তিলকে তাল করা ঋষভের বহুদিনের অভ্যেস। বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকের সামনে বড়ো গলা করে পণের প্রস্তাবটা মেনে না নিলে…। দুই হাত পিছনে করে ব্রায়ের হুক খুলতে খুলতে স্বামীর কথা ভাবে দোলন। লোকটা ওর দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। কসাইয়ের দোকানের বাইরে যেমন অপেক্ষা করে থাকে রাস্তার কুকুরের দল।

তোমার বাবাকে একটু হেল্প করতে বলো না।

এলআইসি ভেঙে, অফিসে অ্যাডভান্স নিয়ে যখন পণের পুরো টাকাটা জোগাড় হল না, তখন এক রাতে দোলনের বুকে হাত রেখে বলেছিল ঋষভ।

বাবা! বাবা কোথায় পাবে? একে তো রিটায়ার করেছে অনেকদিন। তারপর দুমাস আগেই ফ্রিজ কিনে দিল।

ঝাঁঝিয়ে ওঠে দোলন। বিয়ে হয়েছে তাও বছর তিনেক হয়ে গেছে। সংসারে প্রয়োজন বলেই একটা চাকরিও করছে সে। কিন্তু তা যত্সামান্যই। আপদে-বিপদে বাবাই সাহায্য করে থাকেন। প্রায় ডুবতে বসা নাবিকের মতো ঋষভ তখন খড়কুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে।

তবে তোমার বস-কে বলো। উনি তো তোমায় খুব ভালোবাসেন। লোনই দিক পঞ্চাশ হাজার। মাসে মাসে কেটে নেবে তোমার মাইনে থেকে।

চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলে বিরক্তির অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। মিশে যায় অন্ধকারে। কথাটা শোনার পর তাই দোলনের বিরক্তিটাও প্রকাশ পেল না ঋষভের কাছে। শুধু বুকের উপর থেকে ঋষভের হাতটা সরিয়ে নিল দোলন। এরা জানে না, কেন এক বস তাঁর সুন্দরী স্মার্ট দশ হাজার মাইনের কর্মচারীকে এত ভালোবাসেন, এত দামি গিফ্ট দেন।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়। ঋষভ তার অসহায়তার প্রতিটি বর্ণনাই প্রতিরাতে দোলনকে জড়িয়ে ধরে শোনায়। আশা, দোলন হয় তার বাবার কাছ থেকে অথবা অফিস থেকে ঠিক এর সুরাহা করবেই। প্রতিটা রাতের কথাই শেষ হয় ঋষভের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঋষভের তিল থেকে তাল করার এই অভ্যেসের জন্য আগেও অনেক হুজ্জুতি হয়েছে। বন্ধুদের কাছে বাড়িয়ে বলার কারণে ডাবলডোর ফ্রিজ কিনে দিতে হয়েছে দোলনের বাবাকে। জমানো টাকা চলে গেছে বাইকের পিছনে। কিন্তু এবার কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না দোলন। ঋষভের অসহায়তা ক্রমশ তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। যে-দুর্বলতা একটু একটু করে নড়বড়ে করে দিচ্ছে নারীর চারপাশে গড়ে তোলা আত্মরক্ষার বর্মটিকে। এই টানাপোড়েন একান্তই নিজস্ব। ঋষভকেও বলা যায় না।

সমস্যাটা বাড়ল অফিস থেকে দামি ঘড়িটা উপহার পাওয়ার পর। জন্মদিনের দিন অফিস শেষে ডাক পড়েছিল স্যারের কেবিনে। উনি সাধারণত এই সময়ে ডাকেন যখন ছুটির পর অফিস ক্রমশ ফাঁকা হতে থাকে। জন্মদিন উপলক্ষে উপহার দামি ঘড়ি। মাসিক দশ হাজারি কর্মচারীকে উপহার বারো হাজারের ঘড়ি! কারণটা দোলনের অজানা নয়। জন্মদিন তো আসলে একটা অজুহাত মাত্র। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রৌঢ় বস খুবই সোজাসাপটা। তোমার ভবিষ্যৎ করে দেব আমি। শুধু একবার আমার কাছে এসো। রিতাকে তো দেখছ। স্যারের পার্সোনাল সেক্রেটারি রিতা যে দামি উপহারের লোভে তাঁর শয্যাসঙ্গিনী, সেটা নিয়ে অফিসে বিস্তর গুঞ্জন চলে। মুচকি হেসে এড়িয়ে যায় দোলন।

কিন্তু উপহারটা বাড়িতে আনার পরই অশান্তি শুরু।

যিনি তোমাকে এত ভালোবাসেন, তাঁর কাছে তুমি পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার চাইতে পারছ না। আসলে আমার বোনের বিয়ে বলেই তোমার ইচ্ছে নেই।

মাথা নীচু করে শুধু শুনে যায় দোলন।

তুমি একবার বলে তো দেখতে পারো। বলতে তো অসুবিধা নেই। না দিলে না দেবেন। ঋষভের মা-ও বুঝিয়ে যান।

এই অসহায়তা কোথায় রাখবে দোলন। সে যে ঋষভের চেয়ে অসহায়। আস্তে আস্তে ভাঙতে থাকে আত্মরক্ষার বর্ম। জমতে থাকে বিরক্তি, ধুত্তেরি! অফিস শেষে স্যারের কেবিনে উঁকি দেয় দোলন। আলাদা কোনও পথ নেই আর।

পিঁপড়ের ডিম বা পচা পাউরুটি কিংবা ময়দার সাথে কেঁচো মাছ যেমন খায়। বঁড়শিতে টোপ দিয়ে সতর্ক দৃষ্টি ফতনার দিকে। সরু সাদা কাঠিটা জলের উপরে ভাসছে। একটু কাত হলে বা ডুব দিলেই হ্যাঁচকা টান। অভিজ্ঞ মৎসশিকারি প্রৌঢ় বসের জুলজুল চোখে হাসির আভাস। সোনার গয়না, দামি উপহার নয়তো সংসারের অসহায়তা মেযো ঠিক টোপ গিলবেই।

মধ্য কলকাতার অভিজাত হোটেলের ঘরে হাত দুটোকে পেছনে করে ব্রায়ের হুক খুলতে খুলতে শেষ কদিনের কথাই ভাবছিল দোলন। টাকা পাওয়া যাবে জানাতেই বাড়িতে দোলনের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। গতরাতে সোহাগে ভরিয়ে দিয়েছে ঋষভ। শ্বাশুড়ির কাছে অফিসের বস তো ভগবানস্বরূপ। স্যারের জন্য জন্মাষ্ঠমীর প্রসাদ, তালের বড়া পাঠিয়েছেন উনি। এক টিফিনবাক্স ভরা বড়া রয়ে গেছে দোলনের ব্যাগে, বের করা হয়নি।

নগ্ন পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল। দোলনের সারা অঙ্গে মুখ ঘষে চলেছে। তাঁর বহুদিনের কাঙ্খিত গুপ্তধন হাতের মুঠোয়। এই খেলাতে তিনি দক্ষ। জোর করেন না কাউকে। কিন্তু যে-মাছের যা টোপ, সেটা ফেলে অপেক্ষা করে যান। একবার টোপ খেলেই হ্যাঁচকা টানে বিছানায়, দেরি করেন না। দোলনের বাধা দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। ওর ভিজে যাওয়া চোখ দুটো শুধু দেখে যাচ্ছে বিছানায় পড়ে থাকা গোলাপি নোটের বান্ডিলটা। স্যার খুশি হয়ে আগেই দিয়েছেন।

দোলনের শরীর ঘাঁটতে ঘাঁটতে পুরুষ একটু উপরের দিকে উঠতেই সম্বিত ফেরে দোলনের। হাত দিয়ে পুরুষের মুখ সরিয়ে দেয় সে। ওখানে ওর শরীরের একমাত্র তিল। প্রথম আদরের দিন ঋষভ বলেছিল এটা শুধু আমার। এর ভাগ কাউকে দেব না।

ভ্যাবাচ্যাকা পুরুষ থমকে যায়, কী হল!

দোলন গোলাপি নোটগুলোর দিকে চায়। মেঝেতে পড়ে থাকা কাপড় গুছিয়ে বুকের কাছে তুলে ধরে। কৌশলী পুরুষ তাকে কিছু বোঝাতে চায়। বুকের আস্তরণ সরিয়ে পুরুষের মুখ চেপে ধরে দোলন তিলের উপর। তিলটা ক্রমশ তাল হয়ে যাচ্ছে।

ঝাপসা চোখে দেখতে পাচ্ছে দোলন। এক বান্ডিল গোলাপি তাল। পঞ্চাশ হাজার তাল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...