আজকের সমাজে প্রায়শই দুটো ইংরেজি বুলি অনূধর্ব পঁচিশ বছর বয়সের যুবক-যুবতিদের মুখে শোনা যায়। যার প্রথমটি হল ‘লিভ টুগেদার’, হালফিলে যা হয়েছে ‘লিভ ইন’(Live in Relationship )।
মনে পড়ে, আমি তখন ছোটো। আমাদের বাড়িতে কাজলদি নামে এক মহিলা থাকতেন এবং রাতদিনের টুকটাক কাজে মাকে সাহায্য করতেন। শুনেছিলাম যে, কাজলদির স্বামী ওনাকে ছেড়ে নাকি বাংলাদেশ চলে গেছেন। ভাগ্যিস ওঁদের তিন বছরের সম্পর্কে কোনও সন্তান ছিল না। সময়ের করাল গতি আমায় জানিয়েছিল যে, ওনার তথাকথিত স্বামীর সাথে আইনানুযায়ী কোনও বিবাহ হয়ইনি। যোগেশদা নাকি কাজলদিকে খালি মালা বদল করে বিয়ে করেছিল মন্দিরে গিয়ে।
হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫ অনুসারে কোনও বিবাহের নথিভুক্তকরণ না হলে, এই আইনের ৮ ধারা অনুসারে, হিন্দু ধর্মানুযায়ী কিছু বিধি ও সংস্কার পালিত হলে, তবেই আইনের চোখে তা সিদ্ধ বিবাহ হিসাবে গণ্য হয়, যার শেষ প্রথাকে বলা হয় ‘সপ্তপদী’।
এখন বুঝি কাজলদির তথাকথিত বিবাহ আইনসিদ্ধই ছিল না। কিন্তু তাঁরা স্বামী-স্ত্রীর মতো এক সঙ্গে সংসার ও সহবাস সবই করেছেন। একে অপরের সুখে-দুঃখে ভাগীদারও হয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা আইনের চোখে সহমত হয়ে কিছুদিন একসঙ্গে বাস করেছেন ও সহবাস করেছেন। এই সম্পর্ককে আইন প্রত্যক্ষভাবে কোনও স্বীকৃতি দেয় না।
আমাদের পাড়ার নীহারেন্দুবাবু কলকাতার একটি নামি কলেজের অধ্যাপক, তাঁর স্ত্রী মীরাদেবী একটি বিমানসংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী ছিলেন। তাঁদের একমাত্র মেয়ে, সিন্থিয়া ঠিক করল যে, রাকেশের সঙ্গে লিভ ইন (Live in Relationship) সম্পর্কে যাবে এবং তাদের বিধাননগরের বাড়ির পাশের ব্লকেই রাকেশের একটি ফ্ল্যাট ছিল, সেখানেই ওরা দু’জন থাকবে। নীহারেন্দুবাবু এবং তাঁর মা গীতাদেবীর অমত থাকলেও মীরাদেবী রাকেশের বাবার অর্থ-প্রাচুর্য দেখে মোহিত হয়ে মেয়েকে পুরোমাত্রায় সহযোগিতা করে আধুনিকা হতে চেয়েছিলেন। আশানুরূপভাবে সিন্থিয়া যখন গর্ভবতী হয়, তার চারমাস বাদে রাকেশ মুখ ঘোরায়। ফল অনুমানসাপেক্ষ…।
এটাই সমাজের মধ্যে লিভ-ইন সম্পর্কের বর্তমান চিত্র। বাস্তবিকভাবে যে-সম্পর্কে বন্ধন নেই, যে-সম্পর্কে দায়িত্ববোধ নেই বা দায়বদ্ধতা নেই, সেই সম্পর্ক কখনও চিরস্থায়ী হয় না। একটা সুদৃঢ় সম্পর্ক টেনে আনার জন্য দরকার বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার, যে দুটো এই লিভ-ইন সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব সত্ত্বেও লিভ-ইন সম্পর্কের প্রতি এই প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে কেন?
বস্তুত আজকের যুব সমাজের অধিকাংশ এক যাযাবর জীবনযাপনে উদ্যোগী। ছেলেদের একটা বিশাল অংশ বধূনির্যাতনের মামলার ভয়ে বিয়ের পথে পা বাড়াতে সাহস পায় না। আবার আর এক প্রকারের লিভ-ইন সম্পর্ক দেখা যায়, যেখানে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মহিলা এবং পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই পুরুষদের ভিড় বেশি।একাকিত্ব কাটাতে প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিত পুরুষ এবং অবিবাহিত মহিলা যদি একসঙ্গে বসবাস করেন এবং তা তাঁদের স্ব-ইচ্ছায় হয়, তবে সেই সম্পর্কে আইন যেমন কোনও অনুকূল মোহর লাগায় না, তেমন আইনি কোনও প্রতিকূলতাও এক্ষেত্রে নেই। তবে হ্যাঁ বলা প্রয়োজন, উক্ত সম্পর্ক আইনি সুরক্ষার কোনও আলাদা মোড়ক না পেলেও স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়ক্ষেত্রেই আইনি পরিভাষায় স্বীকৃত হওয়া জরুরি এবং তাও সর্বোচ্চ আদালত থেকে। যেমন তিথি এবং অপরাজিতা (সমকামী) নামে দুই বন্ধু যাদবপুরে কিছুদিন আগে অবধি একসঙ্গে থাকত। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের উভয়ের বাড়ির লোকেদের চাপে এবং প্রতিবেশীদের অত্যাচারে তারা আলাদা থাকতে বাধ্য হয়েছে।
লিভ-ইন সম্পর্কে সমস্যা আরও একটি ক্ষেত্রে তৈরি হয়, যদি দেখা যায় এই সম্পর্কে যুক্ত স্ত্রী এবং পুরুষ জন্ম দিলেন এক তৃতীয়জনকে। ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে। ড. ভেলুস্বামী (মহিলা) বনাম ড. পটচাইয়াম্মল (পুরুষ) কেস-এ। সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু এবং টিএস ঠাকুর ২১ অক্টোবর ২০১০, তারিখে খোরপোশ মামলায় রায় দিতে গিয়ে দেখলেন পুরুষটির আগে একটি বিবাহ হয়েছে এবং তা আইনের চোখে বর্তমান অবস্থায় স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু এটাও ঠিক যে উক্ত পুরুষ দিনের পর দিন উক্ত মহিলার (বাদী) সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস এবং সহবাস করেছেন।
বিষয়টির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উক্ত মাননীয় বিচারপতিদ্বয় লক্ষ্য করেছেন প্রধানত তিনটি বিষয়। প্রথমত উক্ত বাদী ও বিবাদী আদৌ একত্রে এমন পরিমাণ সময় একসঙ্গে বসবাস করেছেন কিনা, যাতে সামাজিকভাবে এঁদের বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী ভাবা যায়? দ্বিতীয়ত প্রসবিত সন্তান আদৌ উক্ত বিবাদীর ঔরসজাত কিনা? এবং তৃতীয়ত বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে এঁদের সম্পর্কের তিক্ততার শিকার সদ্যোজাত শিশুটি হতে পারে কিনা?
বিষয়গুলির সদৃঢ় পর্যালোচনার পর রায় বেরোয় যে, বাদী-বিবাদী একসঙ্গে যতদিন বসবাস করেছেন তাতে পরোক্ষভাবে সমাজ তাঁদের সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর আখ্যা ভুল ভাবে দেয়নি এবং নবজাত শিশুটির জন্মানো তার জন্মদাতা পিতা ও মাতার সহবাসের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়েছে। সুতরাং তার জন্মদাতা পিতাকে সেই শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় খরচ বহন করতেই হবে এবং শিশুটি পিতার সম্পত্তির সমান অংশীদার। তিনি এটিকেই স্বতঃসিদ্ধ আইন হিসাবে ব্যাখ্যা করেন।
এরপর বলা নিষ্প্রয়োজন আমার শেষোক্ত প্রশ্নের উত্তর কি! কথায় আছে ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না।’ তাও এক্ষেত্রে আবার সর্বোচ্চ আদালতের। সুতরাং এও বলা নিষ্প্রয়োজন যে যারা দায়িত্ব এড়াবার লোভে লিভ-ইন সম্পর্ককে বেছে নিয়েছেন বা অদূর ভবিষ্যতে বেছে নিতে চলেছেন, তারা আজকের বিষয়টিকে এত হালকাভাবে নেবেন না। আইনের হাত খুব ছোটো নয়।