‘একটা চতুষ্কোণ মাটি দরকার, বুঝলেন?’ নীলাভ মাংকি-ক্যাপটাকে কপালের নীচে আকর্ষণ করল। অসম্ভব ঠান্ডা পড়েছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া, মর্নিংওয়াক শব্দটায় যতটা আরাম এবং স্বাস্থ্যচর্চা মিশে আছে, বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলে। এই হাত, পা, এই শরীর এতটাই জড় যে, সামান্য নড়াচড়াও ভীতিকর। মানস হাতের রুপো বাঁধানো লাঠিটা জোরে ঠুকল মাটিতে, ‘কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে।’
‘আসলে, ভাবছি। ক’দিন যাবৎ একটা কথাই ভাবছি’ নীলাভ মানসের চোখের দিকে তাকায় ‘একটা বাড়ি করতে পারিনি এখনও! আমার একটু মাটি চাই। দেড়-দুকাঠা হলেও হবে। খোঁজ আছে নাকি?’
‘বাড়ি? সাতকুলে কেউ নেই আপনার, বাড়ি করবেন কার জন্য?’
মানস থমকে গেল।‘আমার জন্যই। একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছি। খুব লোভ হচ্ছে জানেন! ভাবতেও ভালো লাগে! নিজের বাড়ি!’ নীলাভ অপ্রস্তুত হাসি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।
মানস হেসে ফেলে। ‘এটা আবার ব্যাপার নাকি? হয়ে যাবে। ঠিক আছে। জানা রইল।’ মানস ভিজে ঘাসের উপর ফের লাঠি ঠুকল। শব্দ হল না। ভেজা মাটি কোনও শব্দ করে না। লাঠিটা দেখতে দেখতে বাস্তবের মাটিতে পা রাখছিল নীলাভ– ‘আচ্ছা! আজ দেখছি লেঠেল হয়ে বেরিয়েছেন! শখ?নাকি প্রয়োজন?’‘আরে, প্রয়োজন ছাড়া কি আর…! বুড়ো হতে কার ভালো লাগে বলুন? ক’দিন ধরেই যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে। তো, গিন্নি লাঠিটা এগিয়ে দিলেন, সঙ্গে রাখো। আরাম হবে। দেখছি কথাটা মিথ্যে নয়। আসলে, ভারটা অন্যের উপর রাখলে স্বস্তি মেলে।’ মানসের হাসি দেখতে দেখতে নীলাভর ঠোঁটও প্রসারিত হতে থাকে। স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর আগেই অবশ্য থেমে যায় নীলাভ। সত্যিই কি বার্ধক্য এসে গেছে? তাই কি চট করে ঠান্ডা লেগে যায়?
‘সব কিছু পালটে গেল কীরকম। এই শহরে তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। যখন এসেছিলাম চব্বিশ পঁচিশের টগবগে ঘোড়া!’ নীলাভ কুয়াশার ভেতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে।
‘আমি যে পাঁচবছর ধরে আছি, আমারই তাই মনে হয়। পড়শি পর্যন্ত পালটে যায় মশাই। শহর একেই বলে।’ হা-হা শব্দে হাসে মানস। নীলাভ মনে মনে হাসে। মানস ভাড়াটের কথা বলছে। পাঁচ বছরের মধ্যে বাড়ি বানিয়েছে। ভাড়াটে বসিয়েছে। সারাদিন খ্যাঁচম্যাচ্! ধুর! নিজের বাড়িতে নিজের সঙ্গে বাস করার আনন্দ বুঝবে না মানস। বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থের যা সম্পর্ক, ভাষার সঙ্গে বর্ণমালার সেই সম্পর্ক।
মানসের হাসির শব্দে জগিং-এ ব্যস্ত তরুণী চমকে তাকাল। দু-একজন স্বাস্থ্য অন্বেষণকারী ওঁদের দেখছে বুঝে লজ্জিত হয় নীলাভ– ‘আস্তে! আস্তে!’
‘ওঃ! ভাষার সঙ্গে বর্ণমালা আর গৃহস্থের সঙ্গে বাড়ি? দারুণ!’
‘কথাটা চুরি করেছি। গণিতশাস্ত্রবিদ ইউক্লিডের কথা এটা। অবশ্য একটু অন্যভাবে বলা।
‘তো, কী বলছিলেন? গৃহস্থ আর বর্ণমালা…?’
নীলাভ হাসল। ‘দেখুন, এসব তত্ত্বের জন্য যুক্তিতর্ক দরকার হয় না। একে স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিতে পারেন। সত্য বলে ভাববেন।’
‘না না! তা বলছি না। তবে, কথাটা বেশ।’ মানস লাঠিখানা মাটির উপর থেকে তুলে নেয়। নীলাভ একটু দাঁড়াল। ইদানীং হাঁপ ধরে যাচ্ছে সহজেই। দুপাক হাঁটতেই মাঠটাকে বিশাল এবং ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে। যেন বিরাট শূন্যতা গিলে খেতে আসছে। যেন হারিয়ে যাবে নীলাভ এই মহাশূন্যতায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কেন পালটে যাচ্ছে শরীর, বা কেন মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তার কোনও যুক্তিতর্ক নেই। প্রশ্ন নেই। এসব হল স্বতঃসিদ্ধ।। এলিমেন্টস নামক বইতে ইউক্লিড একথা বলেছেন।
মানস গিন্নির দেওয়া লাঠিখানাকে ফের ভেজা মাটির উপর বসিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। একটা লাঠি তো নীলাভরও দরকার ছিল। কিন্তু কে এগিয়ে দেবে সেই স্বস্তি-দণ্ড? মানস জানে সাতকুলে কেউ নেই নীলাভর। যদি থাকত, তবে এই কুয়াশাভরা মাঠে রুপোর লাঠি আজ নীলাভর হাতেও থাকত।
এখনও কুয়াশা ছড়িয়ে আছে মাঠ জুড়ে। দূরে দূরে দু-একটা ধোঁয়ামূর্তি নজরে আসে। শুদ্ধ বাতাস শহরে নেই। চারপাশে কি কুয়াশা? নাকি ধোঁয়াশা?
‘আজ মেয়ে-জামাই আসছে গোরখপুর থেকে। ওখান থেকে নেপালে গেছিল। মায়ের জন্য নানাবিধ গিফ্ট আসছে। ওর মা-তো গত কাল থেকেই টেনশনে… কী আনবে ওরা…!’ মানসের সুখী মুখে লালচে গোলাপ ফুটেছে। এই তো জীবন! সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা। মানস হাসিহাসি মুখ করে, ‘গিন্নি বায়না ধরেছেন জামাইকে মালাই চিংড়ি খাওয়াবেন। নারগিসি কোফতা বানাবেন! হই হই কান্ড। বুঝেছেন?’
বুঝল নীলাভ। মানস এখন ফিরতে চাইছে। কাজ আছে বাড়িতে। ফিরে আসতে গিয়ে শর্টকাট করতে চাচ্ছিল মানস। নীলাভ কথাবার্তায় ভুলিয়ে সোজাপথে নিয়ে এল মানসকে। শর্টকাট অপছন্দ নয়। তবে, ওই পথটা বড়ো কঠিন পথ। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। মাস ছয়েক আগে একদিন অবশ্য গেছিল। আজ আর গেল না। একদিন গেলে কদিন যাবৎ অস্বস্তিটা জাপটে থাকে শরীর-মনে। বড্ড কষ্ট হয়। ভয় হয়। যেন স্বপ্নে দেখা নিঃসঙ্গ পথ। আলো নেই। আশ্রয় নেই। শূন্যতা কেবল। ভালো লাগে না। আবার, ভুলেও থাকা যায় না।
বাজারের রাস্তা ধরল মানস। বাজার ছাড়িয়ে ডানদিকের সরু গলিতে ঢুকে পড়ল নীলাভ। এবার শর্টকাট। তার আস্তানাটা আবার কাছে নয়। সোজাপথে সময় লাগবে।
বাসার কাছাকাছি আসতেই সীমন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেসবাড়ির মেস-ম্যানেজার সে-ই। বাজার সেরে ফিরছে। নীলাভকে দেখে দাঁড়াল। ‘নীলাভদা যে! আজ বিফোর টাইমে!’
হাসে নীলাভ। ‘কী আনলে। কী মাছ?’
‘মাছ নয়। মাংস। সবাই ধরে বসল।’
‘কেন? কোনও ব্যাপার আছে বুঝি?’
‘না, মানে ওই আর কী…!’ সীমন্ত এদিক-ওদিক তাকায়।
ছেলেটা স্পষ্ট হল না। অথচ ভেতরে একটা কথা আছে ঠিক। বেশ। খেতে বসে জানা যাবে।
বারান্দায় টিনের চেয়ার টেনে বসল নীলাভ। কাগজফুল গাছে অনেক ফুল ফুটেছে। আসলে বোগেনভিলিয়া। তারা ছেলেবেলায় কাগজফুল বলেই জানত। এমন প্রাণময় গাছটার এমন একটা জড় নাম কেন ছিল? লিপ্তা বলেছিল, এই ফুলে পুজো হয় না। কেন হয় না? লিপ্তা জবাব দিতে পারেনি। অবশ্য অনেক কথারই জবাব দিতে পারেনি লিপ্তা। কখনও পারেনি। ভরাট ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। যুগলপ্রসাদ রোদে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। ছেলেটা চমৎকার বাংলা বলে। মাঝে মধ্যে তৎসম শব্দও ব্যবহার করে। ডাকল নীলাভ ‘এই যে যুগল!
ঠান্ডা কীরকম?’
‘ঠান্ডা?’ যুগল পেছন ফিরে তাকাল ‘উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। আর কদিন পর শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে।’
কিছু বলতে মুখ খুলেছে নীলাভ, দীপংকর চ্যাঁচাল– ‘খাবার রেডি। ফটাফট এসে পড়ুন সবাই।’
খেতে বসে আসল কথাটা জানা গেল। সীমন্তর ছেলে হয়েছে। আজই। সকালে ফোন এসেছে। আগামিকাল সীমন্ত যাচ্ছে বালুরঘাটে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেকে দেখতে।
খুশি হওয়ারই কথা। খুশিই হল নীলাভ। সীমন্তর চনমনে মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। বারান্দায় কে জল ফেলে রেখেছে। পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। যে-যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একমাত্র ওর কোনও কাজ নেই। ধীরেসুস্থে স্নান সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসবে। কাগজফুল গাছটা বাতাসে ফুলপাতা দুলিয়ে চলেছে খসখস শব্দে। যেন বই-এর পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে নিজে থেকে। কত ঘটনা কত মিলন-বিচ্ছেদের কাহিনি লেখা আছে সেইসব পৃষ্ঠায়।
আজ সবাই খুশি। সীমন্তর ছেলে এল। মানসের মেয়ে-জামাই এল। চিংড়ি রেঁধেছে মানসের বউ। স্বাভাবিক। খুশি হওয়ারই কথা। একটা জ্যামিতিক কোণ পুরো হল।
বাইকের শব্দে চটকা ভেঙে গেল। যুগলপ্রসাদ অফিসে গেল। দিবাকর সাইকেল বের করে আনছে বারান্দায়। ভূদেবের অফিস কাছেই। জিৎ, দেবনাথ ব্যাগ ঝুলিয়ে মেট্রো ধরতে দৌড়োচ্ছে। এই লোকটা কখনও হাসে না। ঠিক এইরকম একটা স্কুটার ছিল নীলাভর। এটা কার? সজীবের। সজীব স্কুটার ঠেলে নামাচ্ছে। নীলাভ হাটবাজার, অফিস… সর্বত্র স্কুটার নিয়ে চলত। অবশ্য লিপ্তা ছিল। পিছনে বসে জাপটে ধরে থাকত। জীবনটা বেহিসেবি হয়ে গেল নীলাভর! হিসেব করে চলতে শেখা হল না!’
অন্যদিন সন্ধে রাতে শুয়ে পড়ে। আজ ইচ্ছে হল না। নানা ভাবনায় মাথাটা গরম। প্রেশারটা চেকআপ করাতে হবে। একটু শুয়ে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে। নাঃ! বসে থাকাই ভালো। অস্থির নীলাভ ফের শুয়ে পড়ে। কে ডাকে? অর্ণব স্যার? চার পাঁচজন ছেলেকে ডেকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কী বোঝাচ্ছে?
‘দ্যাখ, একটা সরলরেখা অন্য দুটো সরলরেখাকে ছেদ করলে, একপাশের দুই কোণের সমষ্টি যদি একশো আশি ডিগ্রির কম হয়, তাহলে সরলরেখা দুটোকে দুই পাশে বাড়ালে কোথাও না কোথাও মিলবেই।’ চক দিয়ে খসখস শব্দে সরলরেখা টানে অর্ণব স্যার! সেই শব্দে চোখ মেলে তাকায় নীলাভ। স্বপ্ন দেখছিল! আর ঘুম হবে না। উঠে জল খেল নীলাভ। কনকনে ঠান্ডাজল গলা কেটে ফেলল ধারালো অস্ত্রের মতো। মধুমিতা ঠান্ডা জল খেতে দিত না। ফ্লাস্ক রাখত টেবিলে। গরম জলের ফ্লাস্ক। কিন্তু এতদিন পর ছেলেবেলার স্যার কেন এল স্বপ্নের ভেতর? কী শেখাল এতক্ষণ ধরে? কেন বলল না নীলাভর জীবনের খামতির কথাটা? কেন নীলাভর জীবনের দুটো কোণের সমষ্টি একশো আশি ডিগ্রি হয়নি? একটা চতুষ্কোণ মাটি পাওয়া হল না। তার ভিতরে ঘর। তার ভিতরে সংসার। মধুমিতাও কি এভাবেই ভাবে? হয়তো ভাবে, হয়তো ভাবে না। সে তো সাহিত্যের ছাত্রী! একটু নরম, একটু লাজুক। স্কুটারের পেছনে বসতে ভয় পেত। মুকুন্দপুরে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিল। সিল্কের শাড়ি পিছলে মধুমিতা…! লজ্জায় কেঁদে ফেলেছিল। বন্ধুর বউ বকুনি দিয়েছিল। ‘বউ পড়ে গেল, আপনি হাসছেন?’
বাড়িতে ফিরেও রাগ পড়েনি মধুমিতার। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল সে রাতে। মধুমিতা বিরহের গান গেয়েছিল। ভালো গাইত ও। নীলাভ চেয়েছিল মধু গানের চর্চা রাখুক। ভালো গাইত।
দু-চারজন ছাত্রীও জুটে গেল। সে সময়ই এল লিপ্তা।
গাঢ় অন্ধকারের দিকে জোনাকি খুঁজল নীলাভ। টর্চটা কোথায়? এত অন্ধকার কেন? আজ কি অমাবস্যা? এই যে টর্চ…! লিপ্তার চটক ছিল। স্মার্টনেসও। গুছিয়ে শাড়ি পরত লং কোটের সঙ্গে। মনে মনে কি এমনই একটা অন্বেষণ ছিল? নিজের মনকে বুঝতে পারেনি নীলাভ!
চোখ বুজে ফেলল। ভালো লাগছে না। বরং বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে ভালো লাগবে। …নাঃ! খুব ঠান্ডা বাইরে। অসুখ হলে কে দেখবে? অথচ প্রবল ঠান্ডা বলে কিস্যু ছিল না। আগুন জ্বলত শরীর-মনে। দাউদাউ আগুন। লিপ্তার হাজব্যান্ড তখন চণ্ডীগড়ে। কোয়ার্টার পায়নি। টু বিএইচকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চার বন্ধু থাকত। লিপ্তাকে সেখানে নেওয়ার সুবিধে ছিল না। এদিকে লিপ্তার তখন অখন্ড অবসর। গান শিখতে আসত মধুমিতার কাছে। আর নীলাভ? কী করে যেন সব ভুলে যেতে থাকল। এমনকী গোল্ডিকেও!
মধুমিতা যখন সব বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে মুক্তির সন্ধান করছে নীলাভ। মধুমিতার হাত থেকে মুক্তি। প্রথম প্রথম ঝগড়াঝাঁটি। তারপর স্পষ্টভাষায় মুক্তি চাইল নীলাভ। লিপ্তাকে ছাড়া ওর আর পৃথিবী বলতে কিছুই কি ছিল?
উঃ! কী মশা বাইরে! নীলাভ ফের মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে। কখন ভোর হবে।… স্তব্ধ হয়ে গেছিল মধুমিতা। তারপর জড়তা ভেঙেছিল। ‘মুক্তি চাইছ যখন, যাও। একদিন বুঝবে কত কঠিন কাজ করলে আজ। কিন্তু আরও কঠিন কাজ রয়ে গেল। আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না।’
ইচ্ছেও ছিল না ফিরে আসার। বাড়িটা তো মধুমিতার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সে বাড়ি কখনও নীলাভর ছিল না। খোলামেজাজে বেরিয়ে এসেছিল। মুক্তি! আবার বাঁধা পড়ার জন্য মুক্ত!
মাত্র সাতদিন আগেই শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে লিপ্তার পছন্দমতো জাংক জুয়েলারি সেট কিনে দিয়েছিল নীলাভ। ফেডেড জিন্সের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছিল লিপ্তাকে।
‘একি? ঘুমোননি এখনও?’ দিবাকর বাথরুমে যাচ্ছে।
‘ক’টা বাজল দিবাকর?’
‘মর্নিং ওয়াক? দেরি আছে। সবে আড়াইটে। ঘুমোন।’
বাথরুমে জলের শব্দ। ছলছল শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। এভাবে বয়ে গেল একটা জীবন। মধুমিতা কখনও কিছু দাবি করেনি। ওর এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানের সন্ধান আগে পায়নি নীলাভ। বুঝতেই পারেনি। এখনও কি মধু আগের মতই আছে? আর লিপ্তা? ভয় পেয়ে গেছিল নীলাভর পাগলামিতে। অথচ বুঝতে দেয়নি। বর চণ্ডীগড়ে নাকি ফ্ল্যাট কিনেছে। লিপ্তা চলে গেল সংসারের খোঁজে। সেই চতুষ্কোণ মাটির গল্প। নাকি নীলাভকে বিশ্বাস করতে পারেনি? যে লোক অতি সহজে চতুষ্কোণ মাটি ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসতে পারে তাকে বিশ্বাস করেনি লিপ্তা। মানস কী যেন বলছিল? সাতকুলে কেউ নেই, মাটি দিয়ে কী করবে? সত্যি! কী করবে তুমি? কে থাকবে তোমার মাটিতে? বৃত্তাকার ঘেরাটোপে তুমি এক স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গ সত্তা নীলাভ!
ওফ্! এত মশা! মশারির গায়ে আটকে গুনগুন করে চলেছে। ওর দিকে আঙুল তুলছে মশারা। অভিযোগের বাণ ছুড়ছে! মাথা ধরে যায়!
শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল নীলাভ। মানস ডাকতে এসেছে। উঠে গরম পোশাক চাপিয়ে কুয়াশার ভেতরে নেমে গেল ওরা। বকবক করছিল মানস।
‘নাতনিটি বুঝলেন, পাকা দি গ্রেট। পটপট কথা বলে। খুদে ঠাকুমা। বলে, একা একা বের হবে না কিন্তু। পড়ে গেলে কে ধরবে? ভাবুন!’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসে মানস। সেই হাসিতে সুখের গন্ধ ওড়ে।
মানস জোরে হাঁটতে পছন্দ করে। পায়ের যন্ত্রণাটা হয়তো নেই। আজ তো লাঠিও আনেনি। নীলাভ তাল রাখতে পারছিল না। শরীর বশে নেই। হাঁটু যেন ভেঙে পড়ছে।
‘শরীর ভালো নয় নাকি? চলুন, ফিরে যাই। আমার বাড়ি চলুন। গরম চা হয়ে যাবে এক রাউন্ড।’
না। আর কেন। লোভ হয় ঠিকই। কিন্তু সামলাতে জানতে হয়। সেটা জানা ছিল না বলেই হয়তো জ্যামিতিটা সম্পূর্ণ হল না। মানস বার তিনেক কথা চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু নীলাভর তরফ থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে নীরব হয়ে গেল। ধীর পায়ে হাঁটছিল নীলাভ। মানস অবাক হল। নীলাভ আজ সোজা পথ ধরছে না। শর্টকাট করবে নাকি? গতকালও যেতে চায়নি। আজ নিজে থেকে….? কিছু বলছিল মানস। নীলাভ শুনতে পায়নি। বিষম উত্তেজনায় ধড়ফড় করছিল বুক। কেন যাচ্ছে এপথে? অদৃশ্য এক সুতো যেন প্রবল আকর্ষণে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ছ-মাস আগে একবার এই রাস্তায় ঢুকেছিল। তাকাতে পারেনি। আজ তাকাবে। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখবে।
বাড়ির চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেছে! দোতলাই আছে অবশ্য। গোল্ডিকে দেখেছে একদিন। সঙ্গে গোল্ডির বউ ছিল। কেনাকাটা করছিল। মধু এখন শাশুড়ি। ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে মধুমিতা সুখী? সবটাই হল মানিয়ে নেওয়া। সুখ তো সোজা পথেই আসে। শর্টকাটে তাকে পাওয়া যায় না।
‘কী ভাবছেন?’
‘কিছু বললেন?’
‘বলছি, এসব জায়গায় কত বাড়ি উঠেছে। ক’মাস আগেও ফাঁকা ছিল। প্রোমোটর-রাজ শুরু হয়ে গেছে।’
ঠিক। ফাঁকা ছিল এদিকটা। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা দেখা যেত। পাড়ার দোকানি, পাশের বাড়ির বকুল, পলাশ… চিনে ফেলবে কি নীলাভকে? কেন চিনবে না? নিশ্চয়ই ওরা দেখেছে ওকে। একই জায়গায় যখন বসবাস!
‘মশাই, প্রোমোটররা যা সব হয়েছে…’ মানস বকবক চালিয়ে যাচ্ছে।
এক ঝলকের জন্য তাকাল নীলাভ! বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে যেতে যেতে একবার চোখ তুলল ও। কেউ কি ছিল জানলায়? পর্দাটা নড়ছে না? না। কেউ নেই! কাকে আশা করেছিল নীলাভ!
‘ওই বাড়িটা’ আঙুল তুলে দেখাল নীলাভ ‘ওই যে হলদে… দোতলা বাড়িটা… ওই বাড়িতে… আমার…!’
‘রিলেটিভ? চেনা লোক?’
রিলেটিভ? কি জানি! রিলেশন না থাকলে রিলেটিভ হয়? বলা যায়? নীলাভ আঙুলটা নামাতে ভুলে যায়।
‘আগে সাদা রং ছিল। হাতির দাঁতের মতো রং। দোতলার বারান্দায় জাফরি ছিল।’
‘ও।’
‘ছেলেটা খুব ছোটো তখন। বছর পাঁচেক। খুব হাসত। একটা দাঁত পড়েছিল। ফোকলা। বললে বিশ্বাস করবেন না কোলে নিলে কাঁধের কাছটা লালা ফেলে ফেলে ভিজিয়ে দিত।’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসতে থাকে নীলাভ। এই ঘটনার মধ্যে অবিশ্বাস্য ব্যাপারের অন্বেষণ করতে নীলাভর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় মানস।
‘এত পরিচিত যখন, গেলেই পারেন, সময়ও কাটে।’ গলায় মাফলার জড়াতে জড়াতে পরামর্শ দেয় মানস।
‘যাব? যাওয়া যায়?’ ভীষণ বিস্ময়ে মানসকে দেখে নীলাভ। মধুমিতা বলেছিল এ কাজটা আরও কঠিন। সত্যি কথা। গেট খুলে ডোরবেলে আঙুল রাখা যাবে? কে খুলবে দরজা? কে দাঁড়াবে দরজা খুলে? গোল্ডি? গোল্ডির বউ? নাকি…
কে যেন বলেছিল শূণ্যস্থানে কোনও বস্তু থাকলে তা তার চারপাশের জায়গাটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। বাঁকিয়ে দেয়। কোথায় যাবে নীলাভ? ওর জন্য কোনও সহজ পথ নেই। কোনও সরলরেখা নেই। সবটাই বক্ররেখা! কতদিন শূণ্যস্থানে থাকবে নীলাভ? চারপাশ যে দুমড়ে মুচড়ে গেল! কেন এত দেরি হল সবকিছু বুঝতে? অর্ণব স্যার তো কবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝেও ছিল। কিন্তু বুঝেছিল কি সত্যি? তাহলে প্রয়োগ করতে পারেনি কেন? কেন লিপ্তার দিকে অমন প্রবলবেগে ভেসে যাচ্ছিল ও?
হঠাৎই শীত করে ওঠে নীলাভর। এতক্ষণে যেন টের পেল শীতকাল এসে গেছে! জল বরফ হয়ে যাচ্ছে! প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে দুঃসহ ভীতি এসে হাত পা নখ বের করে তাড়া করে। বিশাল ফাঁকা মাঠ হুহু শূণ্যতার মধ্যে টেনে নিতে থাকে নীলাভকে।
মানস কিছু বলছিল। শুনতে পেল না নীলাভ।
মানসের পাশে পাশে হেঁটে যায় এক উদ্বাস্তু। একা নিঃসঙ্গ!