বর্ষাকালের আর্দ্র আবহাওয়া এবং চারিদিকের জমে থাকা জল পরিবেশকেও অনেকটা দূষিত করে তোলে, ফলে নানা রোগ-জীবাণুর diseases প্রাদুর্ভাব এই সময়টায় মানুষকে নাজেহাল করে।
নানা ধরনের ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া এবং আরও অন্যান্য সংক্রমণের মুখোমুখি বেশি হতে হয় ভেজা আবহাওয়ার কারণে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় ক্ষতিকারক মাইক্রোঅর্গানিজমগুলি সংখ্যায় বহু গুনে বেড়ে যায়, যার ফলে বিভিন্ন রোগের সূত্রপাত ঘটে।
বর্ষার জমে থাকা জল মশাদের জন্য প্রজননক্ষেত্র। ভারতবর্ষে মশা বাহিত অসুখের পরিসংখ্যান সারা বিশ্বের মধ্যে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ৩৪ শতাংশ এবং ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে ১১ শতাংশ।
মশা বাহিত রোগ বলতেই ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং চিকনগুনিয়া। প্রধানত বর্ষার মরশুমেই এইসব রোগে মানুষ আক্রান্ত হয় বেশি। এই তিনটি রোগেরই উপসর্গ হল প্রচণ্ড জ্বর, গায়েহাতে-পায়ে ব্যথা, শীত অনুভব করা, কম্পন, অসম্ভব ক্লান্তি এবং রক্তে প্লেটলেট কমে যাওয়া। এই উপসর্গগুলি দেখা দিলেই, তত্ক্ষণাৎ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এছাড়াও সাবধানতা অবলম্বন করতে
- মশারি টাঙিয়ে শোওয়ার অভ্যাস করুন
- বাড়ির বাইরে বোরোবার আগে মসকুইটো ক্রিম ব্যবহার করুন
- বাড়ির বাইরে বা ভিতরে কোথাও জল জমতে দেবেন না এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন
- প্রতিদিন বাথরুম পরিষ্কার করুন।
এগুলো ছাড়াও বর্ষার সময় জল বাহিত রোগেরও প্রকোপ বেড়ে যায়। ভারতবর্ষে প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন জনসংখ্যা জল বাহিত রোগে প্রতিবছর আক্রান্ত হয়। টাইফয়েড, কলেরা, জন্ডিস, পেটের সংক্রমণ, হেপাটাইটিস-এ, লেপ্টসপাইরোসিস ইত্যাদি জল বাহিত রোগে বর্ষাকালে মানুষ জেরবার হয়ে পড়ে। সাধারণত বাচ্চরা এই রোগগুলিতে আক্রান্ত হয় বেশি। অনুন্নত স্যানিটেশন, আঢাকা খাবার, পচা খাবার, দূষিত জল ইত্যাদির কারণে সাধারণত জল বাহিত রোগগুলি হয়ে থাকে।
টাইফয়েড-এর ক্ষেত্রে উপসর্গগুলি হল জ্বর, মাথাব্যথা, গলায় অস্বস্তি, জযে্ট-এ ব্যথা। কলেরার ক্ষেত্রে ডায়ারিয়া এবং লুজ মোশন, জন্ডিস হলে লিভারের সমস্যা সবথেকে আগে দেখা দেবে। এছাড়াও ক্লান্তি, দুর্বলতা থাকবে সঙ্গে চোখ, নখ হলুদ হতে আরম্ভ করবে এবং মূত্রত্যাগের সময় খেয়াল রাখতে হবে সেটিও হলুদ রঙের কিনা।
পেটের সংক্রমণে বমি, ডায়ারিয়া, গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস হল কমন উপসর্গ। হেপাটাইটিস-এ, দূষিত খাবার এবং জল থেকে ছড়ায়। এটি একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা কিনা লিভারের প্রচণ্ড ক্ষতি করে এবং খিদে একেবারে চলে যায়। এছাড়াও ক্লান্তি, জ্বর, চোখে হলদেটে ভাব, বমি, বমিভাব, মূত্রের রং গাঢ় হয়ে যাওয়া, চুলকানি ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দেয়।
লেপ্টসপাইরোসিস বর্ষাকালে রাস্তাঘাটে জমে থাকা জল এবং নোংরা কাদা থেকে হয়ে থাকে। শরীরের কোথাও যদি কাটা-ছেঁড়া থাকে এবং সেই জায়গাটা যদি ওই দূষিত জলের সংস্পর্শে আসে তাহলে এই রোগটির হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই অসুখের উপসর্গ হল জ্বর, মাথাব্যথা, কম্পন এবং মাংসপেশিতে যন্ত্রণা। সাবধানতা অবলম্বন করতে
- জল ফুটিয়ে খান
- ফল, সবজি খাওয়ার আগে ভালো করে ধুয়ে নিন
- খাবার আঢাকা রাখবেন না
- বাইরের খাবার এড়িয়ে চলুন
- নিজস্ব এবং পারিপার্শ্বিক হাইজিন মেনে চলুন
- হ্যান্ড স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখুন এবং বারবার হাত ধুয়ে নিন
- বাড়িতে এবং বাড়ির বাইরে ড্রেনেজ সিস্টেম যেন সঠিক থাকে খেয়াল রাখুন। খোলা ড্রেন এবং রাস্তার গর্ত, ম্যানহোল ঢাকার ব্যবস্থা করুন
- ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলুন
- বাচ্চাদের টীকাকরণ করান।
বর্ষা যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে তাহলে হাওয়া বাহিত অসুখের ক্ষেত্রেও চিন্তা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। হাওয়ায় এই অসুখের জীবাণু ভেসে বেড়ায় এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাই বেশি এটাতে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও সংক্রামিত ব্যক্তির থেকেও এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। কমন ফ্লু, সর্দি-কাশি, ভাইরাল জ্বর, ইনফ্লুযে্জা ইত্যাদি হাওয়া বাহিত অসুখের কমন উদাহরণ। তাপমাত্রার সামান্য তারতম্য ঘটলেও শারীরিক ভাবে দুর্বল ব্যক্তি এর মধ্যে কোনও একটি সমস্যায় পড়তে পারেন। জ্বর, নাক দিয়ে সমানে জল পড়া, গলা খুসখুস, কাশি, চোখে জল আসা, শীত লাগা এগুলি হল এই অসুখের কমন উপসর্গ। সাবধান থাকতে মেনে চলুন
- কাশি এবং হাঁচি-র সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখুন
- ঘন্টায় ঘন্টায় হালকা গরমজল পান করুন এবং ফোটানো জল খান
- বাচ্চাদের সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে দূরে রাখুন
- বাইরে থেকে বাড়ি ফিরলে অবশ্যই হাত-পা ভালো করে ধুয়ে ফেলুন
- বাড়িতে ভেন্টিলেশন যেন প্রপার থাকে।
এই অসুখগুলি diseases ছাড়াও বর্ষাকালে বহু মানুষ দাদ, হাজা, চুলকানির সমস্যায় ভোগেন। এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে দাদ হয়। বর্ষার ভেজা আবহাওয়া এবং শরীরের ঘাম মিলে দাদের ছত্রাকের বৃদ্ধির পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। শরীরের বিভিন্ন খাঁজে যেখানে যেখানে ঘাম জমে, সে জায়গাগুলি ঠিক ভাবে পরিষ্কার না করলে দাদ-এর আক্রমণ ঘটে। এর সংক্রমণের ফলে ত্বকে গোল গোল চাকার মতো দাগের সৃষ্টি হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশে ধীরে ধীরে এটি ছড়িয়ে পড়ে। যাদের ত্বক বেশি সংবেদনশীল তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্রতিরোধক হিসেবে, শরীরে যেখানে ঘাম জমে জায়গাগুলি পরিষ্কার রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টি অ্যালার্জিক লোশন বা পাউডার লাগাতে পারেন।
যারা দীর্ঘ সময় ধরে জলে থাকেন বা জল ঘাঁটেন বা যাদের আঙুলের খাঁজে ঘাম জমে, তাদের অনেকের হাত ও পায়ে আঙুলের খাঁজ সাদা হয়ে যায় এবং অসম্ভব চুলকানি হয়। এটিকে হাজা বলা হয়। এটাও একধরনের ছত্রাকঘটিত সংক্রমণ। ডাক্তাররা সাধারণত এই ধরনের সংক্রমণে অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল ক্রিম লাগানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং প্রভাবিত জায়গাটি শুষ্ক এবং পরিষ্কার রাখার উপর জোর দেন।
বর্ষাকালে চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। চুলকানিও একধরনের চর্মরোগ। যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় স্ক্যাবিস বলা হয়। এই উপসর্গগুলি শরীরের বেশিরভাগ অংশে যেমন কবজি, কোমরের আশেপাশে, যৌনাঙ্গে, নাভি এবং নাভির চারদিকে, আঙুলের ফাঁকে ছোটো ছোটো দানা বা গুটির আকারে দেখা দেয়। রাত্রে চুলকানির তীব্রতা বাড়ে। সংক্রমিত ব্যক্তি অথবা তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংস্পর্শে যে আসবে, তারই মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। রোগীর ব্যবহৃত কাপড়জামা, তোয়ালে, বিছানার চাদর সবকিছুই ফুটন্ত গরমজলে দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং রোদে শুকিয়ে নেওয়া বাঞ্ছনীয়।