাই শহুরে আদবকায়দা ঠিক জানি না। সাবুদি কিছু বলো না। সাবুদি আপনার খুব সুনাম করে, বলে দিদি খুব দয়ালু, উপকারী। কিগো দিদি বলো।’ বলতে বলতে চোখভরা আশা নিয়ে সবিতার দিকে তাকাতেই, সবিতা কিন্তু কিন্তু করতে করতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

‘দিদি তোমার কলেজে ওর একটা ব্যবস্থা করে দাও না দিদি। সারাজীবন আমরা তোমার খেদমত খাটব দিদি। দাও না দিদি।’ বলতে বলতেই ভাইপোকে একেবারে আমার পায়ে ঝুঁকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।

পরিস্থিতি দেখে একপ্রকার লাফিয়েই দু-পা পিছিয়ে এলাম। ‘কী করছিসটা কী সবিতা? তুই তো জানিস আমি এসব পছন্দ করি না।’ এরকম অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে এর আগে কোনওদিন পড়িনি।

‘রাস্তা ছাড়। আগে কলেজে যাই। পৌঁছে লিস্টটা চেয়ে একবার চেক করে দেখব। তবে আমার মনে হয় না, এই ব্যাপারে খুব একটা কিছু হবে বলে। হয় ভাইপোকে অন্যত্র ভর্তি করিয়ে দে, নয়তো ভালো করে পড়াশোনা করে আবার পরীক্ষায় বসতে বল। এক্ষেত্রে সত্যিই আমার কিছু করণীয় নেই।

বেশ রূঢ় ভাবেই কথাগুলো বলে কোনওদিকে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আজ বলে নয়, বরাবরই আমি একটু আদর্শবাদী। নিয়মনীতি মেনেই চলি। সেসবের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কাজ করা আমার পক্ষে সত্যিই বোধহয় অসম্ভব। তাই মাঝেমধ্যেই লোকের কাছে ভীষণ ভাবে অপ্রিয় হয়ে উঠি।

বিশ্বাস করুন, ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে, পরের দিনই তার থেকে অনেক বেশি চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভেবেছিলাম সবিতা হয়তো আর কাজেই আসবে না। কিন্তু উলটোটাই হল। অন্যান্য দিনের মতো সকাল সাতটাতেই হাজির হল সে। ব্যাতিক্রম বলতে শুধু মুখ হাঁড়ি করে চুপচাপ কাজ করে যাওয়া। যেটা সবিতার একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। ওর চুপ থাকাটা একসময় বেশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। বুঝতে হয়তো পারছিলাম ওর মনের মধ্যে কী উথালপাথাল চলছে। আমারও মনের অবস্থা খানিকটা সেইরকমই।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রশান্ত মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে কী জানি না, আমি অনেক শান্ত, চুপচাপ হয়ে গেছি। বলতে পারেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তনু তখন খুব ছোটো। মনের মধ্যে কষ্ট থাকলেও তা চেপে রেখে সর্বদা ওর সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেছি। আমিই যদি ভেঙে পড়ি, তাহলে ওকে দেখবে কে, এই ভাবনাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে চিরটাকাল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও বড়ো হয়েছে, বড়ো হয়েছে ওর পরিধিও। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার পৃথিবী কেবলমাত্র ওকে ঘিরেই। কিন্তু ওর দিন-প্রতিদিনের বিস্তৃত হওয়া পৃথিবীতে, আমার জায়গাটা যে কোথায়, তা অনুমান করা খুব কঠিন।

বন্ধু হিসাবে কারওর কাছে যে নিজের দুটো মনের কথা বলব, জীবনে তেমন সঙ্গী আর পাইনি। সেই কারণেই হয়তো নিজেকে এভাবে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে রাখা। তবে শুধু আমার চেনা-পরিচিতরা কেন, আমার মেয়েটাই যে আমাকে কতটা জানে, বোঝে, বলা মুশকিল।

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছি, ঠিক সেই সময় তনু ফোনে কথা বলতে বলতে নীচে নেমে এল। আমাকে দেখামাত্রই ফোনটা কেটে এগিয়ে এল, ‘ও মাম্মা, পরশুদিন আমার উৎকল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। বটানিতে লেকচারারশিপে ভ্যাকেন্সি ছিল। রিয়া, পূজা, মুন সবাই অ্যাপ্লাই করেছে বলে, আমিও করলাম। যদিও টিচিং ব্যাপারটাতে আমার খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই, তবুও যতদিন না মনের মতো একটা কিছু হচ্ছে, ততদিন অন্তত। প্লিজ, তুমি একটু বিসি আঙ্কলকে ব্যাপারটা জানিয়ে রেখো।’

‘আবার বিসি সাহেব কেন তনু? এই পদটির জন্য তুমি যথেষ্ট যোগ্য। কনফিডেন্স লেভেল হারিয়ে ফেলছ কেন? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইন্টারভিউ দাও। তুমি এমনিই সিলেক্ট হয়ে যাবে।’

‘আমার উপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে মাম্মা। কিন্তু তুমি জানো না, এখন ছোটো ছোটো চাকরির জন্যও বিশাল কম্পিটিশন। তার উপর এদের পে-প্যাকেজটাও তো বেশ ভালো। সুতরাং কম্পিটিটরও অনেক থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে মাম্মা। আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তুমি শুধু আঙ্কলকে একটু বলে রেখো। আমি যাচ্ছি। বাই মাম্মা।’ বলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেল তনু। আজ ওদের পিকনিক না কি যেন একটা আছে।

‘তনু শোন তো… আমি…’ বাকি কথাগুলো গলার মধ্যেই কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। এক তো কিছু শোনার আগেই তনু বেরিয়ে গেল, দ্বিতীয়ত রান্নাঘর থেকে দুটো জাজ্জ্বল্যমান সন্দিগ্ধ চোখ আমাকে যেন বিঁধতে থাকল। মনের মধ্যে ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল চলল। দু-ঠোঁট আর এক করতে পারলাম না। কোনও অপরাধ না করেই, অপরাধীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা হল আমার।

কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একদিকে একমাত্র মেয়ে, অন্যদিকে আমার আদর্শবাদী নিয়মনীতি। যদি মেয়ের পক্ষে যাই, তাহলে বাকি জীবনটা আদর্শচ্যুত হওয়ার অপরাধবোধে ভুগতে হবে, আর যদি মনের কথা শুনি তাহলে, বাড়িতে অশান্তির পারদ চড়তেই থাকবে। যা হবে হবে। স্থির করলাম, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়ব না।

এইভাবেই কেটে গেল আরও তিন-চার দিন। এই ক’দিনের আত্মসংঘর্ষই আমাকে বয়েসের তুলনায় আরও বৃদ্ধা বানিয়ে তুলেছিল। বাড়িতে একটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। হয়তো সুনামির আগের পরিস্থিতির মতোই। পাঁচদিনের দিন কলেজ থেকে ফিরে টিভিটা খুলে বসতেই, সবিতাও চা দেওয়ার বাহানায় মাটিতে বসে পড়ল। ঠিক সেই সময় তনু ছুটে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ও যে কখন দরজা খুলে ঘরে এসেছে কিছুই টের পাইনি।

‘ওহ্ মাম্মা, আমি সিলেক্ট হয়ে গেছি, কালই জয়েন করতে হবে। আমার ফ্রেন্ডসার্কেলে কারওরই হয়নি। আমি তোমাকে বলে ছিলাম না যে জবরদস্ত কম্পিটিশন হবে। তুমি হেল্প না করলে চাকরিটা আমি পেতাম না। লভ ইউ মাম্মা।’

আনন্দে আটখানা হয়ে গলা জড়িয়ে আমাকে আদর করতে থাকে তনু। ঠিক সেই সময় পাশে দাঁড়ানো সবিতার তির্যক চোখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি সত্যিই অসহ্যকর। মুহূর্তেই যেন আকাশ থেকে মাটিতে কেউ ফেলে দিয়ে গেল আমাকে।

‘কী হল চুপ করে আছ কেন মা, কিছু বলো। তুমি না থাকলে তো…।’

‘তুই চাকরি পেয়েছিস তার জন্য আমি ভীষণ খুশি। কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না তনু। তোর চাকরির জন্য আমি কোনও তদবির করিনি। তুই তোর নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছিস।’

কথাটা শুনেই তনু গলাটা ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় একেবারে একহাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কী, তার মানে তুমি আঙ্কেলের সঙ্গে কথাই বলোনি।’ তনু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কিন্তু, কেন মাম্মা? তুমি তোমার মেয়ের জন্য এইটুকুও করতে পারলে না। আজ আমার চাকরিটা হয়েছে তাই, নাহলে! তোমার কাছে তোমার মেয়ের খুশি, ভবিষ্যৎ কিছু নয়? আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোমার আছেটাই বা কে?’

‘শোন্ তনু’

‘কী শুনব?’

‘আমি বরাবরই চেয়ে এসেছি আমার মেয়েও আমার মতো আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচুক। সারাজীবন আমাকে যেমন কারও কাছে মাথা নত করতে হয়নি, তেমনি আমার মেয়েও যেন জীবনে কারওর দ্বারস্থ না হয়। তাছাড়া, আমি যেখানে জানি, আমার মেয়ে যথেষ্ট মেধাবী। তার কারও সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না, তখন কেন?’

‘মেধা? সেটা তো পরের কথা মাম্মা। এখানে তো নিজের সবথেকে কাছের মানুষের উপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠতে বসেছে। সত্যিটা স্বীকার করো না, যে তুমি তোমার আদর্শবাদী নীতির জন্য তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে রাজি। ছিঃ মাম্মা! তুমি এত স্বার্থপর? নিজের সন্তুষ্টির জন্য…’

‘আমি স্বার্থপর?’

‘এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কী বলতে পারো? আমি এতদিন ভাবতাম পাপা নেই তো কী হয়েছে, আমার মা-ই আমার সব। কিন্তু আজ তোমার আদর্শের এই নাটুকেপনায় আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে।’ রেগেমেগে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটাও যেন বনবন করে ঘুরছে। কোনওরকমে সোফাটা ধরে বসে পড়লাম।

মিনিট পাঁচেক পরে একটু ধাতস্থ হলাম। চোখ খুলেই দেখি সবিতা কোমর বেঁধে একেবারে রেডি। আমি কিছু বলার আগেই সে বেশ দাপটের সঙ্গে বলতে থাকে, ‘আমি অশিক্ষিত, গাঁয়ের লোক আছি বটে, কিন্তু তোমাদের মা-মেয়ের এই নাটক খুব বুঝতে পারছি। আমরা ছোটো জাতের গরিব লোক বলে, সবাই আমাদের সঙ্গে এমনই ব্যবহার করে। আমারই বোঝা উচিত ছিল! মেয়ের জন্য সুপারিশ করতে একটুও বাধল না তোমার? রক্তের সম্পর্ক যে! যত আদর্শ, সিদ্ধান্ত সবই আমাদের মতো গরিব লোকেদের জন্য। বেচারা ভাই আমার, কোন মুখে যে গাঁয়ে ফিরবে! এসব তোমাকেই বা বলছি কেন, এসবে তোমার কী-ই বা যায় আসে। তোমরা তো আনন্দেই আছ না।’

এই অতর্কিত ঘটনায় উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছি। বুঝতেই পারলাম না কীভাবে এক কল্পিত নাটকের চরিত্র হয়ে গেলাম আমি। আমার আত্মজ থেকে পরিচারিকা, সবার কাছেই অবিশ্বাসের পাত্রী হয়ে উঠেছি। ‘ঘুষ নেওয়া, তদবির করা অর্থাৎ যা কিছু-কে চরম অসম্মানের বলে যেনে এসেছি এতকাল, তা-ই আজ আমার জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করছে। চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। তনু, সবিতা, ওই অচেনা লোকগুলো আঙুল তুলে কী যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে। কোনও কিছু কানে ঢুকছে না আমার। বাবার উদাত্ত গলায় ফিরে ফিরে আসছে কবিতার লাইনগুলো… চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত সেথা গৃহের প্রাচীর…’।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...