এখনকার সুপার-ফাস্ট সময়ে, কম্পিউটার ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না। স্পিকার বা সিডি-রোম ড্রাইভের সঙ্গে জুড়ে দিলেই কম্পিউটার হয়ে যায় মিউজিক সিস্টেম বা সিনেমা দেখার যন্ত্র। মাইক্রোফোনের সঙ্গে জুড়ে দিলেই পরিণত হয় টেলিফোনে।  সুতরাং কম্পিউটারের ব্যবহার বিভিন্ন ভাবে হচ্ছে এবং ক্রমশ এর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের সাহায্যে চ্যাটিং, নেট-এ আর্থিক লেনদেন, শপিং প্রভৃতিতে, কম্পিউটার এখন আমাদের দৈনন্দিনের অপরিহার্য অঙ্গ।

যদিও কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট নাটকীয় ভাবে আমাদের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, কিন্তু অত্যধিক কম্পিউটার নির্ভরশীলতা আমাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যারও জন্ম দিচ্ছে। দফতরে এবং বাড়িতেও আপনার কাজকর্ম ভীষণ ভাবে কম্পিউটার নির্ভর। কাজ এড়ানো যাবে না, কিন্তু সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হোন। প্রতিকার আপনারই হাতে।চলুন চট করে দেখে নেওয়া যাক আমাদের জীবন শৈলীর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে কী কী সমস্যা?

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম

কি-বোর্ড এবং মাউসের ব্যবহারের জন্য এই সমস্যা দেখা যায়। হাত এবং কবজি, সঠিক পজিশনে না থাকলে, মিডিয়ান নার্ভ-এ চাপ পড়ে। ফলে কবজি-তে অবস্থিত কারপাল টানেল-এ প্রদাহ অনুভূত হয়। এছাড়াও অসাড়তা, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, মধ্যমা বা তর্জনীর ব্যথা বা কবজিতে যন্ত্রণা অনুভূত হতে পারে। পরবর্তীকালে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের পেশির দুর্বলতা বা আঙুলে এক ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। কারপাল টানেল সিনড্রোম হাতের মুভমেন্টে  অসুবিধা তৈরি করে৷

সমাধান

এর হাত থেকে বাঁচতে রিস্ট-গার্ড ব্যবহার করা যায়। সমস্যা বাড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রিপিটেটিভ স্ট্রেন ইনজুরিস

পেশি এবং হাড়-এর সংযোগস্থলে (টেনডন্স) বারবার ঝাঁকুনি লাগার ফলে বারবার স্ট্রেন ইনজুরিস হতে পারে। বসার ধরন যদি সঠিক না হয়, অত্যধিক শক্তি ব্যবহার করে কাজ করা, টাইপিং-এর ভুল টেকনিক, সঠিক উপায়ে মাউস এবং কি-বোর্ড না ব্যবহার করার কারণে এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এর ফলে শক্তিক্ষয়, হাত-আঙুল ও তালুর অসাড়তা, জ্বলন, ব্যথা, স্টিফনেস অনুভূত হয়-এমনকী কো-অর্ডিনেশনের সমস্যাও হয়ে থাকে।

সমাধান

সমস্যাকে দূরে রাখতে ভালো ওয়ার্ক-স্টেশনে কাজ করা উচিত এবং কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়াও অত্যন্ত জরুরি।

কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম

দীর্ঘদিন কম্পিউটার ব্যবহার করার ফলে, দৃষ্টি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।অনবরত কম্পিউটারের দিকে চেয়ে থাকার ফলে চোখের পেশির সংকোচন হয়। ফলে রি-ফোকাস করতে অসুবিধা হয়। সাধারণ কম্পিউটারে কাজ করার সময় চোখের পাতা পড়ে না। চোখের টিয়ার-ফিল্ম এর গঠন হয় না এবং চোখে শুষ্কতার সমস্যা তৈরি হয়।

সমাধান

মনিটরে অ্যান্টি-গ্লেয়ার কোটিং ব্যবহার করুন৷ চোখে সমস্যার সৃষ্টি হলে ফেলে না রেখে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন৷

ডিপ্রেশন বা অবসাদ

যারা কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট অত্যধিক ব্যবহার করেন তারা সামাজিক জীবন থেকে ক্রমশ দূরে সরে যান এবং ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনের কবলে পড়েন। সহকর্মীদের থেকেও তৈরি হয় দূরত্ব।

সমাধান

এক টানা কাজ না করে সামাজিক মেলামেশা বাড়ান৷ গান শুনুন৷কাজের ফাঁকে খানিকটা করে রিল্যাক্স সেশন রাখুন৷

কম্পিউটার অ্যাডিকশন ডিস-অর্ডার

ধূমপান বা মদ্যপানের মতো কম্পিউটারও আধুনিক প্রজন্মের কাছে একটি অ্যাডিকশন বা নেশায় রূপান্তরিত হচ্ছে। অ্যাডিকশনের পরিমাণ কখনও এতটাই বেড়ে যাচ্ছে যে, তা মানসিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। একাকিত্ব, অবসাদ, ইরিটেশনের সৃষ্টি করছে।

সমাধান

চোখ এবং মন-কে বিশ্রাম দিতে, চোখ বুজে খানিকক্ষণ মেডিটেশন করুন৷ কম্পিউটারে কাজ করার সময়সীমা কমিয়ে আনুন৷ গাছ গাছালি লাগান, ঘাসের উপর হাঁটুন খালি পায়ে৷

ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন (ইএমআর)

মনিটর, সিপিইউ, প্রিন্টার, কি-বোর্ড, স্ক্যানার প্রভৃতি কিছু পরিমাণে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন সৃষ্টি করে, যদিও রেডিয়েশনের মাত্রা মোবাইলের তুলনায় কম। কিন্তু তবু এর প্রভাব আমাদের স্বাস্থ্যের ওপরে পড়ে।

এই সব সমস্যা ছাড়াও স্পন্ডেলাইটিস, পিঠ এবং ঘাড়-এর ব্যথা এবং ব্যবহারগত সমস্যা দেখা যায়।

 সমাধান

খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কম্পিউটার অত্যধিক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।

বিশেষ সতর্কতা

  • কম্পিউটারের কি-বোর্ড যেন আপনার কনুই-এর সাথে সমান উচ্চতায়, সামান্য হেলানো অবস্থায় থাকে। টাইপ করার সময় চেষ্টা করুন কবজিকে সোজা রাখতে। হাত যেন শরীরের সঙ্গে সঠিক অ্যাঙ্গেলে থাকে।
  • মাউস ব্যবহার করার সময়, কাঁধ এবং হাতকে শরীরের কাছাকাছি রিল্যাক্স অবস্থায় রাখুন।
  • আপনার পিঠ যেন চেয়ারের সম্পূর্ণ সাপোর্ট পায়। থাই যেন মেঝের সঙ্গে সমান্তরাল ও সামান্য এগোনো অবস্থায় থাকে। পা-দানি ব্যবহার করুন।
  • মনিটর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
  • কাজের জায়গার তাপমাত্রা, ভেন্টিলেশন এবং আলো যেন আপনার পক্ষে কমফর্টেবল হয়।
  • শরীর এবং মনকে রিল্যাক্স রাখুন। সঠিক পদ্ধতি মাফিক শ্বাসপ্রশ্বাস নিন।
  • স্পিচ রিকগনিশন সফ্টওয়্যার ব্যবহার করলে কি-বোর্ড-এর ব্যবহার কিছুটা হলেও কমবে।
  • কাঁধের ওপরে ফোন রেখে, ঘাড় কাত করে ফোনে কান লাগিয়ে কথা বলা এবং কম্পিউটারে কাজ করার অভ্যাস ত্যাগ করা অত্যন্ত জরুরি।
  • ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন থেকে বাঁচতে, কম্পিউটারের অ্যাক্সেসরিজ থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখুন।
  • ২০/২০/২০-এর নিয়মটিকে মেনে চলুন। অর্থাৎ কম্পিউটারে প্রতি ২০মিনিট কাজ করার পর ২০ সেকেন্ডের বিশ্রাম নিন এবং ২০ ফুট দূরত্বের কোনও বস্তুর দিকে তাকান। যেমন, আকাশ, গাছপালা ইত্যাদি, চোখ-কে বিশ্রাম দিন। স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করুন।
  • দু’হাতের তালু ১০-১৫ সেকেন্ড ঘষে নিন এবং উষ্ণ তালু বন্ধ চোখের ওপরে রাখুন।
  • মনিটরের উজ্জ্বলতা (ব্রাইটনেস), বৈপরীত্য (কনট্রাস্ট) এবং ফন্ট সাইজ অ্যাডজাস্ট করে নিন এমনভাবে, যাতে ৪৫ সেন্টিমিটার দূর থেকেও আপনি পরিষ্কার দেখতে পান।
  • বারবার চোখের পাতা ফেলুন, বেশিক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন না। অথবা ডাক্তারকে কনসাল্ট করে আর্টিফিশিয়াল টিয়ার সলিউশন ব্যবহার করুন। এতে ড্রাই চোখের সমস্যা কমবে।
  • এলসিডি মনিটর ব্যবহার করা সবথেকে উপকারী। মনিটরে অ্যান্টি-গ্লেয়ার কোটিং (অত্যধিক উজ্জ্বলতা থেকে বাঁচতে) ব্যবহার করতে পারেন। চশমা ব্যবহার করলেও অ্যান্টি-গ্লেয়ার কোটিং-এর সুবিধা নিন।
  • কম্পিউটার ওয়ার্ক-স্টেশনটি উত্তম হওয়া বাঞ্ছনীয়। বসার চেয়ারটি অ্যাডজাস্টেবল হওয়া উচিত। হাত এবং পিঠের যেন সম্পূর্ণ আরাম এবং স্বাচ্ছন্দ্য থাকে। চেয়ারের উচ্চতা যেন এমন হয় যে, চোখের দৃষ্টি সবসময় মনিটরের মাঝখানে থাকে।

স্বাস্থ্যকর জীবন কাটান। প্রাত্যহিক জীবনে অ্যাকটিভ থাকুন। ব্যায়াম করুন, সুষম খাবার খান। টেনশন ফ্রি, সামাজিক জীবন কাটান। মনে রাখুন, বেঁচে থাকার জন্য কম্পিউটার জরুরি। কম্পিউটারের জন্য আপনার বেঁচে থাকা নয়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...