নকশা করা বড়ো আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মেঘমালা। আজকাল ঘুরেফিরে প্রায়ই সে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দ্যাখে। চুলে পাক আগেই ধরেছিল, এখন মুখের চামড়াও কেমন যেন কুঁচকে যাচ্ছে। চোখের নীচে কালি। কপালে বলিরেখা বড়ো বিসদৃশ্।

তাহলে কি বুড়ি হয়ে যাচ্ছে মেঘমালা? বয়সের ভার তাকে গ্রাস করছে! এক ঢাল কালো চুল ছিল পিঠময়। বড়ো বড়ো ডাগর দুটো চোখ। মায়াময় ঢলো ঢলো মুখ। বাবা আদর করে নাম রেখেছিল, মেঘমালা। রূপ যেন তার ঐশ্বর্য ছিল। রাস্তায় মায়ের সঙ্গে যখন কোথাও যেত, চেনাজানা কারও সঙ্গে দেখা হলে থুতনি টিপে বলত, সুমনা, তোমার মেয়েতো পরির মতো দেখতে, সামলে রেখো।

 

বাবার পেশা, নেশা দু-ই ছিল থিয়েটার। ছুটির দিন থাকলে মেঘমালাও বাবার সঙ্গে যেত শো দেখতে। শো না থাকলে মহলাঘরে গিয়ে বসে থাকত। খুঁটিয়ে দেখত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কেমন করে হাঁটছে, ডায়লগ না থাকলে কে কোথায় কেমন ভাবে দাঁড়াচ্ছে। কান পেতে শুনত তারা কেমন ভাবে পার্ট বলছে। গলার স্বর কখন চড়ায় তুলছে, আবার কখন খাদে নামাচ্ছে। অর্থাৎ সে মনে মনে থিয়েটারের পাঠ নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই পাঠ যে এত তাড়াতাড়ি কাজে লাগবে তা বুঝে উঠতে পারেনি।

অকস্মাৎ একদিন শো করতে গিয়ে বাবার হার্ট অ্যাটাক হল। বাড়ি ফেরা আর হল না। হাসপাতালেই সব শেষ। গ্রুপের সকলের সাহায্যে বাবার শেষ কাজ করে যখন শ্মশান থেকে মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছিল, দ্যাখে মা বাজপড়া তালগাছের মতো গ্রিল ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে, চোখে শূন্য দৃষ্টি। এতক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিল, আর পারল না। মাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে।

বাবা সম্বল বলতে বেশি কিছু রেখে যেতে পারেনি। অগত্যা অসহায় মা আর নিজেকে বাঁচাতে বাবার ছেড়ে যাওয়া থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরল মেঘমালা। অল্প দিনেই নাম হল বেশ। রূপের জোরে সিনেমাতেও চান্স পেল। তারপর আর ফিরে তাকায়নি সে। এক এক করে অনেকগুলো সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গে না উঠলেও, প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেই গিয়েছিল। সব তার এই রূপের জোরে।

 

কিন্তু সেই রূপেই এখন ভাটা। মেনে নিতে পারছে না মেঘমালা। মধ্যবয়স অতিক্রান্ত। সিনেমার কাজ কমছে দিনকে দিন। থিয়েটারেও আজকাল আর দম পায় না। লোকে এখন খল নায়িকার চরিত্র অফার করে- যা তার না-পসন্দ!

শাড়ির আঁচল দিয়ে বড়ো আয়নাটার কাচ একবার মুছল সে। তারপর আর একবার। চোখের পাওয়ারটা কি বাড়ল? টেবিলে রাখা চশমাটা তুলে চোখে পরে নিল। না, সেই সাদা চুল, চোখের নীচে কালি। কপালে বলিরেখা। ছিটকে সরে এল আয়না থেকে। বিছানার একপাশে বসে আঁচল দিয়ে কপাল আর গলার কাছের ঘাম মুছল। বুকের মধ্যে একটা ভয় তির তির করে কাঁপছে। তাহলে কি শেষ হয়ে যাবে এক সময়ের নামকরা অভিনেত্রী মেঘমালা!

কিছুক্ষণ বিছানায় বসে আবার উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজেকে খুঁটিয়ে দেখার আগেই, মেয়ে অলি ঘরে ঢুকল। কিছুক্ষণ মাকে দেখল।

আবার? আবার তুমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলে মা? তোমাকে না ডাক্তারবাবু বারণ করেছেন। কেন তুমি কথা শোনো না?

অসহায় ভাবে মেয়ের দিকে তাকাল মেঘমালা। কী যেন হারিয়ে ফেলছে দিন দিন। মেয়েকে বোঝাতে পারছে না তার কষ্টের কথা, এই নিঃস্বতার কথা!

না রে! চোখে কী পড়েছিল, তাই দেখছিলাম।

ঝাঁঝিয়ে ওঠে অলি। তাই দেখছিলে? আমি বুঝি জানি না তুমি কী দেখছিলে? আমাকে বোকা পেয়েছ?

কেমন অসহায় ভাবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে মেঘমালা।

অলি এগিয়ে এসে মাকে বিছানায় নিয়ে বসায়।

শোনো মা, বয়স সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলে। তাকে আমরা আটকাতে পারি না। তাই রূপযৌবন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক। তুমি কেন মিছিমিছি কষ্ট পাচ্ছ? মেনে নাও। নাহলে তোমার মন খারাপ হবে, ডিপ্রেশন চেপে ধরবে আর তার থেকে কঠিন অসুখে পড়বে।

একটু থেমে অলি আবার বলল, যদি তুমি আমার কথা না শোনো, তাহলে আমি আয়নাটা তোমার ঘর থেকে সরিয়ে দেব।

না, না, সেটা করিস না।

বই পড়ো, টিভি দ্যাখো, নাহলে গান শোনো। কিন্তু ওই ঘুরে-ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়ানো চলবে না। সব থেকে ভালো হয়, যা রোল পাচ্ছ নিয়ে নাও। তাতে মন ভালো থাকবে, শরীরও।

না, ওসব খারাপ রোল আমি করব না। ঠিক আছে, আমি আর ওই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াব না। তুই অফিস যা।

 

বিয়ে করেনি মেঘমালা। সিনেমা, থিয়েটার, পার্টি, প্রমোশন, বাড়ি ফিরে বৃদ্ধা মাকে দেখাশোনা, এই নিয়ে কাটছিল জীবন। মায়ের মৃত্যুর পর কেমন ফাঁকা হয়ে গেল সবকিছু। সারা বাড়িটা খাঁ-খাঁ করে তাকে গিলতে আসত। একটা সঙ্গের খুব দরকার হয়ে পড়ল। আর তখনই সে সিদ্ধান্ত নিল দত্তক নেবে ছোট্ট একটি মেয়েকে। তাকে নিয়ে সময় কাটবে। পরিচিত এক প্রোডিউসারকে বলতে, তিনিই সব ব্যবস্থা করে দিলেন। ঘরে এল চার বছরের অলি। মায়ের মনও ভরল আর শূন্য বাড়িটা ভরে উঠল কলকাকলিতে।

সেই অলি আজ কত্ত বড়ো হয়েছে। এমবিএ করে চাকরি করছে। মেঘমালার একমাত্র আশ্রয়। মেয়েকে বলেছিল, লেখাপড়া করেছ ঠিক আছে। আবার চাকরি কেন? আমার যা আছে দুজনের ভালো ভাবে চলে যাবে।

তা হোক, তবু নিজের একটা আইডেন্টিটি চাই মা। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। যেমন তুমি একজন অভিনেত্রী।

মেয়ের যুক্তি মেনে নিয়েছিল মেঘমালা।

সেদিনই অফিস ফেরতা ডাক্তারবাবুর চেম্বারে গিয়েছিল অলি। সব শুনে উনি বললেন, আসলে ডিপ্রেশনটা খুব চেপে ধরেছে ওনাকে। ঘুম কম হচ্ছে। নার্ভের ওষুধটা ঠিক মতো বোধহয় কাজ করছে না। আপনাকে একটা সাজেশন দিই, কিছুদিন অফিস ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরিয়ে আনুন মাকে।

অফিসে কাজের চাপে অলি হিমসিম খাচ্ছিল। যাই যাই করেও মাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছিল না। এর মধ্যে একদিন প্রেজেনটেশনে ব্যস্ত ছিল, তার মধ্যে মাকে সর্বক্ষণ দ্যাখে যে-সেই সরলামাসি, ফোন করল।

দিদি, তুমি এক্ষুনি বাড়ি চলে এসো। ম্যাডাম কেমন করছে! আমি সামলাতে পারছি না ! সব ভেঙেচুরে…

সরলামাসির গলায় ভয়। অলি গাড়ি নিয়ে পড়িমড়ি করে ছুটল। আসার পথে ডাক্তারবাবুকে ফোন করে বাড়ি আসতে বলল।

দিয়েছি, শয়তানিটাকে ভেঙে দিয়েছি। বাজে, কী বিচ্ছিরি! আমাকে খারাপ দেখায়। ওকে আর রাখব না।

বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে অলি শুনল মায়ের গলা। ঘরে ঢুকে দেখে, পিতলের ফুলদানি ছুড়ে ছুড়ে নকশা করা বড়ো আয়নাটাকে মা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। হাতের কাছে আর যা কিছু ছিল সব ছুড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন আক্রোশ মিটিয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে বসে তখনও ফুঁসছে মেঘমালা। শুধু সরলামাসি কোনওক্রমে চেপে ধরে আছে। না হলে আরও যে কী অঘটন ঘটত!

কিন্তু অঘটন আটকানো গেল না। অলি এখন মাকে নিয়ে একটি মেন্টাল অ্যাসাইলামের পথে। মেঘমালা দুচোখে শূন্যতা নিয়ে গাড়ির বাইরে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চেতন-অবচেতন জুড়ে এখন, একটা বড়ো প্রমাণ সাইজের আয়না দোল খাচ্ছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...